গল্প হলেও সত্যি
গল্প হলেও সত্যি
অনেক দিন থেকেই মা বলছিলো ছোট পিসেমশাই কে একবার দেখে আসতে।বয়স হয়েছে, তার উপর অসুস্থ। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় সময় ও করে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু এবার একবার যেতেই হবে। ছোট পিসির বাড়ি তারকেশ্বর থেকে একটু ভিতরে ,গ্ৰামের মধ্যে। নির্দিষ্ট দিনে হাওড়া থেকে তারকেশ্বর লোকাল ট্রেনে বসলাম।
বর্ষাকালের বিকালে ৫টা বাজলেই কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যায়। এদিকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি ও পড়ছে। ছুটির দিন, তাই ট্রেনে ভিড় একটু কম, এটাই নিশ্চিন্ত। নাহলে ভিড়ের মধ্যে একেবারেই ভালো লাগে না আমার। লেডিস এ বসলাম না।কারণ অতটা রাস্তা, কে জানে ,একা তো কোনদিন যাই ও নি সেভাবে।এর আগে মায়ের সঙ্গেই দু-একবার গেছি।তাও অনেক দিন আগে। এবার তো মায়েরও শরীর ঠিক ছিলো না। তাই কি আর করা যাবে।
ট্রেনের কামরায় খুব একটা লোকজন ছিলো না।ট্রেন ছাড়ার পর মনে মনে ভাবছি ,ভালোয় ভালোয় পৌঁছে যাই যেন। বাড়িতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।কেমন যেন একটা নিস্তব্ধ ভাব। বসে ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। বাইরে প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়লো কোথাও।না ,আর ফোন নিয়ে থাকা ঠিক না। অগত্যা ফোন বন্ধ করে হ্যান্ড ব্যাগ এ রেখে দিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম ,কে জানে একা আসাটা ঠিক উচিত হলো কিনা।তাও আবার এই বর্ষা বাদলের দিনে।
ভদ্রমহিলা শেওড়াফুলি স্টেশনে নেমে গেলেন। ভাবলাম যাও একজন সঙ্গী ছিল, তাও গেলো। হঠাৎ ট্রেনের লাইটগুলো অফ হয়ে গেল।এ আবার কি নতুন ঝামেলা।একে ভয়ে কাঠ হয়ে আছি, তার মধ্যে আবার লাইট অফ। মোবাইল টা ব্যাগ থেকে বের করতে যাবো , তখনই লাইট জ্বলে উঠলো।যাক বাবা বাঁচা গেল।একটু নিশ্চিন্ত হলাম। খুব একটা লোকজন ও ছিলো না কম্পার্টমেন্ট টায়। আমার ঠিক মুখোমুখি দেখলাম একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে , আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।একটু ভয় ও করছিল। হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, "তুমি পরিতোষ এর ওখানে যাবে তো। ওর শরীর খারাপ তাই দেখতে।"আমি রীতিমতো অবাক। বললাম হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।", বললেন,"অনেক দিন আগে দেখেছো তাই চিনতে পারছো না। আমি পরিতোষ এর বড়দা।"এবার আমার ও হালকা মনে পড়ছে। বললাম, "কিছু মনে করবেন না জেঠু, অনেক দিন দেখিনি তো , তাই মনে করতে পারছিলাম না। কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কিভাবে? আপনিও তো অনেকদিন পর দেখলেন আমাকে"। জেঠু কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, মেয়ের বাড়িতে এসেছিলাম শেওড়াফুলি তে।আর ভালো লাগছেনা , তাই ফিরে যাচ্ছি।
সত্যি বলতে কি, মনে মনে বেশ আনন্দিত ই হয়েছিলাম। এতোটা পথ একা একা যাওয়া খুব ভয় ও পাচ্ছিলাম।এ তো সোনায় সোহাগা হলো। একেবারে বাড়ি পর্যন্ত দু'জনে চলে যাবো। কোনো অসুবিধা হবে না। জেঠু কে বললাম,"সকালে না ফিরে এতো সন্ধ্যে কেন করলেন? বয়স হয়েছে আপনার।আর একা ই বা কেন ফিরছেন। কাউকে বলতেন বাড়িতে পৌঁছে দিতে।" এবার জেঠু বললেন, "একা কোথায়? তুমি আছো তো আমার সঙ্গে। কোনো অসুবিধা হবে না"। বললাম ,"সে তো আছি জেঠু। কিন্তু আমার সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে যাওয়াটা তো , নেহাৎই কাকতালীয় ব্যাপার। নইলে তো আপনাকে একা ই ফিরতে হতো"। আবার কোনো উত্তর নেই।
ভাবলাম থাক, বয়স্ক মানুষ তো , বেশি কিছু বললে মনে কষ্ট হতে পারে। জিজ্ঞেস করলাম কিছু খাবেন কিনা। না বললেন। এদিকে সময় যেন আর পার হতে চাইছে না। মনে হচ্ছে যেন কতো যুগ বসে আছি। ট্রেনে কথা বলতে বলতে কখন যেন একটু ঝিমুনি ভাব এসে গিয়েছিল।"চলো এসে গেছে তো স্টেশন"।ঘোর কাটল জেঠুর ডাকে।
স্টেশনে যখন নামলাম বেশ রাত হয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়েই চলেছে একনাগাড়ে। গাড়িও কম। এইসব জায়গায় ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে না এত রাতে।তার উপর আবার বৃষ্টি পড়ছে। জেঠু কে বললাম , পিসি কে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি যে আমি স্টেশনে চলে এসেছি।আর চিন্তা করবার নেই, কারণ সঙ্গে জেঠু আছে। কিন্তু জেঠু বারণ করলেন ফোন করতে। বললেন,আর অল্প পথ, তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব আমরা। শুধু শুধু ফোন করলে চিন্তা করবে। অনেকক্ষণ পর একটা ভ্যান রিক্সা পাওয়া গেল। বললাম
বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে হবে।রাজি হয়ে গেল লোকটা। বাড়ির সামনে নেমে দেখি জেঠু নেই। কোথায় গেল মানুষটা।এই তো নামলো রিক্সা থেকে। ভাবলাম পিসিকে হয়তো খবরটা দিতে গেছে, যে আমরা দুজনে একসঙ্গে ই এসেছি। পিসির বাড়ি র সামনে গিয়ে দেখলাম বেশ ভিড় আছে। মনে একটা অজানা ভয় ও হচ্ছিল।কে জানে , পিসেমশাই ভালো আছেন তো? আমি আসতে দেরি করে ফেললাম না তো?
মনে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বাড়ি র ভিতরে ঢুকলাম। পিসি সামনেই ছিলো। আমাকে দেখে বললো ,"আয়, ভেতরে আয়।" কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছিলাম না। শুধু বললাম " ,পিসেমশাই কোথায় পিসি? আর তোমাদের বাড়িতে এতো ভিড় কেন?" পিসির থমথমে মুখ টা দেখে আরো ভয় পাচ্ছিল। ভাবছিলাম কে জানে, অঘটন টা কি তবে হয়েই গেল নাকি? পিসি একটা ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম খাটের উপর পিসেমশাই বসে আছে। আরও কয়েকজন আছে। সবাইকে তো চিনি না। সত্যি বলতে কি অনেকটাই নিশ্চিন্ত হলাম মনের দিক থেকে। ভাবলাম ,যাকগে পিসেমশাই যখন সুস্থ আছে, তাহলে আর চিন্তা কি। কিছুক্ষণ পর পিসি এসে বলল, "এসেই যখন পড়েছিস, তখন চল একবার দেখে আসবি।" কাকে দেখবো , কি দেখবো , কিছুই বুঝতে পারছি না। পিসির সঙ্গে সঙ্গে গেলাম । একটা বড়ো বারান্দায় অনেক লোকজন ভিড় করে ছিলো। পিসি সবাইকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে সামনে নিয়ে গেল।আর তারপর আমি যা দেখলাম, তাতে নিজের চোখ, কান কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখলাম ফুল দিয়ে সাজানো খাটে পিসির বড়ো ভাসুর, মানে যে মানুষ টার সঙ্গে আমি এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত একসাথে শেওড়াফুলি স্টেশন থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত এলাম , এতো গল্প করতে করতে, সেই জেঠু শুয়ে আছেন । কখন হলো এইসব? এক্ষুনি তো মানুষ টা সুস্থ শরীরে ঘরে ঢুকলো। এরমধ্যেই এত কিছু কি করে হয়ে গেল। আমি ও তো পিছনেই ছিলাম। পিসিকে জিজ্ঞেস করতে যাবো সবে।তার আগেই পিসি বললো, উনি নাকি দিন দশেক আগে শেওড়াফুলি তে নিজের বড়ো মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন।আজকেই সকালে ফেরবার কথা ছিলো। কিন্তু হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। হসপিটালে নিয়ে যাবার আগেই মারা যান হার্ট অ্যাটাকে।এই তো বিকালেই ওনাকে আনা হয়েছে এখানে। শেষকৃত্য এখানেই করা হবে।
আমার তো প্রথম টায় মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। তাহলে আমার সঙ্গে যে মানুষটা এতো গল্প করতে করতে এলো। আমাকে এতো সাবধানে বাড়িতে পৌঁছে দিলো। তিনি তাহলে কে? কাউকে বলতেও তো পারছিলাম না। সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে। পিসি যা বললো একটু আগে, তার মানে তো এটাই হয় যে, জেঠু দুপুরের দিকেই মারা গেছেন।আর আমার সঙ্গে যখন ওনার দেখা হয়েছিল, তখন তো প্রায় সন্ধ্যে রাত্রি। তার মানে জেঠু তখন জীবিত ছিলেন না। না আর কিছু মাথায় আসছিল না আমার। হতভম্বের মতো ওখানেই বসে পড়েছিলাম। একজন মৃত মানুষ প্রায় ঘন্টা খানেক এর বেশি সময় আমার সঙ্গে কথা বললো, আমার সঙ্গে ট্রেনে একই কম্পার্টমেন্ট এ বসে এলো, অথচ আমি এক বর্ণ ও বুঝতে পারলাম না যে, মানুষটা আর জীবিত ই নেই। এটা কি করে সম্ভব?
আসলে কিছু ঘটনা আমাদের জীবনে এমনভাবে ঘটে যে সবসময় সেটাকে অস্বীকার ও করতে পারি না আমরা। কিছু ঘটনা গল্পের মতো মনে হলেও তার সত্যতা কে আমরা অস্বীকার করতে পারিনা।