Maheshwar Maji

Others

2  

Maheshwar Maji

Others

স্বপ্নলতা

স্বপ্নলতা

5 mins
870


অলকা ছাদের উপর দাঁড়িয়ে অবাকভাবে লাউ মাচাটার দিকে তাকিয়ে আছে।

সবেমাত্র স্নান সেরে এক বালতি কাচা কাপড় নিয়ে উঠে এসেছে।এখনো অর্ধেক মেলতে আছে।এরই মধ্যে তার নজর হঠাৎ করে লাউ গাছটার দিকে আটকে গেল।

মাস দেড়েক আগে লাউ চারাটা অলকাই এঁদো ডোবার ধার থেকে উঠিয়ে আঙনের এক পাশে লাগিয়ে ছিল।তার শাশুড়ীমা বলেন,বউমার হাত ভাল।তার হাতের ছোঁয়ায় যে কোন বীজ হোক বা চারাগাছ একেবারে ডালে,পালায় মাত লেগে যায়।

এই লাউ গাছটাই যেমন,যখন আনা হয়ে ছিল।বাঁচবে বলে সেও ভাবেনি।ওঠাবার সময় দুটো শেকড়ও ছিড়ে গেছিল।সবে তখন দু,তিনটে পাতা পরিণত হয়েছিল।উঠোনে লাগানোর সময় সেগুলোও মুর্ছা গেছিল।

সেই গাছটা দুবেলা অলকার ছোঁয়া পেয়ে সত্যি,সত্যিই নতুনভাবে জেগে উঠল।পুরনো পাতা কটা খসিয়ে নতুন পাতা নিয়ে তরতর করে বড় হতে লাগল।হাত,পা বড় হতেই সে দৌড় শুরু করল পাঁচিল বেয়ে।তখনি অলকা একদিন তার স্বামী সৈকতকে অনুরোধ করল একটা মাচা করে দিতে।

সৈকতের আবার এসবে একদম মন নেয়।সারাদিন গাড়ির চক্করে ঘুরে বেড়ায়।বছর দুয়েক আগে ব্যাঙ্ক থেকে ডাউন প্যামেন্ট করে এই ছোট গাড়িখানা কিনেছে।এ বছর ইন্সটলমেন্ট শেষ হল।তবু তার ব্যস্ততা এতটুকুও কমেনি।সময়ে না চান হয়,না খাওয়া।ফোন বাজলেই হল।দে দৌড়।মোড়ের মাথায় দাঁড় করানো থাকে গাড়িটা।সব রকমই মাল চালাতে হয়।একে তো রাত করে বাড়ি ফেরে তার উপর ভোর হতে না হতেই মাছপাটিদের হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়।মাঝে,মাঝে অলকার বিরক্তি এসে যায়।রাতের এইটুকু সময় তো স্বামীকে কাছে পায়।জড়িয়ে ধরে একটু আদর করারও জো নেয়।আজ দুবছর হতে চলল।সৈকতকে সে আগের মত করে কাছে পায় না।ভোরের সোহাগে আলাদা একটা গন্ধ থাকে।সেই আদরের গন্ধটা বিয়ের বছরই কেবলমাত্র অলকা পেয়েছিল।তারপর যেই স্বামীর মাথায় ওই গাড়ির চিন্তা এসে ভর করল।ব্যাস...সব শেষ।

অলকা প্রতি রাতের শেষে ভাবে আজ আর সৈকতকে কিছুতেই যেতে দেবে না।সকলের হাঁকডাকে সংসারসুদ্ধ জেগে উঠুক।তবু সে কিছুতেই স্বামীর ওমটুকু হাতছাড়া করবে না।মানুষের ভাবনা আর বাস্তবের তাগিদের যুদ্ধে অলকার ইচ্ছেগুলোই হেরে যায় প্রতিবার।

তবু যে সেবার সৈকত এত ব্যস্ততার মধ্যেও অলকার কথা মতো লাউ-এর মাচাটা করে দিয়েছিল সেটাই অনেক।

অলকা মনে,মনে ভাবে,তার বুকের শিশুটি স্বামীর তৈরি বিছানায় কত আয়েস করে শুয়ে আছে!

ঘন লোমস সবুজ পাতার ফাঁকে সাদা,সাদা ফুলগুলো যেন খুশির স্বর্গ রচনা করেছে!

   শাশুড়ীমার ডাকে অলকার ভাবনায় ছেদ পড়ল।

  কী হল বউমা?...অমন করে তাকিয়ে আছো যে!...কতক্ষণ ধরে নিচ থেকে ডাক দিচ্ছি...শুনতে পাওনি বুঝি?ওদিকে চুলোটা যে জুড়িয়ে জল হয়ে গেল!...তাছাড়া তোমার শ্বশুর এখনো দাঁড়িয়ে আছে।চাট্টি খেয়েই তো গাইদুটো মাঠে নিয়ে যাবে।অন্যদিন তো বেরিয়ে যায়!...আর তুমি সেই কখন থেকে বাচ্চা মেয়ের মতো মাচার দিকে তাকিয়ে রূপকথা বুনছো!...সত্যি পারোও বটে।দিন,দিন তোমার বয়স কমছে মনে হয়।এসো...নেমে এসো।ভেজা কাপড়খানা পর্যন্ত গায়ে শুকিয়ে গেল!...এভাবে শরীর খারাপ করবে নাতো কী..হ্যাঁ?


কুমোর কাকীমা জিদ ধরে বসে রইল।একটা মাত্র কলসীই বেচে আছে।এটা যাহোক করে নিতেই হবে।

অলকার ইচ্ছে নেই।মাটির কলসী আজকাল তেমন কাজে আসে না।তবু দু,একটা কিনে রাখতে হয়।বিভিন্ন রকম আচার,অনুষ্ঠানে কাজে লাগে।বাড়িতে নতুন দুটো কলসী আগেভাগেই পড়ে আছে।হাত লাগানো হয়নি।এর পর আর একটা নেওয়া মানে,বিলাসিতা।শাশুড়ীরও সায় নেই।এক সময় তো অলকা বলেই ফেলল,এক সের না পাঁচ পুয়ো চাল দেব কাকিমা।যদি রাজি থাকো,রেখে যাও।

কুমোরকাকীমা একরাশ বিরক্তি ঝেড়ে বলে উঠল,শ্বশুরের ধনকে বড় মায়া দেখছি তোমার।তা নাও।তোমার কথাই রইল।এতটা রাস্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার থেকে ভাল,তোমার ঘরেই পড়ে থাক।তবে একটা কথা রাখতে হবে মা।

 কথাটা বলেই আঙনের চারিদিকে কাকীমাটি একবার চোখ ঘুরিয়ে বলে উঠল,এবেলা তরকারি পাতি কিছুই জোগাড় হয়নি গো।অল্প মতো লাউ ডগি দাও দেখি।অনেকদিন খাইনি গো এমন সুন্দর মাচার লতা!

কথাটা শুনে প্রথমটাই অলকার মাথাটা একদম জ্বলে উঠল।ঝাঁজিয়ে বলে উঠল,ধন্যি তোমার পোড়া নজর গো কাকীমা।ও গাছ সবে পাতা মেলে উঠতে শুরু করেছে।এখনো একটা লাউ এলো না।আর এরই মধ্যে ওর লতা,পাতার দিকে তুমি নজর দিচ্ছো?লাউ আসুক।তখন বরং একটা নিয়ে যেও।

উত্তরে কাকীমাটি অল্প হেসে বলে উঠল,বয়সটা তো আমার কম হল না মা।গাছ চিনতে আমি ঢের জানি।এ গাছে লাউ আসবে না।এই বলে দিলাম।মিলিয়ে নিও।এখনো সময় আছে,লতাই কেটে খেয়ে নাও।স্বাদ পাবে।পরে তাও পাবে না।সব গাছে ফল আসে না মা।দাও তবে একটা পেঁপেই দাও।দু ফালা করে ভাতের সাথে সেদ্ধ করে নেব।

কাকীমাটি যাওয়ার পরও অলকার মনটা অনেকক্ষণ ভারি হয়ে রইল।বার,বার চোখজোড়া লাউ মাচাটার দিকেই ঘুরে যাচ্ছে।মনের ভেতর একটা গোপন দুঃখ তার অন্তরটাকে উইপোকার মত কুরেকুরে খাচ্ছে যেন।

সত্যিই তো সব গাছে ফল হয় না।তবে কী সে নিজেও ওই লাউ গাছটার মতো নিষ্ফলা?

আজ তিন বছর পেরিয়ে গেল।এখনো তো তার গর্ভে কোন সংবাদ এলো না।


রাতের দিকে একটা ভয়ানক স্বপ্ন দেখে অলকা চেঁচিয়ে উঠল।

সৈকত সাথে,সাথেই ওঠে বসল।কামরার কম আলোতেও অলকার মুখটা উজ্বলভাবে দেখা যাচ্ছে।সারা মুখে ঘাম জমেছে।সৈকত অবাক হল।বলে উঠল,নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছ?তা হঠাৎ কীসের ভয় এত?আমি তো আছি।

অলকা বলতে গিয়েও পারল না।শুধু সৈকতের বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠল,আমি কী আর কোনদিনও মা হতে পারবো না?..বলো নাগো?

সৈকত অলকার মাথায় হাত বুলিয়ে পাশে শুইয়ে দিয়ে বলে উঠল,কে বলেছে পারবে না?ডাক্তার তো না বলেননি।শুধু সময় লাগবে।ধৈর্য ধরতে বলেছেন।

অলকা সৈকতের একটা হাত আঁকড়ে বলে উঠল,সব গাছে তো ফল হয় না গো।তেমনি যদি আমারো কোন সন্তান না হয়!

----পুরুষ মানুষ যেমন সন্তান ধারণ করতে পারে না।তেমনি কিছু,কিছু গাছও পুরুষ হয়ে জন্ম নেয়।তাই তাদের ফল হয় না।কে তোমার মধ্যে এসব ভয় ঢোকাল বলো তো?...রাত অনেক হল শুয়ে পড়ো।


সংসারে কিছু,কিছু ঘটনা ঘটে, যার আগাগোড়া কিছুই ভালভাবে বোঝা যায় না।অথবা হতে পারে,ঘটনা তার নিয়ম মতো ঘটে।আমরা ঘটনার আগে,পরে কিছু কল্পনা মিশিয়ে সঠিক কারণটা ঢাক দিয়ে জটিল করে তুলি।

যেমনটা ঘটল অলকার বেলায়।তিনদিন পর জানা গেল অলকা গর্ভবতী।

তার শাশুড়ীমা দুদিন আগে তার বউমার পেটে সন্তান আসার কামনায় উপোস করে পুজো রেখেছিলেন।

সৈকত এই প্রথমবার মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত দূর্বলতার বশে এক গুণিনের কাছে গিয়েছিল নিজের অস্থিরতা কাটাতে।এক মাসের মধ্যে আশার আলো দেখার আশ্বাসও পেয়েছিল।

এদিকে অলকা নিজেও আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছিল,একটা লাউ গাছ তার গর্ভ থেকে বড় হতে,হতে তাদের পুরো আঙনটাকে ঘিরে ফেলেছে।লাউ-এ...লাউ-এ পরিপূর্ণ!..মৌমাছিরা গুন,গুন সুরে গান তুলেছে!..সারা পাড়ার লোককে সে নিজের হাতে কচি লাউ বিলিয়ে দিচ্ছে।

আবার ডাক্তারের শেষ কথাদুটোও অলকার অলীক স্বপ্নের ফানুসে আর একটু যেন হাওয়া ভরে দিল।

  এ সময় একটু খাওয়া,দাওয়া ঠিক মতো করো।সময় মতো ঘুমোবে।আর পারলে প্রতিদিন পাতে অল্প করে লাউ,কুমড়োর শাক রেখো।তাতে সন্তান পরিপুষ্ট হয়। কথাটা খেঁয়ালে রেখো।

   সৈকত রিক্সায় পা রেখে বলেই ফেলল,উঠোনের লাউ মাচাটা শেষে মান রাখল বটে।তা না হলে কোথায় প্রতিদিন শাক খুঁজতে বের হতাম?

অলকা কথা বলল না।এখনো সে তার রূপকথার জগতে হারিয়ে আছে।গর্ভের লাউগাছটাকে সযত্নে লালন করে চলেছে।


Rate this content
Log in