STORYMIRROR

Sangita Duary

Classics

4  

Sangita Duary

Classics

শাওন রাতে যদি

শাওন রাতে যদি

3 mins
348


শাওন রাতে যদি স্মরনে আসে মোরে

বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।।

ভূলিও স্মৃতি মম নিশিথ স্বপন সম

আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে ।।

ঝড়িবে পূবালী বায় গহন দূর বনে

রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।

বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নিপ শাখে

যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে

বিজলী দ্বীপ শিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া

দু’হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে।।

অন্ধকার ঘরে বসে গানখানা শুনে চলেছে সুদেষ্ণা। এটা প্রদীপের ভীষণ প্রিয় গান ছিল।

প্রায়ই দরাজ গলায় গেয়ে উঠতো। বিশেষ করে এই বর্ষাকাল এলে, বাইরে যখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরতো, বিশেষত সন্ধ্যেবেলা, বিশেষ করে যখন ছুটি পেতো, যখন বাড়ি ফিরতো, উদাত্ত কণ্ঠে একের পর এক গান শুনিয়ে চলতো সুদেষ্ণা কে।

এই গানের গলা শুনেই তো মুগ্ধ হয়েছিল সুদেষ্ণা।

নাহলে বাড়িতে যখন শুনলো সবাই পাত্র আর্মিতে, ভারত চায়না বর্ডারে পোস্টেড, কেউ রাজি হয়নি। সুদেষ্ণার বাবা চিরকেলে গোবেচারা মানুষ, মায়ের একটু চড়া স্বর কেই ভয় পান, তিনি কিনা তাঁর একমাত্র মেয়ের বর হিসেবে একজন আর্মিকে মেনে নেবেন? আরে, সারাটা মাস তো টেনশন করেই কেটে যাবে।

তবু বিয়েটা হলো। হলো সুদেষ্ণার জন্যই।

অন্য একটা ঘরে বসে প্রদীপ বলেছিল, "যে কটা দিন বাড়ি থাকবো, রোজ কিন্তু এই জ্যান্ত রেডিও কে সহ্য করতে হবে। আমার বউ আমার গুণমুগ্ধ শ্রোতা হবে, সে আমি যেমনই গাই, গান শেষে লম্বা একটা হাততালি আর শক্ত একটা আলিঙ্গন, কি পারবেন তো? এর বেশি আর কিছু দাবি দাওয়া নেই।"

সেদিনই সুদেষ্ণা কে এই গানটা শুনিয়েছিলেন প্রদীপ, মুগ্ধ সুদেষ্ণা বলেছিল, "গান শুনতে খুব ভালোবাসি। ভগবান আমার গলায় সুর দেননি ঠিকই, কিন্তু আপনাকে পাঠিয়েছেন পেনাল্টি হিসেবে। আপনার দাবি পূরণ করতে প্রস্তুত আমি!"

ব্যাস! বাবা বাধা দিলে সুদেষ্ণা বুঝিয়েছিলো, "দেশের জন্য যে মানুষ জীবন উৎসর্গ করে সেই মানুষটার স্ত্রীর মত বড় সম্মান আমি এজন্মে আর পাবো না বাবা!"

তারপর তো স্বপ্নের মত কেটে গেল কয়েকটা মাস। হাসি গান মজা প্রেম... কষ্ট হত যখন ডাক আসতো। প্রদীপ যাওয়ার আগে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতো,

"ভয় কি, দেখবে কদিন পরেই ঠিক ফিরে আসবো!"

সুদেষ্ণা আদুরে গলায় বলতো, "রোজ তিনবার করে ফোন করবে আর শেষ বারের ফোনে যেন একটা গান শুনতে পাই, মনে থাকবে? নাহলে কিন্তু আড়ি!"

প্রদীপ সুদেষ্ণা র নাক মূলে দেয়, "পাগলী বউ আমার! বেশ তাই হবে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমায় গান শোনাবো।"

সেদিন সকাল থেকে একটাও ফোন করেনি প্রদীপ।

ঘরের কাজে বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছিল সুদেষ্ণার। ডান চোখের পাতা নাচ্ছে বারবার। ওদিকে বাইরেও ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। কি করছে এখন প্রদীপ, ভালো আছে তো?

কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোনের দিকে চোখ চলে যায় বারবার। একটাও মিসডকল এলো না, একটাও মেসেজ এলো না, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল।

ঠিক সন্ধ্যে পেরোতে ফোনটা এলো। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরে সুদেষ্ণা।

অপ্রান্তের সেই গমগমে গলা... শাওন রাতে যদি...

কেঁদে ফেলে সুদেষ্ণা। প্রদীপকে থামিয়ে বলে, "সারাদিনে একটাও ফোন নেই, চিন্তা হয়না আমার?"

প্রদীপ হো হো হেসে ওঠে, "আর্মির বউদের অতো চিন্তা করা সাজে না সোনা। এখানে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। নেটওয়ার্ক কভারেজ ঠিকঠাক কাজ করছে না। তাছাড়া এই ওয়েদারেই এট্যাক হয় বেশি, ওরা ওঁৎ পেতে থাকে।"

সুদেষ্ণা কান্না ভেজা গলায় বলে, "তুমি ঠিক আছো তো?"

প্রদীপের গলায় ঠাট্টার সুর, "তো নয় তো কি আমার ভুত তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে? শোনো গানটা গাই, আজকের দিনটা তো শেষ হতেই চললো, তার আজকের মত শেষ গানটা গাই?

...

বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নিপ শাখে

যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে

বিজলী দ্বীপ শিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া

দু’হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে।।

শাওন রা....

শেষ হলো না গানটা। ওদিকে একটা গুলির আওয়াজ। তারপর.... আর কিচ্ছু মনে নেই সুদেষ্ণার।

শহীদ প্রদীপের কফিন বন্দি নিষ্প্রাণ দেহটা এসেছিল বেশ কয়েকদিন পর। সঙ্গে এসেছিল মারচিং অফিসার, এত এত সংবর্ধনা, বীর শহীদদের স্ত্রীর তকমা, সম্মান... সব, শুধু ফিরে এলো না প্রদীপ। সুদেষ্ণার কানে সেদিন বেজেছিলো সেই কথাটা...দেশের জন্য যে মানুষ জীবন উৎসর্গ করে সেই মানুষটির স্ত্রীর মত বড় সম্মান আপনি এজন্মে আর পাবেন না!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics