চিরসখা হে
চিরসখা হে
সুতপা এখনও বারান্দায়। শীতের রোদ্দুর বারান্দা থেকে নেমে অনেকক্ষণ দূরে সরে গেছে। উত্তুরে হাওয়ায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ও কিছু ভাবছে।
ভাবছে বুবিনের কথা। চার বছর বয়েস হয়ে গেল বুবিনের। অথচ এখনও কথা বলতে শিখল না। এমনকী মা বলতেও নয়। আগে কানেও সমস্যা ছিল। এখন শুনতে পায়। নানারকম আওয়াজ আর ইশারা করে বুবিন বোঝায় ওর খিদে পেয়েছে। কিংবা ওর ছবি আঁকতে ভালো লাগছে না। কোনও কথা বোঝাতে না পারলে বুবিন বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সহ্য করতে পারে না সুতপা। কান্না পায় ওর। বুবিনের চোখের আড়ালে গিয়ে ও তখন চুপ করে বসে থাকে।
কৃষ্ণেন্দু সুতপার মতো নয়। গৌতম সেনের ওপর ওর অগাধ আস্থা। সুতপা কান্নাকাটি করলে ও বলে, কেন নিজেকে মিছিমিছি কষ্ট দাও? আজকাল বুবিন কত তাড়াতাড়ি রি-অ্যাক্ট করে দেখেছ? ডক্টর সেন তো সেটাই বলেছিলেন। রি-অ্যাক্ট করতে পারলেই বুবিন কথা বলতে শিখে যাবে।
গৌতম সেন বিখ্যাত স্পিচ থেরাপিস্ট। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও স্পিচ ডিসঅর্ডারের বহু রোগী ওর কাছে আসে। ওর যোগ্যতা নিয়ে সুতপার মনে তিলমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু তবুও প্রত্যেকবার বুবিনের চেক আপের সময় সুতপা জিজ্ঞাসা করে, বুবিন কথা বলতে পারবে তো ডাক্তারবাবু? গৌতম সেন বলেন, আর একটু ধৈর্য ধরুন। বুবিন একদম গড়গড় করে কথা বলবে। বাড়ি ফিরে সুতপা অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে বলে, মা বল বুবিন--মা! বুবিন হাঁ করে। দুর্বোধ্য কিছু আওয়াজ বেরিয়ে আসে ওর গলা দিয়ে। কিন্তু সেই আওয়াজের ভিড়ে মা আছে কিনা সুতপা বুঝতে পারে না।
পাখিদের ডাকাডাকিতে সুতপার সম্বিত ফিরল। মাথার ওপর ছায়া-ছায়া আকাশ। শীত যেন জাঁকিয়ে পড়েছে। উঠে পড়ল সুতপা। বারান্দার লাগোয়া ঘরটা ওদের শোবার ঘর। আজ রবিবার। কৃষ্ণেন্দু আর বুবিন খাটে ঘুমোচ্ছে। ছুটির দিন মানেই কৃষ্ণেন্দুর দিবানিদ্রা। বাবার দেখাদেখি বুবিনেরও অভ্যেস হয়ে গেছে।
অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে আজ। সুতপা কিচেনে ঢুকল। এখন ওর প্রথম কাজ বুবিনের খাবার তৈরি করা। তারপর চা। ঘুম থেকে উঠেই কৃষ্ণেন্দু চা-চা করে অস্থির করে তুলবে।
সংসারের এই ব্যস্ততা সুতপার ভালো লাগে। একটা পরিপূর্ণতার অনুভূতি হয়। বিয়ের পর মেয়েরা যা চায় ও তার সবই পেয়েছে। শুধু যদি বুবিনটা কথা বলতে পারত---
নুডলস দেখে বুবিন খুব খুশি। নুডলস ওর সব থেকে প্রিয়। অন্য কিছু দিলে ঠোঁট সরু করে সশব্দে হাওয়া টেনে বোঝায় ওর নুডলস চাই। সুতপার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে ও পাশের ঘরে চলে গেল। খেতে খেতে কার্টুন চ্যানেল দেখবে।
চায়ে চুমুক দিয়ে কৃষ্ণেন্দু বলল, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।
কী কথা!
তুমি আবার গান গাওয়া শুরু করো সুতপা। কাল একটা সাইটে দেখছিলাম যে-সব বাচ্চার স্পিচ ডিসঅর্ডার আছে গান শুনলে ওদের কথা বলার ইচ্ছে আরও বেড়ে যায়।
সুতপা হাসল, আমি জানি তুমি গান শুনতে ভালোবাসো। তাই বুঝি বুবিনের দোহাই দিয়ে গান গাইতে বলছ?
কৃষ্ণেন্দু সুতপাকে চেনে। প্রচলিত নিয়মের বাইরে কোনওকিছু ওকে বিশ্বাস করাতে হলে প্রমাণ চাই। ও ল্যাপটপ খুলে একটা বিশেষ সাইট ডাউনলোড করল। তারপর ল্যাপটপটা সুতপার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, এই লেখাটা পড়ো। তা হলেই সব বুঝতে পারবে।
পড়ার পর সুতপা ভুরু কুঁচকে বলল, ডক্টর সেন তো এসব কথা কখনও বলেননি!
ডক্টর সেন ট্র্যাডিশনাল মেথডের ডাক্তার। অলটারনেটিভ মেথডের কথা নাও বলতে পারেন। তবে যদি এরপরেও কোনও সন্দেহ থাকে তুমি না হয় ওকেই একবার জিজ্ঞাসা করে নিয়ো।
এই জন্যেই কৃষ্ণেন্দুকে সুতপার এত ভালো লাগে।কখনও নিজের মত জোর করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয় না। কিন্তু ওই সাইটে যা লেখা আছে তা কি ঠিক? গান শুনলে বুবিন সত্যি ভালো হয়ে যাবে?
সুতপার আকুতিভরা দৃষ্টি এক দুর্নিবার আকর্ষণে খাটের পিছনদিকের দেওয়ালের ওপর আছড়ে পড়ল। ওখানে ওর তানপুরাটা ঝুলছে। এককালের প্রিয় সঙ্গী দু'বছরে অনেকটাই দূরে সরে গেছে।
কৃষ্ণেন্দু বলল, বুবিনের প্রবলেমটা জানার পর থেকে তুমি আর গান গাও না। কিছু বললে বলো ইচ্ছে করে না। তোমার গান শুনলে বুবিন যদি কথা বলতে পারে তা হলেও কি তুমি গাইবে না?
সুতপা কোনও উত্তর না দিয়ে এঁটো কাপদুটো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এখন ওর একটু ভাবার পরিসর চাই। কৃষ্ণেন্দুর চাওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে কোনও ভুল নেই। অন্য কেউ হলে সানন্দে মেনে নিত। কিন্তু সুতপা অন্যদের মতো নয়। গান ওর আনন্দ। ওর মুক্তি। সুর একবার ওর নাগাল পেলে সংসারের সব বন্ধন শুকনো পাতার মতো খসে পড়ে। তখন ও কারও স্ত্রী নয়, কারও মা নয়। তখন ও অনন্তের সাধক।
এই ভাবনাটাই বড়ো গোলমেলে। গান কি আর কেউ গায় না? সুতপা জানে গায়। আবার দিব্যি সংসারও করে। কিন্তু সুতপা পারে না। পারে না বলেই ও বুবিনের কথা ভেবে গান ছেড়ে দিয়েছিল।
ওর মনে হয়েছিল গান গাওয়ার থেকে বুবিনের কথা বলতে পারা বেশি জরুরি। এখন থেকে ও নিজের ভালোলাগার কথা আর ভাববে না। সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে ও শুধু বুবিনের জন্য কথা খুঁজবে।
কিন্তু এখন সুতপার মনে হচ্ছে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে ও পারেনি। ওয়েবসাইটের লেখাটা পড়ার পর থেকে ও তীব্র এক টানাপড়েনে আক্রান্ত। কে যেন ওর বুকের ভেতর থেকে ক্রমাগত বলে চলেছে, বুবিনের জন্য গান ছেড়ে তুমি সুখী হওনি সুতপা। সারাদিনে অজস্রবার তুমি সবার অলক্ষ্যে কাঙালের মতো তানপুরাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে। বাথরুমে শাওয়ারের নীচে তুমি কাঁদতে। যে ত্যাগে মনের সায় নেই সেটা আত্মপ্রতারণা। দু'বছর ধরে তুমি তাই করেছ। অবান্তর জেদ ছাড়ো। কৃষ্ণেন্দু যা বলছে মেনে নাও।
মাঝরাতে বারান্দায় একলা দাঁড়িয়ে সুতপা তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। বাবার কথা মনে পড়ছিল ওর। পরিমলের ইচ্ছাতেই সুতপার গান শেখা। সাধারণ শেখা নয় রীতিমতো ওস্তাদ গাইয়ের কাছে নাড়া বেঁধে শেখা। শুধুমাত্র গানের জন্য দিদির থেকে ও বেশি স্নেহ পেয়েছে বাবার কাছে। পরিমল বলতেন, একটা কথা সবসময় মনে রাখবি তপা। একজন দুঃখী মানুষ কখনও কাউকে আনন্দ দিতে পারে না। তাই গান কখনও ছাড়বি না। গান তোকে যে আনন্দ দেবে তুই সেই আনন্দ সংসারে বিলিয়ে দিবি।
ডক্টর গৌতম সেন মাসে একবার বুবিনকে দেখেন। এ মাসের ডেট আজ। কৃষ্ণেন্দুর অফিসে জরুরি মিটিং আছে। সুতপা নিয়ে যাবে বুবিনকে।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট চারটের সময়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সুতপা ল্যান্সডাউন রোডের চেম্বারে পৌঁছে গেল। ডক্টর সেন সময়ের ব্যাপারে খুব কড়া। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।
আধঘন্টা ধরে বুবিনকে নানাভাবে পরীক্ষা করে ডক্টর সেন বললেন, ছেলের প্রোগেস তো বেশ ভালো। বোধহয় আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
আজ সুতপা আগমার্কা প্রশ্নটা করল না। হেসে বলল, আমার হাজব্যান্ড বলছিলেন গান শুনলে নাকি এই ধরনের পেশেন্টদের কথা বলার ইচ্ছে আরও জোরালো হয়। কথাটা কি সত্যি ডক্টর সেন?
অফ কোর্স সত্যি! বিদেশে এই নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে৷ চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে লাউড মিউজিক নয়, হালকা কিছু।
বন্দি পাখি দৈবাৎ খাঁচার দরজা খোলা পেলে যে-তীব্রতায় আকাশের দিকে উড়ে যায় ঠিক সেইভাবে সুতপা বাড়ি ফিরল। যেটুকু বাধা ছিল তাও সরে গেছে। ওর অন্তর্লীন দুই সত্তা এক হয়ে গেছে। দীর্ঘ দ্বৈরথের পর মা আর শিল্পী একে অপরের পরিপূরক হতে পেরেছে শুধুমাত্র বুবিনের জন্য।
পরের দিনই ঢাকনা থেকে বেরিয়ে সুতপার চেনা স্পর্শ পেয়ে ঝংকার তুলল তানপুরা।
বুবিন বেশ অবাক। কিম্ভুতকিমাকার জিনিসটাকে ও আজন্ম দেওয়ালে ঝুলতেই দেখেছে। সেটা যে কোনওদিন দেওয়াল থেকে নামতে পারে এবং এমনি করে বাজতে পারে ও বোধহয় আশা করেনি।
ছেলের বিস্ময়ে অভিভূত সুতপা বলল, আমি গান গাইব বুবিন। দেখবি, তোর খুব ভালো লাগবে।
বুবিন প্রতিক্রিয়াহীন। গান ও শুনে থাকলেও তাকে যে গান বলে এই বোধ ওর ছিল না। নতুন কিছু একটা ঘটবে শুধু এই প্রত্যাশায় ও চেয়ে রইল মায়ের মুখের দিকে।
তানপুরা সুরে বাঁধতে বাঁধতে চিন্তা করছিল সুতপা। কী গান গাইবে ও? ক্লাসিকাল নাকি রবীন্দ্রনাথ? অনেক ভাবনাচিন্তার পর সুতপা রবীন্দ্রনাথের গান গাইল, সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে---
সুতপা উঁচুমাপের গায়িকা। গাওয়ার গুণে ওর মনের আশ্রয়ে সুখী বনের হরিণ ঘরের বাতাসে মূর্ত হয়ে উঠল। হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যায়। আদর করা যায়।
গান শেষ করে চোখ খুলল সুতপা। দেখল বুবিন পলকহীন চোখে তানপুরাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যেন তানপুরাটাই পৃথিবীর সব থেকে বড়ো বিস্ময়।
কথাটা মিথ্যে নয়। কথা বলতে পারে না বলে শব্দময় জগতের প্রতি বুবিনের তীব্র আকর্ষণ। বারান্দায় শালিখ ডাকলে ও দৌড়ে যায়। চড়ুইপাখিরা কিচিরমিচির করলে কান খাড়া করে শোনে। সুতপার গানের কথা বা সুর ও বোঝেনি। কিন্তু তানপুরার ছোট ছোট ঝংকার ওর মনকে বশ করে ফেলেছে।
সুতপা অবশ্য এসব বুঝল না। ওর মনে হল বুবিনের তানপুরার দিকে তাকিয়ে থাকা মানে গান শুনে ভালো লেগেছে৷ উৎসাহিত হয়ে ও আর একটা গান গাইল, শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর ওই ডালে ডালে---
আশ্চর্য! এবারও একই দৃশ্য৷ বুবিনের চোখ তানপুরার ওপর স্থির। সুতপা খুশিতে পাগল। ভাগ্যিস সাইটটা কৃষ্ণেন্দুর চোখে পড়েছিল। নয়তো এত সহজ একটা রাস্তার কথা জানাই যেত না।
রাতে কৃষ্ণেন্দু বাড়ি ফেরা মাত্র রিপোর্টিং করল সুতপা। এই সময়টায় কৃষ্ণেন্দু ছেলের সঙ্গে খেলে। ওর সঙ্গে অনর্গল কথা বলে। এটা গৌতম সেনের চিকিৎসারই একটা অঙ্গ। বুবিনের সঙ্গে কথা না বললে ওর কথা বলার ইচ্ছে হবে না। খেলতে খেলতে কৃষ্ণেন্দু বলল, তোমাকে কিন্তু লেগে থাকতে হবে সুতপা। চট করে কোনও রেজাল্ট আশা করো না।
সুতপা নির্বোধ নয়। ও জানে সময় লাগবে। তবে তারও একটা সীমা আছে। বেশি দেরি হবে না। হতে পারে না। বুবিনের রক্তে রয়েছে গান। গান শুনে সাড়া ও দেবেই।
প্রবল উদ্যোমে কাজ শুরু করে দিল সুতপা। সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে ওর অপেক্ষা শুরু হয়। কখন বিকেল হবে। বিকেল হলেই ও তানপুরা নিয়ে বসে। তারপর শুরু হয় গান। দিনের পর দিন এইভাবে চলতে থাকে। সুতপার প্রত্যাশার তীব্রতা ক্রমশ বেড়ে চলে। নিজের ওপর ওর আগাধ আস্থা। ও জানে বুবিন খুব শীঘ্রই কথা বলবে। ওর গান বুবিনকে অনাবিষ্কৃত কথার ভাণ্ডারের সন্ধান দেবে। মা হিসেবে এ যে ওর কত বড়ো পাওয়া তা বলে বোঝানো অসম্ভব।
ওদিকে বুবিনও অপেক্ষা করে বিকেলের জন্য।তানপুরাটার সঙ্গে ওর বেশ ভাব হয়ে গেছে। আজকাল তানপুরার সুর শুনতে শুনতে প্রায়শই ওর ঘুম পেয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে ও তানপুরা নিয়ে কার্টুনের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ে। চারিদিকে আঁকাবাঁকা পাহাড়। নদী আকাশ। হাতি গণ্ডার বাঘ সিংহ। দু'একটা আত্মভোলা মানুষ। ওদের কেউ কথা বলতে পারে না। সেই নিঃশব্দ পৃথিবীতে ওরা সবাই বুবিনের বাজনা শুনতে আসে। বাজনা শুনে ওরা অবাক হয়ে যায়। আশ্চর্য এক আনন্দের স্পর্শে ওদের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে।
দিন কেটে যায়। দেখতে দেখতে প্রায় দু'মাস কেটে গেল। কিন্তু বুবিনের কোনও উন্নতি হল না। সুতপার উৎসাহে এখন কিছুটা ভাটার টান। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ও অনেক কিছু আশা করে ফেলেছিল। তার কিছুই মেটেনি। সামান্যতম পরিবর্তনও দেখা যায়নি। ইদানীং ওর ধারণা হয়েছে, এভাবে কিছু হবে না। ডক্টর সেন সম্ভবত বুবিনের সমস্যাটা ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। অন্য কারও সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। কৃষ্ণেন্দু বোঝায়। সুতপার সংশয় দূর করার চেষ্টা করে। সুতপা শোনে কৃষ্ণেন্দুর কথা। কিন্তু ভরসা করতে পারে না। ওর মনে হয় বুবিন একদিন অপার নৈঃশব্দের মধ্যে হারিয়ে যাবে।
যদিও সুতপা গান এখনও বন্ধ করেনি। বিকেল হলে তানপুরাটা দেওয়াল থেকে নামায়। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই বুবিন ঘুমিয়ে পড়ে। অসহ্য টানাপড়েনে ক্ষতবিক্ষত সুতপা ভাবতে পারে না ওর সুরের মায়ায় বুবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। কৃষ্ণেন্দু বোঝালেও পারে না। নিজের ব্যর্থতাই ওর কাছে বড়ো হয়ে ওঠে। যেন বুবিনের কথা কথা বলতে না পারার জন্য ও দায়ী। ওরই কোনও পাপে কষ্ট পাচ্ছে বুবিন।
রবিবার দুপুরে বারান্দায় বসে সুতপা এইসব কথাই ভাবছিল। কৃষ্ণেন্দুর এক সহকর্মী অসুস্থ। ও তাকে দেখতে গেছে। বুবিন ঘুমোচ্ছে।
হঠাৎ একটা বিশ্রী শব্দে সুতপা চমকে উঠল। ওর প্রথমেই মনে হল বুবিনের কথা। বুবিন খাট থেকে পড়ে গেল না তো? প্রায় দৌড়ে বেডরুমে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সুতপা। না, বুবিনের কিছু হয়নি। তানপুরাটা দেওয়াল থেকে পড়ে দু'টুকরো হয়ে গেছে। বুবিন দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা তানপুরাটার পাশে।
তানপুরাটা যে কোনওদিন দেওয়াল থেকে পড়ে ভেঙে যেতে পারে সুতপা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। এখনও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। কতদিনের সঙ্গী! পরিমল কিনে দিয়েছিলেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাইলে রাগ করতেন পরিমল। বলতেন, হারমোনিয়ামের আওয়াজটা বড়ো কৃত্রিম। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবের সঙ্গে মেলে না। তুই তানপুরা বাজিয়ে গান কর তপা। সুতপা তাই করত। বিয়ের পর সুতপা যাতে গানের চর্চা করতে পারে তার জন্য তানপুরাটা এ বাড়িতে এসেছিল। পরিমল মাঝে মাঝেই আসতেন। এসে বলতেন, একটা গান কর মা, শুনি। কতদিন তোর গান শুনি না। মারা যাবার দু'সপ্তাহ আগে এসে আবদার করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা আজ একবার শোনাবি মা? সেই যে, চিরসখা হে---। শুনিয়েছিল সুতপা। সেদিনও সঙ্গী ছিল তানপুরাটা। আজ ওটা ভেঙে গেল। সুতপার মনে হল পরিমলের প্রাণশক্তিতে ভরপুর হাসিটাই বুঝি হারিয়ে গেল আজ।
নিজের ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিল সুতপা। গরমকাল। ঘরের দু'টো জানলাই খোলা। হঠাৎ দমকা হাওয়ার ঝাপটায় ওর সম্বিত ফিরে এল। চোখ পড়ল বুবিনের ওপর। খটকা লাগল সুতপার। বুবিনকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে বুবিন। কষ্টটা জোর করে গিলে ফেলে ছেলের পিঠে হাত রাখল সুতপা, তোর মাথায় পড়লে কী হত বল দেখি!
জানা কথা বুবিন কিছু বলবে না। সুতপা ভেবেছিল কথা না বলুক অন্তত ইশারা-টিশারা কিছু করবে। তাও করল না। যেমন পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। সুতপা দেখল বুবিনের ঠোঁট কাঁপছে। চোখে জল। আদর করে বলল, তানপুরা ভেঙে গেছে তো কী হয়েছে সোনা! বাবা আবার একটা কিনে দেবে। এখন চলো এখান থেকে।
বুবিন গেল না। সুতপা হাত ধরে টেনেও ওকে একচুল নড়াতে পারল না। ওর চোখের সামনে এখন কার্টুনের দুনিয়া। লাল নীল হলুদ পাহাড়। কথা না জানা হাতি বাঘ গণ্ডার। কথা না বলতে পারা একাবোকা মানুষ। আর মাঝখানে একটা ভাঙা তানপুরা। ওর বন্ধু। ওর চিরসখা। কত কথাই তো হত সারাদিন। আজও তো কথা বলবে বলেই দেওয়াল থেকে নামাতে চেয়েছিল বুবিন। ছোট্ট বুবিন। চার বছরের বুবিন। শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারেনি বন্ধুত্বের ভার।
বিধ্বস্ত বন্ধুর পাশে উবু হয়ে বসে পড়ল বুবিন। তারপর মায়ের মতো বাজাবার চেষ্টা করল। আর্তনাদ করে উঠল তানপুরা। সুতপা আঁতকে উঠে বলল, হাত কেটে যাবে বুবিন। চলে আয় বলছি।
এই প্রথম কোনও আওয়াজ নয়, ইশারা নয়, স্পষ্টতই দুটো শব্দ উচ্চারণ করল বুবিন, মা, গান!
সুতপা বিস্মিত। অপ্রত্যাশিত আনন্দে আত্মহারা। ছেলেকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে বলল, বুবিন তুই কথা বললি? আর একবার বল।
তানপুরার তারে হাত বুলিয়ে বুবিন বলল, মা, গান।
দুটি মাত্র শব্দ৷ তাতেই কানায় কানায় ভরে গেল সুতপার মন। কান্না গোপন করে বলল, হ্যাঁ বুবিন গান। আজ আমি সারাদিন গান গাইব। বাবা আসুক।
কৃষ্ণেন্দু ফোন পেল কিছুক্ষণ পর। সুতপা বিশ্ব জয় করার উচ্ছ্বাসে বলল, তুমি কোথায়? শীগগির বাড়ি এসো। বুবিন কথা বলছে।