Maheshwar Maji

Classics

3  

Maheshwar Maji

Classics

রঙ্গমঞ্চ

রঙ্গমঞ্চ

12 mins
1.2K



(এক)

অমল গলা কাঁপিয়ে জোর করে বলে উঠল,...ব...ঐ...ঐ.শাখী।তুমি যেও না বৈশাখী।হৃদয়ের ঘরে যে অনেক কথা জমা হয়েছিল।...কত আশা নিয়ে এসেছিলাম।তোমাকে আমার প্রেমের উপবনে গান শোনাব বলে...সে আর হল না।

দিলীপদা মুখের গুলটা পিচ করে দাঁতের ফাঁকে বের করে ডানহাতের ইশারাই অমলকে থামিয়ে বলে উঠলেন,বৈশাখী,.. তুমি যেও না বৈশাখী।

এই পর্যন্ত গলাটা চড়া থাকবে।তারপর একপাঁক ঘুরে গিয়ে নজরটা ওডিয়েন্সের দিকে করে বাকি কথাটা আস্তে আস্তে শেষ করতে হবে।

    ...আর একবার শুরু কর।প্রথম থেকে।

অরুন তুই দাঁড়া।বৈশাখীর প্রক্সি।

অরুণ বলে উঠল,... বাড়ি থেকে আমাকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না। পাঁকা দেখা হয়ে গেছে।মা,বাবা এক বুক আশা নিয়ে প্রতিনিয়ত আমার সুখের ঘর সাজানোর চেষ্টা করছে।...কী করে আমি তাদের সব স্বপ্নগুলোকে চুরমার করে স্বার্থপরের মত তোমার বুকে মাথা রাখতে আসবো...বলো?...আমি তাদের আশা,ভরশা।আমিই তাদের খুশির একমাত্র ঠিকানা।আমার দেওয়া আঘাতে ওদের বুকে চাপ,চাপ রক্ত উঠবে।...তুমি আমায় ক্ষমা করো অমল।আমি কথা রাখতে পারলাম না।

এইবার অমল শুরু করল,...ব..ঐ..ঐ শাখী...বৈশাখী...বৈশাখী

এতদূর বলা হয়েছে।

ততক্ষণে নারান খুড়ো হাতে লম্বা একখানা তৈলাক্ত বাঁশ নিয়ে দৌঁড়ে আর হরিমন্দিরের মার্বেল পাথরে ঢাঁই করে মারলেন।

আর একটু হলেই অমলের পাদুটো চিরদিনের মত ভেঙে বসে থাকত।

আপাতত মেঝের কম্পনেই অমলের বুকের রক্ত শুকিয়ে কাঠ।

উপস্থিত সকলেই বাকরুদ্ধ!

কিছুই বোঝা গেল না।

এত জোরে তো কালবৈশাখীও হাজির হয় না।আর অমল তো বেচারা শুধু বৈশাখীকেই ডাকছিল।

দিলীপদা গুলে দাঁত ঘষতে,ঘষতে থেমে গিয়েছেন।ধাতস্থ হতে তারও খানিক সময় লাগল।

আর একবার গুলটা দাঁতের ফাঁকে পিচ করে ফেলে নারানখুড়োর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,খুড়ো বলি এটা কী রকম ভদ্রতা!!

...মজা পেয়েছ নাকি?..ইয়ার্কির একটা লিমিট থাকা উচিত!

তোমার কালো মাথা থেকে সাদা হয়ে গেল।এখনো বোধবুদ্ধির উদয় হল না।..লাঠিটা যদি ছেলেটার পা টাই পেয়ে যেত...কী অবস্থা হত একবার ভেবেছ?

নারানখুড়োর চোখ থেকে এখনো যেন আগুন বের হচ্ছে।সেইরকম তাকিয়েই আছেন।ধুতিখানা এখনো সেই লোঙটের মত করেই পরেন।গায়ে একটা ঢিলেঢালা গেঞ্জি।আর গলায় গামছাটা তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আজো অব্দি দীর্ঘ তিরিশ বছর হল সারাক্ষণ ঝুলেই থাকে।বয়সটা

ষাটের কোটায় ঢুকলেও পাটির একটা দাঁত পর্যন্ত খসেনি।

দুর্বলতা একটাই ।গলার স্বরটা যতই চেষ্টা করুক না কেন জোরে বের হয় না। জোয়ান বয়েসে গলায় একবার খৈ-এর সাথে গোটা কতক ধান গিলে ফেলেছিলেন।

সে এক কান্ড গেছে!!

..দুদিন পর হাসপাতালের ডাক্তার চেক করে তবে গলা ফোলা কমিয়ে ছিলেন।

সেই সময় থেকেই গলার এই অবস্থা!

...ইদানিং সেই অসুবিধাটা আগের থেকে বেড়ে গেছে।

...সেইরকম ক্ষীণ কন্ঠে শিস টেনে,টেনে বলতে লাগলেন,...বলি এটা কী বাঁদরামী হচ্ছে শুনি!..এক ঠেঙানিতেই চব্বিশটা দাঁত ঝেড়ে দেব।

দিলীপদা তো খচে বোম।তবু সংযত রেখে বলে উঠলেন,...বাকি দাঁতগুলো কী তুমি তোমার শ্রাদ্ধ ভোজ খাওয়ানোর জন্য ছেড়ে দেবে?...আগে হলটা কী বলবে তো?

নারানখুড়ো দমবার পাত্র নন।আওয়াজটা বেরুলে এতক্ষণে গাঁ শুদ্ধ লোক চেঁচানির শব্দে বেরিয়ে পড়তেন।

রাতের বেলায় খুড়োর তান্ডব নৃত্য দেখতে।

শিস টানতে,টানতে আবার বলে উঠলেন,...আমাকে কী বকাছোদা ভেবিছিস তোরা?...আঁ!!...এই ভর রাতে বৈশাখী নামটা তুলে বার,বার কেন ডাকা শুনি?...নাতনীর আমার দুদিন বাদে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা।নামটা শুনে বার,বার উপর থেকে উঠে আর নামে।...পড়াশুনো সব চুলোয় গেছে।জানলার পর্দা টেনে এখন শুধু রাতের বেলায় বার,বার নিজের নামটা শোনার আশায় বসে থাকে।

...কখন এই বেহায়াটা হরি মন্দিরের চাতালে উঠে বলবে...বৈশাখী!..একদম চলবে না।

ওই নাম নিয়ে রাত,বিরেতে ডাকা একদম চলবে না। যাত্রা করতে হয় কর।তবে আমার নাতনির নাম ধরে একদম ডাকা চলবে না।

এতক্ষণে সবার উৎকন্ঠা অল্প কমলো।ব্যাপারখানাও পরিস্কার হল।

দিলীপদা পরিবেশটা হাল্কা করার জন্য একটু হেসে বলে উঠলেন,.. ও এই ব্যাপার!

পরীক্ষা আছে।তা তো আমরা সবাই জানি।সেইজন্যই তো রাত করে রিহার্সাল শুরু করি।..যাতে কেন্ডিডেটদের অসুবিধা না হয়।...আর সারা গাঁয়ে এইচ এস দেওয়ার মত আছেই বা কজন?...তোমার নাতনি বোশেখী আর অধীরের মেয়ে মন্দা।এই তো দুজন।বাকি জনার্দনের ছেলেটা তো হোস্টেলে পড়ে।

...এই দুজনের জন্য কী আমরা এতবড় যাত্রার রিহার্সাল বন্ধ করে দেব?এটাও তো একটা পরীক্ষা।গাঁয়ের মান,সম্মানের।আজ অব্দি এই সিদাবাড়ি গ্রামের যাত্রাপালার বদনাম করতে কেউ পারেনি।...এদের এখন কাঁচা বয়স।অভিনয়ের বোঝেটা কী শুনি।তাই দুমাস ধরে দাঁড় করিয়ে না শেখালে তো আমাদেরই বদনাম হবে খুড়ো।...তুমি কী সেটা চাও?

নারানখুড়ো একই রকম গজগজ করতে,করতে বলে উঠলেন,... সে সব আমি বুঝি না বাপ।তোরা ওই নামটা তাহলে বাদ দিয়ে দে।তারপর যাত্রা কর।আমার তাতে কোন আপত্তি নেই।

---সেটাই বলো খুড়ো।নামটাই তোমার আপত্তি ...তাই তো?...আরে বাবা..ভৈরববাবু কী জানতেন...যে তুমি একদিন তোমার নাতনির নাম তার যাত্রাপালার নায়িকাকে রেখে দেবে?

...বোশেখীর তখন জন্ম হয়নি।ভৈরববাবু তার আগেই পালাটা লিখে ফেলেছেন।এবার তুমিই বলো খুড়ো দোষটা কার?

নারানখুড়ো বুঝতে পারলেন এই বেটার সাথে কথায় তাল দেওয়া যাবে না। আজ পর্যন্ত গাঁয়ের কেউ তা পারেনি।

তাই কাচুমাচু গলায় বলে উঠলেন,...তাহলে এই ছোড়াকে ভাল করে বুঝিয়ে দে।...যেন এত জোরে আওয়াজ না করে।

দিলীপদা মনে,মনে হিসেব কষে দেখলেন।তর্ক বাড়ালে আজ আর রিহার্সাল হবে না।

একটা দিন নষ্ট হওয়া মানে ছেলেগুলোর অনেক ক্ষতি।

তাদের ভাল,মন্দের সাথে নিজেদের মান,সম্মান জড়িয়ে আছে।

তাই শান্ত গলায় বলে উঠলেন, তুমি খুড়ো বাড়ি যাও।

বাকিটা আমি দেখছি ।

বুড়ো তবু শেষ বারের মত লাঠিটা আর একবার চাতালে ঠুকে বলে উঠলেন,.. তাই বোঝা ভাল করে।না হলে কিন্তু এবার ঠেঙাটা মাথার মাঝেয় পড়বে।

বাকি ছেলেগুলো এতক্ষণে মুখ চেপে ফিক ফিক করে হেসে উঠল।

হাসতে পারল না অমল।বেচারা বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার পর সেই যে গ্রাম ছেড়ে একবার হোস্টেলের দুনিয়ায় বন্দি হল।আজ বি.এড শেষ করে তবে একটু মুক্তি পেয়েছে।

তাই গ্রামে আসা।আর এসেই বন্ধুদের খপ্পরে পড়ল।তারা এবছর নতুন যাত্রা করছে।নায়কের রোলটা অমলকে নিতেই হবে।

অমল কোন বাহানাও শো করতে পারল না। এস.এস.সির এখনো তারিখ ঘোষণা হয়নি।এই অবস্থাই গায়ে হাওয়া লাগানো ছাড়া দ্বিতীয় কোন কাজ নেই।তার মা,বাবার তাকে নিয়ে বড় আশা।তারা বার,বার মানা করেছিলেন। ওসব করার অনেক সময় আছে। আগে একটা চাকরী জুটে যাক।তারপর না যা করার করবে।তাদের আপত্তি থাকবে না।

অমল নিজে অল্প এক্সাইটেড ছিল।তাই মা,বাবাকে বুঝিয়ে বলে উঠেছিল,কোচিং-এ তো ভর্তি হয়ে গেছি।অসুবিধা কিছু নেই। এসবে মনটা ফ্রী থাকবে।

...এখন মাঝখান থেকে বুড়োর লাঠির ঘা আর ওই তার নাতনিটির কথা মনে করে কেমন যেন দমে গেল।

(দুই)

অমল সকালবেলায় সাইকেলটা অশোকদার দোকানে ঠেসিয়ে বাস ধরে কোচিং ক্লাসে যায়।

আজ ফেরার পথে খানিকটা অন্য মনস্ক হয়ে পড়ল।

পড়াশুনোর ব্যাপারে এতটা চিন্তিত নয়। সেদিনের ঘটনাটা নিয়েই সে বেশি ভাবছে।

তার মা,বাবার কানে ঘটনাটা কী করে যেন পৌঁছে ।আর যায় কোথায়!

তার মা তো শুনেই খচে গেছেন।তার ছেলের সাদা গায়ে কাদা লাগানো!!

তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি ব্যাপারটা।কোমরে কাপড়ের খুট গুঁজে বেরিয়েই পড়েছিলেন।ওই বুড়োটাকে শায়েস্তা করতে।

তার নাতনিটি কী স্বর্গের কোন অপ্সরা নাকি!...যে তার ছেলে লাটায় খেয়ে রাত জেগে নাম ধরে চেঁচিয়ে বেড়াবে?...যত্তসব!!

অমল আর তার বাবা দুজন মিলে আটকে ছিল বলেই সেই যাত্রাই রক্ষে!না হলে গ্রামজুড়ে একটা রণক্ষেত্র কান্ড বেঁধে যেত।

দলটা অমলের দিকে ভারী ছিল।তবুও তার মাকেই আটকে রাখল।

ছেলে আর বাবা এক।কেচাল হোক,সেটা তাদের সহ্য হয় না।

কী দরকার?...কাদা ছুঁড়লে দু পক্ষেরই গা নোংরা হবে।তারপর আবার অমলের বাবা একজন পঞ্চায়েতের কর্মী।শেষে যদি দলাদলি কান্ড বেঁধে যায়...আর রক্ষে নেই।

অমল কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ওই বৈশাখী নামক দাবানলটিকে।

একই গ্রামে বাস।চেনারই কথা।সে হলে কী হবে?...অমল কটা দিন গ্রামে ছিল যে উঠতি মেয়েদের খোঁজ পাবে?

...ওকে আবার গ্রামের বন্ধুরাও সমীহ করে চলে।তাই ওর সামনে মেয়েদের নিয়ে কেউ কথা তোলে না।তা হলেও এ,ওর মুখ থেকে খবর পেত।

অমলের মা,বাবাকেও সকলে ভয় করে।অমলকে প্রথম থেকেই তার মা,বাবা বন্ধুদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে বারণ করেছেন।

তাই অমলের ইচ্ছে হলেও বৈশাখীর কোন খবর কারু কাছ থেকে আগ বাড়িয়ে আদায় করতে পারল না।

 একবার আগুনটাকে স্বচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তার।

এই অবস্থায় অমল তার স্মৃতিশক্তির উপর জোর খাটাল।তখনি স্মৃতির সেলুলয়েডে কিছু দৃশ্য ভেসে এলো। দেখল ওই নারানদাদুদের পাঁচিল ঘেষে একটা নড়া কুলের গাছ।

দু,এক সময় ইস্কুল ছুটির পর সেও বন্ধুদের সঙ্গে যেত কুল কুড়োতে।

স্বাদটা আজো জীভে লেগে আছে।

ঠিক তখনি একটা বিনুনি বাঁধা মেয়ে ফুলফিতা নাচিয়ে দৌঁড়ে আসত।

হাতে তার একটা সরু মত কঞ্চি থাকত।

তা দেখে সবাই লাফ,ঝাপ মেরে পালিয়ে বাঁচতো।

অমল শুধু পারত না। মেয়েটির আসার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত।চোখে তার ভাসতো অপার মুগ্ধতার নেশা।খুব ভাল লাগত মেয়েটিকে বিভোরভাবে দেখতে।মায়ের কাপড়খানি সারা গায়ে জড়িয়ে একেবারে গৃহিনীর মত সাজত সে।ভারী লাগতো দেখতে!অমল সেদিকে তাকিয়েই থাকত।

মেয়েটি সামনে এসে বলত,....এই হাঁদা ওভাবে কী দেখছিস রে?...দেব এক লাঠি!.. বুঝবি কেমন জ্বলন।

অমল ঘোর কাটিয়ে বলে ওঠতো,এই তুই এত ছোট তবু সবাইকে তুই দিয়ে কেন ডাকিস রে?...বাড়ির কেউ তোকে মারে না?

...শুনে মেয়েটি আকাশ,বাতাস কাঁপিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠত,পাগলা কোথাকার!...মারবে কেন রে?...আমি তো মহারাণী।আমার আদেশ বাড়ির সকলে পালন করে।

...তার আগে জবাব দে।সবাই পালিয়ে গেল,আমার ভয়ে।আর তুই কেন দাঁড়িয়ে রইলি?

অমল দুঃখ করে বলে উঠত,আমি তো গাছে চড়তে পারি না রে।...ওরা পকেটে ভরে সবকটা কুল নিয়ে চলে গেল।আমি একটাও পাইনি।আজ কত করে মাকে ফাঁকি দিয়ে এলাম....তোদের গাছে দুটো সুস্বাদু কুল খাব বলে।...না খেয়ে যায় কী করে বল?

মেয়েটি ফট করে জড়ানো কাপড়খানা একটানে ছুঁড়ে ফেলে বলে উঠত,..তুই একদম দুঃখ করিস না।দাঁড়া আমি পেড়ে দিচ্ছি। একটা ফিনফিনে ফ্রক পরে মেয়েটি তরতর করে মগডালে ওঠে,জোর করে একটা ডাল ঝাঁকিয়ে দিয়ে নেমে পড়ত।

অমলের সবকটা পকেট ভরেও বেড়ে যেত।তখন দুহাতে ভরতো।

মেয়েটি হেসে বলত,খুশি!

অমলের সেই সময় কী যে ভাল লাগতো!..

....হঠাৎ অন্যমনস্কের ঘোরে ডানে,বামে করতে করতে দুম করে সাইকেল সমেত অমল রাস্তার ধারে একটা পলাশ ঝোপে পড়ে গেল।

উল্টো দিকের সাইকেল আরোহী একজন মেয়ে।সে তো অমলের ব্যবহারে খচে গেল।রে.রে করে দৌঁড়ে গেল অমলের দিকে।

অমল কোমরে হাত তখনো পড়ে রয়েছে।মেয়েটিকে দেখামাত্রই বলে উঠল,

,সরি...সরি..বোন।

মেয়েটি হাত দিয়ে অমলকে আর্ধেক তুলেই আবার ছেড়ে দিল। আগুন চোখ করে বলে উঠল,এই কে রে তোর বোন এখানে?...থাক উল্টে পড়ে।এসে তোর বোনই বাঁচাবে।আমি তোর বোন না।... চললাম।একে তো সাইড দিতে শিখিসনি।...তার উপর বোনকে ডাকছে!...হাঁদারাম!

অমল ভাবতেই পারেনি।মেয়েটি তাকে ওই অবস্থায় ফেলে দিয়ে পালাবে। 

প্রথমবার যা লেগেছিল।দ্বিতীয়বার হাত ফসকে পড়ে গিয়ে আঘাতটা আরো বেশি পেল।

তাই এবার সে সোজা শুয়েই পড়ল।যখন কোনরকমে ঝেড়ে,ঝুড়ে উঠল।

তখন দেখলে তার চারপাশে কেউ নেই।মেয়েটিকে তো দেখাই গেল না। 

...পৃথিবীতে এমন মেয়েও তাহলে আছে!যাকে বোন বললে খচে যায়।

তখনি অমলের মস্তিকে একটা ঢং করে ঘন্টার আওয়াজ বেজে উঠল। 

---হাঁদারাম!

কথাটা একদম চেনা।এই উপমাটা কেবলমাত্র সেই ছোট্ট মহারাণীই ব্যবহার করতো।নারানদাদুদের বাড়ির সেই মহারাণী!!

...তবে কী নারান দাদুর সেই মহারাণীই আজকের বৈশাখী??

(তিন)

দিলীপদা আজ সত্যি সত্যিই রেগে গেছেন।তাই জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,... একি রে অমল!...আজ তোর হয়েছেটা কী?...বার,বার পাঠ ভুল করছিস?

মা,বাবা কী পাত্রী দেখছে নাকি?...এত চিন্তা করছিস যে!...আর বার,বার তোকে বলা হচ্ছে এদিকে তাকাবি।এদিকটা হল দর্শকের জায়গা।..তবু সেই বাম দিকেই ঘুরে যাচ্ছিস কেন?নাকি সেদিনের নারানখুড়োর লাঠির শব্দটা আজো ভুলতে পারিসনি?চিন্তা নেই। ও আর আসবে না। ননিকে বলে দিয়েছি।এখন ওই তার বাপকে সামলাবে।

চল..এবার শুরু কর।...কই অরুণ দাঁড়িয়ে পড়।বৈশাখীর মা কমলা হাতে প্রসাদের থালা নিয়ে প্রবেশ করল।

অরুণ বলা শুরু করল,...এই শুনছো..শুনছো এদিকে আমি.. আমি বৈশাখীর মা বলছি।কমলা।

অমল না চেনার ভান করে বলে উঠল,.. বৈশাখী!! কে বৈশাখী? আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।

অরুণ বলে উঠল,আমরা বৈশাখীর সুখ কিনতে চেয়েছিলাম বাবা।ঈশ্বর তাই ওকে আজ অনেক সুখে রেখেছেন।আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে।... হে বাঙালীর ঘরে যত দায়িত্ববান মা বাবার দল।আপনারা আর দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে কন্যাদের চোখে সুখের কালো ফিতে বেঁধে আভিজাত্যের রাজপ্রাসাদে ছেড়ে আসবেন না।

....চোখ খুললেই সেই প্রাসাদের নগ্ন,বীভৎস রূপ দেখে আপনার তিলে,তিলে গড়া সেই মেয়েটির দুচোখে কালো বিভীষিকা নেমে আসবে।...হ্যাঁ... হ্যাঁ.. আমি ঠিক বলছি।

সবাই মগ্ন হয়ে আছে আপাতত কমলার কথায়।অরুণ ভালোই প্রক্সিগুলো টানে।নিজে জোকারের রোল ছাড়া করে না। দর্শকদের মাতিয়ে রাখে।

অমলের মনযোগ আজ আর পাঠে একদম নেই।

বৈশাখী আজ জানলার পর্দাটা দুবার খুলেছে।একবার আলোটা জ্বেলেছিল।তবু তাকে ঠিকমত দেখা গেল না।

আজ সকালেও সাইকেলের ঘটনায় তেমন মুখটা দেখা পায়নি।

...মনের ভিতরটা তাই বড্ড উসখুস করছে সেই ছোট্ট বেলার বিনুনী ঝোলা গেছো মেয়েটার ডাগর মুখখানা একটি বার দেখার জন্য। মুখের কথা যে আজো এতটুকু পাল্টেনি।সেটা সকালের সাক্ষাতেই অমল বুঝে গেছে।

...রূপ তো আর সেই তেমনটি থাকবে না।অমলের পরিস্কার মনে আছে।

ওর ডানপাশে একটা দাঁত অল্প মত বেরিয়ে থাকত।হাসলে বড্ড ভাল লাগত।আজো কী দাঁতটা ঠিক সেইরকমই আছে?না কোন ডেন্টিস্টকে দেখিয়ে সারিয়ে নিয়েছে?

দিলীপদার কথায় অমল চমকে উঠল,কী করছিস কী ?কখন থেকে এত জোরে,জোরে চেঁচাচ্ছি শুনতে পাসনি?

...তোর তো পাঠগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে।তবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেন আছিস?

অমলের মনটা খারাপ হয়ে গেল।

তাই আস্তে করে বলে উঠল,আমার আজ শরীরটা ভাল ঠেকছে না কাকু।

তাই বাড়ি যাচ্ছি।কাল তখন আসব।

দিলীপদা বলে উঠলেন,সেই ভাল।

অমলের উদ্দেশ্য অন্যরকম।বৈশাখী ঝোলা বারান্দায় নেমে এসেছে।অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাদের রিহার্সাল দেখছে।এই সুবর্ণ সুযোগ তার সাথে কথা বলার।ওখানটা একদম ফাঁকা এবং অন্ধকার।কেউ তাকে দেখতে পাবে না।

অমল পিছনটা ভাল করে দেখে আস্তে করে বৈশাখীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,এই দেঁতো।শোন।

বৈশাখী কান পেতেই ছিল।অমলের হাব,ভাব অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে সেও কিছু বুঝেছিল।অমল যে তার সাথে কথা বলতে চায়।সেও মনে,মনে বুঝেছে।তাই অমলের বেরিয়ে আসার সাথে সেও নিচে নেমে এলো।

অমলের ডাক শুনে বৈশাখী বলে উঠল,এই হাঁদা তোর কমরটা ভাঙেনি তো?...আমি অবশ্য ভাঙার জন্যই ধাক্কাটা লাগিয়ে ছিলাম।

অমল বলে উঠল,বুঝেছি।কাল তোদের স্কুলের পিছনে ফুটবল মাঠে দশটার সময় দেখা কর।কথা আছে।

বৈশাখী বলে উঠল,বল গুতো খাবি? তাহলে যাব?

ততক্ষণে, বৈশাখীর বাবা উঠে এসেছেন।মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,দিনরাত পড়াশুনো করে মাথাটা দেখছি খারাপ করে ফেললি!এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাওয়ার সঙ্গে গুতোগুতি খেলছিস নাকি?

...কালকেই একবার তোকে ডাক্তার দেখিয়ে আনতে হবে।

এখন চল। বিছানায় গিয়ে মায়ের সাথে...শুয়ে পড়।

অমলের তো এদিকে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় আরকি!একদম চুপটি মেরে পাথরের মত অন্ধকারে থম বসে রইল।বৈশাখীর নুপূরের শব্দে তার প্রস্থান বোঝা গেলেও,তার বাবার পাজোড়ার শব্দ এখনো মেলায়নি। ব্যালকনির অন্ধকারে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে রিহার্সাল দেখছেন।অমল অল্পও নড়ল না।নড়লেই শব্দ পাবে।শব্দ পেলে,ধরা পড়তেও সময় লাগবে না। তখন আর এক কেচাল!হেয়...হেয় জুড়ে দিলে সর্বপ্রথম হয়তো তার দিলীপকাকুই এসে প্রথম চড়টা কষবেন।

মিনিট দুই পরেই অমল পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল।

গরম,গরম জলের ধারা যখন তাকে চান করিয়ে দিল।

অমলের উপর উষ্ণ প্রস্রবণ শেষ হতেই গলাটা একবার ভাল করে ঝেড়ে বৈশাখীর পিতৃদেব অন্ধকার বারান্দা থেকে নিজেকে চোরের মতো সরিয়ে ফেললেন।

এদিকে অমল বেচারা জুত করে যে একবার বমি করবে তারও উপায় নেই।

সব তার কপাল!!

(চার)

অমলের ডানহাতের তালুতে একটা সজোরে তালি মেরে সারা শরীর দুলিয়ে বৈশাখী হো..হো শব্দ করে হাসতে লাগল।

অমল সেই ফাঁকে তার সেই কিশোর বেলায় দেখা পুচকে মেয়েটাকে এখনকার সাথে একবার ভাল করে মিলিয়ে নিচ্ছে।

দাঁতটা এখনো তার নিজের জায়গাতেই আছে।

চুলগুলো লম্বা হয়েছে।তবে মুখটাকে মেলান যাচ্ছে না কিছুতেই। চোখদুটোর চাউনি যদিও পাল্টায়নি।

তখনো কাজল মাখত..এখনো মাখে।

 বৈশাখী হঠাৎ করে হাসি থামিয়ে বলে উঠল, এই শোন আবার ভাল,টাল বেসে ফেলিস নি তো?...তাহলে আজকেই শেষ দেখা কিন্তু।

অমল বলে উঠল, আসলে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল।তাই ডাকলাম।

---তাহলে আগে কেন দেখিসনি?...তুই হোস্টেল থেকে ফিরতিস।তখন কই একবারো তো খবর নিসনি আমার?

---তখন তো আর তোর দাদুর লাঠির ঘা আমার পায়ের কাছে পড়েনি।....তোর নামটা শুনেই সেই ছোটবেলার কুল খাওয়ার কথা খুব মনে পড়ে গেল।তাই একবার দেখতে ইচ্ছে হল।

---আর ভুলেও কোনদিন রাতের বেলায় ওভাবে অন্ধকারে দাঁড়াস না।... এটা ইন্ডিয়া ...মনে রাখিস।

---মাথা খারাপ!!

---হ্যাঁ রে তুই তাহলে বিয়ে কখন করবি?

---আগে একটা চাকরী তো জুটুক কপালে।

---আমিও ভাবছি... আগে চাকরী করবো..তারপর বিয়ে।কিন্তু সে কথা মা,বাবাকে কিছুতেই বুঝছে না। ওদের ওই এক বুলি।

চাকরী করে তুই করবিটা কী শুনি?...জামাই এতবড় ব্যবসায়ী ।ওর টাকায় কে খায়!..তারপর আবার তোকে কষ্ট করে চাকরী করার কী দরকার?

অমল অবাক হল।

বলে উঠল,দাঁড়া..দাঁড়া।এক মিনিট।জামাই মানে?....তোর কী বিয়ে হয়ে গেছে?

বৈশাখীর চঞ্চল চোখদুটো শান্ত হয়ে গেল।মনে হল চোখের পলকদুটো ভারি হয়ে আসছে।

ঠোঁটদুটো একটু কেঁপে উঠল।তারপর নিচু সুরে বলে উঠল,

...আমার একদম এ বিয়েতে ইচ্ছে নেই রে।সুশান্তর বয়স বত্রিশ ।আমার আপত্তি সেখানেও নেই। আমি চাই নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে।তারপর যদি পঁয়ত্রিশ বছরের ছেলেকেও বিয়ে করতে হয়।রাজি আছি।ওর, খুব বড় একটা নার্সিং হোম আছে।তাছাড়া দুটো স্টেশনারী দোকানও নাকি কর্মচারীদের ভরসায় ছেড়ে রেখেছে।সুশান্ত তার বাবার একমাত্র ছেলে।এই মাস কয়েক আগে ওদের বাড়ির লোক আমাকে আশির্বাদ করে গেছেন।

কী করব আমি ভেবে পাচ্ছি না।পরীক্ষাটা চুকে গেলেই চারহাত এক করে দেবে।

সেইজন্যই তো দাদু সেদিন রেগে গেছিল।...কী করব আমি?...পড়তেও ইচ্ছে যাচ্ছে না। খালি ভাবছি।কী হবে ভাল রেজাল্ট করে?..কোন মূল্যই তো থাকবে না।

..... সেদিন বার,বার তোর ডাকটা আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। সারাক্ষণ ভাবছিলাম...কে যেন আমাকে অন্তরের ঘর থেকে হাতছানি দিয়ে প্রাণের ঘরে ডাকছে।সেই ডাকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম জানিস।

...তুই বিশ্বাস কর।আমার একবারো মনে হয়নি তুই অভিনয় করছিস।

পরে আমি নিজেই নিজেকে বোঝালাম।স্বপ্ন..শুধু স্বপ্নের মতো।তা কোনদিন বাস্তবের সাথে মেলে নারে।

ছোট্টবেলার সেই মহারাণীর দুচোখে প্লাবন দেখে অমলের মনটা ব্যথায় টনটন করে উঠল।

চোখদুটো তারো ভিজে এসেছে।

তাই অশ্রুকটা আড়ালে ফেলে বলে উঠল,দুঃখ পাস নারে!

বৈশাখী বলে উঠল,আমার বড্ড ভয় করছে রে অমল।শেষে তোদের যাত্রাপালার বৈশাখীর মত আমারো করুণ পরিণতি হবে নাতো!

..মা,বাবা সুখের মোহে অন্ধ হয়ে গেছে। আমি ওসব সুখ বিন্দুমাত্র আশা করিনি অমল।আমি চাই মুক্তির আনন্দ পেতে।হাত,পা ছড়িয়ে নিজের মত করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে।নিজের পায়ে দাঁড়াতে।মেয়ে বলে কী আমি এটুকুও স্বপ্ন দেখতে পারি না বল?

অমল গলাটাকে ঝেড়ে বলে উঠল,এসব প্রশ্ন আমাকে কেন করছিস?আমি আর কী করব বল?

বৈশাখী উঠে পড়ল।নিজের চোখ, মুখ ভাল করে মুছে বলে উঠল,পারবি আমার হাত ধরে এই গন্ডি থেকে আমাকে চিরদিনের মত মুক্ত করতে?

বিয়ে করতে বাধ্য করব না। নিজের পছন্দ মত করিস।

অমল কোন উত্তর দিতে পারল না। পলাশের রাঙা ফুলগুলো খসে এখন লম্বা,লম্বা সটা ঝুলছে।

পলাশের যত গর্ব তার ফুলেই!

তখন চারিদিকে তাকে নিয়ে কত মাতামাতি!কবিতা!এখন আর এই সটার দিকে কেউ তাকায় না। জীবনটা এরকমই!!

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফস করে ছেড়ে বৈশাখী বলে উঠল,....না থাক।তোর মা,বাবা অনেক আশা নিয়ে তোর দিকে চেয়ে বসে আছেন। তাদেরকে দুঃখ দিয়ে তুইও কোনদিন সুখী হতে পারবি না।

অমল সব বুঝতে পারছে।বৈশাখী মিথ্যে বলেনি।

সে কিছুতেই পারবে না.... মা,বাবার চেনা স্বপ্নগুলোকে দু পায়ে মাড়িয়ে বৈশাখীর হাত ধরে অজানার অন্ধকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে।

তিল,তিল করে জমা করা মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নগুলো বড় ভয় দেখায়।মনটাকে পোষা কুকুরের মত অনুগত করে রাখে।তাই তার মন বিদ্রোহ করলেও একটা পা পর্যন্ত ওঠাতে পারবে না।

দুজনেই বুকের উপর কয়েক মণ ওজনের পাথর চাপা রেখে কয়েক পা এগিয়ে দুটো পথে ভাগ হয়ে গেল।আলাদা,আলাদা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

....এরপর দুজনের কবে দেখা হবে কেউ জানে না।

খেলার মাঠ পেরিয়ে মোড়ের ব্যস্ততায় মিশে গেল অমল।তবু যেন কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছে না।

সেদিনের ছোট্ট বিনুনী বাঁধা মেয়েটির কথাটা, মনের চার দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরছে।,...আমি তো মহারাণী!

আজ সে কত অসহায়!

...অমল নিজেও তো রাজা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মধ্যবিত্তরা কোনদিন রাজা বা রাণী হয় না।শুধু মঞ্চে ভাল মত তাদের অভিনয় করতে পারে।একদম দক্ষ অভিনেতার মত।বিশাল এই পৃথিবীর বিচিত্র রঙ্গমঞ্চে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics