অপারগ
অপারগ


ভরা বসন্তেও তিনদিন হঠাৎ আসা অকাল শ্রাবণের পর আজ মেঘমুক্ত আকাশে রোদের হাতছানি দেখে বিছানায় বসে বসেই সকালসকাল মনটা ভালো হয়ে গেল ইমনের। এককাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় ও। দূরে একটা কোকিল একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে, কি খুঁজছে ওই কোকিল? কাছের কোনো সঙ্গী বা বন্ধুকে? মনেমনে ভাবে ইমন। এমনসময় মুঠোফোনটা স্বশব্দে জানান দেয় নতুন কোনো বার্তা এসেছে। টাচস্ক্রিনে ফুটে ওঠে আদি লিখেছে, "কিরে মন, আজ আসছিস তো গোলপার্ক সিসিডিতে, বিকেল চারটে। তোর অপেক্ষাতে থাকবো..."
সেই ছোট্টবেলা থেকে বন্ধুত্ব ওদের, ইমন সেন, আর, আদর্শ গুপ্ত।
বন্ধুরা মজা করে ওদের পদবি মিলিয়ে দিত। ওদের বন্ধুত্বও ছিল যেমন অটুট, ঝগড়াগুলোও ছিল নজিরবিহীন, না না, ঝগড়া না, বলা ভালো, হাতাহাতি, তুমুল যুদ্ধ। লাথি, ঘুষি, কিল, চড়। তারপর? কে আগে এগিয়ে আসবে, এই ইগোর লড়াইটা ছিলনা, শুধু সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় যেই মনে হতো, "যাহ! কাল এসকেবির নোটটা তো আনতে বলা হলোনা ইডিয়টটাকে?"
অমনি চোখ মুঠোফোনে, তুমুল সাধুবাক্যের পর নির্মেদ ভাব। পরদিন একে অপরের কাঁধ ধরে ফের কলেজে এন্ট্রি, যেন কিছুই হয়নি।
কলেজ শেষে আদি চলে গেল ব্যাঙ্গালোর, চাকরি জীবনে। ব্যস্ততা অনেককিছুই ভুলিয়ে দেয়। ওদের বন্ধুত্বও শিথিলতার পথে।
ইমন মাস্টার্স করতে বিশ্বভারতী ভর্তি হলো, সেখানেই পরিচয় আকাশের সাথে।
আকাশ চ্যাটার্জি, বাংলার গেস্ট-লেকচারার। দারুন আবৃত্তি করতে পারে, তুখোড় কবিতা লেখে। দুচোখে শিল্পীসত্ত্বা যেন জ্বলজ্বল করছে সর্বদা।
এহেন পুরুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ইমনের ছিলনা। পাঁচবছর কমিটমেন্টের পর বিয়ে।
ছ'টা মাস স্বপ্নের মতো কেটে গেল, আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো না, ওদের সম্পর্ক ছিল শান্ত নদীতে পালতোলা নৌকার মতো, নিবিড়, নির্জন।
হানিমুনে সিমলা গিয়েছিল ইমনরা। সেই প্রথম বুঝতে পারে ইমন, আকাশ "অপারগ"। প্রথম প্রথম ইমনের মনে হতো হয়তো আকাশের শিল্পীসত্ত্বা তাদের মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু মধুচন্দ্রিমাতেও ইমনকে দূরে সরিয়ে রাখাটা ইমন মানতে পারেনি। এক সন্ধেবেলায় আকাশ খোলাখুলি বলেও দিলো সে কথা। ভালোবাসা মনের মিলন হলেও কয়েকটা শর্ত তো রেখেই যায়, সেই শর্তেই আত্মার মিলনের পাশাপাশি দৈহিক মিলনও গুরুত্ব রাখে ভীষণভাবে।
বাড়ি ফেরার পর থেকে
ই আকাশের বদল আরো বেশি করে চোখে পরে, ঠিক মতো বাড়ি ফেরেনা, ইমনের সাথে ভালোভাবে কথাও বলেনা। হঠাৎই ইমন আবিষ্কার করে আকাশ আবার জড়িয়ে পড়ছে, মেঘনার সাথে, প্লেটোনিক লাভে। আকাশের টেবিলে ছড়ানো কবিতার পৃষ্ঠা, "কবিরা কখনো হতে পারে নাকি, কারো প্রেমিক? তারা ভালোবাসে আর গান গায়/তাদের প্রেমিকা, কেবল আসে, যায়!!!"
সেদিনই ঘর ছেড়েছিল ইমন। তারপর কেটে গেল আরো কয়েকবছর। মধুছন্দার বিয়েতে আবার মুখোমুখি দুজনে। ভীষণ পুরুষ হয়ে গেছে আদি। পুরোনো ছেলেমানুষিটা একেবারেই ভ্যানিশ। আপাতত কলকাতাতেই। ফোনে রোজই কথা হয়। পুরোনো বন্ধুত্ব ডানা মেলে কোথাও একটা গভীর ভালোলাগার জায়গা নিচ্ছে দুজনের মনেই।
ইমন জানে, যাই হয়ে যাক, আদি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে বসেও ওর জন্য অপেক্ষা করবে।
এলোমেলো ভাবনাগুলো সরিয়ে ইমন বর্তমানে ফিরলো, আজ শাড়ি পরবে, এমনিতে শাড়ি পরাই হয়না। পুরো ওয়ার্ডরোব তছনছ করেও মনোমত একটা পছন্দ হলোনা। আকাশীনীল একটা হাতে নিতেই ভাঁজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা চিরকুট, আকাশের দেওয়া, বসন্ত-উৎসবে, "প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!"
বুকটা দুমড়ে গেল ইমনের, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেল আদির মুখ, ভেসে উঠলো কয়েকটা ছবি, আকাশের....
আর কোনো তাড়া নেই। একেক করে শাড়িগুলো ভাঁজ করে তুলে রাখছে ইমন।
সংসার করার আগেও কি তীব্র আকর্ষণ ছিল ইমন আর আকাশের মধ্যে।
দ্যাখা হওয়ার আগের সেই অধৈর্য্য, কথা বলার আকুতি, সব শেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের সম্পর্কটা স্বীকৃতি পাওয়ার পর।
ভালোবাসার জিনিসগুলো দূরে থাকাই ভালো, ঠিক লেন্সের ওপারে থাকা জিনিসের মতো, খুব কাছে এসে গেলে সৌন্দর্য হারিয়ে বীভৎস রূপ নেয়, রহস্য ঘুচে সবকিছুই আটপৌড়ে হয়ে যায়।
আদি নাহয় তার কল্পনাতেই থাক, ইমন নিজের ইচ্ছে মতো রংতুলি টানবে ক্যানভাসে। রক্তমাংসের মানুষকে তো আর নিজের ইচ্ছেমতো গড়ে নেওয়া যায়না, গেলেও সেই গড়ে নেওয়ার পরিশ্রমে বেহিসেবি রক্ত ঝরে, যাকে গড়া হচ্ছে তার এবং যে গড়ছে তারও। কেউ দেখতে পায়না, বুঝতেও পারেনা। বোঝে কেবল সেই সৃষ্টি এবং সৃষ্টিকর্তা।
আদিও আকাশ হয়ে উঠুক এটা ইমন সহ্য করতে পারবেনা। তার চেয়ে এই ভালো।
আদি ইমনের স্বপ্নেই থাক। সময়ের সঙ্গে কোনোদিন বদলাবেনা আদি-ইমনের ভালোবাসা, তাদের বন্ধুত্ব, তাদের কল্পনার খেলাঘর।