Sayandipa সায়নদীপা

Classics Inspirational

5  

Sayandipa সায়নদীপা

Classics Inspirational

সালিশি

সালিশি

7 mins
900


একটি সংবাদপত্রের ছোট্ট একটি খবরের শিরোনাম:


অশ্লীল পোশাকে আধা সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, অভিভাবকদের মধ্যে চাঞ্চল্য 


সমগ্র খবরটা পড়ার প্রয়োজন নেই, শিরোনামটুকুই যথেষ্ট বাঙালীর বৈঠকি আড্ডার জন্য, ক্রমাগত রসাতলের দিকে এগিয়ে যাওয়া দেশকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার জন্য। 


★★★




হানিমুন থেকে ফিরে স্কুলে ঢোকার মুহূর্তেই অস্বস্তিটা টের পেয়েছিল রুচিরা। পরিচিত স্কুলটা কেমন যেন অন্যরকম লাগতে শুরু করেছিল। প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারেনি কিন্তু বোমটা ফাটল স্টাফ রুমে ঢুকতেই। রুচিরাকে দরজায় দেখেই বিগত দুই বছরের পরিচিত সহকর্মীদের মধ্যে কী রকম একটা গুজগুজ ফুসফুস শুরু হয়ে গেল। ভ্রূ' কুঁচকে গেল রুচিরার। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে পাশে বসে থাকা সহকর্মী বৃন্দাকে বলার চেষ্টা করল, "কি গো, ভাল আছ?" 

"হ্যাঁ রে। তুই তো দিব্যি আছিস জানি।" 

হাসল রুচিরা। ধরে নিল নতুন বিয়ে হয়েছে তার, সেই অর্থে বৃন্দা বলেছে কথাটা। পাশ থেকে তুলি দি বলে উঠলেন, "তোমার ছবিগুলো দেখলাম ফেসবুকে।"

আবারও মিষ্টি করে হাসল রুচিরা। তারা বিয়ের পর হানিমুনে গোয়া গিয়েছিল, ভীষণ আনন্দ করেছে সেখানে। তারই ছবি দিয়েছিল ফেসবুকে। পর্ণা দি, একটু সিনিয়র। আর তিন বছর পরে রিটায়ারমেন্ট। এবার পর্ণা দি বলে উঠলেন, "তুমি এমনিও ওই সব পোশাক পর নাকি গোয়া বলেই পরেছিলে?" 

পর্ণা দি'র কথাটা কেমন যেন বক্রোক্তির মত লাগল কানে, তবুও রুচিরা রিয়াক্ট করল না। পর্ণা দি বয়স্ক মানুষ, তাই হয়ত একটু রক্ষণশীল। তাই রুচিরা ভদ্রভাবেই জবাব দিল, "কিছু পোশাক বেড়াতে গেলেই শুধু পরি।"

"বিয়ে তো এই সবে মাত্র হল, আগে নিশ্চয় মা বাবার সঙ্গেই যেতে?"

"হ্যাঁ, আর কার সঙ্গে যাব?"

"মা বাবা কিছু বলত না?"

"না, কী বলবে!"

"ওহ।" ছোট্ট কথাটাই মুখ বাঁকিয়ে বেশ কায়দা করে বলল পর্ণা দি। খারাপ লাগল রুচিরার। তাকে কেউ অপমান করলে সে হজম করে নিতেও পারে কিন্তু তার মা বাবাকে করলে নয়। রুচিরা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, "কী ব্যাপার বলুন তো পর্ণা দি, কিছু কী হয়েছে?"

"না না, কী আবার হবে!" আবারও বাঁকিয়ে জবাব দিলেন তিনি। 

কী হচ্ছে কারণ ভাবতে ভাবতেই রুচিরার ডাক এল হেড মিস্ট্রেসের রুম থেকে…



★★★



"আপনি একজন শিক্ষিকা হয়ে এরকম অবিবেচকের মত কাজ কিভাবে করতে পারলেন?"

প্রশ্নটা ধেয়ে এল একজন অভিভাবকের থেকে। 

  আজ থেকে ঠিক দু' দিন আগে হানিমুন থেকে ফিরে স্কুলে জয়েন করার দিনই হেড মিস্ট্রেসের রুমে ডাক পড়ে তার। সেখানে গিয়ে জানতে পারে হানিমুনে গিয়ে অশ্লীল পোশাক পরে হাজব্যান্ডের সঙ্গে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করায় নাকি স্কুলের মানসম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে, অভিভাবকরা ক্ষেপে উঠেছেন। গতকালই কোনো এক ক্ষিপ্ত অভিভাবকের বিক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ ঘটনাটি একটি স্থানীয় সংবাদপত্রেও স্থান পেয়েছে। তাই সেই সব কিছুর ফলস্বরূপ আজকে স্কুলের প্রাঙ্গণেই এই খাপ পঞ্চায়েত বসানো হয়েছে। স্কুলের সকল শিক্ষিকা, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যসহ অভিভাবকরা সকলেই উপস্থিত রয়েছেন এখানে। যদিও বলা হয়েছে একটা আলোচনা হবে কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে এটাকে একটা গ্রাম্য সালিশি সভার বেশি কিছু বলে ভাবতে পারছে না রুচিরা। এখানে অপরাধীর মত তাকে অদৃশ্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। 


"আপনি একজন শিক্ষিকা হয়ে এরকম অবিবেচকের মত কাজ কিভাবে করতে পারলেন?"

ধেয়ে এল প্রশ্নটা। একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল রুচিরা। তারপর যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলল, "কোনটা অনুগ্রহ করে যদি একটু বলেন তাহলে খুব ভালো হয়।"

"আপনি জানেন না কোনটা?" গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্য। রুচিরা উত্তর দিল, "ভাসা ভাসা কিছু শুনেছি, তবে সেটা আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য একটা পর্যাপ্ত কারণ বলে মনে হয়নি।"

"পর্যাপ্ত কারণ নয় বলছেন কী করে! একজন শিক্ষিকা হয়ে গোয়ার বিচে দাঁড়িয়ে ওরকম অশ্লীল পোশাক পরে ছবি তোলার আগে নিজের পেশার কথা একবারও মনে পড়ল না?" কোনো এক ছাত্রীর মা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন কথাগুলো। মৃদু হাসল রুচিরা, "পেশার কথা নতুন করে কেন মনে করতে হবে! আমার পেশা তো আমার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে।"

"তাই নাকি? তাহলে ঐ পোশাক পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ছাড়লেন কোন হিসেবে? আপনি তো অংকের দিদিমণি, এতটা বেহিসেবি আপনি কি করে হয়ে গেলেন?"

"হিসেবটা মেলানোর জন্য আমাকে আগে বলুন তো, আমার অপরাধ ঠিক কোনটা- ওই পোশাক পরাটা নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই ছবি দেওয়াটা?" দৃঢ় গলায় জানতে চাইল রুচিরা। উপস্থিত জনতার মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। একটু পরেই অবশ্য উত্তর এল, "যদি বলি দুটোই।"

"আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করেন না?" জানতে চাইল রুচিরা। উত্তর এল, "ছবি পোস্ট করা আর এই ছবি আলাদা জিনিস।'' 

"কীরকম?"

"এইরকম পোশাক পরে।"

"তাহলে বলছেন এরকম পোশাক আমি পরতেই পারি কিন্তু সেই ছবি দেওয়া চলবে না। তাই তো?"

"একজন শিক্ষিকা হয়ে হট প্যান্ট পরার রুচি কী করে হয়?"

"একজন শিক্ষক, ডাক্তার ইত্যাদি হয়ে মদ্যপান ও ধুম্রপানের রুচি কী করে হয়?" এবার পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রুচিরা। জবাব এল সহজেই, "কথা ঘোরাবেন না?"

"এটাকে কথা ঘোরানো নয়, যুক্তি দেওয়া বলে। বিচার সভা বসলেই যুক্তি তর্ক থাকবেই।"

"প্রাসঙ্গিক যুক্তি দিন।"

"সেটাই দিচ্ছি। একজন শিক্ষক ও ডাক্তার জানেন মদ্যপান ও ধুম্রপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, তাও তারা অভ্যেস ছাড়তে পারেন না। আমি তো একটা পোশাক পরেছি মাত্র, এতে কারুর তো কোনো ক্ষতি হওয়ার নেই?"

"ক্ষতি হওয়ার নেই? আপনাকে ওই পোশাকে আপনার ছাত্রীরা দেখছি, তাদের মধ্যে এর কী প্রভাব পড়বে?"

"আমার মতে কোনো প্রভাব পড়বে না।"

"বাহ চমৎকার! একজন শিক্ষিকার থেকেই তো ওরা শেখে।" 

"তাই যদি বলেন তাহলে তো আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রথম শিক্ষিকা আমাদের মা। আমাদের মায়েরা যাই পোশাক পরে তার প্রভাব তো সবার আগে পড়বে আমাদের মধ্যে। নিজেদের পোশাক সম্বন্ধে আপনারা নিজেরাই অবহিত, তাই তার কথা বর্ণনা করে আমি সময়ের অপচয় করব না।"

"আপনি বারবার কথা ঘোরাচ্ছেন। শিক্ষিকার ব্যাপার আলাদা।"

"সত্যিই তো তাই। শিক্ষিকাদের ব্যাপারে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও কিছু নয়। শিক্ষিকাদের সবসময় অন্যদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। কে কী বলবে না বলবে ভাবতে হয়। ২০১০ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে শিক্ষিকারা চাইলেই সালোয়ার কামিজ পরে স্কুলে আসতে পারেন। শিক্ষিকাদের সালোয়ার কামিজ পরতে দেওয়ার দাবিতে যে পিটিশন জমা পড়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় বিচারক জয়ন্ত বিশ্বাস বলেছিলেন, 

''The teachers are educated enough and know about the decency of their dress. So, the school authority need not impose a dress code on them."

অথচ মজার ব্যাপার দেখুন, আজও আমাদের স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুলে নানান অজুহাতে সালোয়ার পরে আসতে দেওয়া হয় না। ড্রেস কোড হিসেবে শাড়িকেই চাপিয়ে দেওয়া হয়।"

"আপনি বলতে চান আপনার গোয়ার পোশাকটি ডিসেন্ট ছিল?" রুচিরা চিনতে পারল ভদ্রলোককে। তার শ্বশুরবাড়ির পাশের পাড়াতেই থাকেন। নিজের মনেই মুচকি হাসল রুচিরা। তারপর বলল,

"আপনি যখন সকালে কলে জল নেন তখন দেখি পরনে শুধুমাত্র একটি বারমুডা থাকে। আমি যদি খুব ভুল না করি তাহলে আপনিও সম্ভবত একজন শিক্ষক।"

ভদ্রলোক এবার উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, "আমি বাড়িতে কী পোশাক পরি না পরি সেই প্রসঙ্গ এখানে তোলার কি কোনো প্রয়োজন রয়েছে?"

"আমারও তো সেটাই প্রশ্ন। আমি হানিমুনে গিয়ে কী পোশাক পরলাম না পরলাম তা নিয়ে স্কুলে এত সমস্যা হচ্ছে কেন? বিগত দুই বছরে একটা দিনও কি আমায় এমন কোনো পোশাক পরে স্কুলে আসতে দেখেছেন যেটা একজন শিক্ষিকার ক্ষেত্রে বেমানান? আমিও বিশ্বাস করি একজনকে তার পেশার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয় এবং পেশাক্ষেত্রে যাওয়ার সময় মানানসই পোশাক পরতে হয়। কিন্তু পেশার বাইরেও তো আমাদের একটা ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে, তাই না? ওনার যেমন কলে জল নেওয়াটা ব্যক্তিগত জীবনের অঙ্গ, তেমনই আমার বেড়াতে যাওয়াটা ব্যক্তিগত জীবনের অঙ্গ।"

আবারও চাপা গুঞ্জন শুরু হল। কয়েক মুহূর্ত পর এক অভিভাবিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, "কিন্তু সোস্যাল মিডিয়ায় ছবি দেওয়ার আগে ভাবলেন না যে আপনার ছাত্রীরাও দেখবে সেটা?"

রুচিরা মুখটা গম্ভীর করে বলল, "ছবি দেওয়ার সময় এটা সত্যিই আমার মাথায় আসেনি।"

হাসি ফুটে উঠল সেই অভিভাবিকার মুখে, কিছু একটা বলতে গেলেন তিনি, কিন্তু তার আগেই রুচিরা আবার বলে উঠল, "কিন্তু ব্যাপারটা হল আমি তো সব ছোট ছোট শিশু কিশোরীদের পড়াই। এরা তো কেউ প্রাপ্ত বয়স্ক নয়। তাহলে ফেসবুকের ছবি এরা দেখল কেমন করে?" 

"আজকালকার বাচ্চারা অনেক এডভান্স। ফোনের সব ঘাঁতঘোঁৎ জানে।"

"কিন্তু ওদের ফোনটা তো আমি দিইনি। ফোনের সব ঘাঁতঘোঁৎও আমি শেখাইনি। আর আমি বিশ্বাস করি এটা ওদের ফেসবুক করার বয়স নয়। তা সত্ত্বেও ওরা ফেসবুক করছে, আপনাদের কথা মত এমন কিছু দেখছে যা ওদের দেখার কথা নয়। তাহলে? এর জন্য সালিশি সভা বসবে না?"

এবার আর জনতার মধ্যে গুঞ্জন দেখা গেল না। রুচিরা দেখল তার সামনে উপস্থিত জনতার মুখগুলো আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। রুচিরা সুযোগ পেয়ে আবারও বলে উঠল, "আমাদের প্রত্যেকের পেশার বাইরে একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে যেটা তার একান্ত নিজস্ব। সোশ্যাল মিডিয়াও তারই অংশ। একজন পুরুষ শিক্ষক হানিমুনে গিয়ে নগ্ন শরীরে সমুদ্র স্নান করলে বিতর্ক ওঠে না কিন্তু একজন মহিলা হট প্যান্ট আর টপ পরলে স্কুলে সালিশি সভা বসে যায়। আর কতদিন মেয়েদেরকে এভাবে পোশাকের দাঁড়িপাল্লায় মাপবেন বলতে পারেন? বাচ্চারা তো বলে আমার কাছে পড়তে তাদের ভালোই লাগে। অনেক অভিভাবকও বলেছেন একই কথা। তাহলে আজ হঠাৎ আমার একটা পোশাকে সেই সব মিথ্যে হয়ে গেল? আমি আজ হঠাৎ করে আমার ছাত্রীদের মধ্যে কু প্রভাব ফেলে দিলাম! বাহ, চমৎকার। আজকালকার বাচ্চারা অনেক এডভান্স কিন্তু তাদের অভিভাবক হয়ে আমরা কেন এডভান্স হতে পারি না, নিজেদের মনকে খুলে দিতে পারি না? আজ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও পোশাকের দাঁড়িপাল্লায় মেয়েদের মাপতে থাকি সেই উনিশ শতকের মত? কেন? কেউ একজন অন্তঃত উত্তর দিন।"


   হলে উপস্থিত প্রায় পঞ্চাশটা মুখে এখন আর উত্তর এল না। রুচিরার চুপ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘর জুড়ে নেমে এল পিন পড়ার নিস্তব্ধতা।


#inspiringwoman


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics