Apurba Kr Chakrabarty

Abstract Tragedy

5  

Apurba Kr Chakrabarty

Abstract Tragedy

উপেক্ষা (৩য় পর্ব)

উপেক্ষা (৩য় পর্ব)

12 mins
1.1K



শিবানন্দ আশ্রম অনেকটাই জায়গা জুড়ে তার এলাকা।নিজস্ব জমি ক্ষেত, পুকুর, গো পালন করা হয়। ধর্ম চর্চা ও আধ্যাত্মিকতার সাথে ছিল কিছু সন্ন্যাসীদের আবাস, আর কিছু অনাথ শিশু বালক বালিকাদের পালন পোষন হত। প্রায় চল্লিশ একর এলাকায় জুড়ে এই আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন এক সংসার বিরাগী গৃহী। স্ত্রী বিয়োগ, কন্যা অনাচার, বাবা মায়ের ভাবা বেগে আঘাত করে বিধর্মীর সাথে পালায়,আর পুত্রের, আমেরিকা চাকরী ও ওখানে স্থায়ী নাগরিকত্ব নিতে এক শ্বেতাঙ্গী বিবাহ করে। দেশের প্রতি তীব্র অনীহা। 

শিবানন্দ নাম নিয়ে তার সারা জীবনের চাকরীর সঞ্চিত ধন,ও সরকারী নিয়মে অবসরকালীন টাকা ,শহরের নিজ বাড়ী ও তার পৈতৃক সম্পত্তি সব কিছু বেচে নির্জন নদীর তীরে বিশাল এলাকা জমি ক্রয় করেন।তখন অনেক কম দাম ছিল। প্রথম প্রথম নিঃসঙ্গ একাকী,আর চাষবাস কাজে গরীব কজন শ্রমিক তাদের সংসার পোষন এই থেকেই চলত। গ্রামের ক্ষেত মজুর শ্রমিক পরিবারে শিশু বালক বালিকাদের তিনি পড়াতেন, নৈতিক শিক্ষা ক্রমে তার জ্ঞান ও দর্শন, এই শ্রমিক দের মাধ্যমে ছড়িয়ে এই গ্রাম ও পাশাপাশি এলাকার অনেক মানুষই তার কাছে আসতেন মানসিক শান্তির আশায়।অবিবাহিত গরীব বেকার আবার সংসারী। অনেকেই এখানে থাকত।

শিবানন্দ আশ্রম কুড়ি বছর হল, চার পাঁচ বছর অনেক পরিপূর্ণতা পায়, কিছু প্রভাবশালী মানুষের আনুকুল্যে, পঁচিশ জন অনাথ শিশুদের নিয়ে তার পথ চলা।সরকারী অনুমোদন সামান্য অনুদান আর অনেক মানুষের আর্থিক সাহায্যে আজ রীতিমত প্রচারে।আশি বছরের শিবানন্দ আজও সরকারী পেনশন পান।দেখলে অনেক কম বয়স লাগে।

আধ্যাত্মিক চর্চার সাথে শরীর চর্চা আর সামাজিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের নানা সব প্রশিক্ষণ চলত। আধুনিক বায়ো ফার্টিলাইজারে সব্জির চাষ ও তার ভক্ত অনুগামীদের কাছে তা বিক্রি করা হয়।একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ ক্ষেত ও বাজার, অনেকেই কাজ করে যাদের বড় অংশ আবাসিক ভক্ত। থাকা খাওয়া আর মোটা বস্ত্র বিনিময়ে শ্রম দিতো। ত্যাগ আদর্শে কোন অংশে সন্ন্যাসীদের চেয়ে কম ছিল না।

ভারতী এই আশ্রমের ভক্তদের , প্রতি মাসে আর্থিক সাহায্য করত।অনেকেই এমন সাহায্য করত।কেউ শিষ্য ,কেউ ভক্ত, কেউ অনুগামী। এই আশ্রমে ভারতী আর সন্ধ্যার আনাগোনা বেড়েছিল, চার বছর আগে থেকেই।বড় নাতি সম্রাট যাদবপুর থেকে বি ই পাস করে তখন ইউ এস এ, কর্মসুত্রে গিয়েছিল। আর মহুয়া কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছে। রাজা এইটে পড়ছিল।

দিন দিন সন্ধ্যা কেমন আধ্যাত্মিক জগতে আর সেবাধর্মে মনটা চলে যাচ্ছিল।কিন্তু রাজার জন্য তার বাড়িতে মোহ, নিজের অন্তরের কথা অন্তরে রাখত। ভাবত রাজা কোন স্থায়ী কাজ পেলে বা বড় ছেলে মেয়ের মত সফল হলে তার এ সংসারে ছুটি। স্বামীর সাথে তার যা সম্পর্ক সেটা তার কাছে কেমন নিজেকে অবাঞ্ছিত অপাঙ্ ক্তেয় অযাচিত লাগত। উনি আজও প্রথম স্ত্রী প্রেমেই মগ্ন ,সে মূর্খ কালো, তার বিগত জীবন ছিল অগৌরবের, অন্য গৃহে পরিচালিকা বা দাসীবৃত্তি করছে তাই শিক্ষিত শিক্ষক স্বামীর অহংকারী মন তাকে, তার যোগ্য মনে করে না । হয়ত বিশ্বাসী অনুগত পরিচালিকা ভাবে,এই সব চিন্তা করে সন্ধ্যার চোখে আর জল আসত না।নিজেকে, তার মত জীবনে অবহেলা আর বঞ্চনায় দীর্ন মানুষের জন্য কিছু করতে তাকে প্রেরণা দিত। শিবানন্দ স্বয়ং সন্ধ্যাকে ভীষণ স্নেহ করতেন ।তার নিস্বার্থ ত্যাগ, জনম দুখী জীবন, মেধা ,ভারতী শিবানন্দকে বলেছিল। ভারতী শেষ বয়সে সন্ধ্যাকে নিজের মেয়ে মত ভালোবাসত। তার ভীষণ আফসোস হত। নির্মলের আচরনের জন্য ক্ষমা চাইলে।

সন্ধ্যা ভীষণ রেগে বলত,"আমার কোন দুঃখ নেই। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামী সন্তান পায়,আমি সন্তান পেয়েছি ,মা পেয়েছি। স্বামীর চেয়েও মায়ের স্থান অনেক উপরে। আপনি আমার আর্দশ ।আপনিও অনেক কম বয়সে স্বামী হারা।আমার তবু তো স্বামী জীবিত।কত শিক্ষিত জ্ঞানী শিক্ষক মানুষ।"

ভারতী বলে "ওটা অজ্ঞান মূর্খ, ওকে তোমার জন্য একদিন কাঁদতে হবে,সেদিন তুমি ওকে উপেক্ষা করবে এটাই তোমার কাছে আমার একমাত্র দাবী।"

 সন্ধ্যা যদি বলত "কিন্তু মা উনি তো আপনারই সন্তান !"

 ক্ষোভে ধিক্কারে বলত " গর্ভে ধারণ করলেই সন্তান হয় না।যে সন্তান বাবা মাকে শ্রদ্ধা করে না, চরম অজ্ঞ হয়েও নিজেকে সবজান্তা ভাবে, নিজের সুখ আনন্দ ছাড়া কিছুই বোঝে না।সে স্বার্থপর অধম সন্তান। তুমি আমার সন্তান, রাজা তোমার সন্তান। শিবানন্দ জী তাই বলেন, আশ্রমের সবাই তার সন্তান ।উনার জন্মসুত্রের সন্তানদের নাম মুখেই আনেন না।"

হীনমনত্যায় দুখী মনে সন্ধ্যা নিজেকে স্বামীর কাছ থেকে দুরে দুরে রাখত। ফুলশস্যা আর তার পর দিনের অভিজ্ঞতা তার সুখের ছিল না। নিজেকে তাই তার সৎ ছেলে মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে ভুলে থাকত।স্বামীর যত্ন সেবা করত,কিন্ত মনে কোন আবেগ সম্পর্ক ছিল না।অনেকটা দাসী চাকর বা মেস হোস্টেলের চাকর কাজের মাসীর মত।শাশুড়ির মৃত্যু ও দুইছেলে মেয়ের পড়াশোনার কারনে বাড়িতে অনুপস্থিততে, তার কাছে রাজা ভিন্ন এ বাড়ীতে থাকা বড় যন্ত্রণার বেশ অনুভব করছিল। 

সে মানুষটা তাকে পছন্দ করে না, চায় না জীবিত স্ত্রীর চেয়েও মৃত সুন্দরী শিক্ষিতা উচ্চ ফ্যামিলির মৃত স্ত্রীর প্রতি প্রেমে মগ্ন। তা তাকে শুধু মাত্র বিচলিত করত না। তার নারীত্বে আঘাত করত, হতাশ হত। শুধু শাশুড়ির ভালোবাসা আর ছেলে মেয়েদের বিশেষত ছোট কচি সতীন পো রাজাকে ভীষণ ভালোবাসে,সেই টানে তার এই বাড়ির প্রতি আকর্ষণ।রাজার এবাড়ী থেকে পড়াশোনার পাঠ শেষ হলে ,ঐ শিবানন্দ আশ্রমে চলে যাবে ভিতর ভিতর ঠিক করেছিল।

সে এত কম বয়স থেকে, এভাবে নিঃসঙ্গ গৃহ বন্দী থাকবে না। রাজাকে বড় করে, পড়াশোনার করিয়ে মেধাবী সন্ধ্যার আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। আরও অনাথ শিশুদের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করতে মনে মনে সংকল্প করে। আশ্রমের প্রধান শিবানন্দ জীকে তার অভিপ্রায় জানালে তিনি সম্মত হোন। স্নেহের হাত সন্ধ্যার মাথায় রেখে বলেন " তুমি তো মা এ আশ্রমের সেরা সম্পদ। "

রাজা তখন এইচ এস দিয়েছিল,ঐ বছর ডিফেন্স একাডেমীর পরীক্ষাও দেয়।মেধাবী রাজা চান্স পেয়েছিল ।মহারাষ্ট্রে পুনায় যেদিন রওনা হল।তার পরদিনই নির্মলকে সন্ধ্যা বলল,


"আমার দ্বায়িত্ব শেষ, আপনার মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, আপনার ছেলে মেয়েদের আমার সাধ্য মত সেবাযত্ন করে বড় করে তুলব। আমি আজ মুক্ত,এবার আমি আশ্রমে যাব ওখানে আমি ,আমার মত করে , কিছু অনাথ ছেলে মেয়েদের সেবা করব।"

নির্মল হতবাক, কি বলবে ! অনেক ক্ষণ ভেবে বলে "তোমার এই পরিকল্পনা রাজা জানে!"রাজা যে তার অন্তরের দুর্বল স্থান নির্মল জানত।

সন্ধ্যা বলে,"না ওকে বলিনি, একবছর পর যখন ও আসবে আমাকে জানাবেন আমি চলে আসব।ওর মনে কোন দুঃখ দেবো না, ওকে এসব বলার কোন দরকার নেই, বাইরে একা থাকবে, দুঃখ কষ্ট ওর কেরিয়ারে ক্ষতি হতে পারে।"

"হুম বুঝলাম। আশ্রমে থাকতে কত লাগবে! প্রতি মাসে, আমি সেটা পাঠাব।"

"কোন টাকা লাগবে না,একা মানুষ, আমার সেবার বিনিময়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।"

"পরিবেশ কেমন, নিরাপত্তা এসব খোঁজ নিয়েছ!"

"আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন , আমি সব খবর নিয়েছি, আরও অনেক মেয়ে ভক্ত আছে।অনাথ বালিকা থাকে।স্বয়ং বাবা শিবানন্দ মহারাজের সাথে আমি কথা বলেছি।আপনার মায়ের সাথে আমার দীর্ঘ দিন ওখানে যাতায়াত, মা আমাকে নিয়ে যেতেন, খুব ভালো পরিবেশ। "

"তোমার কিছু হাতে টাকা রাখা দরকার। "

"আমার কিছুই লাগবে না।আপনার যে ঘরে আমি থাকতাম। চাবিটা রাখুন, ঐ ঘরের আলমারিতে আপনার স্ত্রীর আর মায়ের গহনা আমাকে মা রাখতে বলে ছিলেন, এবার আপনার দ্বায়িত্ব।"

"না না আমি ও সব নিয়ে কী করব! "

"আপনার মেয়ে, দুই ছেলের এখনও বিয়ে বাকী, মেয়েটাকে আর বৌমাদের দেবেন।"

"তুমি কী কিছুই আমার নেবে না?"

"এতদিন তো আপনার অন্নে খেলাম, আপনার ঋণ শোধ করি কী করে। যদি দরকার পড়ে নিশ্চয় বলব।"

"কিন্তু আইনগত তুমি আমার স্ত্রী,আর চার মাস পরে আমার অবসর, তোমার নাম সব তথ্য পাঠানো আছে আমার কিছু হলে, তুমি আমার পেনশন বা সব কিছুর একমাত্র দাবীদার। তোমার এটা আইনগত অধিকার।"

"অনেক অধিকার থাকলেও পাওয়া যায় না।থাক না আইনের কথা।আর আপনার আয়ু যেন অনেক দীর্ঘ হয়,আপনার পেনশন পাবার ভাগ্য যেন আমার না হয়।"

"তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট ।"

"সেটা ঈশ্বরের হাত, দিদি কবে সতী লক্ষ্মী স্বর্গ গেছেন আমাকে আশীর্বাদ করুন,কাজের মধ্যেই যেন উনার পথ অনুসরণ করতে পারি।" সন্ধ্যা এবার নির্মলকে প্রনাম করে বিদায় নিল।

নির্মলের চোখ দুঃখে হতাশায় জলে ভরে গেছিল। মা তাকে মাঝে মাঝেই বলত" নির্মল তুই হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছিস, একদিন তোকে সন্ধ্যার জন্য কাঁদতে হবে।" মায়ের কথা কতটা নির্মম সত্যি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। ভারতী কত বলত "মেয়েটা তোকে লজ্জা সমীহ করে, নিজেকে গুটিয়ে রাখে। অসহায় আত্মীয় স্বজনহারা,মেয়েটা মানসিক ভাবে ভীষণ দুর্বল সবার সাথে মিলেমিশে হার স্বীকার করে থাকতে চায়।কোন চাহিদা নেই, মান সম্মান নেই। মনটা ওর ভীষণ ভালো,একটু শুধু ভালোবাসা চায়।"

নির্মলের আত্মসম্মানে লাগত, বলত "তুমি তো ওকে ভালোবাসো,ঠিক আছে আমি ওর খেয়াল রাখব। ওর কোন দিন সমস্যা হবে। ছিল তো পরিচালিকা! ও এখন অনেক সম্পত্তির মালিক, আর আমার অবর্তমানে আমার পেনশন পাবে। এত তেল দেবার কী আছে!" অহংকারী নির্মল সন্ধ্যাকে স্ত্রীর যোগ্য মনে করত না।

আজ ছিল বৌদ্ধ পুর্নিমা স্কুলের ছুটি।সকালে এমন অঘটন ঘটবে ভাবতে পারছিল না।দোতলার বারেন্দায় বেড়িয়ে এসেছিল মনে হচ্ছিল সন্ধ্যাকে ডেকে বাড়িতে থাকতে অনুরোধ করি। কিন্তু সে তো ফুল শয্যার রাতে তাকে বা তার মনের কথা ভাবে নি! সন্ধ্যা আজ তার কথা ভাববে কেন! মা ছিল তখন বড় ভরসা।জগতের রুঢ় বাস্তব রূপ সে জানত না।

আশ্রমের গাড়ি এসেছিল, সন্ধ্যা আর তাকায় নি।সন্ধ্যার শুন্য হাতে চলে গেল , এই বাড়ির মোহ ছেড়ে, টাকা গহনা কিছুই তাকে আটকাতে পারে নি ।

হতাশ দিশেহারা নির্মল ভাবছিল যদি রাজা চাষা, হয়ে গ্রামে থাকত, সন্ধ্যাকে এ বাড়ী ধরে রাখতে পারত।

ভারাক্রান্ত নির্মল ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিল। একটু পর একজন মহিলা এল। বলল, "কাকাবাবু, কাকীমা আপনার দেখভাল আর রান্নার জন্য আমাকে আজ থেকে কাজ করতে বলেছেন।"

"তুমি সব কিছু বাড়ি ঘরের জানো! "

"আমাকে কাকীমা সব বলেছেন ,রান্নার ঘরের চাবি আমাকে দিয়েছেন। রান্নার সব মাল এখন আছে, কাল দেখে গেছি, যখন দরকার হবে আমি বলব। আর সব্জি মাছ এসব বাজারের জন্যে, আপনার বাড়ির রাখাল তনুকে বলবেন, ঐ তো সব করে, কাকীমা সব ব্যবস্থা করে গেছেন। শুধু টাকা যা লাগবে আপনি দেবেন। "

"তোমার কত লাগবে!"

"আমি দুবেলা রান্না করে দেবো, খাবার পরিবেশন করে এঁটো বাসন ধুঁয়ে দিয়ে যাব।মাসে ছ হাজার টাকা কাকীমাকে বলেছিলাম, উনি আপনার সাথে দরদাম ঠিক করতে বলেছেন।"

"ও যা বলেছে, তাই হবে ,আমি আর কি বলব!"

আজ নির্মল বুঝল,সন্ধ্যার মুল্য,বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ রান্না ,আর ছেলে মেয়েদের দেখভাল, ছোট ছেলে রাজাকে মানুষ করা,পড়াশোনা করানো,এর মুল্য তার সামান্য তো খাওয়ার পড়ার বিনিময়ে! সে তো আঠারো বছরে নূন্যতম বিশ পঁচিশ লাখ টাকার পাওয়ার অধিকারী! কিন্তু একটা কানাকড়ি সে চায় নি!

নিজের শিক্ষা দীক্ষা অহংকার যে কত ঠুনকো আজ ভাবছিল। কতটা সে সন্ধ্যাকে অবমুল্যায়ন করেছে আজ বুঝতে পারে। কালো অশিক্ষিতা বাপ মা হারা পরের বাড়িতে পরিচালিকা মেয়েটার এত মুল্য সেদিন বোঝে নেই। আজ তার এ জন্য চরম মুল্য দিতে হচ্ছে।

মাঝে মাঝেই নির্মল তার রান্নার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে সন্ধ্যার খবর নিতো,আশ্রমের হালচাল জানত, খুবই গোপনে, সন্ধ্যাকে এসব বলতে মানা করত।এজন্য বাড়তি টাকা দিতো। শুনত সন্ধ্যা ওখানে মাতিয়ে রেখেছে। বাচ্চা অনাথ কুড়ি পঁচিশটা ছেলে মেয়ে,নতুন মা অন্ত জীবন। তাদের পড়াশোনা শেখায়, আবার তাদের খাবার ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা রান্নার ঘরে ঢুকে ব্যবস্থাপনা দেখে। বেশ ভালো আছে।

তথাকথিত শিক্ষা আর শিক্ষিতদের দাম নেই, নিজের চেষ্টায় সন্ধ্যা দশম শ্রেণীর সব বিষয় পড়াতে পারে রাজাকে পড়াতে পড়াতে,টেন অবধি পড়ায়, তখন মহুয়া কলকাতা থেকে বাড়ি এলেই তার কাছে অনেক কিছুই সন্ধ্যা বাধ্য ছাত্রীর মত জেনে বুঝে নিত। মহুয়াও এবিষয়ে তাকে ভীষণ সহযোগিতা করত। নাইন অবধি পড়াশোনা কিন্তু সন্ধ্যার ভালো মেধাছিল, আর পরিনত বুদ্ধি তাকে শিক্ষিত করেছিল। না থাক ডিগ্রি।কার যেন কথা "প্রতিটি শিক্ষিত মানুষই হয় স্বশিক্ষিত" নির্মল ভাবে।

একবছর পর রাজা বাড়ি এসেছিল, বাবা তখন অবসর নিয়েছিল, মা যে বাড়ি ছেড়ে আশ্রমে সে এক গ্রামের বন্ধুর কাছে পত্র মারফত জেনেছিল তাও তিনমাস হল। মা বাবা তাকে নিয়মিত পত্র লিখত, কিন্তু মা বাড়ি ছেড়ে আশ্রম কেউ বলেনি। রাজাও তাই কিছু বলেনি।


তার আসার কথা দিনক্ষণ বলেনি ,কারণ মা কেবল পত্রে লিখত ,বাবা রাজা তুই কবে আসবি অবশ্যই জানাবি ,আমি তোর জন্য বাড়িতে তোর সব প্রিয় খাবার, ছোলা পাটালি, নারকেল নাড়ু, সিড়ি নাড়ু, চাল ভাজা, মুড়কী করে রাখব।

চালাক রাজা বুঝতে পারত মা তার আগমন দিন জেনে আশ্রমে কদিন থাকবে না।আশ্রমের কথা এক বার উল্লেখ করে না,অথচ মা আশ্রমে থাকে।সে এর কি রহস্য, জানতে সেদিন সরাসরি আশ্রমে হাজির,বাড়িতে প্রথম আসেনি।সন্ধ্যা তখন অনাথ শিশুদের খাবার পরিবেশনে ব্যাস্ত। এতটা নজর করেনি।আশ্রমের এক ভক্ত নজরে আসে । সে রাজাকে ডাকে।

মায়ের কাছে রাজা যেতেই সন্ধ্যা কেমন হতচকিত, বিস্ময়ে বলে "রাজা! ব্যাটা আজ আসবি চিঠিতে লিখিসনি তো!" কেমন চোখ মুখে অপরাধী ভাব।

রাজা হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে চুম খেয়ে বলে, "আমি তো মায়ের ছেলে! সারপ্রাইজ দিলাম, দাও দাও আমার ক্ষিদে পেয়েছে,"বলে অনাথ শিশুদের পাশে বসে পড়ল।

নিরূপায় সন্ধ্যা তাকে বলে "ঘরে চল বাবা এখানে খাবি!"

"এখানেই খাবো ,শাল পাতাতেই খাবো,যা তোমার এখানকার ছেলে মেয়েরা খাচ্ছে তাই খাবো।"

সন্ধ্যার চোখ জলে ভরে গেছিল। ছেলের জেদের কাছে সে চিরকাল আত্মসমর্পণ করেছে। আজও করল।খাওয়া দাওয়া করে রাজা বলে ,

"মা তুমি এখানেই থাকো,আমি বিকালে আবার আসব।বাবার সাথে দেখা করে আসি।রবি আমাকে পত্র মারফত লিখেছিল তুমি আশ্রমের অনাথ শিশুদের মা হয়ে আছো, আমার বুকটা সেদিন গর্বে ভরে ওঠে।আমার মা একজন কেন!অনেক মা হারা শিশুদের মা হবার ক্ষমতা রাখে।" বলতে বলতে মা অভিমানী রাজা কেঁদে ফেলেছিল।সেদিন এক মাস একান্ত ভাবে মাকে চেয়েছিল, তার ট্রেনিং এর কথা মাকে বলবে ,আমায়ে ভালোবাসা আদর যত্ন আর মায়ের হাতে প্রিয় খাবার।কিন্তু মুখে তা  বলতে পারছিল ।রাজার দুঃখী হতাশ মুখের অভিব্যক্ত হয়ত সন্ধ্যা কিছুটা বুঝেছিল 

সন্ধ্যা নীরবে রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন অসহায় দিশেহারা চোখে জল, কী  করবে,ভাবতে পারছিল না। 

সেদিন অনাথ আশ্রমের গাড়িতে রাজাকে তার বাড়ি দিয়ে গেল।

বাবা আশ্রমের গাড়িতে রাজাকে হঠাৎই আসতে দেখে বেশ অবাক। বলে "তুমি বাবা হঠাৎ আশ্রমের গাড়িতে! আমার তো মাথায় কিছু আসছে না!"

রাজা বাবাকে প্রনাম করে বলল, "সারপ্রাইজ দিলাম , প্রথম মা কে এবার তোমাকে!"

"কীসের সারপ্রাইজ !"

"মা যে আশ্রমে, আমি যাবার পরদিন চলে গেছে কেউ তোমরা জানাও নি।দিদিও পত্র লিখেছে সেখানেও উল্লেখ নেই।রবি আমাকে জানিয়েছে।আমিও তাই আগে আশ্রম যাই,মা তো আমায় দেখে ভুত দেখার মত চমকে গেছে।"

নির্মল বলে "এটা তোমার মায়ের ইচ্ছা,তুমি বাড়ি ছেড়ে যাবার পরদিন তোমার মা আশ্রমে চলে গেল,শুন্য হাতে কিচ্ছু নেয়নি।আমাকে অনুরোধ করল,তোমাকে ওর আশ্রমে থাকার কথা না বলতে।তাতে তোমার কষ্ট হবে পড়াশোনার ক্ষতি হবে।আমারও তাই মনে হল ,আর তোমরা মায়ের ইচ্ছা ছিল যেদিন তুমি আসবে তার আগে এ বাড়ীতে তোমার মা আসবে।তোমাকে বুঝতেই দেবে না,ও বাড়ি ছেড়ে আশ্রমে।"

"কেন বাবা!"

"তোমার মায়ের ধারনা , তোমার তাতে দুঃখ হবে, তোমার মা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।"

"তাই বলে আমার জন্য কদিন অতগুলো অনাথ ছেলে মেয়ে মায়ের যত্ন থেকে বঞ্চিত হবে!"

"তোমার জন্যে , তোমার মা সব করতে পারে।"

"সে তো জানি, আমি যত বদমাইসী করি ! ছোটবেলায় মা আমাকে জীবনে গায়ে হাত তুলত না, বকা ঝকায় না কাজ হলে মা কাঁদত। আর আমিও সব দুষ্টমী বন্ধ করতাম ।"

"তুমি কী খাবে বাবা! আমার তো এই মাত্র খাওয়া হয়ে গেল!"

"আমি আশ্রমে মায়ের অন্য ছেলে মেয়েদের সাথে খেয়ে এলাম তোমায় চিন্তা করতে হবে না।আমি মাকে আশ্রমের থাকতে বলেছি, বিকালে আবার যাব।আমি যতদিন থাকব ,মা আশ্রমে থাক আমি যাব,আমার জন্যে অতগুলো ছেলে মেয়েদের ছেড়ে এসে মায়ের মন খারাপ হবে।আমার জন্য তার কোন দরকার নেই। "

নির্মল কেমন মনমরা,অবসরের পর কেমন আরও বেশী বয়স্ক লাগছে। রাজা বলে "তোমার শরীর স্বাস্থ্য কেমন খারাপ হয়ে গেছে। "

"যাক বাবা, আমার অনেক বয়স হল, তোমার জন্মদাত্রী কবে চলে গেছে,আর এই মা সংসার বিরাগী, আমার আর ভালো লাগে না।একা একা এতবড় বাড়ি রাতে মনে হয় যেন প্রেতপুরী। তুমি কদিন থাকো বুঝবে কী ভাবে দিন গত হচ্ছে।"

রাজা নীরব থাকে, মাকে অবহেলা আর অগ্রাহ্য রাজা ঠাকমার মুখে শুনেছিল। মা কখনও বলত না। মৃত্যু শয্যায় ঠাকমার অনেক কিছুই সেদিন বলতে গেছিল মা এসে গেছিল, সব থামিয়ে দিয়ে ছিল।

নির্মল খানিক অনুতপ্ত আর গ্লানি মনে বলে, "অবসরের পর , তোমার মা তো কিছুই নেবে না।তোমার ঠাকমার দেওয়া গহনা অবধি নিল না।আমি অনাথ আশ্রমের গুরুদেব কে ডেকে গোপনে, আমার প্রাপ্য অদ্ধেক কুড়ি লাখ টাকা তোমার মায়ের নামে আশ্রমে দান করেছি।

তোমরা সবাই বাবা সক্ষম, এতে তোমার মায়ের ঐ আশ্রমে সম্মান ইজ্জত বাড়বে ,তবে আমি দিয়েছি বললে হয়ত আপত্তি করবে, তুমি যেন মাকে বলবে না।

তবে তোমাদের সম্পদ তোমাকে বলার দরকার মনে হল। বাকি বিশ লাখ, তোমাদের তিন ভাই বোনদের নামে পাঁচ লাখ করে ব্যাঙ্কে এফ ডি করে দিয়েছি, আর আমি পাঁচ লাখ রেখেছি।যদি কোন দরকার হয়।"

"আশ্রমে দিয়ে ঠিক করেছ, মা না জানুক মায়ের সম্মান বাড়বে,আমাদের কোন সম্পদ দরকার নেই, দরকারে আরও দেবে,আমাদের এফ ডি দরকার নেই। আমি স্টাইপেন্ড পেলেও নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছ, আর কী দরকার!"

"ঐ টাকায় আশ্রমে দুটো বড় হলঘর অনাথ ছেলে মেয়েদের জন্য করেছে ,আরও কিছু অনাথ শিশুদের পালন করার পরিকল্পনা,শিবানন্দ জীর আছে। ঐ হলঘর দুটো তোমার মায়ের নাম লিখতে যায়, টাকা পয়সা কথা বলেনি ,শুধু তার সংসার ছেড়ে অনাথ ছেলের মেয়েদের সেবার সম্মান স্বীকৃতির জন্য, তবু তোমার মায়ের তীব্র আপত্তিতে , সে নাম লেখা হয়নি।"

" মা তো কোনদিনই কাজের স্বীকৃতি চায় না।নিজে তুচ্ছ ছোট, আর সবাই বড়, অসহ্য !"

হঠাৎই সন্ধ্যা আশ্রমের গাড়িতে এসেছিল।রাজা ছুটে মায়ের কাছে গেল। 

নির্মল নীরবে দেখছিল, সন্ধ্যা রাজাকে বেশ বকাঝকা করছে,

"আমাকে বলবি না কবে আসবি?কত সখ করে তোর জন্যে কত কী খাবার তৈরী করতাম! আর আমি কেউ নই তাই তো!" দুঃখে অভিমানী মুখ, চোখে জল, গলা যেন কান্নায় আটকে গেল। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছিল। 

রাজার তা নজরে আসে অপরাধী মনে কাঁচুমাচু মুখে সে বলল,

"ঠিক আছে মা, আমি তো একমাস তোমার কাছেই থাকব!" তারপর মাকে সে  জড়িয়ে ধরে আদর কোরে, মায়ের রাগ দুঃখ অভিমান সামলানোর চেষ্টা করে।

"বেশ এই একমাস তুই কোথাও যাবি না,অনেক দিন তোকে যত্ন করে খাওয়াতে পারি নি।"

"কিন্তু তোমার আশ্রমের ছেলে মেয়েরা!"

"গুরুদেব আমাকে জোর করে পাঠালেন, বললেন মা তুমি তো ছেলে অন্ত প্রান, তুমি তোমার ছেলে, দুজনেরই মনে কষ্ট হবে।একমাস আশ্রমের গাড়ীতে সন্ধ্যের বেলা তোমায় মা  বাড়ি দিয়ে যাবে। আর সকালে যেদিন তোমার মনে হবে ,তুমি তোমার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রমে আসবে,ওর ভালো লাগবে, এখানে অনেক কিছু দেখার শেখার আছে ।আর তোমার ছেলে তোমার মতই, না হলে এমন বড় ঘরের ছেলে,এত বড় পদের কাজ করবে, অনাথ ছেলে মেয়েদের সাথে খায়! খুব তৃপ্তি মনে খেলো।"

 পরম তৃপ্তি আর মনে খুশীতে একমুখ হেসে সন্ধ্যা বলে "ব্যাটা তুই আসবি কতদিন ধরে স্বপ্ন দেখছি ,রাতটা তোকে মনের মত রেঁধে খাওয়াব, রাতে আমার তেমন কাজ নেই। একটু পড়াশোনায় ওদের দেখাই সে এখন বিকালেই দেখাব।"

রাজা কেমন চুপচাপ,  এতদিন পর মাকে একক ভাবে না পেয়ে ব্যথিত কেমন  মনমরা ,তবে মুখে কিছু বলছিল না।

সন্ধ্যার নজর এড়ায় না। তাই সন্ধ্যার মুখ  উদ্বিগ্ন, অস্থির কিছু ভাবছিল।তারপর একটু  হেসে সে রাজাকে শিশুকালের মত আদর স্নেহে জড়িয়ে ধরে বলে,

" আমার ব্যাটা, আমার কচি সোনা, তোর জন্য না হয় একমাস আশ্রমেই যাব না বাড়িতেই থাকব,মা বেটা কত গল্প করব।" তারপর তৃপ্ত মুখে মিষ্টি হেসে রাজাকে আরও কাছে টেনে চুম খেলো।

রাজার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল চোখে আনন্দ অশ্রু, মাকে জড়িয়ে ধরে তুলে ধরে বলল,"মা! তোমার তুলনা শুধু তুমি, আমার গর্ব,আমার অহংকার। আমার সব মনের কথা তুমি জানতে পারো।" তারপর আনন্দে মাকে জাপটে ধরে তুলে ধরল। সন্ধ্যার হতচকিত, চোখে আনন্দ অশ্রু।


নির্মলের দুঃখে হতাশায় মনটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল,এ বাড়ি তার সঙ্গ ছেড়ে সে মহা আনন্দে আশ্রমে থাকে ! আর রাজার জন্য আশ্রম ছেড়ে এ কদিন বাড়িতে থাকবে সে মনের আনন্দে। দোষ ওর নয়, আমার। আমার সেদিনের ভালোবাসা আদর যত্ন পেলে, ও কখনও এ বাড়ী ছেড়ে আশ্রমবাসী হতো না।আমার কাছে কোন কিছুই ও দাবী করে না। আমার কথাও ভাবে না। আমার উপেক্ষার জবাব ও কড়ায় গন্ডায় হাসি মুখে দিচ্ছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract