Sangita Duary

Romance Tragedy Classics

4.3  

Sangita Duary

Romance Tragedy Classics

নদী তীরে দুজন

নদী তীরে দুজন

11 mins
1.1K



ডোরলক দিয়ে দরজাটা খুলেই মেজাজ খিঁচড়ে গেলো তমার। চিন্ময় এখনও আসেনি! তবে যে বাসে জানালার ধারের সিটে বসে তমা যখন ফোনে ধরলো চিন্ময়কে, তখনতো বেশ রোগুড়ে গলায় বললো, এই তো বাড়ির সামনেই!


ইররেগুলার তো বটেই দিন দিন বাজে রকমের কেয়ারলেস আর মিথ্যুক হয়ে উঠছে চিন্ময়। সব বোঝে তমা, এসব শুধু দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার ছল!


আরে বাবা, অফিস কি তুই একাই করিস? তমাকেও তো রোজ সেই নটার বাস ধরে গোবরডাঙ্গা ছুটতে হয়। সারাদিন ছাত্র ঠেঙ্গাও, তারপর বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে পড়ো, রান্নাবান্না সারো, আর উনি ফুলবাবুটি সেজে মৌজ করে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে টিভি দেখবেন।


আজ ডি আই অফিসে যেতে হয়েছিল তমাকে। দেরি হবে ভেবেই চিন্ময়কে আগেভাগে বলে রেখেছিল, যেন সন্ধ্যের আগে একটু ম্যানেজ করে বাড়ি ফেরে, সরলাদি তো আর তাদের অপেক্ষায় সন্ধ্যে অবধি বসে থাকবে না, খুব জোর ছটা, তারপরেও ওরা কেউ না ফিরলে পাশের ফ্ল্যাটের রমাদির কাছে টুসকিকে গচ্ছিত রেখে চলে যাবে। যদিও রমাদি ভালোমানুষ তবু মানুষের ব্যস্ততার মাঝে নিজেদের অযাচিত প্রবেশ তমার একদম পছন্দ নয়।


আজ ফিরুক চিন্ময়, মেয়েটা কি তার একার? সকালে বাজারটুকু করে দেওয়া ছাড়া মেয়ে কিংবা সংসারের কোন কাজে থাকে?


এভাবে আর বরদাস্ত নয়, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে।


***************




-" এই ফুলকপি কত করে? দুটোই তিরিশ হবে?"


মাছের বাজার বিজবিজ করছে, পার্টিকুলার ওই জায়গায় যেতে চিন্ময়ের অসহ্য লাগে, ঠিক যেমন, খুব জোরে পটি পেয়েছে কিন্তু টয়লেট নোংরা। এই অবস্থায় পেট গুলিয়ে বমি উঠে এলেও সেই টয়লেটেই বসতে হবে! কাল সকালে একটা মিটিং আছে, তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, বাজার করার সময় নাও হতে পারে।


মাছের বাজার সেরে বাইরে বেরোতেই চিন্ময়ের মনটা ধিনকা চিকা করে উঠলো, দারুণ কয়েকটা গলদা পেয়েছে। আজ রাতে জমিয়ে মালাইকারি। এইরে! তমা আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল, কব্জি উল্টে সময় দেখে চিন্ময়, সাড়ে সাতটা। আজ মহাভারত নাচছে তার কপালে! কী কুক্ষণে যে ক্লাবে ঢুকতে গেল!


"ছিঃ চিন্ময় ছিঃ, এইজন্যই বন্ধুরা তোমায় এত খেলো করে, বউ কে এত ভয়?" নিজের অন্তরাত্মা প্রতিবাদ করে ওঠে মুহূর্তে।


নিজের পৌরুষত্বকে ধিক্কার জানায় চিন্ময়, হ্যা, দেরি হয়েছে তো কি হয়েছে? সারাদিন খাটনি হয় কাদের জন্য? নিজের একটু রিফ্রেশমেন্ট থাকবেনা?


তাছাড়া চিন্ময় তো আগেই তমাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেছিল, তমাই তো জেদ করে...!


চিন্ময়ের মাও চাকরি করেছে, তাকে বড় করেছে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। বাবা তো এয়ারফোর্স এ ছিল, মার কোন দরকারে সেই জম্মু থেকে ছুটে আসতো?


তবুও এক মাসের ছুটিতে বাবা যখন বাড়ি আসতো, কী যত্নই না মা করতো বাবাকে! পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতো, ছুটির দিনে নো বান্ধবীর বাড়ি, নট আ সিঙ্গল অনুষ্ঠান, শুধু ওরা তিনজন। মা বলতো, " বাকি এগারো মাসে বাবার অভাব এই এক মাসেই উসুল করে নেব!"


আচ্ছা, বাবা যদি বাড়িতেই থাকতো, দশটা পাঁচটা অফিস করতো, তবুও কি মা বাবাকে এতটাই মাথায় করে রাখতো?


রাখতো, রাখতো, সবাই তো আর তমালিকা ব্যানার্জি নয়, বিয়ের পরেও সারনেম বদলাব না, মোটা মাইনের চাকরি ছাড়বো না, নিজের শখ আহলাদ সংসারের জন্য কম্প্রোমাইজ করবো না।


আরে বাবা চিন্ময়ের নিজের যা রোজগার, বউ মেয়েকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে তো যথেষ্ট!


চিন্ময় নিজেই তো কত স্যাক্রিফাইজ করেছে, করেনি? বালিগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির কুড়ি হাত দূরেই বাবার তৈরি ওমন হালফ্যাশন বাড়ি চিন্ময় স্যাক্রিফাইজ করনি? হ্যা, মানছে সে, সেপারেট থাকাটা তারই ডিসিশন ছিল। কোন আহাম্মক কোম্পানির ফার্নিসড করা ফ্ল্যাট ডিনাই করে?


তাছাড়া শাশুড়ি বৌমা একসাথে থাকলে কোন্দল হবেই। যত দূরে থাকবে সম্পর্ক ততই মধুর থাকবে। কার জন্য? বলি কার জন্য? তমার জন্যই তো? এই যে দুবেলাই রান্নার মাসির হাতের ট্যালট্যালে ঝোল, চিন্ময় বিয়ের আগে খেয়েছে?


কতদিন তমাকে বলেছে, একটু আলুপোস্ত বানাও, চিতল মুইঠা করো... সে মহারানী ঠোঁট বেঁকিয়ে চলে গেছেন। তার আবার কিসের দায়, শখের চাকরি সামলে বরকে রেঁধে বেড়ে খাওয়াবেন?


সব কপাল! তার ওপর এদিক ওদিক করেছ কি বউএর মুখ ঝামটা।


কেন? সেই বা নিজেই সব ছাড়বে কেন? বউ চাকরি করেছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? আর নয়, এবার কিছু বলুক, চিন্ময়ও হেস্তনেস্ত কিভাবে করতে হয় জানে।


"দেখি দাদা একটু সাইড...", সামনের লোকটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে থমকেছে চিন্ময়, "আরে অরণ্য, তুই, এখানে? কবে এলি?"


অরণ্য অন্যমনস্ক ছিল, তুতলে গিয়ে বলল, "হ্যা, এই খানেই একটু দরকার ছিল। আরে আমি কালই তোদের বালিগঞ্জের বাড়িতে যাবো ভাবছিলাম, তা তুই এখানে কী করছিস?"


বহুদিন পর কাছের বন্ধুকে দেখতে পেয়ে চিন্ময় জাগতিক চিন্তা ভুলে যায়, "এইখানেই তো কোম্পানির ফার্নিসড ফ্ল্যাটে আমার বর্তমান আস্তানা। ওই তো আমাদের কমপ্লেক্স। চল চল বাড়িতে চল, আরে, আমার ফ্ল্যাটের চৌকাঠে এসে ফিরে যাবি, তা কখনো হয়?" বলেই খানিক নিজের মগজে ঘা দিলো, যাক আজকের মত তাহলে তমার ঝাড় থেকে রেহাই পাবো। বাইরের লোকের সামনে তমা নিশ্চয়ই নিজের স্বামীর গুষ্টির শ্রাদ্ধ করবে না!


তাছাড়া অরণ্যরও দেখা দরকার চিন্ময় এখন কিভাবে লাইফ লিড করে, স্কুল কলেজে অরণ্যের মারকাটারী রেজাল্ট সবসময় ওকে চিন্ময়ের থেকে অ্যাডভান্সড রাখতো। মা তো উঠতে বসতে অরণ্যের তুলনা আনতো। শুধু মা কেন, স্কুল কলেজের প্রতিটা মেয়ে হ্যাংলার মত ঘুরঘুর করতো অরণ্যের পিছনে। চিন্ময় তখন হিরোর পাশে সাইড রোলে খেলছে।


তারপর কোথাও কিচ্ছু নেই, অরণ্য কলেজে আসেনা।


কয়েকদিন পর জানা গেল, পাড়ার এক মেয়েকে নিয়ে ভাগলবা। মেয়েটা নাকি হেব্বি দেখতে।


সব জানাজানি হতেই নাবালিকা মেয়েকে বাবা আইনের জোরে বাড়ি নিয়ে গেলেন, ঠিকানা বদলে ফেললেন।


তখন অরণ্যর পড়াশোনা লাটে। পরপর দুটোবছর নষ্ট করলো।


শেষে কাকিমা অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে, দিব্যি দিয়ে ছেলেকে পরীক্ষায় বসায়। ততদিনে চিন্ময়ের ইন্টার্ন চলছে।


কলেজ পাশ করে অরণ্য আর্মি জয়েন করলো। একদিকে ভালোই হলো, মেয়েটির ব্যভিচারিতা অরণ্যকে দেশপ্রেমী বানালো। চার্মিং বয় অরণ্য গোস্বামী তখন ট্র্যাজিক হিরো সেজে বর্ডারে।


পুরোনো স্মৃতি মনে করে দারুণ মজা লাগছে চিন্ময়ের। অরণ্যর এক্স কত সুন্দরী ছিল জানা নেই, তবে আজ চিন্ময় অরণ্যকে দেখিয়েই ছাড়বে, তার তমাও কম সুন্দরী নয়, চাকরিও করে।


আজীবন সাইড রোল খেলেও চিন্ময় কেমন জীবনটাকে এনজয় করছে!


অরণ্য চিন্ময়ের হাত সরিয়ে দেয়, "আজ নারে ভাই, আমার অন্য কাজও আছে, তাছাড়া একেই রাত হয়ে আসছে, তুইও জাস্ট বাড়ি ফিরছিস! অন্য একদিন ,কেমন?"


অরণ্যের বারণ অগ্রাহ্য করে চিন্ময়, "ছাড় তো তোর দেরি, আমার বিয়েতে তো এলিনা, এত কাছে এসেও আমার বউকে না দেখে চলে যাবি? চল তো... ভালো গলদা পেয়েছি, রাতে একেবারে ডিনার করিয়ে ছাড়বো, আমার বউয়ের হাতে রান্না, মিস করলে আঙ্গুল চুষবে কিন্তু মামু!"


বলে অরণ্যকে একপ্রকার বগলদাবা করে বাড়ির দিকে এগোয় চিন্ময়।



****************


দরজা খুলতেই তমার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অরণ্যকে প্রায় ভিতরে ঠেলে দেয় চিন্ময়, "আমার পুরনো বন্ধুকে ধরে আনলাম তমা", বলেই চিন্ময় তমার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় অরণ্যকে, "দিস ইজ মাই ওল্ডএস্ট ফ্রেন্ড অরণ্য, এতদিন বর্ডারে ছিল, আমার বিয়েতে আসতে পারেনি, আর অরণ্য, মিট মায় বিলাভেড ওয়াইফ তমালিকা ...!", একনাগাড়ে বলে সামান্য দম নেয় চিন্ময়।


তমা নমস্কার করে বলে, "তমালিকা সেনগুপ্ত!"


তমা চিন্ময়ের সারনেম ইউজ করছে, আরে বাপ্স! দারুণ!


তমা অরণ্য তখন মুখোমুখি, নিশ্চুপ। চিন্ময় অরণ্যের পিঠ চাপড়ে দেয়, "কিরে কেমন আমার বউ? চোখ ফেরাতে পারছিসনা?"


পুরোনো জ্বলুনিটা চিড়বিড় করছে চিন্ময়ের, অরণ্যের কানের সামনে মুখ আনে, "তোর এক্স এতো সুন্দরী ছিলনা, নারে?"


অরণ্য চোখ নামিয়ে নেয়।


চিন্ময় উৎসাহে ফুটছে, "তমা, আজ আমার বন্ধুর অনারে গলদার মালাইকারী, বুঝলি অরণ্য, আমার গিন্নি রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী, মানে বুঝলি না, আরে, স্কুলের দিদিমণি তো, সারাদিন ছাত্র ঠেঙ্গায়, আর বাড়ি ফিরে আমাকে ঠেঙ্গায়। তবে হ্যাঁ, যা রান্না করে না... আজ প্রমান দেব বন্ধু, কত সুখী আমি!"


বেশ আত্মতুষ্টিতে ভুগছে চিন্ময়। নিশ্চয়ই অরণ্যের হিংসে হচ্ছে, এটাই তো চেয়েছিল চিন্ময়!


যখন তুমি হিরো ছিলে, সাইড রোলে আমি, দাবার চাল উল্টে গেছে, ভোগী এখন আমি...


অরণ্য ইতস্তত করছে। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে, "চিনু, আজ চলি রে, তুই ছাড়লি না তাই এলাম, আসলে আজই একবার পিসির বাড়ি যেতে হবে"!


চিন্ময় হা হা করে ওঠে, "কিন্তু সেলিব্রেশন টা? রাতে খেয়ে যা... খুব মিস করবো কিন্তু!"


অরণ্য চিলতে হাসে, "সব পেয়ে গেলে তো পাওয়ার দামটাই নষ্ট হয়ে যায় রে, চলি!"


বেরিয়ে গেছে অরণ্য। কিন্তু কী বলে গেল, পাওয়ার দাম... চিন্ময়ের মাথায় ঢুকলনা, যাক গে, আজ হেব্বি কুলকুল লাগছে। গিন্নির ঝাড় তো টপকানো গেছেই, সেই সঙ্গে বহুদিনের একটা জ্বালা... উঃ!


**************




-"অরু দা আমায় বেড়াতে নিয়ে যাবে?"


-" সামনে না তোমার পরীক্ষা?"


-" রোজই তো পড়ি, ভালো রেজাল্ট আমি করবোই, দেখো!"


-"বেশ তো, আমার প্রথম ছাত্রী যদি ভালো রেজাল্ট করে, তাহলে শিক্ষক হিসেবে আমারও জয় হবে, আরও দুটো টিউশন পাবো...


-" তা পাবে, আচ্ছা অরুদা, আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তুমি আর আমাদের বাড়ি আসবে না?"


-'' আর কেন আসবো? তখন তো আমার প্রয়োজন শেষ!"


বুকের ভিতর থেকে ধবধবে একটি রুমাল অরণ্যর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ষোড়শী তমালিকা। রুমালের এককোণে লাল সুতোয় লেখা, 'অরণ্য', মাঝখানে লেখা, 'ভালোবাসি', নিচের কোণে, 'তমালিকা!'




************





পরীক্ষার পর মাসির বাড়ি যাওয়ার নাম করে বেরিয়েছিল তমা। শহর ছেড়ে একটু দূরে। সামনে একটা নদী, সরু নদী। চারপাশে জঙ্গল। ভীষণ শান্ত, চুপচাপ জায়গাটা।


নদীর পাড়ে বসে অরণ্যর কাঁধে মাথা রাখে তমা, "অরুদা...!"


অরণ্য তমার ঠোঁটে তর্জনী ছোঁয়ায়, "অরণ্য, তোমার অরণ্য!"


" সারাজীবন আমার পাশে থাকবে তো?"


"থাকবো"...


"আমায় ভুলে যাবে না তো?"


" পাগলী মেয়ে!"


"একটা গান শোনাও..."


" হুম! আরও দূর চলো যাই, ঘুরে আসি..."


" যাবে আরও দূরে...?"


" যদি হারিয়ে যাই, যদি তুমি খুঁজে না পাও?"


" বেশ চলো, একটা চিহ্ন এঁকে দিই!"




রাস্তার পাশে মোটা একটা বটগাছ। গাছের গোড়ায় সিঁদুর মাখানো নুড়ি পোঁতা, কেউ বোধহয় পুজো দেয়, কয়েকটা ধুপ অর্ধেক পোড়া। অরণ্য নুড়ির গায়ের সিঁদুর বুড়ো আঙুল লাগিয়ে নেয়, তারপর সেই সিঁদুর তমার সিঁথিতে, "বলো, কোথায় হারাবে?"


তমা জড়িয়ে ধরে অরণ্যকে, "আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে?"


তমার চিবুক ছোঁয় অরণ্য, "নিয়ে যাবো, তবে এখন নয়, আমাকে চারটে বছর সময় দাও!"




চারটে বছর! তারপর কটা বছর কাটলো যেন?


অরণ্যর মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।




সেদিন সন্ধ্যের পর যে যার বাড়ি চলে গিয়েছিল দুজনেই। পরদিন সকালে তমার বাবা অরণ্যর বাড়িতে হামলা করে। অকথ্য গালিগালাজ, পুলিশি ভয়, তাঁর নাবালিকা মেয়ের মাথায় অরণ্য সিঁদুর পরায় কোন আইনে?


অরণ্যকে শাসিয়ে চলে যান তমার বাবা।


দুদিন পর শোনা যায়, এখানকার পাট চুকিয়ে তমারা অন্য কোথাও চলে গেছে। অনেক খুঁজেছিলো অরণ্য, তমার বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে, আত্মীয়দের বাড়ি গিয়ে, কোথাও সন্ধান পায়নি।


দুটো বছর নষ্ট হলো। তারপর আর্মিতে, সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল অরণ্য। দেশ সেবার একাগ্রতা যদি মনের জ্বালা ভুলিয়ে দেয়!!





আজ অরণ্য অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। তবে এত বছর পর বাড়ি ফিরেই যে মুখটা মনে পড়েছিল সবার আগে, সে তমালিকা। সেদিন মিন্টো পার্কে তমার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা, ওই খবর দেয়, তমা এখন ঐখানে থাকে, ঠিকানা দেয়নি, তবে জায়গাটার নাম বলেছিল শুধু। অরণ্য সেই জন্যই গিয়েছিল ওখানে। ব্যস্ত বাজারে একবারও কি তমালিকা ব্যানার্জি কে দেখতে পাওয়া যাবে না? ভাবতে ভাবতেই চিন্ময়ের সঙ্গে ধাক্কা। তারপর....


***************




অন্যদিন স্কুল থেকে ফিরে তমা বাথরুমে যায়, স্নান সারে, একবারই।


আজ খাওয়া শেষে হলে রান্নাঘর গুছিয়ে তমা আবার বাথরুমে ঢোকে।আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আজ ওর নিজেকে আরও একবার দেখতে হবে। ফাঁকা সিঁথি। আজকাল আর সিঁদুর পরা হয়ে ওঠে আর কই! অরণ্য ঠিক এই সিঁথিতেই...


অরণ্যই তমার জীবনে প্রথম পুরুষ, সেই কৈশোর থেকে, যেদিন তমা সম্পূর্ণ নারী হয়ে উঠলো সেদিনও অরণ্যর পুরুষালি অবয়ব তমাকে মোহিত করে রাখতো।


পড়ার টেবিলে অরণ্য যখন কিছু লিখতো, মাথাটা ঝোঁকাতো। গলার কাছের বোতাম খোলা, বুকের লোমগুলো দেখা যেত। তমার শরীর শিউরে উঠতো।


অরণ্য নাকি ওর কলেজে খুব বিখ্যাত। তমার হিংসে হত। অরণ্য শুধুমাত্র তার। তমা তো পেয়েওছিলো অরণ্যকে নিজের করে।


তারপর...সেদিন, বাড়ি ফিরে তমা তখনও অরণ্যর গন্ধে স্বপ্নে আচ্ছন্ন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলেছে, দেখতে, সিঁদুর পরে ঘোমটা মাথায় কেমন লাগে তাকে দেখতে...


পিছনে মা! বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ!


পরদিন অরণ্যর বাড়ি গিয়ে বাবা যা নয় তাই বলে এলো।


শুধু তাই নয়, ওখানকার ঠিকানা বদলে দেশের বাড়ি ফিরে গেলো, তমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো হোস্টেলে।


সময়ের পলি পড়ে ধূসর হচ্ছিল সেই নদী পাড়ের দিনটা। কিন্তু অরণ্য ! সে যে তমার জীবনে প্রথম স্পর্শ! তাকে ভোলা কি এতোই সহজ?




বাথরুমের দরজায় চিন্ময়, "কি গো, এখনও বাথরুমে, শরীর ঠিক আছে তো?"


তমার জিভ জড়িয়ে যায়, "আ আসলে, হজম হয়নি বোধহয়... আসছি..."


চিন্ময়ের গলায় উদ্বেগ, "সেকি, তুমি তো সেরকম কিছুই খেলে না, খুঁটলে শুধু, তাতেই...!


তমা এবার মিথ্যে বলে, "স্কুলে মিটিং ছিল, ওখানেই উল্টোপাল্টা খাওয়া হয়ে গেছে...!"


" ঠিক আছে, তুমি সময় নাও, দরকার পড়লে ডেকো, আমি টুসকি র কাছে আছি!"




চিন্ময় চলে গেছে।




তমার তখন জেদ। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তারপর আর কাউকে পরোয়া করবে না!


চাকরি পেয়ে তমা গিয়েছিল অরণ্যর বাড়ি। অরণ্যর মা, আদর করেই বসিয়েছিলেন তাকে। আদর করেই বুঝিয়েছিলেন, তমার জন্যই তাঁর একমাত্র ছেলে দেশ ছাড়া। তমার জন্যই তাঁর সংসার নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে আর কোনো অমঙ্গল তমার জন্য আসুক, এটা উনি চাননা।


ঝগড়া লড়াই করে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু যেখানে চোখের জল লুকিয়ে থাকে, অনুভূতি লুকিয়ে থাকে, সেখানে লড়াই করার স্পৃহা থাকেনা। শুধু নিজের চোখের জল বুকে লুকিয়ে চোয়াল শক্ত করতে হয়।


তমাও তাই করেছিল। তার জন্য একটা পরিবার নষ্ট হয়ে যাক, এ তমা চায়নি।


তারপর একদিন চিন্ময়দের বাড়ি থেকে সম্বন্ধে আসে। মা বোঝায়, "তার যদি আসারই থাকতো, এতদিনে ঠিক ফিরে আসতো। 'ন' বছর'টা কম নয়!


তোর বাবার শরীরটা ভালো নেই, তোর জন্য যদি কিছু হয়ে যায়..."


নাহ! তমা সব খারাপের জন্য আর নিজেকে দায়ী করতে পারবে না, "আমি রাজি, তোমরা দিন ঠিক করো..."




বিয়ের আজ পাঁচ বছর কেটে গেছে। মেয়েরা আদতে নরম কাদার ডেলা। যে ছাঁচে ফেলা হয়, তারই আঁকার ধারণ করে। এই ক'বছরে চিন্ময়ের প্রতিস্থাপন অরণ্যকে ঝাপসা করে দিয়েছিল। স্বামী সংসার সন্তান স্কুল নিজের শখ নিয়ে তমা নিজের ছন্দেই ছিল।


বাড়ি ফিরে বরের সঙ্গে তুমুল ঝগড়ার পর মাঝরাতে চিন্ময়ের বুকের ওম সব ভুলিয়ে দিত যেমন, সকালে টুসকি ঘুম জড়ানো মুখখানি তমার সব অপ্রাপ্তি ঘুচিয়ে দিত। দিব্যি তো ছিল তমা!


কেন, কেন... আচ্ছা, অরণ্য আবার বিয়ে করেছে?


কথাটা ভেবেই একটা চোরা স্রোত বয়ে গেল তমার বুকের ভিতর। না করার তো কিছু নেই, তমা নিজেও তো...


তমার ঠান্ডার ধাত। একটু বেশি জল মাখলেই নাক বন্ধ, কপাল টিপটিপ। তবুও শাওয়ার টা চালিয়ে দেয় তমা। শরীর খারাপ যদি মনখারাপি ভুলিয়ে দেয়!




"কিগো, এখন আবার স্নান করলে?" মশারি টাঙাতে টাঙাতে জিজ্ঞেস করে চিন্ময়।


তমা চুল মুছছে, "হ্যা, বল্লামনা, শরীরটা কেমন লাগছিলো..."


তমা এবার ড্রেসিংটেবিলে। হাতে মুখে ক্রীম ঘসছে, আড়চোখে ঘুমন্ত মেয়েকে দেখে নেয় একবার। বলে, "তুমি তো কই, এই বন্ধুর কথা আগে বলোনি!"


চিন্ময় প্রথমটা বুঝতে পারেনি, "কে, ও অরণ্য? আরে ওর কথা আমারও কি মনে ছিল ছাই?


তবে ওর কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো!"


" কেন?"


চিন্ময় গুছিয়ে বসে, "কলেজে খুব হিরো সেজে কেতা মারতো। তারপর একটা মেয়েকে টিউশন পড়াতে গিয়ে ল্যাং খেলো, নাবালিকা মেয়ে, তার বাপ তো মেয়েকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সোজা পথে নিয়ে গেল, শুনেছি, অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল ওরা। আর অরণ্য,দেবদাস সেজে বর্ডার পাহারা দিতে গেলেন। ভালোই হয়েছে, মরবি তো মর, দেশের জন্য মর। কোথাকার একটা মেয়ে, সে বোধহয় এতদিন পাঁচ ছটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার করছে!"


তমা ঝাপসা চোখে বিড়বিড় করে, "পাঁচটা নয়, একটা।"


তারপর বলে, "উনি বিয়ে করেননি?"


-"বোধহয়, না। করলে তো জানতেই পারতাম।"


চিন্ময় পায়ের উপর পা তুলে টরেটক্কা বাজায়, "আজ ব্যাটা তোমায় দেখে ব্যোমকে গেছে জানো, ওর হেব্বি ঘ্যাম ছিল, ভালো রেজাল্ট ছিল, হিরোমার্কা ফেস ছিল, আবার যাকে পটিয়েছিলো, সেও নাকি ব্যাপক দেখতে...


আমি মার্কেটে ওকে দেখে সুযোগটা ছাড়িনি। ব্যাটা তুই একাই শুধু দেখাবি?


দেখ দেখ, আমিও কী কী জিনিস বিলং করি... শালা দিব্যি ছিলি, প্রেম একেবারেই ল্যাং মেরে বর্ডারে পাঠিয়ে দিলো... খ্যাক খ্যাক!"


অরণ্য বিয়ে করেনি। বুকের ভিতর চোঙা ভাবটা থিতিয়ে যাচ্ছে তমার। আর বারবার চোখ চলে যাচ্ছে সরু সিঁথির দিকে। ড্রয়ার থেকে তমা সিঁদুর কৌটো বের করে, সরু করে ভরিয়ে দেয় সিঁথি।




ঘরে রাতবাতি জ্বলছে। টুসকিকে ধারে ঠেলে তমা চিন্ময়ের কাছে এলো। অশান্ত শিশুর মত চিন্ময় মুখ ঘসছে তমার ঘাড়ে। অবাধ্য আঙ্গুল তমার নাইটির বোতাম খুলছে... তমা চোখ বন্ধ করে। নদীর পাড়ে সেই ঠান্ডা হওয়াটা আবার তমার সারা শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে, আজ প্রথম বার, প্রায় চোদ্দো বছর পর!


তমা জানেনা। আজ তার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে আগুন ধরাচ্ছে কে? চিন্ময়? নাকি, অরু... অরণ্য?


তমা জানেনা। তমা জানতে চায়না।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance