পরব
পরব
শুশুনিয়া হিল থেকে হাফ কিলোমিটার নর্থে,ছোট্ট একটা গ্রাম।শিমুলচাঁপা।ষাট,থেকে সত্তরটি ঘর রয়েছে সে গ্রামে।
আদিবাসি জনজাতির বসবাস।খুব শান্ত এখানকার বাতাবরণ।
এখন শুশুনিয়াতে পার্ক,কটেজ এবং লজ হয়েছে।তাই ট্যুরিষ্ট যাত্রীদের আনাগোনা কম বেশি সারা বছরই লেগে থাকে।
তাতে অল্প,স্বল্প হলেও আশেপাশের গ্রামগুলোতে আয় বেড়েছে।
যুবকটির নাম সৈকত বাগচি।পেশায় আই.টি ইঞ্জিনিয়ার।
তার প্রেমিকা রিয়া কোলে।দুজনই কোলকাতা মহানগরের বাসিন্দা।কলেজে তাদের প্রথম পরিচয় ।তারপর ভালবাসা।
সৈকত গত ভ্যালেন্টাইন ডের মর্নিং-এ রিয়াকে হঠাৎ ফোন করে বলেছিল,আই লাভ ইউ জানু।
রিয়ার ঘুম তখনো চোখ থেকে সরেনি।এমন অবস্থায় সৈকতের গলা পেয়ে লাফ দিয়ে ওঠেছিল, কোথায় ডার্লিং?
--ইজ আ সারপ্রাইজ!
--আমি তোমার সাথে এক্খুনি দেখা করতে চাই।তোমার মিষ্টি ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া না পেলে যে আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাব জান।আজকের দিনটার কসম বলো তুমি কোথায়?
--আই নো জানু।সেইজন্যই তো একটা নতুন জায়গা আবিস্কার করেছি।
--কোথায়?.. জায়গার নাম কি?
---এটাই তো সারপ্রাইজ জানু।আজকের বিশ্ব প্রেমদিবসে তোমাকে এই চমকটাই তো উপহার দিতে চেয়েছি।ফোনের লোকেশান ট্রাক করে তোমার প্রেমিককে খুঁজে নাও।দেখি তুমি আমায় কতটা ভালবাসো?আজ সূর্যাস্তের পূর্ব অব্দি যদি আমায় খুঁজে বের করতে পারো।কথা দিলাম,তোমাকে একটি জলজ্যান্ত স্বর্গ উপহার দেব।
--ওকে।ডান।
রিয়া তার বাবাকে সটান গিয়ে বলেছিল,ড্যাডি আজ তোমার স্যান্ট্রোটা আমার লাগবে।
তার বাবা মেয়ের চোখ দেখে যা বোঝার বুঝে গেছিলেন।
তাই ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছিলেন,সাবধানে চালাবি।
রিয়া জবাবে বলেছিল,কারণটা জিজ্ঞাসা করলে নাযে?
তার বাবা হেসেছিলেন,
--যে মেয়ে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে ড্যাডির গাড়ি ছাড়া যায়।সে আর যায় হোক বিনা কারণে তার বাবাকে লোকাল বাসে চেপে অফিস যেতে এমনি,এমনি বাধ্য করাবে না।আজকের দিনটা তো তোদের।আফটার অল একদিন আমাদেরও ছিল।লেটস গো।
বলেই চাবিটা রিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
রাগ যে একেবারে হয়নি।তা না। মাথাটাই তেতে গেছিল।ভেবেছিল,প্রথমে সৈকতকে একটা কষিয়ে চড় মারবে।তারপর বলবে,ইউ ননসেন্স।তোমার ফালতু সারপ্রাইজের চক্করে এ কোন নরকে টেনে আনলে আমায়?
..মহানগরের সীমানা ছাড়িয়ে গাড়িটা সিগন্যাগ ধরে একসময় মফস্বলের দিকে এগুতে লাগল।তারপর একসময় হাইওয়ে ধরে দূরে অনেক দূরে।রাস্তাগুলো সরু হতে হতে পাঁকা,আধপাঁকা তারপর কাঁচাই এসে মিলিত হচ্ছিল।রিয়া সেইজন্য বার,বার সৈকতের লোকেশন চেক করছিল।সে ঠিক পথ ধরে আগাচ্ছে তো?
মনের ভেতর রাগটা সেই তখন থেকে চড়চড় করে বাড়ছিল।
অথচ সামনে পৌছে সৈকতকে বিভোরভাবে বসে থাকতে দেখে রাগটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল।সবে তখন বিকেল চারটে।সূর্যের তাপ আর ততটা ছিল না।
নতুন খড় দিয়ে বানানো একটা ঘর।কাঁচা বাঁশ আর খেঁজুরপাতা দিয়ে ঘেরা। চারপাশটা সুন্দর করে সাজানো।ঘরের ভেতর নরম কাঠ দিয়ে তৈরি করা আলাদা একটা বিশ্রামকক্ষ। উঠোনের চারিদিকে ছোট,বড় নানা ধরণের পলাশ গাছ।তখন তাদের মাথাগুলো রক্তরাঙা।
ঘরের সেই আরামকক্ষের মধ্যে সৈকত পা গুটিয়ে কবিতা লিখছে!!
রিয়া নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে বসেছিল। পড়ে দেখল।সৈকত সব কটা কবিতা তাকে নিয়েই লিখেছে।রিয়ার খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু পারেনি। শুধু অভিমানের ভারে ঠোঁটদুটো তিরতির করে কেঁপে উঠেছিল, তুমি কেন গো এমন?..সাথে ডাকতে পারোনি?..এতটা রাস্তা আমাকে একা আসা করালে?
সৈকত রিয়াকে বাহুডোরে বেঁধে বলেছিল, আসলে কোলকাতার কোলাহল আমাকে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।তাই পালিয়ে এসেছি।পরে ভাবলাম,তোমাকেও ডেকে নিই।প্রকৃতির এই নিঃশব্দতায় আমরা মনের কথাগুলো সেরে ফেলবো। তাই তোমাকে আজকের দিনে এই কষ্টটুকু উপহার দিলাম।
আমার এক বন্ধুর হাত ধরে আসা এখানে।তুমি আসছো শুনে ও বাড়ি চলে গেল। পাহাড়ের পাশে কোন এক গাঁয়ে থাকে। ওই আমায় প্রথম বলেছিল, হিলের পাশে একটা সুন্দর আদিবাসী গ্রাম রয়েছে। সেখানে প্রতিবছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পুরো জানুয়ারি মাস অব্দি পর্যটকদের জন্য কয়েকটা নতুন কুড়েঘর বানানো হয়।পর্যটকরা সেখানে প্রকৃতির কোলে একদম সাধারণ জীবনযাপনের স্বাদ নিতে পারেন।খুব বেশি কটেজ নেই। গোটা তিরিশেক। দু,তিন মাসের জন্য।তাই একটু আগে,ভাগেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। যদি না পায়?
..গ্রামবাসিরা নিজের হাতে যাত্রীদের জন্য সমস্ত রান্না তৈরি করে।বাড়ির ঢেঁকিছাটা চালের ভাত,দেশি মুরগীর ঝোল আর দু,তিন রকমের শাক,টাগ ভেজে খেতে দেন।
এই সময় এরা অতিথিদের দেবতাজ্ঞানে পুজো করে।পর্যটকদের রক্ষণা,বেক্ষণা, সব দায়িত্ব তাদের।চাইলে মহুলের নেশাও করা যায়।
সেবার তারা দুজনে মিলে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে ছিল,সেই কুড়ে ঘরের মধ্যে।আদিবাসি রমনীদের হাতে রাধা কম মশলার মুরগীর ঝোল আর ঢেঁকিছাটা চালের ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পরস্পরের চোখে হারিয়ে গেছিল।সূর্যাস্তের অস্তরাগ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই উঠে পড়েছিল গাড়িতে।
কাঁচা,পাঁকা রাস্তার দুদিকে বন পলাশের রাঙা ঝোপ। দোয়েল,ফিঙের সুমধুর শিস!!
তারা দুজনই অপার মুগ্ধতায় হারিয়ে গেছিল। সে এক অকল্পনীয় স্বর্গসুখের অনুভূতি!
সেবার বিশ্ব প্রেমদিবসে সৈকতের কাছ থেকে রিয়া এমন এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত উপহার পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছিল।
জায়গাটার একটা ছোট্ট ভিডিও তুলে রিয়া ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছিল।সেইথেকে শিমুলচাঁপা গ্রামটা ভাইরাল হয়ে যায়।তাই এখন কম,বেশি প্রায় সারা বছর ধরে শিমুলচাঁপায় পর্যটকদের আনাগোনা লেগে আছে।
তবে ভ্যালেনটাইন্স ডের সময় এ গাঁয়ে সাজো,সাজো রব পড়ে যায়। এই সময় আবার আদিবাসিদের বাঁধনা পরব পড়ে।ঘর,দ্বোর সব পরিস্কার,নিকানো উঠোন।মাটির দেওয়ালে আঙুল দিয়ে নানা রকমের নক্সা ফুটিয়ে তোলা হয়।
এ বছর ভেলেন্টাইন্স ডে টিকে এই ছোট্ট আদিবাসি গাঁয়ের প্রায় সকলে মনে রেখেছে। শহর থেকে প্রমের দেব,দেবীরা আসবে তাদের কুলায়। তারা চায়,সকলের মনে হাসি ফুটুক। নিখাদ প্রেম জেগে উঠুক।
বিদ্যালয় প্রায় ফাঁকা। মাত্র পাঁচ,ছয়টা ছেলে,মেয়ে এসেছে।যেখানে,প্রতিদিন গড় হাজিরা মোটামুটি পঞ্চাশ থাকে।
তাই এলাকার প্রাথমিক ইস্কুলের মাষ্টারমশাই অধৈর্য্য হয়ে নীলমনির কাছে জানতে চাইলেন, আচ্ছা নীলমনি, আজ কী তোমাদের গ্রামে কোন পরব আছে? আজ তো কোন ছুটিও নেই।তাহলে বাকি ছেলে, মেয়েরা সব কোথায় ?
নীলমনি হাঁসদা, এ বছর ক্লাস ফোরে প্রথম হয়েছে। তার বাবা একজন ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী।তার বাবার বাজে স্বভাব না থাকলে এখন সে দুর্গাপুরে হয়তো কোন ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। তবু সে ইংরেজিটা ভালই পারে।
ভেলেন্টাইন্স ডে কথাটার বাংলা মানে সে বোঝে। তাই গালদুটো লজ্জায় সামান্য টোল খেল। তাতে মাষ্টারমশাই আরো একটু অবাক হলেন। বললেন, লজ্জা পাচ্ছো কেন?
--স্যার আজ আমাদের গাঁয়ে ভেলেন্টাইন ডে এর পরব বসেছে।
কথাটা শুনে মাষ্টারের ভ্রু যুগল উঁচু হতে হতে সে প্রায় মাথায় ঠেকে যাওয়ার উপক্রম।
বললেন,সে আবার কেমন পরব?
---আমার সাথে গিয়ে একবার দেখে আসবেন চলুন।
কি ভেবে মাস্টারমশাই সত্যি সত্যিই নীলমনির সাথে চলতে শুরু করলেন।ভ্যালেনটাইন্স ডের পরব, কেমন হয়? তাকে দেখতেই হবে।