Sucharita Das

Classics Inspirational

3.6  

Sucharita Das

Classics Inspirational

শেষ থেকে শুরু

শেষ থেকে শুরু

6 mins
1.7K


আজকাল হাঁটু দুটো তে ভীষণ ব্যথা করে।কে জানে কেন,বাতের ব্যথা ই হবে হয়তো। পঁয়ষট্টি বছরের নিরূপমা দেবী পা ছড়িয়ে বসে নিজের পা দুটোতে হাত বোলাতে থাকেন। কয়েকবছর আগেও যখন রিটায়ার হননি, স্কুলে শিক্ষকতা করতেন,এত সমস্যা ছিলো না ।এই বছর তিনেক হলো খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছেন ব্যথাতে। স্বামী কে তো অনেকদিন আগেই হারিয়েছেন। চাকরি করা,ছেলে মানুষ করা ,সব তো একা হাতেই করেছেন। অথচ এখন আর শরীর যেন চলতেই চায় না। একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। জিনিয়া মানে ওনার ছেলের বউ খুব হাসিখুশি মেয়ে। তথাকথিত শাশুড়ি বউমাদের সম্পর্কের মতো না ওনাদের দুজনের সম্পর্ক। জিনিয়া চাকরি করতো বিয়ের আগে থেকেই। বিয়ের পরেও করে শ্বশুরবাড়ি থেকেই। শাশুড়ির ওপর যাতে চাপ না পড়ে ,তাই একটা সর্ব ক্ষণের রান্নার আর কাজের মেয়ে সে এখানে আসবার পরই রেখে দিয়েছে।আর ছুটির দিনে জিনিয়া দাঁড়িয়ে থেকে রীতিমতো তদারকি করে সবার পছন্দের রান্না করায় মেয়েটিকে দিয়ে। নিরূপমা দেবী খুব খুশি এরকম বৌমা পেয়ে।


------মা তুমি চলো একদিন , তোমাকে যোগা ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেব। দেখবে এইসব ব্যথা তোমার থেকে কত দূরে চলে যাবে। আর শরীর ও তোমার কত ফিট থাকবে। সারাদিন যে আলস্য লাগে বলো, সেটা আর লাগবেই না।


------না রে জিনিয়া এই বয়সে আর নতুন করে এইসব করার জন্য আমাকে জোর করিস না। তোদের কম বয়স তোরা কর এই সব। আমার ওইসব নতুন করে শিখতে লজ্জা করবে।আর এইসব ব্যথা কি আর যাবার রে, এ একেবারে আমার সঙ্গে উপরে যাবে বুঝলি রে মা।


-------মা যোগা শেখার কোনো বয়স হয় না বুঝলে। আজকাল ক্লাসে তোমাদের বয়সী কতো মহিলারা শিখতে আসেন। আজকাল তো সবাই নিজের ফিটনেস নিয়ে সচেতন। নিজের ফিটনেসের জন্য সবাই কতো কিছু করে।জিম জয়েন করা, যোগা ক্লাসে জয়েন করা,এরোবিক্স শেখা, সুইমিং করা।আর তুমি সামান্য যোগা ক্লাসে ভর্তি হতে এতো লজ্জা পাচ্ছো। আমার সঙ্গে চলো একদিন ,দেখবে একবার শিখতে শুরু করলে শরীরের ফিটনেসের সঙ্গে সঙ্গে ,মনও কতো চাঙ্গা থাকবে তোমার।



নিরূপমা দেবী তার এই ছেলেমানুষ বউমা টিকে আর কিছু বললেন না। বড়ো স্নেহ করেন যে। পরের রবিবার সন্ধ্যেবেলায় জিনিয়া তার শাশুড়িকে বললো,"মা চলো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।আজ নিয়ে যাব তোমাকে ওখানে। নিরূপমা দেবীর শত বারণ সত্ত্বেও জিনিয়া তার শাশুড়িকে নিয়ে চললো যোগা ক্লাসে। ওখানে গিয়ে নিরূপমা দেবী দেখলেন, সত্যিই ওনার বয়সী অনেকেই আছেন। আর তারা নিঃসঙ্কোচে শিখছেন সবাই। জিনিয়া শাশুড়িকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলো। সপ্তাহে তিনদিন আসতে বলা হলো। কিন্তু জিনিয়া তো অফিস যায় অন্যদিন। তাহলে কি করে আসবেন নিরূপমা দেবী একা একা। চিন্তায় সারা রাস্তা অন্যমনস্ক নিরূপমা দেবী। গাড়ি এক জায়গায় পার্ক করে জিনিয়া শাশুড়িকে বললো, "আজ তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরবো বলে গাড়ি নিয়ে এসেছি।কাল থেকে হেঁটে আসবে তুমি ক্লাসে। এখন চলো ফুচকা খাবো আমি। তুমিও খাবে।" 


নিরূপমা দেবী বললেন" তুই খা। আমি ওইসব খাবো না। বয়স হয়েছে ,আজকাল আর বাইরের ওইসব খাওয়া সহ্য হয়না আমার। তোদের অল্প বয়স, তোরা খা।" জিনিয়ার খাওয়া হয়ে যেতে শাশুড়িকে বললো,"চলো মা, এক জায়গায় যাবো।" তারপর গাড়িতে শাশুড়িকে বসিয়ে জিনিয়া সোজা শপিং মলের সাইডে গাড়ি পার্ক করলো। তারপর শাশুড়িকে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে শাশুড়ির জন্য একটা অফ হোয়াইট কুর্তি আর ল্যাগিংস কিনলো। তারপর একটু ঘুরে আবার বাড়ি। 



পরদিন অফিস বেরোবার আগে জিনিয়া শাশুড়িকে বারবার করে বলে দিলো, যোগা ক্লাসে যাবার আগে তিনি যেন নিজের জন্য কেনা ড্রেসটি নিয়ে যান।কারণ শাড়ি পড়ে যোগব্যায়াম শেখা যাবে না। নিরূপমা দেবীর সকাল থেকে বুক দুরুদুরু করছে। খুব টেনশন ও হচ্ছে। সেই পরীক্ষা দিতে যাবার আগে যেরকম টেনশন হয় ,ঠিক সেরকমই।এই বয়সে এসে এইসব হয় আর। তার ওপর আবার ওইসব ড্রেস ও পরতে হবে ওখানে গিয়ে।সব মিলিয়ে রীতিমতো নার্ভাস নিরুপমা দেবী। ক্লাসে না গেলেও জিনিয়া ভীষণ রাগারাগি করবে অফিস থেকে এসে। কি যে করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।

-----ও মাসিমা তোমার ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে তো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। নইলে বৌদিমণি আমাকে বকবে। যাবার আগে বারবার বলে গেছে সে, যেন তোমাকে যোগ ব্যায়ামের ক্লাসে পাঠাই আমি।"

---------হ্যাঁ বাপু দাঁড়া তৈরি হচ্ছি।অতো তারা দিস না তো। বলে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন," একা কি করে যাবো আজ ,সেই ভয়ে আমার হাত ,পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আর ও বকবক করে যাচ্ছে।" মাঝে একবার জিনিয়ার ফোন এলো কাজের মেয়েটির কাছে। জানতে চাইছে মা বেরিয়েছে কিনা। তারপর নিরুপমা দেবীকেও ফোনে জিনিয়া বললো, "কেন ভয় পাচ্ছ মা শুধু শুধু। আমি আছি তো। কোনো নতুন কিছু শিখতে গেলে ভয় তো অল্পবিস্তর সবার ই পায়। তারপর দেখবে তোমার এতো ভালো লাগবে ওখানে, রোজ যেতে চাইবে তুমি।"



জিনিয়ার ভয়ে অগত্যা বাধ্য হয়েই নিরুপমা দেবী নিজের কালকের কেনা ড্রেস ব্যাগে ভরে চললেন যোগা ক্লাস। ঠিক প্রথমদিন স্কুলে যাবার সময় যেমন ভয় করছিল ,ঠিক তেমনি লাগছে ভয় মনেতে। তফাত শুধু একটাই সেদিনের ছোট্ট নিরুপমা তার বাবার হাত ধরে স্কুলে গিয়েছিল।আর আজ একা যাচ্ছে। যদিও তাঁর আদরের জিনিয়া মনের দিক থেকে তাঁর সঙ্গে ই আছে। কাউকে চেনেন ও তো না। ওই কাল যে মেয়েটি শেখাচ্ছিল তার সঙ্গে ই যা একটু মুখ চেনা আছে। ভয়ে ভয়ে নিরুপমা দেবী ঢুকলেন কাচের দরজা ঠেলে। সঙ্গে সঙ্গে একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বললো,"আন্টি তুমি নতুন তাই তো।চলো আগে নিজের ড্রেস টা চেঞ্জ করে নাও। নিরুপমা দেবী মেয়েটির পিছনে গিয়ে ড্রেসিং রুমে নিজের শাড়ি ছেড়ে , কালকের কেনা ড্রেস টা পড়লেন। কি সুন্দর ব্যবস্থা এখানে।সবার জামাকাপড় রাখার আলাদা ব্যবস্থা। কই আর তো অতটা ভয় পাচ্ছে না। ড্রেস চেঞ্জ করে বড়ো হলঘরে আসতেই মেয়েটি দেখিয়ে দিলো ক্লাসে কোথায় বসবেন।সবাই নীচে বসে আছে, এবার ক্লাস শুরু হবে। বেশিরভাগ ওনার বয়সীরাই এখানে আছেন। পাশের হলঘরে আবার কমবয়সী যারা তারা শিখছে। আসলে বয়স্ক মানুষদের সমস্যার কথা ভেবেই হয়তো সবাইকে আলাদা আলাদা শেখাবার ব্যবস্থা । ওঁরা তো আর তাড়াহুড়ো করে পারবেন না সবকিছু। শিখতেও একটু দেরি লাগবে। হাঁটু তে ব্যথা, কোমরে ব্যথা প্রায় প্রত্যেকেরই আছে তো। খুব যত্ন করে প্রত্যেকটি বিষয় বলে দিচ্ছে যে মেয়েটি শেখাচ্ছে সে। কাল থেকে আবার একটা করে ডায়েরি আনতে বললো, যা যা শেখানো হবে, সেগুলো লিখে রাখবার জন্য। প্রথমদিন তো, তাই হাল্কা প্রাণায়াম ই দেখিয়ে দিলো মেয়েটি। এক দুজন ওনার বয়সী মহিলাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ও হলো ক্লাসের পর। সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য ই লাগলো নিরুপমা দেবীর । যতটা ভয় পাচ্ছিলেন ,ঠিক ততটাই খুশিও হলেন মনে মনে। আবার একদিন পর ক্লাস আছে।




বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন জিনিয়া এসে গেছে অফিস থেকে। জিনিয়াকে দেখে বাচ্চা মেয়ের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, যোগা ক্লাসে যা যা হয়েছে সব কথা। ঠিক যেমন করে স্কুলের প্রথম দিনে তার সঙ্গে যা যা হয়েছে, একটা বাচ্চা মেয়ে তার মা'কে বলে, ঠিক সেইভাবেই নিরুপমা দেবী জিনিয়ার কাছে সব বলছিলেন। আর জিনিয়া মিটিমিটি হেসে তার এই শাশুড়ি মায়ের সব কথা শুনছিল মন দিয়ে।




জিনিয়া খুব খুশি তার শাশুড়ি নিয়মিত যোগা ক্লাসে যাচ্ছে, নিয়মিত ঘরেও প্রাকটিস করছে এসে। বাইরের পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করলে, একটু কথা বললে এই বয়সে ওনারও মনটা ভালো লাগবে। কারণ ওনার ছেলে বা জিনিয়া দুজনের কেউই তো সেভাবে সময় দিতে পারেনা বয়স্ক মানুষটিকে।সেদিন নিরুপমা দেবী উচ্ছ্বসিত হয়ে খাবার টেবিলে জিনিয়াকে বললো,"জানিস জিনিয়া এবার শীতকালে যোগা ক্লাস থেকে আমাদের বয়স্ক মানুষদের ও পিকনিক করতে নিয়ে যাবে বলছে।" জিনিয়া তার শাশুড়ি মা কে বললো,"ভালোই তো মা, যাবে নিশ্চয়ই যাবে"। জিনিয়া তো এটাই চেয়েছিল, এই শেষ বয়সে ঘরে বন্দী করে নিজেকে না রেখে ওর শাশুড়ি মাও বাইরের মুক্ত পরিবেশে নিজেকে চিনুক।এই শেষ জীবনটা উনিও নিজের মতো করে বাঁচার একটা পথ খুঁজে পাক। যেটা এই বয়সের বেশীরভাগ মানুষই খুঁজে পান না। জীবন তো একটাই। জীবনের প্রতিটি ধাপে যেমন সমস্যা আছে, ঠিক তেমনি সেই সমস্যার সমাধানেরও রাস্তা আছে। শুধু আমাদের সেই রাস্তাটা খুঁজে বের করতে হবে।বয়স্ক মানুষদের ও তো ইচ্ছা হয় শেষ জীবনটা সুন্দরভাবে উপভোগ করতে। জীবন শেষের এই সময়টাকে নতুন করে শুরু করতে।তা সে যে কোনো ভালো কাজের মাধ্যমেই হোক বা অন্য কারুর সহায়তায়। সবারই তো অধিকার আছে সুস্থ, সুন্দর ভাবে বাঁচার।


           


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics