ডিসঅর্ডার
ডিসঅর্ডার


জানলার বাইরেটা মিশমিশে কালো।একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে ।
মন্দা বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল ।
যদিও এখন রাত একটা।
তবু মন্দার দুচোখে ঘুম নেই ।চেষ্টা করে ঘুমোবার, কিন্তু পারে না।চোখ বুজলেই সে একটা অচেনা চেহারা দেখতে পায়।
ভযঙ্কর তার চেহারা।
চোখ,মুখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে!
লোকটার লম্বা দুখানা হাত।হাতের ডগায় ফলার মতো ধারালো নখ।
দাঁত দিয়ে সবসময় কাঁচা রক্ত টসটস করে ঝরে পড়ছে।
লোকটার ঘাড়টা একদিকে কাত করা।সবসময় তাকে হাত নেড়ে ফিসফিস করে ডাকে,আয়...আয় বলছি।একবারটি সাহস করে চলে আয়।
আর তখনি মন্দার চোখদুটো খুলে যায় ।আর কিছুতেই ঘুম আসে না।এরকম প্রায় একমাস হতে চলছে।
সেইজন্য সারাদিন মাথাটা রপরপ করে।শীরা, ধমনীগুলো যেন যন্ত্রণাই ছিঁড়ে যেতে চায়।
দুপুরে অল্প ঘুম আসে বটে।
তবে সে ওই কিছুক্ষণ।আধঘন্টা পর আবার সেই বীভৎস চেহারা, খিলখিল করে রক্তমাখা দাঁতগুলো বের করে হেসে ওঠে।
তা দেখে মন্দার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে ।
গলা শুকিয়ে যায়।
কিছুতেই আর চোখের পাতা এক করতে পারে না।
নিখিল আগের মাসে যখন কারখানায় কাজে গেল হাওড়ায়।তখন মন্দা একবার তার এই ভয়ের কথা বলেছিল,আমার না খুব ভয় করে।মনে হয় কেও আমাকে সারাক্ষণ ডাকছে।
জেগে থাকলে মনে হয়।ঘরের কড়িকাঠ না হয় গরম বাতাস আমাকে ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে। আমাকে ওরা কোথাও নিয়ে যেতে চায় ।
নিখিল সেকথা শোনার পরের দিনই,পাশের গাঁয়ের এক গুণীনকে ডেকে এনেছিল।
সবাই তাকে "মদনফুঁকো" বলে ডাকে।
চোখে,মুখে ফুঁ দিয়ে কালো ছায়া অথবা ডাইন,ভূত নামিয়ে দেন।
সারা বছর ধরে বাড়িতে মা মনসার পূজো করেন।মন্ত্রশক্তি আছে।মা মনসার পা ঠেকিয়ে ফুল,বেলপাতা দিয়ে তাবিজ,মাদুলি বানিয়ে দেন।
সেইসব ধারণ করলে কোন অশরীরী ভয় কাছে ঘেঁষতে পারে না।
সেইরকম একটা তাবিজ মন্দার গলায় পরিয়ে নিখিল কাজে চলে যায় ।
মন্দার ভয় তবু যায়নি।দিন সাতেকেও কোন উপকার না পেয়ে মন্দা, তাবিজটা গলা থেকে খুলে পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিল।
বাড়িতে শ্বশুরমশাই আছেন।শাশুড়িও নানা কাজে হাত জোটান।মন্দার দিন,দিন নিস্তেজ হয়ে যাওয়া তাদের চোখেও এড়ায়নি।
তারা আরো ভাল গুণীনের খোঁজ করেন।
সেই সূত্রেই কিছুদিন পর একজন ফকিরবাবার সন্ধান পাওয়া যায় ।
জাতে তিনি মুসলমান।তবে ভূত,প্রেতের কোন জাত থাকে না।তাই তাকে ডাকা হল।পাশের একটা চালায়।চাটায় পেতে তিনি সেখানে বসে পড়লেন। রেশমের চাদর পেতে ধুনোর ধুয়োই মরা পশুর খুলি দিয়ে তন্ত্রবিদ্যা শুরু করেছিলেন।
মন্দাকে সেখানে কিছুক্ষণ পর ডাকা হয়। সামনে বসিয়ে ফকিরবাবা তার মাথায় ময়ূরপেখম বুলিয়ে দিয়ছিলেন।তারপর জোর গলায় বলে উঠেছিলেন,অব যা বেটি।দুনিয়ার কোন কালা ছায়া তোকে ছু নেহি পাএগা।
তারপরেও মন্দার ভয় যায়নি।
বীভৎস চেহারাটা যেন তাকে না নিয়ে যাবে না।
সেদিন সকালবেলা।
মন্দার পাঁচ বছেরের ছেলেটা পাড়ায় বন্ধুদের সাথে খেলতে বেরিয়েছিল।আর তিন বছরের মেয়েটা ঠাকুমার হাত ধরে অঙ্গনবাড়ি গেছিল,ডিম খিচুড়ি খেতে।
ঽঠাৎ পাড়াময় হায়,হায় রব উঠল।
মন্দা ভিজে কাপড়ে ঘরের কড়িকাঠে ঝুলে পড়েছে।পাড়ার লোকজন মিলে যখন গলার রশি কেটে নামালেন।মন্দার কাপড়ের জল তখনো টপটপ করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল বেয়ে ঝরে পড়ছিল।
পারিবারিক কোন বাদ,বিবাদ নেই।নিখিলের সাথে মনোমালিন্যের কোন খবরও কেউ শোনেনি।
তবু মন্দা আত্মহত্যা করে মারা গেল।শারীরীক কোন রোগভোগ ছিল না।তবু কেন এমনটা ঘটল?
তার উত্তরও মানুষ পেয়ে গেল।
ভূতে টেনেছে।
বাস্তুদোষ।
এর আগে এ বাড়িতে এরকম ঘটনা নাকি আগেও ঘটেছে।নিখিলের দাদু এবং তার দাদুর মাও নাকি এভাবে ভূতের টানে আত্মহত্যা করে মারা গেছেন।
এ ভূত ভিটেতেই ঘোরাফেরা করছে।তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও বসবাস করতে হবে
তবে মন্দার মৃত্যুর দিন সাতেক পর ভুবন ডাক্তার এসে চুকচুক শব্দ করে নিখিলদের দাওয়ায় মজলিসের মাঝে বলে উঠলেন,মেয়েটাকে বাঁচান যেত।আমি যদি ওর কথাটা সেদিন তোড়জোড়ের মুখে না শুনে ,একটু শান্ত মনে শুনতাম।এ অঘটনটা কিছুতেই ঘটতে দিতাম না।
মেয়েটা হাতজোড় করে আমাকে একদিন বলেছিল,কাকু আমাকে বাঁচান।আজ একমাস ধরে দুচোখে ঘুম নেই।খালি একটা শব্দ আর একটা চেহারা আমার জীবনটাকে দুর্বিসহ করে তুলেছে।
ঘুমোলে ভয় দেখায় আর জাগলে পরে সারাক্ষণ চমকাই।এ থেকে কি কোনভাবেই নিস্তার নেই ডাক্তারকাকু?
পাশের গাঁয়ে তখন আমি রুগী দেখতে বেরিয়ে ছিলাম। পেছনে প্রচন্ড তাড়া ছিল।একটা ছেলের হঠাৎ জ্বর বেড়ে গেছে।তাই বার,বার মোবাইলে কল ঢুকছিল।এতকিছু ঝামেলার মধ্যে মেয়েটার সব কথাগুলো ভালমতো কানে ঢোকেনি।
যেটুকু ঢুকেছিল,পরে ছেলেটার কন্ডিশন খারাপ দেখে,সেটুকুও মন থেকে পুরোপুরি মুছে গেছিল।
গতকাল যখন মেয়েটার মৃত্যুসংবাদ পেলাম।তারপর থেকেই মনটা বিষাদে ভরে আছে।
আসলে,এটা এক ধরনের মনের রোগ।এখন এসব রোগের চিকিৎসা হয় ।
সাইকো ডিসঅর্ডার।
কথাটা শুনে সবাই কেমন যেন মুখ করে ভুবন ডাক্তারকে দেখতে লাগলেন।