বৃষ্টি আসুক শহরে
বৃষ্টি আসুক শহরে


অফিস শেষের নিস্তব্ধতাটা বেশ উপভোগ করে তৃষাণ আজকাল। বিকেলের চুইয়ে পরা মিঠে রোদ্দুরে মিশতে মিশতে অনেক দূর অবধি হাঁটা যায় একা একা। ক্লান্ত লাগেনা একটুও। কেমন একটা দীর্ঘশ্বাসময় শান্তি ঘিরে থাকে ওকে এই সময় টুকু। অদ্ভুত মোহময় এক হাসি যেন লেগেই আছে সবার ঠোঁটে। অবিশ্রান্ত ছুটে চলার মাঝে এই রাস্তাটুকুই বোধহয় বিশ্রাম সবার।
তৃষাণ এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আলতো করে চোখ তুলে তাকালো সূদুর আকাশটার দিকে। দীগন্তের ওপার দিয়ে ধীরেসুস্থে ধেয়ে আসছে বিশাল এক কালো মেঘের দল। হঠাৎ এক ফালি ঠান্ডা হাওয়ার ঢেউ আছড়ে পড়লো ওর চোখে মুখে। কাছেই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে তবে। এদিকেও কি বৃষ্টি হবে? বহুদিন এ তল্লাটে বৃষ্টি হয়না। ভেজেনা মাটি, ভেজেনা গাছপালা,ভেজেনা এই বেয়াড়া মন।
মরুভূমির ও তো একটা মরূদ্যান থাকে। কিন্তু ওর কি আছে? আদৌ কি আছে কিছু, নাকি সবই শুধু হারিয়ে ফেলার হিসেব কষা?? হাসে তৃষাণ। হাসতে হাসতেই বিকেলটা কেমন কমলা হয়ে আসে। ছোটবেলায় এমন বিকেল এলে ভীষণ অবাক লাগতো ওর। আবার এক অনাবিল আনন্দেও ভরে উঠতো ভেতরটা।
আজ মাসের শুরুতে মাইনে পাওয়ার দিনটা ছাড়া অমন আনন্দ আর কখনো হয়না তৃষাণের।
আচ্ছা, টাকাটাই কি তবে সব?
নাহ সব নয়, তবে কিছুটা তো বটেই।
পুজোয় ওর একটা নতুন জামার জন্য বাবাকে পাগলের মত খাটতে দেখেছে ও। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন নিজে না খেয়ে ওকে খাওয়াতে দেখেছে মা কে। জিগ্যেস করতে বলেছিল, ' আজ আমি সকাল সকাল পুজো সেরে খেয়ে নিয়েছি,তুই খা বাবা।' সেদিন তৃষাণ পরীক্ষা দিতে চলে যাওয়ার পর, মায়ের চোখের জল গুলো আজ যেন চোখ বুজলেই পরিষ্কার দেখতে পায় ও। এই বুকের পাজরের প্রত্যেকটা ইট ওদের চোখের জল দিয়েই গাঁথা।
তৃষান জানে সমস্ত পৃথিবীর কাছে হেরে গেলেও ওদের কাছে সারাজীবন জিতে যায় ও।
উচ্চমাধ্যমিক রেসাল্টের দিন টিভিতে কৃতি ছাত্র ছাত্রীদের রেসাল্ট শুনে বাবা কে বলতে শুনেছে, ' আগের জন্মে অনেক পুণ্য করলে তবে ঘরে অমন ছেলে জন্মায়।' আবার সেই বাবাকেই আড়ালে ছেলের অত্যন্ত সাধারণ রেসাল্ট নিয়ে গর্ব করতেও শুনেছে ।
ওদের না পাওয়া গুলো পাওয়ার চাদরে মুড়তে গেলে টাকা চাই বইকি।
হাঁটতে হাঁটতে গড়ের মাঠের সামনে এসে দাঁড়ালো তৃষাণ। আজ বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না একদম। আলতো পায়ে সবুজ ঘাস মারিয়ে মাঠে গিয়ে দাঁড়ালো ও। জুতোটা খুলে বসলো নরম ঘাসের ওপর। ফুরফুরে হাওয়ায় শরীরটা এলিয়ে দিল। তারপর কালো আকাশটার দিকে তাকিয়ে হাসলো মৃদু। ব্যাগ থেকে সকালবেলা এক ছাত্রের দেওয়া ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির প্রস্পেক্টাসটা বের করলো সজত্নে। কয়েকটা পাতা ওলটাতেই বড়ো বড়ো করে লেখা নামটা চোখে পড়লো আবার।
'ড: তন্নিষ্ঠা চ্যাটার্জী
হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট, জুলজি, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি।
'সেই এলি আমার শহরে, শুধু দেরি হয়ে গেল অনেকটা......!!' প্রস্পেক্টাসটা বুকের মধ্যে চেপে ধরলো তৃষাণ।
বৃষ্টিটাও ঠিক সময় বুঝে হানা দিল শহরের বুকে।
যুগযুগ ধরে বৃষ্টিরাই জানে ঠিক কখন পড়লে চোখের জল গুলো লুকিয়ে ফেলা যায় নীরবে।