ক্ষিধে
ক্ষিধে


মাথার ওপর গ্রীষ্মের প্রখর রোদ, রাস্তায় চটি পরেও পা ফেলতে ভয় হয়। ছাতিফাটা আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণেই গলা শুকিয়ে দিচ্ছে। ময়লা গামছায় ঘামাচি ওঠা ঘাড় মুছতে মুছতে পঞ্চুর হোটেলে ঢোকে শিবরাম।
কাঠের তেলচিটে বেঞ্চির ওপর রাখা ময়লা মগ তুলে ঢকঢক করে খানিকটা জল গলায় ঢেলে চেঁচায়, "পঞ্চু, ভাত দে!"
জং ধরা ছান্তা উঁচিয়ে এগিয়ে আসে পঞ্চু, "পাঁচশো পার হয়ে গেচে শিবু'দা, কালই তো বললুম তোমায়। আগের টাকাটা আগে শোধ করো।"
শিবু তেড়ে যেতে গিয়েও নরম সুরে বলে, "হ্যারে যখন পোথম হোটেল খুলেচিলি, কে ফাস্টে খদ্দের ছিল রে তোর, অ্যাঁ? কে ওই ইস্টিশন পয্যন্ত গে গে খোদ্দের ধরে আনতো? আজ কটা খোদ্দের হচ্চে বলে মো'কে খোঁটা দিচ্চিস?"
পঞ্চু নির্বিকার। শিবু আড়চোখে দেখে, গলায় আরও একটু কোমলতা মেশায়, "বলচি, অ পঞ্চু, বুজিসই তো, দিন আনা দিন খাওয়া নোক, এই দ্যাক না, সেবার কেরলে নে যাবে বলে জগা'দা একলাই চলে গেল। সেকেনে চলে গেলে কি আর এই একশো দিনের কাজের পিচনে ছুটে মরতুন বল?"
পঞ্চু আবার উনুনে ফিরে যায়, "যাওনি তোমার বাপের ভাগ্যি। এই যে পিতিবি জুড়ে করোনা হচ্ছে, পারতে ঘরে ফিরতে? কাজপাতি বন্দো। টেরেন, বাস সব বন্দো। আমার হোটেল খানা চলে কী করে? তারউপর, তোমরা সবাই যদি মাগনায় ভাত চাও, কোত্থেকে হাঁড়ি চড়াই? আমার তো আর অন্নপুননার খোরাক নেই!"
রাক্ষুসে ক্ষিধে পেটে পঞ্চুর গলা খ্যাঁকারি হজম করতে পারলোনা শিবু, "দিতে হবে নে তোকে ভাত। তোর ভাত তুই একাই গেল্। দেকব, কটা খদ্দের টিকে থাকে তোর!"
জলের মগ উল্টে বেরিয়ে যাচ্ছিল শিবু, পঞ্চু রে রে করে দৌড়ে আসে, "শকুনের অভিশাপে গরু মরে নে শিবু'দা। তবে পীঠটান দেওয়ার আগে ধার'টা সুদে দে যাও।"
ইচ্ছে করছে ফোটা তরকারীতে পঞ্চুর মুখখানা গুঁজে দিতে। লুঙ্গির ট্যাঁক থেকে দুশো টাকা ছুঁড়ে দেয়, "এটাই আছে, সেদ্দো করে গেল্!"
আর কিছু শোনার অবকাশ না রেখে দৌড়ে বেরিয়ে যায় শিবু।
ছোট থেকে ক্ষিধে একেবারে সহ্য করতে পারেনা শিবু। তার এই ক্ষিধের জন্য কত-কতই না মাশুল দিতে হয়েছে!
মায়ের বুকের দুধ টানতে টানতে, দাঁত গজাল যখন, মাড়ি শিরশির করতো, শিবু দিলো একটা কামড়। মায়ের বুক ফুলে ঢোল, যন্ত্রণায় কঁকিয়ে যায় মা। ঠাকুমা ফেলু বুড়ির কাছে নিয়ে যায়, জলপোড়া দেয়, মন্ত্র ফুঁ দেয়।
ফোলা কমেনা। শিবুরও ক্ষিধে কমে না, একটা বুকের দুধ কম পড়ে, অন্যটা টানতে চায়, মা বাধা দেয়, শিবু ছোট ছোট পায়ে লাথি মারে মায়ের বুকে।
বুক ফুলতে থাকে, পেকে যায়। একদিন, মরে যায় শিবুর মা।
বাপটা অন্যের জমিতে চাষ করতো। মা মরে যাওয়ার শোকে কাজে মন টিকলো না। ঠাকুমা জোর করে বাপকে বাইরে পাঠালো, কারখানায় কাজ করতে।
লেদ কারখানায় কাজ নিয়েছিলো শিবুর বাবা, অসাবধানে একদিন লোহার চাঁই পড়লো মাথার ওপর, ব্যাস, মরে গেল।
ঠাকুমার বয়স হয়েছিল, তবু লোকের বাড়ি বাড়ি মুড়ি ভেজে, বড়ি দিয়ে দিন চালাতো।
সেবার অনাবৃষ্টিতে চাঁদিফাটা রোদ্দুরে হঠাৎ ঠাকুমার নিঃশ্বাস আঁটকে গেল। তখন কত বয়স শিবুর? দশ-বারো!
মামা এনে রেখেছিল বাড়িতে, মামী দিনরাত খাটাতো। খেতে দিত দিনের বেলায় দুইহাতা ভাত, এক খাবলা আলুভাতে।
রাতে, দুটো রুটি আর এক ডেলা ভেলিগুড়।
শিবুর রাক্ষুসে ক্ষিধে একদিন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। রান্নাঘরে ঢুকে উনুনে বসানো দুধের কড়াই থেকে গ্লাস ডুবিয়ে চোঁ চোঁ চুমুক দিয়েছিল।
মামী জানতে পেরে উদমা মার মেরেছিলো, বের করে দিয়েছিল ঘর থেকে।
ঘাড় ধাক্কা খেয়ে শিবু নিজের বাড়ি ফিরে এসেছিল।
কিন্তু খাবে কী? রেঁধে দেবেই বা কে?
পাশের পাড়ার মণ্ডলদের ধান কাটতে লোক লেগেছে। শিবু কাত্তিককে ধরলো। কাত্তিক রাজি হলেও তার বাপ রাজি হলোনা, "নিশ্চয় মামার বাড়ি থেকে চুরি করে পালি এসচে, খবরদার কাত্তিক ওকে একদম কাজে রাখবিনি, ওর খোরাক জানিস?"
চাষের কাজ জুটলো না শিবুর।
একটা গেঞ্জিকল ছিল বাজারে। মূলত সুতো কাটার কাজ। শিবু মালিকের হাতে পায়ে ধরে কাজ জুটিয়ে ফেললো।
ইস্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রোজ দেখা হত কল্পনার সঙ্গে। নীল পাড় সাদা শাড়ি পরে, দুদিকে দুটো বেণী ঝুলিয়ে লাজুক চোখে দেখতো শিবুকে। দুই গালে টোল ফেলে মুচকি হাসতো যখন শিবুর বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠতো।
কতদিন স্বপ্নে দেখেছে শিবু, কল্পনা পাট ভাঙা শাড়ি পরে ভাত বেড়ে বসে রয়েছে শিবুর জন্য।
কাজে গিয়েও মন বসেনা, ভুল কেটে ফেলে। মালিক ডেকে সাবধান করে দেয়।
ফিরতি পথে আবার কল্পনার মুখোমুখি। শিবু মনে সাহস আনে, কল্পনাকে ডেকে বলে, "আমার বউ হবে?"
কল্পনা দৌড়ে পালায়।
তারপর, বেশ কয়েকদিন কল্পনার দেখা পায়না শিবু। রাগ করেছে নাকি কল্পনা? শিবুর প্রস্তাবে তাকে হারামি ভাবলো নাকি?
কাজে মন বসেনা শিবরামের। মন পড়ে থাকে ইস্কুলের রাস্তায়। কাউকে জিজ্ঞেস করবে? কাকে জিজ্ঞেস করবে?
একদিন, ঘরে ফেরার সময় শিবু দেখলো, ইস্কুলের পিছনে বটগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কল্পনা। কেমন উস্কোখুস্কো, ঠোঁটের চামড়া ওঠা।
শিবুকে দেখে দৌড়ে আসে, "বিয়ে করবে বলেছিলে, করবে? আজই?"
শিবুর বিস্ময় দেখে কল্পনা বলে, "বাপটা মাতাল, পয়সার জন্য আমাকে..."
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে কল্পনা। শিবুর বুকে সাহস ফেরে, কল্পনাকে বুকে চেপে জড়িয়ে ধরে।
শুরু হলো শিবুর নতুন জীবন, ঠিক যেমনটা সে স্বপ্নে দেখতো, তেমনটা। রাতদিন বউকে নিয়ে ঘরে দোর দেয়। ঘরের বাইরে বেরোয়না। ওদিকে গেঞ্জিকলের মালিক খবর পাঠায়। শিবু উত্তর দেয়না। কাজটা হাতছাড়া হয়।
কাজ নেই, ঘরে দানা বাড়ন্ত। কিন্তু ক্ষিধে বাড়লে হুঁশ থাকেনা শিবুর।
একদিন খেতে বসে ভাত কম পড়লো থালায়। ভাবলো, তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বোধহয় কম ভাত দিয়েছে কল্পনা। হাঁড়ি হাতড়ে দেখলো, একটা দানাও নেই আর। রাগে আরও গরম হয়ে গেল মাথাটা, দাঁত খিঁচিয়ে বউকে বললো, "বাপের বাড়ি দিয়ে এয়েচিস চাল?"
কল্পনা মুখে আঁচল চেপে কাঁদে।
বড়রাস্তার পাশে একটা আবাদি জমিতে একশো দিনের কাজ চলছিল, ধরে কয়ে লেগে গেল শিবু। অভাব কমলো। ঘরে চাল এলো, আগের মত আবার ভাত ফোটার গন্ধ এলো। কেবল আগে মত আর কাছে এলোনা কল্পনা।
শিবু কাছে টানলেও, না।
সকাল বেলা চা মুড়ি খেয়ে শিবু বেরিয়ে যায়। আগের রাতে পুকুরে আস্ত নারকেল পাতা ডুবিয়ে রাখে কল্পনা। পরদিন সকালে গুগলি, শামুকে ভরে যায় পাতা। কল্পনা সেগুলো তুলে গরম জলে ডুবিয়ে ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে অ্যালুমিনিয়ামের বালতি করে নিয়ে বেরোয় ভদ্রপাড়ায়। ওখানে এই গুগলির খুব চাহিদা। বড় মানুষেরা মাছ মাংসের মত গুগলিও দাম দিয়ে কিনে রেঁধে খায়।
শিবুকে আর বিশ্বাস নেই, বেখেয়ালে কখন কাজ হারায়! তখন আবার তো সেই একথালা ভাতের জন্য এই কল্পনাকেই গাল পাড়বে, গায়ে হাত তুলবে।
কোনোদিন ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়, কোনোদিন আবার এক বেলাও কেটে যায়। শিবু ঘরে ফেরে, বউকে দেখতে পায়না। ক্ষিধেয় আর রাগে আরও গরম হয়ে ওঠে মাথা। রোজের মজুরি যা পায় নিয়ে চলে যায় পঞ্চুর হোটেলে। ভাত খায়।
ঘরে ফিরে কল্পনাকে বেদম মারে, "শালী, বরের উপর ভসসা নেই? কে তোকে টাকা রোচকার করতে কোয়েচে? তোর শক বুজিনি আমি? রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নোককে রূপ দেকিয়ে বেরোনো? আর কোত্থাও বেরোবিনি।"
বউকে ঘরে আঁটকে রেখে শিবু রাস্তায় বেরোয়। মোড়ের মাথায় একটা মদের ঠেক। দেশি মদের। শিবু সেখানে যায়, জ্বালা মেটায়। মাতাল হয়ে ঘরে ফেরে, আবার মারে বউকে।
ঘরে চাল ফুরোয়, টাকা ফুরোয়। শিবু পঞ্চুর দোকানে ধারে ভাত খায়। মদের দোকানেও ধার বাড়ে।
এরই মধ্যে ঢুকে এলো এই করোনা। সব বন্ধ। কাজ বন্ধ, লোকের বাইরে বেরোনো বন্ধ। লোকে খাবে কী?
এখন রেশনে চাল দিচ্ছে ফ্রি'তে, সেখানেও যা ভীড়!
কল্পনার সাথেও আজকাল দুটো কথা বলা যায়না, সারাক্ষণ আছোলা মেজাজ। এত মার খেয়েও মেয়েমানুষের যে কিকরে এত তেজ থাকে!
শিবু খ্যাসারির ডালের বড়ার ঝাল খেতে চাইলে কল্পনা ঝেঁঝে ওঠে, "সরকার চাল দিচ্ছে, ডাল'টা কি আমার বাপের কাছ থেকে আনবো?"
মুখটা ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে। এই মেয়েমানুষের প্রেমেই কিনা সে একদিন মজেছিল! সাধে কি আর নিজের বাপ বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল? এখন আপদ এসে চড়েছে এই শিবুর ঘাড়ে।
ময়লা গামছাটা টেনে নিয়ে শিবু বেরিয়ে যায়, মদের ঠেকে। মদ খেলে জ্বালা কমে! মদ খেলে পৌরুষত্ব বাড়ে!
দাওয়ায় বসে কুলোতে চাল বাচছে কল্পনা। রেশনের চালে বড্ড কাঁকড়। মাথা পিছু পাঁচ কেজি চাল দিলে কী হবে, পাঁচশো কাঁকড়ে ভরা। দশ কেজি চালের পুরোটা ঘরে ফেরেনা। শিবু দোকানে পনেরো টাকা করে বিক্রি করে দিয়ে আসে প্রত্যেকবার। আর সেই টাকায় মদ গেলে। বারণ করলেই বলে, মদ খেলে নাকি করোনা হয়না।
কত বোঝায় কল্পনা, "বাইরে যেওনি, সবাই দূরত্ব বজায় রাকতে কইচে!"
কিন্তু কল্পনার কথা শুনলে তো!
সপ্তাখানেক হলো মুখে রুচি আসেনা কল্পনার। ভাত ফোটার গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি উঠে বেরিয়ে আসতে চায়। শরীরটা ভারী লাগে, ঘুমোতে ইচ্ছে যায় সবসময়।
সেদিন টাইমকল থেকে জল ভরে পিতলের কলসিখানা কাঁখে তুলতে গিয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।
মাধু খুড়ি ধরে ফেলল, "দেহে কি তোমার যুৎ সইচে নে বউ? চাও তো আমার দিকে একটিবার।"
কল্পনার ঘোলাটে দৃষ্টি দেখে মাধু খুড়ির হাসি ফোটে, "অ শিবু, কই গেলি রে? যা যা মিষ্টি নে আয়, ঘরে তোর সোনারচাঁদ আসচে।"
শিবুর চোখদুটো চকচক করে উঠলো। সে বাপ হবে!
বউকে পাঁজাকোলা তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়, "কোনো কাজ করবেনে তুমি। সব আমি করবো। মাধু খুড়ি কোয়েচে তোমায় ফল, দুধ খাওয়াতে, যাই, বাজার থেকে ঘুরে আসি একবার!"
নরম কচি একটা শরীরের যেন গন্ধ পেল শিবু, গন্ধ পেল ঘিয়ে পোড়া কাজলের, পাউডারের। দূর থেকে যেন কানে এলো একটা কচি খিলখিল হাসি, ট্যাঁ কান্না।
বুকের ভিতর আনন্দের বাণ ডেকেছে।
গামছা টেনে শিবু বাজারে যায়।
মদের দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে বসে ঠ্যাং নাচাচ্ছে মদন। শিবুর হাসি মুখ দেখে চ্যাঁচায়, "কি বে, শিবে, আজ এত ফুত্তি? ঠেকে বসবিনি?"
শিবু ঘাড়ের দুই পাশে ঝুলতে থাকা গামছাটা গলায় পেঁচিয়ে নেয়, হলদেটে দাঁত বের করে এগিয়ে যায় মদনের দিকে, চারিদিকে আলগা দৃষ্টি বুলিয়ে চুপিচুপি বলে, "ফুত্তিই বটে। বাপ হবো রে!"
হৈহৈ করে ওঠে মদন, "শালা সেই জন্যিই মুখ গুঁজে পালাচ্চিলি? ও কেষ্ট'দা, ভুতো'
দা কই গো সব? আমাদের শিবে বাপ হচ্চে গো! নে নে মাল খাওয়া দিকি!"
শিবু লজ্জা পায়, "মদ ছেড়ে দেব রে মদনা, ঘরে বাচ্চা আসচে, সে যদি দেকে তার বাপ মাতাল, কী শিকবে বল সে? আমি যেমনিই হই, আমার বাচ্চাকে আমি বড়নোকদের মত বড় করবো দেকিস, লেখাপড়া শেখাব। তবে তোরা খা, আমি খাওয়াবো। দাঁড়া, পঞ্চুটাকে ডেকে নে আসি, শালা সেদিন আমায় ভাত দেয়নি। আজ ওকে আমি মদ গেলাব।"
পঞ্চুকে ডাকতে বেরোতেই বৃষ্টি শুরু হলো। পঞ্চুকে নিয়ে যখন ফিরলো শিবু, ভিজে পুরো কাক। মাথায় গামছা ঢেকে কি আর বৃষ্টি ঠেকানো যায়? নাকটা সরসর করছে, একটা হ্যাঁচ্ছোও হয়ে গেল।
মদন বোতল এগিয়ে দেয় ,"গলায় ঢেলে দে, গরম হয়ে যাবি।"
শিবু ভাবলো, আর কখনও যখন খাওয়াই হবেনা তখন, এই শেষ।
কালো লম্বা বোতলটা ডাকছে শিবুকে। ঢকঢক করে পুরো বোতল শেষ করে শিবু ভাবলো, শেষবার যখন ,প্রাণ ভরে খেয়ে নেওয়া যাক। বোতলের পর বোতল জমা হলো। অচৈতন্য শিবু পড়ে রইলো দোকানের এক কোণে।
------------------------------------
রাত বাড়ছে। শিবু এখনও ঘরে ফেরে না। কল্পনার চিন্তা বাড়ে। ফল দুধ আনতে এত সময় লাগে?
বৃষ্টিও শুরু হলো। আঁটকে যায়নি তো কোথাও?
একটা ছাতা নিয়ে ভারী শরীরটা তুলে কল্পনা বাইরে বেরোয়। অন্ধকার পিছল রাস্তায় পা পিছলে পড়ে। তলপেটের নিচে কেউ যেন গরম শীষ ঢুকিয়ে দেয়। যন্ত্রণায় ভেঙে যায় পেট। রাস্তার কাদাজল রক্তে ভিজে যায়।
-------------------------------–-------------------------------------
দুটো মানুষের মাঝে এখন মস্ত একটা দেওয়াল। পেটের ভিতরের রক্তের ডেলা তরল হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে কল্পনার ভিতরটা যেন শক্ত কঠিন হয়ে গেল ধীরে ধীরে।
নিয়মমাফিক সব হয়, শিবু রেশন তোলে, কিছু চাল বেচে সেই টাকায় সবজি কেনে, খালের বাঁধানো পাড়ে বলে ছিপ দিয়ে ল্যাটা মাছ ধরে, কাঁকড়া ধরে, সাধ হলে খ্যাসারির ডাল আনে, কল্পনা পেঁয়াজ কুঁচিয়ে মাছের ঝাল রাঁধে, তেঁতুল ডোলে টক রাঁধে, আলু কেটে ডালের বড়ার ঝাল বানায়।
কেবল, কথা বলেনা, মূক হয়ে সব কাজ সেরে যায় নির্বিঘ্নে।
দুপুরে শিবু তক্তপোষে শোয়।
কল্পনা মাটিতে চাটাই পাতে। ছেঁড়া শাড়ি গায়ে জড়িয়ে চোখ বোজে।
দিনদিন শিবুর খুকখুক বাড়ছে। রাতে সেই যে শুরু হয় একবার, থামতেই চায়না। পেটটাও গড়বড় করে, অতো ঝালঝাল তরকারি সহ্য হয়না। বমি চলে আসে। নাক বুজে আসে। মাথাটা দপদপ করে। কী যে হলো তার হঠাৎ!
শিবুর কষ্ট হয়। মনে হয়, বাচ্চাটা নষ্ট হলো তার জন্যই। ছেলেবেলায় মাকে খেলো, বাপকে খেলো, ঠাকমাটাও তার জন্যই তো খেটে মরলো। আর এখন নিজের বাচ্চাটা... তাকেও খেল শিবু?
ছিঃ! রাক্ষস সে! এত খায় তবু সাধ মেটেনা?
সেদিনের পর বাড়ি ফিরে দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের মাকালীর ছবির কাছে মাথা কুটেছিল, "কেন সেদিন বাচ্চার গন্ধ শুঁকিয়েচিলি মা? কান্না শুনিয়েচিলি? আমার বাচ্চাকে আমিই খেয়ে ফেললুম?"
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় শিবুর। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল হয়ে থাকে। শিবু মনে মনে প্রলাপ বকে, "বেশ হয়েছে, এই তোর শাস্তি শিবু!"
পঞ্চায়েত থেকে বাড়ি বাড়ি লোকেরা এসে মুখের লালা, নাকের শ্লেষ্মা পরীক্ষা করছে।
দুদিন পর একটা অ্যাম্বুলেন্স এলো, তুলে নিয়ে গেল শিবুকে। কল্পনাকে বলে গেল ঘরবন্দি থাকতে, বাইরে একেবারেই না বেরোতে।
ক্লাবের ছেলেরা এসে চাল, ডাল, আলু, সাবান, তেল, নুন রেখে যায় উঠোনে।
বাড়িতে কল্পনা একা। একা সে সবসময়ই। মাতাল বাপ মদ খেয়ে এসে মারতে মারতে একদিন তার মাকে মেরেই ফেললো। তখন কল্পনা কতটুকু! আট বছর! পাশের পাড়ার মাস্টার দিদি জোর করে ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। পড়তে ভালো না লাগলেও কল্পনা রোজ ইস্কুল যেত, ওইটুকু সময় তো বাপের হাত থেকে রেহাই পেত সে!
আর পেত, প্রথম যৌবনে ভালোলাগার স্বাদ, শিবুকে।
কাউকে বলতে পারেনি কল্পনা, সবাইকে মিথ্যে বলেছে, বিক্রি নয়, তার বাপই তাকে ভোগ করতে চেয়েছিল সেদিন। কল্পনা দরজা বন্ধ করতে যাওয়ার অছিলায় বেরিয়ে শেকল তুলে পালিয়ে বেঁচেছিলো।
তখন শিবুকেই আশ্রয় বলে মনে হয়েছিল।
বিয়ের পর নতুন জীবন, নতুন ঘর সংসার, কল্পনা হাতে স্বর্গ পেয়েছিল যেন!
কিন্তু তার কপাল পোড়া। নাহলে শিবু মদের নেশা ধরে, বদলে যায় বছর ঘুরতে না ঘুরতেই!
মাধু খুড়ি যেদিন তার পেট হওয়ার খবর দিলো শিবুকে, কল্পনা তার চোখে খুশির ঝিলিক দেখেছিল। আদর করে শিবু কল্পনাকে ঘরে এনে শুইয়েছিলো। আবার স্বপ্ন দেখছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে। পেটে হাত বুলিয়ে আদর করছিল বাচ্চাটাকে, হয়তো ওই পারবে শিবুকে ভালোমানুষ তৈরি করতে!
সেই বাচ্চাটাই আর রইলনা।
সবাই বলে, শিবুর নাকি নজর খারাপ, ওই নাকি বাচ্চাটাকে খেয়েছে। আচ্ছা, কেউ তার নিজের সন্তানকে খেতে পারে? সন্তান কি খাওয়ার জিনিস?
কল্পনার চোখের পাতা কাঁপে। অসম্ভব তো কিছু নয়, কোনো মানুষের কি ওরকম রাক্ষুসে খিদে থাকে শিবুর মত? ওরকম রাগ থাকে চন্ডালের মত?
ভয়ে কুঁকড়ে যায় কল্পনা। ভয়ে, ঘেন্নায় দূরে সরে যায় শিবুর থেকে। ওই একটাই সম্পদ তার নিজের হতে পারতো। সেটাও খেয়ে নিল শিবু?
ঘরের কাজে মন বসেনা। আগে নিজের পাতের ভাতে ঠিকঠাক পেট ভরতো না। এখন ভাত বেশি হয়ে পান্তা হয়, পচে যায়। কল্পনা পুকুরে মাছেদের খাওয়ায়।
দিন নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, সন্ধ্যে নেই, কল্পনা অন্ধকার দাওয়ায় বসে থাকে। চেয়ে থাকে আকাশের দিকে।
মাধু খুড়ি যেচে আজ একগ্লাস দুধ দাওয়ায় রেখে জানালা দিয়ে বলে গেছে, "নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী করবে বৌমা? শরীরটা তো রাকতে হবে। ভাত বসাও, এই দুধটুকু রেকে গেলুম, ভাতে মেকে খেয়ো, ভালো নাগবে দেকো!"
মাধু খুড়ি চলে গেলে কল্পনা দোর খোলে, খোলা দাওয়ায় এসে বসে।
একটা কুকুর বসে আছে উঠোনে। জিভ বের করে হাঁফাচ্ছে, চোখ দুটো ছলছল করছে। আহা রে! মায়া হয়। এই দুর্দিনে এদের মুখে কেউ খাবার দেয় না যে! কল্পনা হাঁড়ি থেকে ঠান্ডা ভাত এনে মাটির সরায় দুধ দিয়ে মেখে দেয়। স্পষ্ট দেখে, কুকুরটার চোখে কৃতজ্ঞতা। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় কল্পনা, বলে,"খা, বাবা খা!"
অনেকদিন পুকুর থেকে গুগলি তোলা হয়নি। আজ ঘাটে গিয়ে কল্পনা দেখে ঘাটের সিঁড়ি কালো হয়ে ভরে রয়েছে। কল্পনা চটপট তুলে নেয়। পচা নারকেল পাতা তুলে খসিয়ে নেয় গুগলি। এগুলো বিক্রি হলে হাতে কিছু টাকা আসবে। শিবু হাসপাতাল থেকে ফিরলে ভালো মন্দ কিছু মুখের সামনে ধরতে হবে তো!
হাঁড়ি ভর্তি গুগলি মাথায় নিয়ে কল্পনা বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। কুকুরটা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে পিছন পিছন চলে। খুব ন্যাওটা হয়েছে তার।
অনেক ঘুরলো কল্পনা। সব বাড়িই ভিতর থেকে বন্ধ। কড়া নাড়লেও খোলেনা। ঘুরে ঘুরে কল্পনা হাঁফিয়ে যায়। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যায়। ক্ষিধেয় পেট টনটন করে ওঠে। উরুর দুই পাশের কোলভাগ ছড়ে যায় গরমে।
মাথার ওপর সূর্য জ্বলছে।
কল্পনা রাস্তার পাশে প্রতীক্ষালয়ে বসে পড়ে। আঁচল দিয়ে ঘাড় গলা মোছে। শুনশান রাস্তা, কেউ কোত্থাও নেই।
ক্লান্তিতে একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল হয়তো, একটা স্পর্শে সম্বিৎ পেলো।
একটা মুশকো লোক গোলগোল লোভী চোখে ঝুঁকে পড়েছে তার ওপর, নিজের ঠোঁটে জিভ বোলাচ্ছে।
কল্পনা চিৎকার করে।
পায়ের নীচে কুকুরটাও বসে ঝিমোচ্ছিলো। কল্পনার চিৎকার শুনে উঠে পড়ে। লোকটার প্যান্ট কামড়ে ধরে। ঘেউঘেউ চিৎকারে আরো কয়েকটা কুকুর জড়ো হয়। লোকটা পালায়।
---------------------------- ----------------------------------
কল্পনা আর একা নয়।
হাঁড়ি ভর্তি গুগলি সেদ্ধ আর ভাত কল্পনা কলাপাতায় ঢালে, ল্যাজ নেড়ে কল্পনার চারপেয়ে সন্তানরা পরম তৃপ্তিতে খায়।
কল্পনা তার মানব সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।
সে বেঁচে থাকলে, জন্ম নিলে, হয়তো একদিন আর একটা শিবু হয়ে উঠতো, কিংবা কল্পনার বাবার মত কেউ! যতই হোক, রক্তের দোষ কোথায় যাবে?কিংবা ওই প্রতীক্ষালয়ের মুশকোটার মত কেউ, আবার কোনো অসহায় কল্পনাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে লোভে নিজের ঠোঁট চাটবে, মেয়েমাংসের লোভে নাল ঝড়বে জিভ দিয়ে!
কিন্তু যে সন্তানরা অবহেলায় ঘোরে রাস্তায় রাস্তায়, নর্দমায় খুঁড়ে খুঁড়ে উচ্ছিষ্ট খায়, অলক্ষ্যে মানুষের ঘরে ঢুকে পড়লে,তাদের গায়ের নোংরা গন্ধে নাক চেপে জুতোর বাড়ি মেরে তাড়িয়ে দেয় লোকজন, আর গায়ে ঘাএর ক্ষত নিয়ে, ছেঁড়া কামড়ানো ল্যাজ নিয়ে নীরব যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যু প্রার্থণা করে পরমেশ্বরের কাছে, তাদের একটু কোমলতা দিলেই, একটু ভালোবাসলেই তারাই রক্ষাকর্তা হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়- এ কল্পনা বেশ উপলব্ধি করেছে এই দুর্দিনে।
এতগুলো শ্বাপদ সন্তানদের আশ্রয় দিতে পেরে, খাবার দিতে পেরে কল্পনা এখন পরিপূর্ণা, অন্নপূর্ণা।
একদিন শেষ দুপুরে শিবু বাড়ি ফেরে। সুস্থ হয়েছে। স্বাস্থ্য ফিরেছে। চোখের তলায় কালি উধাও, বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেহ। হাসপাতালে তাহলে ভালোই যত্ন হয়!
বাঁশের বেড়ার আগল খুলে ভ্রু কুঁচকে যায় শিবুর। বন্য গন্ধে নাক সিঁটকোয়। মাটিতে পড়ে থাকা মোটা বাঁশ নিয়ে তেড়ে আসে ঘরের দিকে।
কল্পনার সন্তানরা তখন মধ্যাহ্ন ভোজনে ব্যস্ত। বাঁশের তাড়া খেয়ে বিস্ময়ে তাকায়, পাল্টা তেড়ে যেতে গিয়ে লক্ষ্য করে, তাদের মা আনন্দাশ্রু মেখে উঠে দাঁড়িয়েছে।
ওরা মাথা নুইয়ে নেয়, মুখের খাবার ফেলে করুণ চোখে শুয়ে পড়ে চার পা মুড়ে।
শিবু হাতের তালুতে নাক চেপে দুমদাম এগিয়ে আসে, "মানষের মুখের অন্নভাত এদের খাওয়াচ্চো? মা নক্ষ্মী মেনে নেবে? তারপর ভাড়ার শূন্য হলে আমরা খাবো কী?
ক্ষমা ঘেন্না সব গেচে নাকি? আমার তো আর সাত পুরুষের জমিদারি নেই যে ফেলে ছড়িয়ে বিলিয়ে জীবন কাটবে, আমার খিদের সময় কে এসে ভাত ধরে মুখের সামনে?
এগুলোকে দূর করো আগে, এক্কুণি। ছ্যাঃ!"
কল্পনার তীক্ষ্ণ চোখ শিবুর ভিতরটা পরিষ্কার দেখতে পায়, লালা ঝরছে তার ক্ষুধাতুর জিভে, চকচক করছে লোভাতুর মন।
বুক থেকে দীর্ঘ হাহাকার ছেড়ে কল্পনা চোখ বোজে একবার। বুঝিবা কয়েক ফোঁটা অশ্রুদানাও ঝরে পড়ে বেখেয়ালে। মুখে নকল একটা হাসি ফুটিয়ে বলে, "বেলা পড়েছে, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে খুব? ভাত বাড়ি?"