Sucharita Das

Horror Tragedy Classics

3.3  

Sucharita Das

Horror Tragedy Classics

মর্গের বিভীষিকা

মর্গের বিভীষিকা

7 mins
802


আজ মনে হয় আর কোনো বডি আসবে না। মুকুল মর্গের বাইরে বসে ভাবছিল।আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরবে তাহলে।সবে ভাবছে ও এবার উঠবে। তখনই গাড়ি র আওয়াজে চমকে তাকালো। দেখলো গাড়ি র ভেতর থেকে একটা বডি নামানো হয়েছে। সামনে গিয়ে দেখলো ও।একজন মহিলা। অন্ধকারে মুখটা ঠিক দেখতে পেলো না মুকুল। শুনতে পেল সুইসাইড কেস। আজকে এত রাত্রি তে এমনিতেও বডি পড়ে থাকবে। ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে বললো ও বডি টাকে। কাল সকালে যা হবার হবে। সব বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লো ও। রাস্তায় যেতে যেতে মুকুল ভাবছিলো, মানুষ যখন বেঁচে থাকে তখন তার কতো যত্ন করা হয়।আর মরে গেলে সেই মানুষটাই হয়ে যায় একটা বডি ,না তো লাশ। তখন আর তার কোনো মূল্য নেই।


মুকুলের মনে আছে,ও যখন এই মর্গের দায়িত্ব রত এক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে জয়েন করেছিলো,তখন বাড়িতে সবাই প্রবল আপত্তি করেছিলো।কেউ চাইছিল না ও লাশ কাটা ঘরে কাজ করুক। আসলে মর্গ বা লাশের ঘর সম্পর্কে সবার মনের মধ্যেই একটা অজানা ভয় কাজ করে। সত্যি বলতে কি, প্রথম প্রথম মুকুল নিজেও খুব ভয় পেতো। কতো রকমের বডি যে এখানে আসে, তার তো কোনো ঠিক নেই। কিছু কিছু বডি এত ভয়ঙ্কর হয়ে যায় দেখতে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।আর কি দুর্গন্ধ।সহ্য করা যায় না। আসলে সব ই তো অপঘাতে মৃত্যু। সেজন্যই তো আনা হয় এখানে।এই তো সেদিন ,বিষ খেয়ে দুটো ছেলে মেয়ে সুইসাইড করেছিলো। ওদের বডি যখন এসেছিল, এতো দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল, মুকুলের নাকে এখনো আছে সেই গন্ধ। আবার গা টা গুলিয়ে উঠলো ওর সেটা মনে করে। প্রতিদিন আট থেকে দশটা বডি আসে এখানে। তাদের পোস্টমর্টেম এর পর সেই বডির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মুকুলের। সেগুলোকে পোস্টমর্টেম এর পর ভালো করে পলিথিনে মুড়ে তার উপর কাপড় জড়িয়ে আলাদা আলাদা করে ঠান্ডা ঘরে রেখে দিতে বলে ও। তারপর বাড়ির লোকজন এসে শনাক্ত করে বডি নিয়ে যায়।


কে জানে আজ লাস্ট ট্রেন টা পাবে কিনা। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যেতে শুরু করলো ও। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।আজ ছাতা টাও আনতে ভুলে গেছে। স্টেশনে এসে ভাগ্যক্রমে ট্রেনটা পেয়ে গেল ও। মনে মনে ভাবলো , যাক বাবা বাঁচা গেল। পুরো ট্রেনে গুটি কতক লোকজন আছে। মুকুল একটা সিটে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। সারাদিন বসে বসে কোমরটা ধরে যায়।এখন আধ ঘন্টা নিশ্চিন্তে শুতে পারবে ও। চোখটা বন্ধ করে নেয় ও। "এই যে শুনছেন",হঠাৎই একটা ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে ওর ঘুম টা ভেঙ্গে গেল। চমকে উঠে বসে পড়ল। একজন মহিলা ঠিক ওর সামনের সিটে বসে আছে।চোখ কচলে ভালো ভাবে দেখলো ও।না ভুল না। সত্যি ই একজন মহিলা ডাকছে ওকে। এতো রাতে এই মহিলা একা , তাও আবার লাস্ট লোকালে। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না । একটু ভয় ও পাচ্ছে ওর। যদিও সারাদিন লাশের ঘরে থেকে থেকে ভূতের ভয় ওর নেই। মৃত মানুষের সঙ্গে ই তো সারাদিন কাটে ওর।"কি ভাবছেন দাদা। এতো রাত্রিতে আমি এভাবে একা কেন? আসলে কোলকাতায় এসেছিলাম ডাক্তার দেখাতে। অপরিচিত জায়গা তো।সব খুঁজে দেখতে দেখতেই অনেক সময় লেগে গিয়েছিল।আর অত কিছু তো জানি না। তাই ট্রেন ধরতেও এতো দেরি হয়ে গেল।" "কিন্তু আপনি এভাবে একা কেন এত রাতে? কাউকে সঙ্গে আনেননি কেন? এতো রাতে কোনো বিপদ ও তো হতে পারে আপনার।"এবার মেয়েটার মুখটা বিমর্ষ লাগলো। আনমনা হয়ে বললো, "বিপদ যা হবার তা তো হয়েই গেছে দাদা।" জিজ্ঞেস করলো মুকুল, কি হয়েছে আপনার? মেয়েটি কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বললো, "আপনার বাড়ি কোথায়?" জবাব দিলো মুকুল,এই তো বীরশিবপুর। মেয়েটি বললো বীরশিবপুরে তো আমার ও বাপের বাড়ি। আর আপনি থাকেন কোথায়? মানে আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়? মুকুল জিজ্ঞেস করল ওকে। বললো কোলাঘাট। মেয়েটি আরো অনেক গল্প করলো , বললো বছর দুয়েক আগে ওর বিয়ে হয়েছে।ওর বিয়ের পর ওর বাবা-মা একা হয়ে গেছে। ছোট ভাই ওর থেকে অনেক টাই ছোট। আরো বললো মেয়েটি, শ্বশুরবাড়িতে ওর বাবা মা অত যেতে পারে না।গরীব বলে অতো সম্মান ও পায় না সেখানে ওরা।আর মেয়েটিকেও অতো আসতে দেয় না ওরা বাবা মায়ের কাছে। মুকুল নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস করছিলো না। আসলে অপরিচিত কারুর সম্পর্কে এতো আগ্ৰহ ও দেখাতেই বা যাবে কেন। রোজ কতো লোকের সঙ্গেই তো ট্রেনে দেখা হয়। ট্রেন থেকে নেমে সব ভুলে যায়। মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললো,"দাদা আমার মতো কত মেয়ে রোজ এইভাবেই হারিয়ে যায়। কেউ জানতেও পারে না তাদের কথা।" মুকুল বললো,"মন খারাপ করো না বোন, সব ঠিক হয়ে যাবে।"আবার মেয়েটি বললো, "আর কিছুই ঠিক হবেনা দাদা। আমার জীবনে সব শেষ হয়ে গেছে।" কথায় কথায় মুকুলের নামবার সময় হয়ে গেল।ও মেয়েটিকে বলে উঠলো নিজের সিট থেকে। মেয়েটি ও সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে বললো, "আমার একটা উপকার করবেন দাদা। আমার এই চিঠি টা আমার বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন একটু।ওদের তো ফোন নেই, তাই চিঠি তেই সব লিখে দিয়েছি।" নিজের বাপের বাড়ি র ঠিকানা ও বলে দিলো মেয়েটি। আরো বললো, যেন কাল সকালেই পৌঁছে দি চিঠি টা। কেন জানে না , মুকুল না বলতে পারলো না মেয়েটি কে। আর একই জায়গায় যখন। ছোট জায়গা, একটু জিজ্ঞেস করলেই পেয়ে যাবে ওর বাবার বাড়ি। মুকুল মেয়েটিকে বলে নেমে গেল ট্রেন থেকে। রাস্তায় যেতে যেতে ভাবলো কখন লিখলো মেয়েটি চিঠি টা।আর ভাবতে পারছে না ও। এমনিতেই সারাদিনের ধকলে ও ক্লান্ত হয়ে আছে।


পরের দিন সকালে টেবিলে রাখা চিঠি টা নিয়ে , মেয়েটি যে ঠিকানা বলে দিয়েছিল, সেখানে পৌঁছে দিয়ে, তারপর নিজের কাজে যাবে বলে ঠিক করলো মুকুল। খুব বেশি দূরে না মেয়েটির বাড়ি। দরজা খুলল ওর বাবা সম্ভবত। শীর্ণকায় চেহারা, পিছনে ওর মা আর ছোট ভাই ছিলো। সবাইকে দেখেই মনে হয় খুব ই অভাবের মধ্যে আছে ওরা। মুকুল বললো, "আপনার মেয়ে বাবলি আপনাদের জন্য এই চিঠি টা দিয়েছে।কাল আমার সঙ্গে ওর ট্রেনে দেখা হয়েছিল। আমার বাড়ি এখানে জেনে চিঠিটা আপনাদের দিতে বলেছে।" মেয়ের কথায় ওর বাবা মায়ের চোখে জল চলে এল। বললো , "আমরা দুজনেই চোখে কম দেখি বাবা। যদি তোমার হাতে দশ মিনিট টাইম থাকে, তাহলে চিঠিটা একটু পড়ে দাও।"মুকুলের ওখানে কাজ ও আছে।চার টে নতুন বডি এসেছে।সব পোস্টমর্টেম হবে।ও না পৌঁছাতে পারলে তো হবেই না। তা সত্ত্বেও না করতে পারলো না ও বাবলির বাবা মাকে। চিঠি টা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো ও, 

শ্রীচরনেষু বাবা, মা,

            তোমরা আমার প্রণাম নিও। তোমরা যখন এই চিঠি টা পাবে, জানিনা আমি ততক্ষণ বেঁচে থাকবো কিনা। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন যখন জানতে পারলো আমি মা হতে চলেছি, তখন ওরা তোমাদের কিছুতেই জানাতে দিলো না। অনেক চেষ্টা করেও আমি তোমাদের জানাতে পারিনি এই খবরটা।ওরা জোর করে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে আমার গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে তা পরীক্ষা করালো। আর যখন জানতে পারলো সেটি মেয়ে সন্তান ,তখন থেকে আমার জীবন আরো দুর্বিষহ করে তোলে ওরা। প্রথম প্রথম ঘরে তেই অনেক চেষ্টা করলো, আমার গর্ভজাত সন্তানকে হত্যা করার। কখনো সাবান জল গুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে, কখনো বা সিঁড়ি দিয়ে নামবার মুখে তেল জাতীয় কিছু ফেলে দিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই আমি এবং আমার সন্তান বেঁচে যাই। এরপর ওরা আমাকে অ্যাবরশান এর জন্য বলে। আমি ওদের বলে দিই, আমি বেঁচে থাকতে আমার সন্তানকে কাউকে  মারতে দেবো না আমি।শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে খাবারের সঙ্গে কোনো ভন্ড তান্ত্রিকের দেওয়া ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেয়। রাত্রি বেলা আমি নিজের অজান্তেই সেই খাবার খেয়ে নিই। তারপর থেকেই আমার শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। জানো মা, আমি যখন খাচ্ছিলাম নিজের সন্তানের জন্য, ওকে সুস্থ রাখবার জন্য, তখন আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এসে আমাকে সব কথা বলে। কিভাবে ওরা আমার সন্তানকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে।সব শুনে আমার শরীর খারাপ করছিলো। আমি দরজা বন্ধ করে দিই ঘরে ঢুকে। একটা কাগজে তোমাদের জানাবার জন্য সব লিখে রাখি। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম যে , আমি আর বাঁচবো না।আর রক্ষা করতে পারবো না আমার সন্তানকে। চিঠিটা আমার হাতের মুঠোয় বন্দী করে আমি চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলাম।চিঠিটা পড়তে পড়তে মুকুলের চোখ ও নিজের অজান্তে জলে ভরে উঠলো।আর বাবলির মা বাবা ওখানেই স্থবির হয়ে বসে পড়েছিল। মুকুল কোনো কথা বলতে পারছিলো না ওনাদের। কি বলবে ও ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না। কোনো কথা না বলে, ও নিজের কাজে বেরিয়ে পড়লো। কিছু বলবার বা ভাববার মতো অবস্থা ওর তখন ছিলো না।


মর্গের বাইরে আজ বেশ ভিড়। অনেক গুলো বডি আছে আজ। টাইম ও লাগবে তাই।কাল রাতে যে বডি টা এসেছিল,ওটার ও পোস্টমর্টেম হবে। মুকুল একটা একটা করে বডি ছাড়ছে পোস্টমর্টেম এর জন্য। হয়ে গেলে যথাস্থানে রাখাবার ব্যবস্থা করছে।সব শেষে কাল রাতে যে বডি টা এসেছিল, ওটকে পোস্টমর্টেম এর টেবিলে তুলতে বললো। কিন্তু একি দেখছে ও।এ তো কাল রাতে ট্রেনে পরিচয় হওয়া মেয়েটি। মানে বাবলি।চোখ কচলে ভালো করে দেখলো ও। হ্যাঁ এটা তো বাবলি। আর ওর হাতের মুঠোয় বন্দী ওটা কি। একটা কাগজের টুকরো মনে হচ্ছে। কাছে গিয়ে মুকুল ওর মুঠোটা খোলবার চেষ্টা করলো।শক্ত হয়ে গেছে পুরো বডি টা।তাও অনেক কষ্টে ও বের করলো কাগজটা। ফোল্ড করা একটা চিঠি। মুকুল তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলল।এ কি দেখছে ও?অবিকল এক ই চিঠি তো আজ সকালে ও বাবলি'র বাবা মায়ের কাছে পড়েছে ।সেই এক হাতের লেখা, এক ভাষা। হুবহু এক চিঠি। চিঠি টা টেবিলে রেখে মুকুল বাইরে বেরিয়ে এলো।কেমন যেন ওর শরীর খারাপ লাগছিলো। বাইরে এসে ও আরো স্তম্ভিত। বাবলি'র বাবা আর মা বাইরে বসে কাঁদছে। ওকে দেখে ওরা বললো, মুকুল ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর ই নাকি ওদের পাশের বাড়িতে ফোন করে , অজানা কেউ জানিয়েছেন যে, ওরা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মর্গের কাছে চলে আসে। নাহলে ওদের মেয়ের সঙ্গে আসলে কি হয়েছিলো তা ওরা কিছুই বুঝতে পারবে না। বাবলি'র শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা ওদের না জানিয়েই , এটাকে সুইসাইড বলে চালিয়ে ওদের মেয়ের সৎকার করে দেবে।


মুকুলের কাছে এবার ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে গেল ছবির মতো। তার মানে এটা ই বাবলি। মুকুলের মাধ্যমে ও নিজের বাবা মা কে জানাতে চেয়েছে সব ঘটনা।যাতে তার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি ওই নরপশু গুলো পায়। মুকুল ও নিজের মনে মনে বলে উঠলো , এদের ছাড়া যাবে না। কিছুতেই না। দুটো নিষ্পাপ প্রাণ কে হত্যার শাস্তি তো এদের পেতেই হবে। নাহলে যে বাবলির আত্মা কোনো দিন শান্তি পাবে না।


      



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror