Sangita Duary

Abstract Fantasy Others

3  

Sangita Duary

Abstract Fantasy Others

বলয়

বলয়

9 mins
228



সৌরবলয়ের প্রচন্ড উত্তাপের মধ্যে বসে আছেন প্রজাপতি। সামনে রাখা স্তূপীকৃত কাদার মন্ড। এখান থেকেই পরিমাণমত কাদা নিয়ে তিনি জীব গড়বেন, তাদের গন্তব্য, ভবিতব্য আঁকবেন। কিছু কাদার তালে সত্বগুণ, রজঃগুণ আর তমগুণএর পরিমাণ সমান থাকবে আর কিছু কাদার তালে থাকবে অসামঞ্জস্য। তারাই হবে জাগতিক গ্রহের বহির্ভুত জীব।

এক খাবলা কাদার তাল নিয়ে প্রজাপতি চক্ষু মুদে কল্পনা করলেন গ্রহণযোগ্য রূপ। তারপর আঙুলের নিপুণতায় গড়ে তুললেন একটা শিশুদেহ। কিন্তু মনের আকার দেওয়ার সময়ই ঘটলো বিপত্তি। হাত ফসকে গেল প্রজাপতির, কাদার ডেলা পড়ে গিয়ে বিকটাকৃতি পেল, একে তো মর্ত্যে পাঠানো যাবে না! তাহলে...?

প্রজাপতির মস্তিষ্কে নতুন খেলার সুর বাজছে। চটুল হাসির ফাঁকে অস্ফুটে ধ্বনিত হচ্ছে,"দেখাই যাক!"

------------------------------------------------------------------

অবচেতনে বারবার একটা আলোর দ্যুতি দেখতে পায় বল্লম। একমাত্র সেই পায়, তাদের এই শ্যাওলা গ্রহে আর কেউ তা পায়না। কেন পায়না? কারণ তাদের কারোরই মন নেই।

হ্যাঁ, পিশাচদের মন থাকতে নেই, মন থাকলেও কোনরূপ দয়া মায়া করুণা ভালোবাসা ইত্যাদি মানবীয় অনুভূতিদের লালন করতে নেই- এটাই বরাবর জেনে এসেছে বল্লম। জন্ম থেকে দেখে এসেছে তাদের শ্যাওলা গ্রহের পৈশাচিক কার্যকলাপ, অভ্যস্ত হয়েছে তাদের পৈশাচিক জীবনযাপনে। তবু দেওয়াল জোড়া কালো আয়নায় যখনই মানব জগতের কার্যকলাপ দেখে, তার বায়বীয় হৃদয়ের অলিন্দে এরকম উত্তুরে বাতাস বয় কেন? কেন তার কোঠরোগত শূন্য চোখের গহ্বর থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে বারবার!

সূর্য ডুবতে বসেছে। শ্যাওলা গ্রহের আনাচে কানাচে জ্বলে উঠছে একটার পর একটা কালো হোমাগ্নি। প্রেত পিশাচের দল এখন খুব সক্রিয়। মানবীয় জগতে পৌঁছনোর এখনই তো সঠিক সময়!

চারিদিকের অজস্র কিটের স্তূপের মধ্যে থেকে যে স্তূপটা সবচেয়ে উঁচু, সেই স্তূপের ওপর ধ্যানমগ্ন বসে রয়েছেন জটিবুড়ি, শ্যাওলা গ্রহের সবচেয়ে পুরোনো পিশাচিনী। অনেক কিছু জানেন ওই বুড়ি, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালের বহু অজানা রহস্য ওঁর ঝুলির ভিতর বন্দি। বল্লমের অনেকদিনের শখ, ওই বুড়ির কাছে স্বর্গের গল্প শোনে। শ্যাওলার দেওয়াল আয়নায় পৃথিবী দেখা গেলেও স্বর্গ সেখানে দৃশ্যমান হয়না। শুধু কি তাই, স্বর্গের নাম শুনলেই তাদের প্রত্যেকের শরীর জ্বলে, বায়বীয় শরীরে অদৃশ্য অগ্নি-চাবুক পড়ে। আর ততই স্বর্গকে জানার আগ্রহ, মর্ত্যকে চেনার অদম্য আকুতি বল্লমের বেড়ে ওঠে প্রতিনিয়ত। কিন্তু কেন এমন হয় বল্লমের সাথে? পিশাচদের তো এরকম হতে নেই, বীভৎস রস ছাড়া অমৃতেও তাদের তেষ্টা নিবারণ হয়না। তবু কেন বল্লমের অজানাকে জানার এত তাড়না?

বল্লম ছোট ছোট পায়ে জটিবুড়ির কাছে যায়।

কোটি বছরের জটা ঠেলে বুড়ি নোংরা দাঁতে ঠকঠক মাথা নেড়ে হাসেন," মনিষ্যির ঘাড়ে চাপার খুব শক! রোস বাচা, খ্যামতা এট্টু বাড়ুক, তখন না হয় যতখুশি ওপারেতে যেও। ভুলে যেওনি, এতোদিন, মনিষ্যি আমাদের নিয়ে খিস্তি খেউর করেছে, গপ্পো নিকেচে, গপ্পো শুনেচে, আবার নাকি আমাদের গপ্পো শুনিয়ে, ট্যাকা নাকি, সেটাও কামিয়েচে। এবরে তো সত্যি সত্যি ভয় দেখানোর সময় এয়েচে, পোতিবার কেন আমরাই হারবো অ্যাঁ?"

বল্লম বলতে গেল,"পৃথিবী না, আমি স্বর্গে...", ওমনি সঙ্গে সঙ্গে একটা গরম লোহার শিক এসে তার গায়ে ঢুকে জ্বালিয়ে দিল শরীরটাকে।

জটিবুড়ি জটা মেলে দিল, "ওরে হতভাগা, স্বর্গে যাওয়া কি সহজ? শুনলেই মিলিয়ে যেতে হয়! আগে তো পিথিবীতে যা, মনিষ্যি হ, তবে না বুজবি, কী স্বর্গ, কী নরক!"


-------------------------------------------------------------------

ত্রিমুন্ডির আসনে একমনে ধ্যানে বসেছেন এক জটাধারী। সামনে প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখা।

শ্যাওলা গ্রহের জটিবুড়ির যজ্ঞাগ্নিতে পরিস্ফুটন ঘটছে সবকিছুর। এবার এক প্রাপ্তবয়স্ক পূর্ণক্ষমতাসম্পন্ন পিশাচকে প্রবেশ করতে হবে ওই অগ্নিতে, তারপর তার বায়বীয় রূপ হাজির হবে পৃথিবীতে, ওই ধ্যানমগ্ন জটাধারীর সামনে, বশ্যতা শিকার করতে হবে পিশাচকে, ওই পিশাচের মাধ্যমেই সিদ্ধ হয়ে ওই জটাধারী অসম্ভব সব কাজ করতে পারবে, এটাই নিয়ম।

বল্লম এদিক ওদিক তাকায়, জটিবুড়ির ভাসা ভাসা কথাটা এখনও তার কানে বাজছে, সেই যে অগ্নি শলাকা তার শরীর জ্বালিয়ে দেওয়ার আগে সে শুনেছিল... স্বর্গ জানতে গেলে আগে পিথিবীতে যেতে হবে। মনিষ্যি হতে হবে।

কিন্তু মনিষ্যি কি এমনি এমনি হওয়া যায়!

আশেপাশে কেউ নেই, বল্লম দৌড়ে গিয়ে যজ্ঞাগ্নিতে ঝাঁপ দেয়।

জটিবুড়ি বিস্ফারিত চোখে তাকায়, ক্রোধ সামলে নেয়। মনিষ্যি জন্ম কি এত সহজের! আমরা তো মনে মাথায় সর্বাঙ্গে পিশাচ, কিন্তু মনিষ্যি! একটা ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে জটিবুড়ির ঠোঁটে।

ওপ্রান্তে যজ্ঞের আগুন লেলিহান হয়ে ওঠলো হঠাৎ, নীল শিখায় দেখা যায় একটা অবয়ব, বল্লমের।

বল্লমও আবিষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকে সামনে বসা ধ্যানমগ্ন জটাধারীর দিকে, ঠিক যেন পুরুষরূপী জটিবুড়ি। উনিও নিশ্চয়ই স্বর্গের খোঁজ জানেন জটিবুড়ির মত! বল্লমের ছোট্ট অদৃশ্য বুকের ধুকপুকনি বেড়ে যায়। এঁরই অধীনস্ত থাকতে হবে বল্লমকে। ওঁর ইচ্ছে মত সব কাজ করতে হবে তাকে।

বল্লম তো তাইই চায়, কোনো সিদ্ধপুরুষের হাত ধরে তার স্বর্গ আর মর্ত্যের সাথে সংযোগ স্থাপন হোক।

ধীরে ধীরে চোখ খোলেন জটাধারী। চমকে ওঠে বল্লম। এ চোখে তো গভীরতা নেই, শুরু দৃষ্টির খাঁজে লুকিয়ে আছে ঠিক তাদের মতোই পৈশাচিক দৃষ্টি! বল্লম নিজেকে বোঝায়, যাঁর ওরকম জটা তিনি ত্রিকালজ্ঞ হবেনই!

--------------------------------------------------------------------

জটাধারীর পায়ের কাছে মাথা কূটছে একটা পঞ্চাশোর্ধ্ব রমণী," আমার কুল রক্ষে করো বাবা! সাত বছর হয়ে গেল এখনো নাতির মুখ দেখতে পেলুম না!"

জটাধারীর নির্দেশে দুইজন শ্বেত পোশাকধারী, মহিলাটিকে একটি ঘরে নিয়ে গেলেন, বুঝিয়ে দিলেন কর্তব্য। মহিলা দুইচোখে আশার আলো জ্বালিয়ে বিদায় নিলেন সেদিনের মত।

বল্লমের চোখেও খুশির ঝিলিক, এই জটাধারী তাহলে সামান্য নন, সত্যিই উনি এক মায়ের গর্ভে একটি প্রাণ এনে দিতে পারবেন! ভক্তিতে, শ্রদ্ধায় বল্লমের গলা বুজে আসে।

খানিক পরে আরও একজনের আগমন হলো।

এক মুশকো মধ্যবয়সী লোক, হাত পা নেড়ে অনেক কিছু বললো। কিছু বল্লম বুঝলো, কিছু বুঝলো না।

লোকটি চলে যেতে ডাক এলো বল্লমের। এক পরিবারের সব সদস্যদের শরীর থেকে রক্ত শুষে ছিবড়ে বানিয়ে দিতে হবে। এই কাজের সাথে সে জন্ম থেকেই পরিচিত, তবু কেমন যেন ভয় পেল বল্লম। 

কিন্তু উপায় নেই, ক্রীতদাস সে এখন।

-------------------------------------------------------------------

বল্লমের মাথার মধ্যে এখন পৈশাচিক ঘোর, ঠোঁটের কোণে সাতটি দেহের টাটকা রক্ত। আঁশটে উষ্ণ তরলে তার শরীরের পৈশাচিক কোষ উজ্জীবিত হচ্ছে। তন্দ্রালু স্বপ্নে স্বর্গের যে অস্পষ্ট ছায়া তার কল্পনায় ছিল, সেটা ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।

হঠাৎ বল্লমের মনে পড়ে, আজই তো সেই মায়ের কোল ভরানোর দিন। 

বল্লম হাওয়ার বেগের আগেই পৌঁছে যায় জটাধারীর আশ্রমে, নিশ্চয়ই কোনো দেবপুরুষের সাক্ষাৎ ঘটবে আজ!

আশ্রমের ঘরে ঢুকে থমকে যায় বল্লম। তক্তপোষের ওপর মসলিন চাদর বিছানো, তার ওপর প্রায় নিস্তেজ একটি নগ্ন রমণী, চোখের দুই কোণ থেকে অশ্রু ঝরছে। জটাধারীর সেদিকে দৃষ্টি নেই, তিনি উপগতে ব্যস্ত। বল্লম ছিটকে বেরিয়ে আসে।

----------------------------------------------------------------------

ধুনির চারপাশে ছড়ানো রয়েছে অজস্র উপাচার। আজ অমাবস্যার রাত। জটাধারী এক বিশেষ যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। ডাকিনি তন্ত্রে আজ সিদ্ধ হবেন তিনি। কালজাদু, গুপ্তবিদ্যার মাধ্যমে তিনি সমস্ত অসাধ্য সাধন করবেন। এদের কাছে অসাধ্য কাজের অর্থ হলো অসাধু কাজ। এতদিন না বুঝেই সব করে এসেছে বল্লম। তার যে উপায় নেই! এই কয়দিনে বল্লমের বয়স বেড়েছে অনেকটা, অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেক। সে বুঝতে পেরেছে, ওই জটাধারী কোনো শুভ উদ্দেশ্যে তাকে করায়ত করেননি। এই কয়দিন যাবৎ অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিয়েছে বল্লম, অগুনতি মায়ের গর্ভপাত করতে গিয়ে প্রাণ কেঁদেছে বল্লমের, বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে অনিচ্ছা সত্বেও। অথচ একটিও তৃপ্তিপ্রদায়ক কাজ সে করেনি। বিনিময়ে জটাধারীর কাছ থেকে পেয়েছে প্রসন্নতা আর লোহিত লবনাক্ত পানীয় যা তার বায়বীয় পিশাচ সত্তাকে আরও ক্ষমতাবান বানিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।

বল্লমের স্বর্গ চেনার স্বপ্ন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। 

হঠাৎ একটা শিশুর আর্ত চিৎকারে চিন্তা বিঘ্ন হয় বল্লমের।

জটাধারীর অনুচররা ধরে নিয়ে আসছে একটি সপ্তমবর্ষীয়া শিশুকন্যাকে। কী করবে একে নিয়ে এরা?

এই কি তবে ডাকিনী-সিদ্ধির মূল মাধ্যম? তারমানে বল্লমের প্রয়োজনীয়তা শেষ হবে এবার, তাকেও ফিরতে হবে আবার সেই অন্ধকার শ্যাওলা গ্রহে, বরাবরের মত তার স্বর্গ চেনার স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে যাবে!

নাহ, বল্লম কিছুতেই তা হতে দেবে না।

বাচ্চাটিকে এখন ধুনির সামনে শোয়ানো হয়েছে। কিন্তু জটাধারীর মনোযোগ বিঘ্ন করবে কিভাবে?

বল্লম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনুচরটির শরীরে প্রবেশ করে। অদূরে পড়ে থাকা ভাঙা কলসি তুলে এনে ওর মধ্যের জল ঢেলে দেয় ধুনির আগুনে। আগুন নিভে যায়। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে জটাধারী তেড়ে যায় অনুচরটির দিকে, সেই সুযোগে বল্লমের বায়বীয় শরীর অনুচরের দেহ থেকে নির্গত হয়ে শিশুটিকে তুলে নিয়ে মিলিয়ে যায়।


শূন্যে খোলা বাতাসে ভাসছে বাচ্চাটি, বল্লমকে দেখতে পাচ্ছে না, তবে অনুভব করতে পারছে। দেখতে পেলেও ও ভয় পেত ঠিক। আর কতক্ষণ এভাবে চলতে হবে কে জানে? কোথায় রাখবে বাচ্চাটাকে? কোথায় থাকতো বাচ্চাটা?

বল্লম যদি একটা শরীর পেত মানুষের মত!

হঠাৎ মাথাটা দুলে ওঠে বল্লমের। কেউ ডাকছে তাকে, জটাধারী! যেতেই হবে বল্লমকে।

কিন্তু বাচ্চাটাকে কোথায় রেখে যাবে সে? ঐতো! রাস্তার ধারে কয়েকটা লোক, ওদের কাছে রেখে গেলে হয়না?

সাবধানে বাচ্চাটাকে নামিয়ে বল্লম উড়ে যায় জটাধারীর কাছে। জটাধারীর চোখ আগুনের মত লাল, প্রচন্ড ক্রোধ ফেটে পড়ছে তার, বল্লমকে নির্দেশ দেয়, আজ মধ্যরাতের মধ্যেই আরও একটা সপ্তদশী শিশুকন্যা জোগাড় করে আনতে।

বল্লমের এবার শরীর জ্বলে ওঠে। প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায় ছিন্ন করে দেয় জটাধারীর মাথা। গরম রক্ত ছিটকে পড়ে ওর অদৃশ্য অবয়বে, বল্লম পরিতৃপ্তি পায়, বহুদিন পর। জটিবুড়ির মুখটা ভেসে ওঠে, সেই ফোকলা দাঁতের হাসি।

হঠাৎ বাচ্চা মেয়েটির কথা মনে পড়ে, ওর কাছে যাওয়া দরকার।

পলকে সেই স্থানে পৌঁছে দেখে চারটে নররূপী পিশাচ বাচ্চাটিকে ছিঁড়ে খুটছে। প্রচন্ড রাগে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে বল্লম। লোকগুলো ভয় পেয়ে মেয়েটিকে ফেলে পালাতে যায়, পারেনা। বল্লমের সুতীক্ষ্ণ নখ ওদের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।

----------------------------------------------------------------------

শ্যাওলা গ্রহের দেওয়াল জুড়ে যখন পৃথিবী ফুটে উঠতো, বল্লম দুচোখ ভরে প্রকৃতি দেখতো, মানুষ দেখতো, তাদের জীবন যাপন, অনুভূতি, বড্ড টানত বল্লমকে। কিন্তু সেই পৃথিবীটাই এখন শ্যাওলা গ্রহের চেয়েও বীভৎস লাগে। স্বর্গও কি তাহলে এরকম?

ভালো লাগেনা বল্লমের। সে বরং তার নিজের গ্রহেই ফিরে যাক। 

আনমনে হাঁটছে বল্লম, হঠাৎ এক জায়গায় মানুষের শোরগোল। কী হয়েছে? বল্লম কান পাতে।

কী সব অপারেশন নিয়ে কথা হচ্ছে।

বল্লম ভিতরে ঢোকে। এতদিনে পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাই তার চেনা হয়ে গেছে, এই জায়গাটার নাম নার্সিংহোম। বল্লম দেখে, একটা যুবক পড়ে রয়েছে আই সি ইউ তে, মারা গেছে।

অথচ ডাক্তার ক্রমাগত পেশেন্ট পার্টিকে বলে যাচ্ছেন,"ইমিডিয়েটলি টু ল্যাখস সাবমিট না করলে আমরা অপারেশন করতে পারবো না!"

মানুষেরা নাকি ডাক্তাদের ভগবান বলে! এরা ভগবান!

বল্লম জটিবুড়ির শেখানো মন্ত্র আওড়ে ফুঁ দিলো মৃত দেহটার ওপর, চোখ খুলল দেহটি।

বেশ একটা আনন্দ হচ্ছে বল্লমের, স্বর্গীয়। নিজের মনেই চমকে উঠলো বল্লম। কী? স্বর্গীয়! স্বর্গ! কই এবারে তার শরীরে ছ্যাঁকা লাগলো না তো!

----------------------------------------------------------------------

বিশাল একটা মাঠ জুড়ে অনেক লোক। সামনে মাইক, এক অনাড়ম্বর মহিলা এবং এক যোগীপুরুষ হাত তুলে কিছু বলছেন। বল্লম শিখেছে, একে স্লোগান বলে। কিন্তু ওঁরা যা বলছেন সব তো সত্যি বলছেন না!

অণুসেকেন্ডে বল্লম ওঁদের ধুলোময় অফিসে পৌঁছে যায়, বদলে দেয় সমস্ত খসড়া, কাজের প্ল্যান, এবার বেশ পরিষ্কার সবকিছু। বল্লম পিশাচ-চোখে দেখতে পায়, এই রাজ্যে আর অভাব থাকবে না, বেকারত্ব থাকবে না, রোগ থাকবে না, লোভ থাকবে না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বল্লম। আবার সেই অনুভূতি, স্বর্গীয়! কিন্তু বল্লম জ্বলে যাচ্ছে না।

-------------------------------------------------------------------

মস্ত একটা কামরায় অনেক লোক জমায়েত, এক এক করে প্রত্যেকের করতল দেখছে এক সাধু। শূন্যে হাত ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে ফুল, ফল, প্রসাদ।

বল্লম সাঁ করে গিয়ে তুলে নেয় ওগুলো। ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে থাকে সব্বাই। আবার সেই এক অনুভূতি, স্বর্গীয়।

--------------------------------–

ইন্টারভিউ রুম, হোমড়া চোমরা লোকগুলো তর্জনীর গায়ে বুড়ো আঙুল ঘষে ইঙ্গিত দেয় চা পানির খরচ দিতে।

বল্লম আঙ্গুল ধরে ঘুরিয়ে দেয়, জোর করে বলিয়ে নেয়,''কংগ্রাচুলেশন্স!"

-------------------------------------------------------

মধ্যরাতে হাসপাতালের ডিউটি সেরে ফিরছিল এক নার্স। পথে স্কুটি বিগরোয়। পিছনে কয়েকটা মদ্যপ ছোকরা, মেয়েটিকে ধাওয়া করে। বল্লমের মানবিক চোখে ভেসে ওঠে সেই বলিপ্রদত্ত সপ্তবর্ষীয়া, মেয়েটি বাঁচেনি, অজস্র কাগজে হেডলাইন হওয়া সত্বেও আজও কিছু পিশাচের যোনি-ক্ষুধা মেটেনি। খানিক ভেবে বল্লম ঢুকে যায় মেয়েটির ভিতর। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ায়, ঠোঁটের কোণে শ্বদন্ত, ছুঁচালো নখ, চোখে আগুনের ভাঁটা। ভয় পেয়ে দৌড় দেয় ছেলেগুলো।

----------------------------------------------------------




সামনে বিশাল সমুদ্র। চারিদিকে কেউ কোত্থাও নেই। বল্লম এবার নিজের রূপ ধরে, এখানে তো কেউ তাকে দেখার নেই, ভয় পাওয়ার নেই। স্বর্গ কী সেটা বল্লমের দেখা হয়নি, তবে স্বর্গীয় অনুভূতি বল্লম বহুবার পেয়েছে।

কোনরূপ নির্যাতনের সময় বল্লম নিজে দৃশ্যমান না হয়ে, ভর করেছে নির্যাতিতদের ওপর, ভয়ে পালিয়ে বেঁচেছে শিকারীর দল। 

কখনও বা পুলিশদের পাশবিকতার সামনে বল্লম ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য কৃষকদের কাছে তার পরলৌকিক শক্তি আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়ছে। কত পতিত জমিতে সোনা ফলেছে! কত ডুবে যাওয়া বাণিজ্যে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ পড়েছে! বিনা চিকিৎসায় আর কেউ মরে না, ভুল চিকিৎসা আর কেউ পায়না।

স্বর্গ এখন সত্যিই মাটিতে নেমে এসেছে।

 যা এতদিন মানুষদের ভগবান করতে পারেনি, শত অনুরোধ, প্রার্থণা, ভিক্ষে চেয়েও ভগবান দেখা দেননি, তা একা এই স্বর্গপিপাসু পিশাচ করে দেখিয়েছে।

আসলে ভক্তির শক্তি যখন শেষ হয় তখনই ভয়কে হাতিয়ার করতে হয়।

আশ্চর্য! ওদের শ্যাওলা গ্রহে কিন্তু কখনও স্বজাতীয় যুদ্ধ লাগেনি, তাই ওদের বাহ্যিক কোনো শক্তির প্রয়োজন পড়েনি শান্তি ফেরাতে। একমাত্র মানুষই সুখ শান্তি সমৃদ্ধির জন্য বহিরাগত শক্তির কাছে প্রার্থণা করে, ভিক্ষে করে, সে শুভ হোক কিংবা অশুভ। আসলে ওরা নিজেদের শক্তিশেলের ব্যবহার সঠিকভাবে করতেই শেখেনি!


এবার বল্লমের ফেরার পালা। সব কাজ সাঙ্গ।জটিবুড়ি ডাকছে। আবার যদি প্রয়োজন হয়, আবার যদি কোনো জটাধারী ডাকেন, তাহলে হয়তো আবার কোনো বল্লম আসবে, বদলে দেবে পৃথিবীর নক্সা! কিন্তু সেই বল্লমের বুকে যদি স্বর্গতৃষ্ণা না থাকে? তাহলে?


আর দেরী করা যাবে না। ভোর হতে আর পরমাণুক্ষণ বাকি, এক্ষুণি সময়ের দরজা খুলবে।বল্লম আগুন জ্বালায়, শ্যাওলা গ্রহের অন্দরের কথা ভাবে। কিন্তু একি! দরজা তো খুলছে না! বদলে খুলে যাচ্ছে অন্য আর একটা দরজা, সেটার ওপারে চোখ ধাঁধানো রশ্নি! সাতটা রঙের চোখ ঝলসানো বিচ্ছুরণ। কোন স্থল ওটা? আর ওই যে উপরে, ওখানে কে বসে? সাদা গোঁফ, দাড়ি, চারটে মাথা... মাথার পিছনে ঘূর্ণীয়মান অগ্নিবলয়, দুই চোখে অদ্ভুত গভীর প্রশান্তি, ঠোঁটে বরাভয়ের হাসি। ওঁর সামনে কাদার মন্ড, এক খাবলা করে কাদা তুলে নিচ্ছেন আর মূর্তি গড়ছেন, ছুঁড়ে দিচ্ছেন একটা বিশেষ দিক লক্ষ্য করে। চার হাতের মধ্যে দুই হাত মূর্তি গড়তে ব্যস্ত, বাকি এক হাতে পুস্তক আর অন্য হাতের করতলে একটা বিকটাকৃতি মূর্তি সযত্নে শোয়ানো। বল্লম এবার চিনতে পারলো নিজের পুত্তলিকা, অশ্রুসিক্ত নয়ন মুদে করজোড়ে এগিয়ে গেল জাজ্বল্যমান দরজাটির দিকে।


 







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract