মনের ডায়েরি
মনের ডায়েরি


আজ আবার তোমাকে দেখলাম অলি। ফেসবুকের দেওয়ালে। স্বামী কন্যার মধ্যমনি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছো। সেই সঙ্গে তোমার নিজস্ব পেজে পোস্ট করা তোমার গল্পগুলোও পড়লাম সময় নিয়ে, এক এক করে। কবে এত বড় হয়ে গেলে তুমি? কবে এত পরিণত হলো তোমার কলম? আগে তো বানান ভুলের গুরুমা ছিলে।
দেখলাম, গেল বইমেলায় তোমার লেখা একটা উপন্যাসও বেরিয়েছে। বইমেলায় এবার আমার যাওয়া হয়নি তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তোমার বইটা জোগাড় করে পড়েও ফেলেছি। মুগ্ধ হয়েছি তোমার শিল্প শৈলীতে। এবার বুঝতে আর ভুল হয়নি, তোমার উপন্যাসে উমা-আশিসের প্রণয়ের প্রেক্ষাপট যে তোমার এবং আমারই কাটিয়ে আসা অদৃশ্য সুতোর বাঁধন!
খুব ভালো কাজ করেছ ওদের মিলিয়ে দিয়ে। সমাজের বুকে হাজার প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে একটা প্রেম যখন মধুর পরিণতি পায়, আমি এক নির্বোধ পাঠক হয়েও বুঝতে পারি, সেখানে লেখিকার কতটা পরিমান আবেগ জড়িয়ে থাকে। সেদিন তোমার মতো বিধাতাও যদি অদৃশ্য জাদুদন্ড ঘুরিয়ে আমাদের ভাগ্যটাও বদলে দিতেন? তাহলেও কি তুমি এরকম পাল্টে যেতে? এতটাই গুণবতী হতে? খুব সাধারণ মিষ্টি মেয়ের আব্রু ভেদ করে তোমার লেখিকা সত্ত্বার উন্মেষ ঘটতো?
সত্যিই, আমূল পাল্টে গেছে তুমি, আগের অলির সাথে কোনো মিলই নেই। বেশ একটা গিন্নি গিন্নি ভাব এসেছে চেহারায়, কিন্তু তোমার মুখের হাসিটা আজও সেই একইরকম, নিষ্পাপ। তোমার মেয়েটিও ঠিক তোমার ধাঁচেই গড়া। টানা টানা চোখ, ফোলা ফোলা ঠোঁট, হাসলে কি ঠিক তোমার মতোই গালে টোল পরে অলি? তোমাদের ওই তিনজনের সুখীসুখী চার দেওয়ালে, বেমানান কেবল তোমার স্বামী মানুষটি।
রেগে গেলে অলি? তুমি তো জানো সত্যি কথা বলার ক্ষেত্রে আমি ভীষণভাবে ঠোঁটকাটা। আর এই স্বভাবের জন্য কতবার তোমার সাথে আমার কলহ লেগেছে? আগে হলে তুমি বলতে, "এই নিয়ে চারহাজার পাঁচশ উনিশবার! এই উনিশটা কুড়ি হলেই কিন্তু তোমার সাথে কাঁচি, কাঁচি, কাঁচি!"
দেখেছো অলি? ঠিক তোমার মতোই আমিও হিসেবে কেমন পাকা হয়ে গেছি? স্মৃতিটাও তুখোড় হয়েছে বলো? কিন্তু তুমি ওই "কাঁচি কাঁচি" বলতে কেন? আমি তো কোনোদিনও তোমার আবেগকে প্রশ্রয় দিইনি, উল্টে তোমার দাদার বন্ধু হওয়ার সুবাদেই সবসময়ই ধমকে গেছি তোমাকে। হয়তো এটাও তোমার দূরদর্শিতা ছিলো, হয়তো তখন তুমি বুঝেও ছিলে একদিন তুমিই আমার জীবনে চরম সত্যি হয়ে দাঁড়াবে। বাকি সবটুকুই মিথ্যে হয়ে যাবে কালচক্রে। আমার উচ্চশিক্ষার অহঙ্কার মিথ্যে, আমার সৌমকান্তি চেহারার অহংকার মিথ্যে, আমার দুচোখে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন মিথ্যে এমন কি তোমার বিয়ের রাতে তোমার করুন সজল নয়ন উপেক্ষা করে তোমার বরের চারপাশে তোমার পিড়ি ঘোরানোর অদম্য ইচ্ছেটাও মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল কেন, সেটা ঠিক সেইদিন না বুঝলেও আজ বুঝি অলি।
তোমায় মিথ্যে বলবো না, তোমার ছবিটি দেখার পর তোমার পতিদেবের জায়গায় কতবার নিজেকে এডিট করে বসিয়েছি। না! জয় তোমার স্বামীরই। নয়তো যে অলিপ্রিয়া একটা সময় 'পার্থ দা' ছাড়া বুঝতো না কিছুই, চিনতোনা কিছুই, সেই পাগলিটা কিনা অন্য একটা অচেনা মানুষের সাথে একই ছাদের নিচে, একই বিছানায় এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলো? আচ্ছা
কোনোদিন, কখনো তোমার স্বামীর তোমায় আদর করার সময় আমার কথা মনে পড়েনি? কোনোদিন তোমার স্বামীর চুম্বন উপেক্ষা করে আমার ওষ্ঠ পাওয়ার আকুতি জাগেনি তোমার মনে?
জানি, এসব হাবিজাবি ভাবনাগুলো যদি কেউ চকিতে দেখে ফেলে, তাহলে ভাববে, ভীমরতি ধরেছে আমার, নয়তো আমি একটা চরিত্রহীন, নাহলে পরস্ত্রীকে কেও এমন ভাবে ভাবে?
কি করবো বলো? যতগুলো দিন তুমি আমার সঙ্গে ছিল, একবারও ভালো করে দেখিনি তোমার চোখদুটো। তখন আমি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ইংলিশে এমএ, তোমার মতো পাতি উচ্চমাধ্যমিককে 'ভালোবাসি' বললে আমার বিদুষিণী সতীর্থরা যে আমায় নিয়ে কটাক্ষ করতো! আমি, দি গ্রেট পার্থ ঘোষ, নারী হৃদয়ে তুফান তুলতে পারে, কিন্তু সে নিজে থেকে কোনো মোহিনী জ্বালে জড়াবে না, এই ছিল আমার এজেন্ডা।
তবু কেন এমন হলো অলি? তোমার সাথে খুনসুটি করতে করতে তবে কি আমিও তোমায় নিজের অজান্তেই তখন ভালোবেসে ফেলেছিলাম? প্রকাশ না করতে পারার জন্য কি অহমটাই দায়ী ছিল সেদিন?
বিয়ের কার্ড হাতে তুমি এসেছিলে তোমার দাদার সঙ্গে। ফিরে যাওয়ার সময় পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলে, "আমার সবটুকু পুন্য তোমায় দিয়ে দিলাম, ঈশ্বর তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করুন, ভালো থেকো !"
সেই প্রথম মনের ভিতরটা হুহু করে উঠেছিল, একটা ভয়, কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।
ইচ্ছে করে তোমার বিয়ের দিন গোপালপুর চলে গিয়েছিলাম। সৈকতে বসেও তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো ভেসে উঠছিল চলচ্চিত্রের মতো। বুঝেছিলাম, ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। উপলব্ধিটা যে বড় দেরি করে হলো অলি। এতটাই দেরি যে, আমার ঠোঁটকাটা গুনটাও কাটা পরে গেল নিজ চরিত্র থেকে।
একদিকে অবশ্য ভালোই হয়েছে নিজের স্ত্রী হলে তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে কি আর এইসব ছত্র আসতো আমার মনে? বিয়ে করলেই নাকি ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়? প্রেম পানসে হয়ে যায়?
তোমার বরের সাথে তোমার সম্পর্কও কি এরমটাই হয়ে গেছে অলি?
হা হা, মজা করছি গো! এখন আর মজা ছাড়া আর কিই বা করতে পারি?
আমাকে ভুলে, মানুষটার সাথে সাথে মানুষটার পদবিটাও যে তুমি নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছো, তবে এটাও ভাবতে ভালো লাগে নিজের অরিজিনকে বাদ দাওনি এখনো, বেলতলায় সেই পাঁচ ফুট দুইয়ের ফর্সা ফর্সা অলিপ্রিয়া রায়, এখন স্বামী সন্তান অলংকৃতা বাগুইহাটির অলিপ্রিয়া রায়চৌধুরী।
অনেকদিন পর খুব প্রীত হলাম তোমার সুখী মুখখানি দেখে। যদিও দশ বছর পরেও আমি আমার নিজের মনের আয়নায় রোজই তোমাকে দেখি, রোজই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো একটু একটু করে জাবর কাটি। এটাই বা কে পায় বলো? তুমি সুখে থেকো। আমার অহম আমায় ভাগ্যবান হতে দিলনা, কিন্তু পরজন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে জন্ম জন্ম তোমায় নিজের করে পেতে চাই আমি, তুমি লেখিকা না হলেও, তুমি বিদুষী না হলেও, তুমি সুন্দর না হলেও। সেদিন তোমার সমস্ত পুণ্য আমায় দিয়ে আমার স্বপ্ন স্বার্থক করতে চেয়েছিল। তুমি বড় হও, দিকে দিকে তোমার প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ুক, যথাযথ মর্যাদা পাও তুমি, এটাই আমার স্বপ্ন, এটাই এখন কেবল আমার একমাত্র চাওয়া। ভালো থেকো প্রিয়া।।