মিত্র মধুসূদন
মিত্র মধুসূদন
দক্ষিণ দিকের জানলাটা শঙ্কর খুলে রাখতেই পছন্দ করেন, কিন্তু পাড়ার ওই বখাটে ছেলেগুলোর জন্য সে উপায় আর নেই। ওই এক ঠেক হয়েছে ঐখানে, দিন নেই, দুপুর নেই, সন্ধ্যে নেই, সারাক্ষণ ঠ্যাং নাচিয়ে কি যে এত গ্যাজাল ঠোকে ওরা! বাড়িতে কেউ শাসন করার নেই! পড়াশোনা শিখে কোথায় চাকরির চেষ্টা করবি, তা না! একদিন তো শঙ্কর বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিলেন, "কি ভাই, এইখানে সর্বক্ষণ বসে থাকা কেন?"
ফাজিল মত একজন বলেই বসলো, "কি করব জ্যেঠু, চাকরি নেই দেশে, তাই সমাজসেবায় নেমেছি। এটাকে আমাদের ক্লাব বলতে পারেন, আপদে বিপদে ডাকবেন, বন্ধুর প্রয়োজন হলেও নাম নেবেন, ঠিক হাজির হয়ে যাবো!"
গজগজ করতে করতে ফিরে আসেন শঙ্কর, "ক্লাবের কি ছিরি! ঘর নেই, স্রেফ একটা বেঞ্চ পেতে ক্লাব, তাও আবার রাস্তার ওপর, জবরদখল!"
পাড়ার সব গণ্যমান্যরা গেলেন কোথায়? তাঁর নাহয় ছেলে বিদেশে আর স্ত্রী স্বর্গদেশে যাওয়ার পর এইখানে আর কেউ নেই, তাই মনের আর গলার জোরটা স্বাভাবিকভাবেই কম, তাই বলে এর একটা বিহীত হবে না?
অবশ্য বিহীত হবেই বা কিকরে?
কে এখন আর কার কাজে লাগে, সবাই নিজের নিজের ঘর বাঁচাতেই ব্যস্ত।
আর ওই ছেলেগুলোর বাড়ির লোকদেরও বলিহারি যাই, ছেলেরা ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়াচ্ছে আর সেটা তারা সহ্য করছে? হুমহুম বাবা! এর জন্য শিক্ষা চাই, সঠিক শিক্ষা। যেমনটা তিনি দিয়েছেন তাঁর ছেলেকে। এই এতবড় পাড়ায় কার ছেলে ওরকম একটা ঘ্যমা চাকরি নিয়ে স্ক্যান্ডেনেভিয়ায় সেটলড, দেখাক দেখি!
শঙ্কর মনে মনে ইষ্টদেবতাকে প্রণাম করেন, ভাগ্যিস, বাবাইকে দেশে রাখেননি, নাহলে বাবাইও ওদের মতোই...!!
মাসের পয়লা যেন ঠিক বিভীষিকার মত আসে শঙ্করের। ফাঁকা হাতে পেনশন তুলতে যেতেই হয় আর ব্যাংকে ওই দিন যা ঠেলাঠেলি ভিড়! ওইদিনই সব্বাইকে মাইনে তুলতে হবে।
একা একা থেকে আজকাল বড্ড কমজুরি হয়ে পড়ছেন শঙ্কর, একটু হাঁটলেই বুক ধড়ফড় করে, একটু বেশি কথা বললেই দম আটকে আসে যেন।
ব্যাঙ্ক রাস্তার ঐপারে। শঙ্কর এই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যা গাড়ি চলছে অবিরাম, রাস্তা পেরোতেই ভয় করছে। শঙ্কর একবার এগোচ্ছেন তো দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছেন। এই ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুরে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা যায়! ফিরে যে যাবেন, আবার তো আসতে হবে এবং এই পরিস্থিতিতে পড়তেও হবে।
শঙ্কর চোখ বুজে ইষ্ট দেবতার নাম করেন, "হে মধুসূদন, হে দীনবন্ধু... পার করে দাও সখা!"
পাস থেকে একটা স্বল্পপরিচিত কণ্ঠস্বর, "চলুন চলুন আমি পার করে দিচ্চি আপনাকে!"
শঙ্কর চোখ মেলেন, আরে এ তো সেই বেঞ্চে বসা ফাজিল ছোঁড়াটা! এ এখানে?
ছেলেটি শঙ্করকে হাত ধরে ওই পারে পৌঁছে দিয়ে বললো, "বলেছিলাম না, আপদে বিপদে ডাকবেন!"
শঙ্কর মনেমনে গর্জালেন, "আমি ডাকি আর তুমি এসে হাজির হও, ভগবান নাকি হে?"
তবু তো একটা কৃতজ্ঞতা দেখাতে হয়।শঙ্কর মুখে বললেন, "বেঁচে থাক বাবা, জীবনে উন্নতি করো। তা বাবা, নাম কি তোমার? থাকো কোথায়?"
ছেলেটির ঠোঁটে হাসি, "কেন, ওই যে ডাকলেন, মধুসূদন... আমার নাম মধুসূদন মিত্র, থাকি ওওওই গোয়ালা পাড়ায়!"
গোয়ালা পাড়ায়! মিত্র! শঙ্কর মুখ কোচকান। গোয়ালা পাড়ায় তো সব ছোটলোকদের বাস! ছ্যা ছ্যা! ওই পাড়ার ছেলে, কাজ নেই, শিক্ষা নেই, গরু চড়াবে না তো আর কি করবে?
বয়স যত বাড়ে, বন্ধুসংখ্যা তত কমে হয়তো। জীবনের প্রথম বন্ধু, বাবা, কবেই চলে গেছেন, সারাজীবন বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকা স্ত্রী টিও চলে গেলেন। ছেলে যতই বড় হয়, তাকে ছোঁয়া টাও অসম্ভব হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। শঙ্করেরও বয়স বাড়ছে, এখন তো প্রায় রোজই টেলিফোনে এক একটি বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ আসছে। ভেঙে যাচ্ছেন শঙ্কর। চারপাশটা শুন্য, কেউ নেই, কোত্থাও কেউ নেই। হাত বাড়ালে কাউকে পাবেন না তিনি, এই বোধটাই যে মৃত্যুর চেয়েও বীভৎস।
আজকাল খুব মনে হয়, বাবাই যদি দেশে থাকতো, অন্তত দুবেলা ছেলেটাকে দেখতে তো পেতেন! কি লাভ সন্তানকে এত শিক্ষিত করে ,যেখানে শেষ বয়সে বাবা মা এতটা নিঃসঙ্গ হয়ে যায়! হে মধুসূদন!
দরজায় টোকা। এমন সময় কে এলো? ভিজে চোখ মুছে শঙ্কর দরজা খোলেন, আরে, সেই ফাজিল ছোঁড়া! ও আচ্ছা আচ্ছা, এনার নামও তো আবার মধুসূদন, মধুসূদন মিত্র।
একদিক থেকে ভালোই হলো, কথা বলার সঙ্গী তো একটা হলো, হোক না সে গোয়ালা পাড়ার, নেই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো।
শঙ্কর বললেন, "তা, মিত্র, কি মনে করে?"
মধুসূদন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় উত্তর দেয়, "এই যে আপনি ডাকলেন! খুব একা লাগছে?"
আশ্চর্য্য! কি করে ছেলেটা বুঝে যায় শঙ্করের মনের কথা? হ্যাঁ, তিনি মধুসূদন কে ডেকেছিলেন, কিন্তু সে মধুসূদন তো...!
মধুসূদন বলতে থাকে, "জানেন, এই সংসারে কেউ কারোর নয়, কেউ কারোর জন্য বসে থাকেন না। আপনার স্ত্রী আপনাকে দেবতা মানতেন, চলে গেলেন। আপনার ছেলে যাকে হাত ধরে হাঁটা শেখালেন, আটকাতে পারলেন? এই সংসারে সব থেকে বড় অসুখ কি জানেন? নিজেকে নির্বান্ধব ভাবা। আরে, আপনি এসেছেন তো একা, চলে যাবেনও একা, তাহলে এত হাহুতাশ কেন?"
শঙ্কর মনে মনে কটূক্তি করেন, "গীতার বুলি নাকি সিনেমার ডায়লগ? আজকাল তো সব একসঙ্গে পাঞ্চ করে পঞ্চপাণ্ডব বানানো হয়!"
মধুসূদন বাঁকা হাসে, "কি ভাবছেন, সিনেমার ডায়লগ দিচ্ছি? জীবনটাই কি একটা সিনেমা নয়? আপনার তো তবু এই বাড়িটা আছে, ব্যাংকে টাকা আছে। এইসংসারে কত মানুষ আছে জানেন? রাস্তায় পড়ে থাকে, মাথার ওপর ছাদ নেই, খাবার দানা নেই! ওদের একবার আপন করে দেখুন না, কত বন্ধু পেয়ে যাবেন, নিজেকে আর একা লাগছে না!"
দুপুরের খাওয়া সেরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শঙ্কর। স্বপ্ন দেখলেন, উঁচু খাদ থেকে পড়ে যাচ্ছেন, কেউ ধরার নেই।
বুক চেপে উঠে পড়েন শঙ্কর। হাঁফাচ্ছেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, ইনহেলার... কোথায়?
টেবিল হাতড়ে খুঁজলেন, শেষ হয়ে গেছে। এক্ষুনি চাই নাহলে...
বুক চেপে বাইরে বেরিয়ে আসেন শঙ্কর। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। ওই তো ওষুধের দোকান, রাস্তা টা পার হলেই... পারছেন না দৌড়তে, পড়ে গেলেন। রাস্তার পাশে বসে থাকা এক ভিখিরি দৌড়ে এলো... কি হলো বাবু... এই তোরা কে কোথায় আছিস...
সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক চালচুলোহীন মানুষ দৌড়ে আসে। ময়লা বোতল খুলে জল দেয় মুখে, একজন দৌড়ে গিয়ে ওষুধ দোকানের দোকানিকে ডেকে আনে।
শঙ্কর এখন কিছুটা সুস্থ। বাবাইকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি, ব্যস্ত হয়তো। ওষুধ দোকানের ছেলেটাই মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। আর ওই ভিখিরি গুলো বাড়ির বাইরে পাহারাদার হয়ে বসে থাকে। ওখানেই শোয়, ঘুমোয়। শঙ্কর ওদের দিকে আর ঘেন্নার চোখে তাকান না, সেদিন তো ওদের জন্যই....!
কিন্তু মধুসূদন যে কিনা শঙ্করের সব দরকারে ছুটে আসে, সে কই? সেতো একবারও এলো না!
মধুসূদনের সেদিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে শঙ্করের। একেই বোধহয় "বসুধৈব কুটুম্বকম" বলে?
আজকাল খুব মনে পড়ে মধুসূদনকে। একদিন তো ওদের ডেকে জিজ্ঞেসও করলেন শঙ্কর, "তোমরা মধুসূদনকে চেন, ওই যে গোয়ালা পাড়ায় থাকে? ওই যে রাস্তার পাশের বেঞ্চে বসে আড্ডা দেয়? চেন?"
সবাই ঘাড় নাড়ে, কেউ চেনেনা। শঙ্করের মন ভারী হয়ে যায়। কি অদ্ভুত মায়া মাখানো ছেলেটির মুখে, রংটা চাপা, কিন্তু কি উজ্জ্বল! চোখদুটো বেশ বড়, ঐদিকে তাকালে কেমন যেন আচ্ছন্ন লাগে।
অনেক রাত, ঘুমাচ্ছেন শঙ্কর। হঠাৎ একটা বাঁশির আওয়াজ। বাঁশি! কোথায় বাজছে? আহা! যেন শঙ্করকেই ডাকছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শঙ্কর সেই বাঁশির আওয়াজ অনুসরণ করেন। ওই তো বাড়ির বাইরে একটা কদম গাছ, বাহ! গাছটা ফুলে ফুলে কি সুন্দর ভরে গেছে! কিন্তু এখন তো কদম ফোটার সময় নয়!
ওই তো, ওই তো মধুসূদন! ওই কি তবে বাঁশি বাজাচ্ছে?
শঙ্কর এগিয়ে গেলেন। এই রাত্তিরে ছেলেটা ... একি, ও কে?
মধুসূদন বাঁশি থামায়, "কেন আমায় চিনতে পারছনা? রোজ তো ডাকো আমায়। আমি যে সবার বন্ধু, তোমারও বন্ধু!"
শঙ্কর হাঁটু মুড়ে করজোড়ে বলেন, " দিশা দাও প্রভু, পথ দেখাও!''
মধুসূদনের ঠোঁটে সেই ভুবন ভোলানো হাসি, "ভক্তি আর প্রেম দিয়ে যে-ই আমাকে চায়, সে-ই আমাকে পায়। আজ তুমি সব বন্ধন মুক্ত করে এসেছ। এসো, আমার হাত ধরো, এতগুলো দীন মানুষকে তুমি আশ্রয় দিলে, এখন তুমি আমার আশ্রয়ে থাকবে।"
পরদিন সকালে রাস্তার পাশের কদম গাছের নিচে শঙ্করের প্রাণহীন দেহটা পাওয়া গেল। চারিদিকে কদম ফুলে ঢাকা।
(Oscar Wilde এর The Selfish Giant এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে)