খেলার সাথী
খেলার সাথী
চার বছরের তোতনের সাথে একটি চড়ুই-এর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
তাই এখন তোতনের খিদে না থাকলেও তার মায়ের কাছে এটা,সেটা খুঁজে খায়।তারপর সেই খাবারের খানিকটা ভাগ চড়ুইটার দিকে ছুঁড়ে দেয়।পুচকে ঠোঁট দিয়ে চড়ুইটা সেগুলো খুটে,খুটে খায়।আর পিটপিট করে তোতনের দিকে চেয়ে থাকে।
এইভাবে সকলের অগোচরে তাদের বন্ধুত্বটা দিন কয়েকের মধ্যেই বেশ পাঁকা হয়ে উঠল।
তোতন এখন উঠোনে নেমে এলেই চাল থেকে চড়ুইটা ফুড়ুত করে উড়ে এসে তার সামনে পা নাচাতে শুরু করে।চড়ুইটাকে অনুকরণ করে তোতনও নেচে,নেচে চলে।সেই দেখে একদিন তার বাবা বলে উঠলেন,এমন করে লাফাচ্ছিস যে!
তোতন বলে উঠল,আমি তো পাকি।তাই এমন কচ্চি।তুমি পালবে এমন কত্তে?
---তা পাখিমশাই নাচানাচি বন্ধ করে এবার একটু পড়তে বসলে হয় না?
---আজ কো ছুতি।ম্যামরা বলেন ছুতিল দিনে খেলতে হয়।তাই আজ আমি খেলব।
---তাই নাকি?তা কী,কী খেলা তুই জানিস বল তো?
তোতন একটু ভেবে বলে উঠল।কিলকেট।বাবা তুমি বল কলবে?আমি চক্কা মালবো।
---তুই ছক্কা মারতে শিখে গেছিস?
---চক্কা,ফোল সব পালি।
এক মিনিট দালাও।আমি ব্যাটটা আনি।তুমি বল চুলবে।
তার বাবা অল্প খেলেই হাঁপিয়ে উঠলেন।তার মা ও ঘর থেকে ডাক দিলেন,এদিকে আয় তো সোনা।
প্রসাদের ফল টুকরো কটা তোতনের হাতে দিয়ে বলে উঠলেন,খেয়ে নে।তারপর চান করবি।
তোতন চালের দিকে তাকিয়ে দেখল চড়ুইটি নেই।এদিক,ওদিক তাকাল।কোথাও খুঁজে পেল না। অভ্যেস মত একটা ফলের টুকরো উঠোনের একদিকে ছুঁড়ে নিজের মনেই বলে উঠল,পসাদ খেলে ঠাকুর আশিলবাদ দেয়।খেয়ে নিবি।
সেদিন সন্ধে পর্যন্ত চড়ুইটাকে আর একবারও তোতন দেখতে পেল না। তাই মনটা অল্প চুপসে গেল।সন্ধের সময় ড্রয়িং খাতার উপর চড়ুইটাকে এঁকে তার বাবাকে দেখাল,বলো তো বাবা এতা কাল চবি?
তার বাবা অল্প খুঁটিয়ে দেখার পর ভারাক্কী চালে জবাব দিলেন,পাখি তো নিশ্চিত।তবে কোন পাখি তা বলতে পারছি না।
তোতন খাতাটা নিজের হাতে টেনে বলে উঠল,তুমি না বুদ্দু।কিচ্চু জান না। ও আমার বন্দু।
তার বাবা চোখজোড়া গোল করে বলে উঠল, সেকি রে!..কোথায় থাকে তোর বন্ধু? একসাথে খেলাধুলো করিস নাকি?
তোতন বিজ্ঞের মত করে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
---কী করে বন্ধু পাতালি?
---এমনই।একদিন আমি খামালে খেতে বসেচিলাম।ও আমার পাশে বসল।ওকোও দুতো দিলাম।তালপল থেকে লোজ আসে।আমাল সাতে খেলে।হল না আমাল বন্দু?
----তোর বন্ধুর সাথে আমার কাল পরিচয় করিয়ে দিস তো।তোর জন্মদিনে তো ওকেও ডাকতে হবে।তাই না?
তোতন তার বাবার কথা শুনে হাততালি দিয়ে নেচে উঠল,কি মজা...কি মজা!
তারপর একটু থেমে আবার বলে উঠল,বাবা পাখিরা তাকে কোতায়?ওদের মা,বাবা আছে?
তার বাবা তোতনকে কাছে ডেকে কোলে বসিয়ে বললেন,সবার মা,বাবা থাকে তোতন।এবার খেয়ে,দেয়ে ঘুমিয়ে পড়।সকালে উঠতে দেরী হয়।ইস্কুলের গাড়ি দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে।
পরদিন ইস্কুল থেকে ফিরেই তোতন উঠোনে চড়ুইটাকে দেখতে পেল।অন্য একটা চড়ুই-এর সাথে ঝগড়া করছে।তার বন্ধু চড়ুইটিকে তোতনের চিনতে অতটুকুও অসুবিধা হল না।চোখের দুপাশে কালো ছোপ আছে।অন্যটার তা নেয়।সারা গা কটা।পুরনো পাটের মত পালকের রঙ।তোতনের জুতোর শব্দ পেয়েই কটা রঙের চডুইটা চালে গিয়ে বসল।তার বন্ধুটি কিন্তু নড়ল না।পিটপিট চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল।তোতন টিফিন বাক্সটা খুলতে গিয়ে বলে উঠল,তুই মস্ত পাঁজি তো।কাল সালাদিন তোকে কত্ত খুঁজলাম।পেলাম না। তোল জন্য পসাদ লেখেচিলাম।
তারপর বাক্সের বিস্কুট টুকরোগুলো তার দিকে ছুঁড়ে আবার বলে উঠল,একটু পলে আয়।মায়েল কাছ থেকে নিয়ে কলাই ভাজা দেব।..কেমন?
তার মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে বলে উঠলেন, এমনভাবে বলছিস যেন চড়ুইটা তোর সব কথা বুঝে গেল।এরকমভাবে খাবার ছড়ালে আমাদের উঠোনে তোর বন্ধুদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না।ওই দ্যাখ আরো তিনজন এখুনি জুটে গেল।
---ওলা তো ওল বন্দু।আমার বন্দু ও একা।
ওর মা জামা,প্যান্টটা পাল্টে বলে উঠলেন,এত ভীড়ে তুই তোর বন্ধু চড়ুইটাকে চিনবি কী করে?ওরা তো সবাই একই রকম দেখতে।
তোতন জবাব দিল,আমি না পাল্লে...ওই আমায় চিনে নেবে।
ওর মা অল্প হেসে বলে উঠলেন,খুব হয়েছে।এবার চল চাট্টি খেয়ে নিবি।
তার কদিন পরেই দোল পূর্ণিমা চলে এল।তোতনের ভারী মজা।তার বাবা ওর জন্য একটা পিচকারী এনে দিয়েছেন।গোটা চারেক গুব্বারা বোম।সকাল,সকাল একটা তার দাদুকে ছুঁড়ে মেরেছে।তার দাদু তো রেগে টং।হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে মেরেছিলেন।তোতন থাম্বার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল।তারপর লাঠিটা ধরে ডোবার জলে ফেলে এসেছে।সেই থেকে তার দাদু উপরের ঘরে বিছানায় গজগজ করছেন।
তোতন আবির নিয়ে পাশের বাড়ি সোনু আর তিতিক্ষাকে মাখিয়ে এসেছে।তারাও তাকে ছাড়েনি।আয়নায় একবার নিজের চেরারাটা দেখে তোতন খুব জোরে হেসে ফেলল।আবার ছুটল বাইরে।খোল,করতার বা
জছে।হরিবোলের দল আবির মেখে এদিকেই আসছে।দৌঁড়তে গিয়ে হঠাৎ গলির কাছে তার চড়ুই বন্ধুটির সাথে দেখা হয়ে গেল।
তোতনকে দেখে চিকচিক করে কী যেন বলছে।
তোতন তার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,আজ আমলা হলি খেলচি।তুই খেলবি না?
বলেই হাতের একমুঠো লাল আবির চড়ুইটার গায়ে ছুঁড়ে মারল।চড়ুই বেচারা বার দুই বিগবাজি খেয়ে উড়ে গিয়ে বসল চালের উপরে।সারা গা লালে লাল।ডানা ঝাপটে রঙ ঝাড়তে বসল।তা দেখে তোতনের হাসি আর ধরে না। হাসতে,হাসতে লুটিয়ে পড়ার উপক্রম।তার মা ছেলের কান্ড দেখে বলে উঠলেন,কীরে পাগল,হাসছিস কেন এমনভাবে?
তোতন হাসি থামিয়ে বলে উঠল,আমি আজ বন্দুকে আবিল মাকিয়ে দিয়েচি।ওই দেকো লাগ কলে চালে বসে আচে।
তার মা চড়ুইটার অবস্থা দেখে সত্যি সত্যিই হেসে ফেললেন।
কালো আর খয়েরী রঙের চড়ুইটা এখন রঙ পাল্টে লাল ভূত দেখাচ্ছে।
তার মা বলে উঠলেন,বন্ধুকে ডেকে মিঠাই খাইয়ে দে।দেখবি রাগ ভেঙে যাবে।
তোতনের বাবা আজ দুদিন হল কারখানায় টানা ডিউটি করছেন।বাড়ি আসার সময় নেয়।জব্বর প্রোডাকশন চলছে।এসময় ডিউটে করলে ডবল পেমেন্ট।তাই সুযোগটা তার বাবা হাতছাড়া করতে রাজি নন।তাতে তোতনের মায়ের কাজ অনেকটা কমেছে।নাহলে সাত সকালে ওঠার পর থেকে স্বামীর ডিউটি যাওয়া পর্যন্ত দম ঘোরানোর সময় পান না। আজ তাই রান্না ঘরটা ঝাড়তে বসেছেন।শাশুড়ী বেঁচে থাকতে এসব কাজ তাকে কস্মিনকালেও করতে হয়নি।তখন সেই শাশুড়ীকে তার প্রধান শত্রু বলে মনে হত।আর এখন সেই শাশুড়ীর কথা মনে পড়লে,দুচোখে উষ্ণধারা নেমে আসে।হাত ধরে সংসারের সব কাজ শিখিয়ে গেছিলেন বলেই আজ তোতনের মাকে বেশি কষ্ট পেতে হয় না।
এমন ব্যস্ততার সময় আবার তোতনের বন্ধু চড়ুইটা লাল ডানা ঝাপটে বার,বার তার কাছটাই এসে বিটকেল ক্যাচার,ম্যাচার জুড়েছে।একবার তো তোতনের মা হাতের বাঁশটা দিয়েই তাকে ছুঁড়ে মারলেন।বড় জোর বেঁচেছে।এমন কাজের সময় অসুবিধা জুড়লে কার মাথা ঠিক থাকে?সেইজন্য তোতনকে পর্যন্ত আজ সকাল থেকে বাইরে খেলতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।কথাটা মনে পড়তেই তার মা চমকে উঠলেন।অনেকখন হয়ে গেল। তোতন একবারও মা বলে ডাক পাড়েনি।তিনি হাতের কাজ ছুঁড়ে দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।ডাকলেন,তোতন...সোনা।তারপর ছুটে গেলেন কুলি।তারপর বাড়ি।তার বুকের আওয়াজ বাড়তে লাগল।এমন সময় তোতনের বন্ধু চড়ুইটা আবার তার কাছে ডানা ঝাপটে কিচির,মিচির জুড়ে দিল।তোতনের মা শুকনো গলায় বলে উঠলেন,তোর বন্ধু কোথায়?
চড়ুইটা ওড়ে গেল।তিনি তাকে অনুসরণ করে চলতে লাগলেন।চড়ুইটা বসল গিয়ে ডোবার ধারে।তোতনের মা ছেলের মাথাটা ঢোবার জলে দেখতে পেয়েই উন্মাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
----ও মা গো!এ আমার কী হল গো!..তোতন ...ও তোতন।
তোতনের মায়ের কান্না শুনে গাঁয়ের যত লোক এসে জড়ো হল।তাদের মধ্যে একজন সাথে,সাথেই তোতনকে পাঁক কয়েক ঘুরিয়ে উবুড় করে শোয়ালেন।তারপর পেটের উপর আস্তে করে চাপ দিতেই তোতনের মুখ বেয়ে হড়হড় করে জল বেরোতে লাগল।তোতন চোখ মেলে চাইতেই তার মা বুকের উপর ঝাঁপিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
তার বাবাও এতক্ষণে খবর পেয়ে বাইকে চেপে কারখানা থেকে ফিরলেন।ডাক্তারও এসে গেলেন।নাড়ি,টাড়ি দেখে বলে উঠলেন,ভয়ের কোন কারণ নেই।বাড়ি গিয়ে অল্প সরবত ঘেটে খাওয়ান।এখন ওর বিশ্রামের দরকার।আর একটু দেরী হলে বিপদ ঘটে যেত।
তোতনের মা তখন চালের দিকে তাকিয়ে লাল আবিরমাখা চড়ুইটাকে দেখছেন।দু চোখ ভাসছে উষ্ণধারায়।
আজ তোতনের জন্মদিন।সারা বাড়িময় সাজান হয়ে গেছে। বেলুন,ফুলঝুরি,রঙিন কাগজ ঝুলছে চারিদিকে।তোতেনের পিমণিরা এসেছেন।মামা বাড়ি থেকে তার মামা দিদা আর মেশোমশায়রাও এসেছেন।সারা বাড়ি জমজমাট।তোতনের মাথায় পরানোর জন্য একটা চোঙাকৃতি চকচকে টুপিও আনা হয়েছে।সেটা পরে তোতন একটা ভেপু বাজাচ্ছে।
কেকটা টেবিলের উপর নামিয়ে পাঁচটা মোমবাতি সাঁজান হল।
তোতনের হাতে ছুরিটা ধরিয়ে তার পিশেমশায় কেকটা কাটার সাথে, সাথেই সবাই হাততালি দিয়ে হ্যাপি বার্থ ডে গেয়ে উঠল।
তোতনের মা একটা প্লেটে আজকের সব রান্নাগুলো অল্প করে সাজিয়ে শেষে এক টুকরো কেক রাখলেন।তারপর সেটা সবার অলক্ষ্যে চালের একপাশে নামিয়ে দিয়ে এলেন।তোতনের চড়ুই বন্ধুটি আজ তার সাথীদের নিয়ে চালে কখন থেকে বসে আছে।এখন তারা খাবার পেয়ে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল।তোতনের মা সেইদিকে তাকিয়ে অল্প কেঁদে ফেললেন।
আয়োজনের শেষ পর্বে তোতনের দিদি আর জামাইবাবু জিজ্ঞাসা করলেন,আচ্ছা বোন।তোতনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা রাতে করলি না কেন?সবার তো রাতেই হয়।
তোতনের মা জবাবে বলে উঠলেন,তোতনের কয়েকজন খেলার বন্ধু সন্ধে হলেই ঘুমিয়ে পড়ে।তারা না এলে কী ওর জন্মদিন মানায়?
সবাই বলে উঠলেন, কই তাদের তো এখানে দেখলাম না।
তোতনের মা বলে উঠলেন, তারা তো খেয়ে,দেয়ে কখন চলে গেছে। ওরা মানুষের সাথে বসে খায় না। তাই চালে বসেই খেয়েছে।
তার দিদি বলে উঠলেন,সে তো একদল চড়ুই!
----ওরাই তোতনের সারাদিনের খেলার সাথী।
কথাটা শুনে উপস্থিত সবার মুখগুলো কিছুক্ষণের জন্য হা হয়ে গেল।