Sucharita Das

Children Stories Classics Inspirational

4  

Sucharita Das

Children Stories Classics Inspirational

মৃন্ময়ী

মৃন্ময়ী

17 mins
294


"মৃন্ময়ী একবার এদিকে আয় তো, আমার শাড়ীর কুঁচিটা একটু ঠিক করে দিয়ে যা।" মৃন্ময়ী রান্নাঘরে কাজ করছিল, মামাতো দিদির ডাকে পড়িমড়ি করে ছুটে এলো ঘরে। দিদি এখনি স্কুলে বেরোবে, সময়মত না গেলে দিদি খুব রেগে যাবে। দিদির ঘরের সামনে এসে সে বললো,"এই তো দিদি এখনই করে দিচ্ছি"। ওর মামাতো দিদি রমিতা বললো," সে তো করেই দিবি জানি, কিন্তু এত দেরী হলো কেন তোর আসতে"? মৃন্ময়ী দিদির শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বললো," ওই যে তুমি স্কুলে যাবার আগে খেয়ে যাবে, তাই বড়মামী বললো তোমার জন্য দু পিস মাছ যেন আগে রান্না করে দিই। তাই করছিলাম গো দিদি, সেজন্যে একটু দেরী হয়ে গেল।" রমিতা সব শুনে বললো,"কৃতার্থ করেছো আমাকে মাছ রান্না করে দিয়ে। এদিকে আমার দেরী হলে, খাবার সময়টা‌ কখন পাব শুনি"। মৃন্ময়ী মুখটা কাঁচুমাচু করে বললো,"ভুল হয়ে গেছে গো দিদি, আর হবে না এরকম।" মুখে কথাগুলো বললেও মনে মনে ভাবে, বলে তো দিলো সে দিদিকে যে আর হবে না এরকম। কিন্তু এত কাজ সামলাতে সামলাতেই তো ও হিমশিম খেয়ে যায় সকাল থেকে এ বাড়িতে। এটা মৃন্ময়ীর মামার বাড়ি।


তিন মামার সংসারে সে আর তার মা তো বাড়তি দুজনই। কিন্তু ওরাই বা কি করবে, ওরা তো নিরুপায়। বাবা মারা যাবার পর ওর আর ওর মায়ের আশ্রয় এই মামার বাড়িতে ছোট দাদুর বাড়িতেই হয়েছিল। ছোট দাদু যদিও ওর নিজের দাদু না, কিন্তু মৃন্ময়ীর মাকে তো এই ছোট দাদু আর দিদাই মানুষ করেছিল, আশ্রয় দিয়েছিল। বিয়ে থাও দিয়েছিল তথাকথিত সুপাত্র দেখে। যদিও বাপ, মা মরা মেয়ের জন্য ছোট কারখানায় কাজ করা ছেলেও সুপাত্র ই হলো। বিয়ে থা দিয়ে দিলেও মায়ের ভাগ্য বিধাতা যেখানে মায়ের প্রতি অসন্তুষ্ট, সেখানে ছোট দাদু আর দিদাই বা কি করবে। তিন বছরের মাথায় মৃন্ময়ীকে কোলে নিয়ে ওর চির দুঃখী মা আবার সেই পুরোনো আশ্রয়েই ফিরে এলো। কারখানায় কাজ করতে করতে অ্যাক্সিডেন্টে মৃন্ময়ীর বাবা মারা গেল। তখন তো দাদু আর দিদাও বেঁচেছিল। তখন আর মৃন্ময়ীর কতো বয়স হবে, এই বড়জোর দু বছর। সেই থেকেই ওদের মা আর মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিল ছোট দাদু। দুজনের দায়িত্ব নেওয়াও তো এই যুগে চাট্টিখানি কথা নয়। ধীরে ধীরে মৃন্ময়ী বড়ো হয়ে উঠতে লাগলো মামারবাড়িতে। অবশ্য সবার ভালোবাসায় সে বড়ো হয়ে ওঠে নি, বরং বলা যায় অনাদর আর অবহেলায় সে বেড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে।


ওর থেকে একটু বড়ো ওর মামাতো দুই দিদি যখন ভালো স্কুলে পড়তে যেত, ছোট্ট মৃন্ময়ী তখন দিদিদের স্কুলের ব্যাগ ,দিদিদের টিফিন সব গুছিয়ে দিতো। ওর খুব ইচ্ছা করতো ও দিদিদের মতো স্কুলড্রেস,জুতো মোজা পরে, টিফিন নিয়ে স্কুলে যাবে। একবার রাত্রিবেলা মাকে বলেও ছিল ও কথাটা। কিন্তু মা বলেছিল,"চুপ কর মা, এরা আমাদের থাকবার জন্য আশ্রয় দিয়েছে, দু বেলা দু মুঠো খেতে দিচ্ছে, এই অনেক। এর বেশি কিছু আমি চাইতে পারব না আর। এমনিতেই তোর বাবা চলে যেতেই আমাদের তোর বাবার বাড়ির আশ্রয় চলে গেছে, এখন এদের ওপর বেশি চাপ দিলে, এরাও যদি আশ্রয় না দেয়, তাহলে কোথায় যাব বলতো তোকে নিয়ে? তার থেকে এই ভালো, এদের ফাই ফরমায়েশ খেটে দেব দুজনে, আর এরা তার বদলে দুজনের খাওয়া,থাকা পরা সব দায়িত্ব নেবে। এর বেশি কিছু চাস না মৃন্ময়ী।"


না, মায়ের সেদিনের বলার পর থেকে ছোট্ট মৃন্ময়ী আর কখনও বলেনি স্কুলে ভর্তি হবার কথা। তবে দিদিদের একটা পুরোনো খাতা আর পেন সে পেয়েছিল একবার। তাতেই মায়ের কাছ থেকে ওর অক্ষর জ্ঞান হয়েছিল। ওই নাম সই করতে পারার মতো। আরও একটা শখ ছিল ওর। একটু জ্ঞান হতেই মায়ের মতই কাপড়ে এমব্রয়ডারি করতে চাইত ও। তারপর তো কতগুলো বছর কেটে গেল। দিদা, দাদু মারা গেল। মায়ের হঠাৎই শরীর ভেঙ্গে গেল দীর্ঘদিনের শরীরের উপর অনিয়ম করার জন্য, অক্লান্ত পরিশ্রম করার জন্য, আর ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ার জন্য । দুর্বল শরীর নিয়ে মা আর সেভাবে চলাফেরা করতে পারতো না। তারপর থেকেই সংসারের সব কাজের দায়িত্ব মৃন্ময়ীর উপরেই। শুরু শুরুতে শুধুমাত্র ফাই ফরমায়েশ খাটলেও, এখন তো রান্নাবান্না করা থেকে সংসারের খুঁটিনাটি যাবতীয় সব মৃন্ময়ীকেই সামলাতে হয়। মৃন্ময়ী যেদিন থেকে সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সামলায়, বাড়িতে সকলেরই কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব সংসারের কাজকর্মের প্রতি। বড় মামীর হাই প্রেশার , তাই সে রান্নাঘরে ঢোকে না। শুধুমাত্র তার মেয়ে চাকরি করতে যাবার আগে যখন খেতে নামে, তখনই শুধুমাত্র মৃন্ময়ী ঠিকমতো খাবার দিচ্ছে কিনা,তা দেখবার জন্য বড়মামী ঢোকে রান্নাঘরে। আর মেজমামীর তো শুরু থেকেই গা ছাড়া ভাব সংসারের কাজে। সে বড়লোকের মেয়ে, তার নাকি অভ্যেস নেই কাজ করার। বাকি রইল ছোটমামী, সে তো ননীর পুতুল। দেখতে শুনতে ভালো বলে, সে সংসারের কাজকর্ম কম করে, সাজগোজ , বন্ধুবান্ধব এইসব নিয়েই তার সময় কাটে বেশী। তার ওপর ছোটমামা ভালো চাকরি করে, সংসারে খরচও সে বেশি দেয় প্রতিমাসে। মামা বলেই দিয়েছে স্পষ্ট, "দরকার হলে আর একটা কাজের লোক রাখো, কিন্তু আমার বউ সংসারের কাজ করতে পারবে না "। ছোটমামা যখন কথাগুলো বলছিল, তখন সবাই টেবিলে রাতের খাবার খাচ্ছিল, আর মৃন্ময়ী সবাইকে পরিবেশন করছিল। সবাই তখন একসাথে বলে উঠলো," না না কাজের লোক কি হবে ঠাকুরপো, আমাদের মৃন্ময়ী তো আছেই। ও তো আমাদের দশভুজা।" খাবার দিতে দিতে মৃন্ময়ী মনে মনে ভাবলো," এটা কি এরা আমার প্রশংসা করছে, নাকি যাতে আরও বেশি করে এদের সংসারের জন্য খাটতে পারি, তার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে, কে জানে।"


সেই থেকে আজ পর্যন্ত মৃন্ময়ীর যেন রেহাই নেই এ সংসার থেকে। বাড়ির কাজের লোক, রান্নার লোক দুজনের কাজই ও একা করে। শুরুতে সামলাতে পারতো না। মা যতদিন সুস্থ ছিল, মা ওকে আগলে আগলে রাখত। সব কাজ মা নিজেই করতো। ছোট্ট মৃন্ময়ী তখন মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতো। কখনও কলতলায় মায়ের সঙ্গে এঁটো বাসন নিয়ে পৌঁছাতে যেত, কখনও বা মা রান্নার জন্য আনাজপাতি কাটতে বসলে , মটরশুঁটির খোলা ছাড়িয়ে দিত কচি হাতে। মা তখন অত কষ্টের মাঝেও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মমতার হাসি হেসে, ওকে আদর করে বলতো,"পাকা গিন্নি আমার"।



দুপুরবেলা এই সময়টুকু মৃন্ময়ীর নিজস্ব।

এই সময় নিজের জন্য ছাদের চিলেকোঠার বরাদ্দ ঘরটিতে ও নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটায়। ওর একটা ছোট পুরানো সুটকেস আছে। মৃন্ময়ী রোজ দুপুরে ওই সুটকেস খুলে বসে। আজও সুটকেসটা খুলে ওর ভেতর থেকে একটা সাদা কাপড়ের টেবিল ক্লথ বের করলো। কাপড়ের চারধারে অপরূপ কারুকার্য করা হাতের কাজ। যেন মনে হচ্ছে কেউ বসিয়ে দিয়েছে কাপড়ের ওপরে ছোট্ট ছোট্ট গোলাপের ফুল আর ডালপালা গুলোকে। রোজ মৃন্ময়ীর এইসময়টা পার হয়ে যায় নিজের হাতের কাজ করতে করতে। কত রকমের সুন্দর সুন্দর কাজ করা বালিশের কভার, টেবিল কভার করেছে ও। এ বাড়ি থেকে সে অর্থে কখনও কোনো পয়সা পায়নি। চারবেলা খেতে দেয় ওদের , জামাকাপড় দেয় পুরোনো , নতুন সবরকমেরই। তাই আলাদা করে পয়সা আর কেনই বা দেবে ওকে। শুধু বাড়িতে কেউ এলে , যাবার সময় ওর হাতে কিছু দিয়ে গেলে, ও সেই পয়সা দিয়েই নিজের সেলাইয়ের জিনিসপত্র কিনে আনে সামনের দোকান থেকে। এই একটাই তো শখ ওর আছে। ওর হাতের অপরূপ কারুকার্যে যেন কাপড়টা প্রাণ পেয়ে যায়। আরোও একটা হাতের কাজ মৃন্ময়ীর বড় প্রিয়। মাটির প্রতিমা আর বিভিন্ন ধরণের পুতুল তৈরি করা। মামারবাড়ির পাশের ঠাকুরদালানে অবতার দাদু খড় আর বাঁশ দিয়ে প্রতিমার কাঠামো তৈরি করতো। তারপর সেই কাঠামোয় মাটির প্রলেপ দিয়ে দিয়ে তাকে পুরু করে, সেই কাঠামোকে প্রতিমার রূপ দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মৃন্ময়ী খুব মনোযোগ সহকারে দেখতো। ওর সবথেকে ভালো লাগতো দেবীর চক্ষুদান করাটা। কি সাবলীল অথচ দক্ষতার সঙ্গে দেবীর চোখ আঁকত অবতার দাদু।যেন মাটির প্রতিমায় প্রাণের সঞ্চার ঘটতো। অবতার দাদুর কাছে মৃন্ময়ী শিখেছে, কি করে মাটির তাল কে ঠেসে ঠেসে সেটাকে প্রতিমা বানাবার জন্য উপযুক্ত করতে হয়। তারপর সেই মাটিকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কিভাবে প্রতিমা তৈরি করতে হয়। ধীরে ধীরে মৃন্ময়ী পুরোটাই শিখে গিয়েছিল। আর মামারবাড়ির পাশের ঠাকুরদালানে তো সারা বছরই কোনো না কোনো পুজোর জন্য প্রতিমা নির্মানের কাজ চলতই। ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করে মৃন্ময়ী দৌড়ে চলে আসত ঠাকুরদালানে।একনিষ্ঠ মনে তারপর শিখত মৃন্ময়ী ঠাকুর তৈরির যাবতীয় কাজ।



সারাদিন ঘরের কাজের পর দুপুরে নিজের আর মায়ের খাবারটা নিয়ে চলে আসতো মৃন্ময়ী নিজেদের চিলে কোঠার ঘরটাতে। এ বাড়িতে আসা ইস্তক এখানেই ওদের আশ্রয়। আজ মৃন্ময়ী একটু কচুশাক রান্না করেছিল। পাশের বাড়ির কাকিমা দিয়ে গিয়েছিল গত কালই। বড়মামী বলেছিল, ফেলে দিতে, কেউ নাকি খায়না ইলিশ মাছের মাথা ছাড়া কচু শাক রান্না করলে। কিন্তু মৃন্ময়ী জানে ওর মা কচুশাক খেতে বড় ভালোবাসে। আর তাই আজ অল্প নারকেল দিয়ে খানিকটা কচু শাক নিরামিষেই রান্না করেছে ও। একা হাতে কেটে বেটে রান্না করে কচু শাকটা ছোট বাটিতে করে রান্নাঘরের একপাশে রেখে দিয়েছিল মায়ের জন্য। বড়দি স্কুলে যাবার সময় বড়মামী বোধহয় দেখেছিল, মৃন্ময়ী কচু শাকটা কেটে রেখেছে। সবাই যখন খেতে বসেছিল, বড়মামী মৃন্ময়ীকে বললো, " কচুশাকটা তো কাউকেই দিচ্ছিস না মৃন্ময়ী।ওটা কার জন্যে রান্না করেছিস , নিজের জন্যে"? কথাটা শুনে খেতে দিতে দিতে মৃন্ময়ীর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। মনে মনে ভাবলো, এই তো বড়মামী বলছিলো কাল, ইলিশ মাছের মাথা ছাড়া কচু শাক রান্না করলে নাকি কেউ খায়না এ বাড়িতে। সে তো নিরামিষে রান্না করেছে কচু শাকটা, আর অল্প করেই করেছে মায়ের জন্যে, তাই দেয়নি কাউকে। বড় মামীর কথায় চোখ ভর্তি জল নিয়ে কচু শাকের ছোট বাটিটা এনে ওর থেকে অল্প করে করে সবাইকে দিলো ও। আশ্চর্যের ব্যাপার ইলিশ মাছের মাথা ছাড়া রান্না হলেও , কেউই কিন্তু না করলো না খাবার সময়। আগে জানলে বেশি করেই করতো ও। সবাইকে দেবার পর এক ছিটে বাটিতে পড়ে রইলো। এটুকু সে মায়ের জন্য রাখবে। মাকে আস্তে আস্তে উঠিয়ে বসালো মৃন্ময়ী। তারপর কচু শাক দিয়ে অল্প অল্প করে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে লাগলো ও মাকে। কচু শাকটা খেয়ে কি আনন্দ মায়ের। একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তিতে মায়ের মুখটা ভরে উঠলো। তারপর মৃন্ময়ীকে আস্তে আস্তে বললো, "কচুশাক রান্না করেছিস আজ। কতদিন পর খেলাম।" মায়ের মুখে খুশির ছোঁয়া দেখে মৃন্ময়ীর চোখটা জলে ভরে গেল, ও বললো, "হ্যাঁ মা , তোমার জন্য করেছিলাম আজ।" সন্তানের মুখে খুশির ছাপ দেখলে যেমন, মা, বাবার হৃদয় খুশিতে ভরে যায়। ঠিক তেমনি মা, বাবাকে খুশি হতে দেখলেও সন্তানের হৃদয় এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তির আনন্দে ভরে ওঠে। মায়ের রুগ্ন মুখে এক টুকরো হাসি দেখে মৃন্ময়ীর অন্তরটা ভরে গেল। মাকে খাইয়ে দিয়ে, আস্তে আস্তে শুইয়ে দিলো মৃন্ময়ী। কতদিন থেকে ভাবছে ও মা'কে একটা ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু কে দেখাবে, আর কাকেই বা বলবে ও? সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। আর তাছাড়া এমনিতেই তো ওরা দুজন এদের কাছে বাড়তি বোঝার মতো। কে আর চাইবে এই অতিরিক্ত খরচ বহন করতে।



সেদিন সকালে মৃন্ময়ী যখন রান্নাঘরে চরকির মতো ঘুরছে , একহাতে জলখাবার, বড়দির স্কুলের খাবার দেওয়া সব করছে, ঠিক তখনই বড়মামী এসে বললো," কাল তোর দিদির হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন এখানে দুপুরের আর রাত্রির খাবার খাবে মৃন্ময়ী। ওদের নেমন্তন্ন করেছি কাল। আর সেই সুযোগে বিয়ের একটা দিনক্ষণও ঠিক হয়ে যাবে একেবারে। কি রান্নাবান্না করবি সব ভেবে রাখিস মৃন্ময়ী।" মৃন্ময়ী তো এটাই বুঝতে পারছে না এতগুলো লোকের দু বেলার খাবার, চা, জলখাবার সে একা হাতে কি করে করবে। সে এটাও ভালো করেই জানে যে, তাকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না এ বাড়িতে। বড়মামী মৃন্ময়ীকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো, "কি রে চুপ করে আছিস যে, কি রান্না করবি বল্"। মৃন্ময়ী বললো," আসলে একা হাতে এতগুলো লোকের রান্না করতে পারবো তো মামী, তাই ভাবছি"। শুনে বড়মামীর সে কি হাসি, বললো,"এমন করছিস যেন পঞ্চাশ জন লোক আসছে। খুব পারবি এই ক জনের রান্না করতে।" মৃন্ময়ী মনে মনে ভাবলো, এ বাড়িতে বড় মামারা তিনজন, মেজ মামারা চারজন, আর ছোট মামারা দু'জন। সে নিজে আর মা ,সব মিলিয়ে এগারো জন আর বড়দির শ্বশুরবাড়ির দশ জন। মোট একুশ জনের রান্না টাও তো খুব কম না। চাইলে বড়মামী বাইরে থেকে কিছু খাবার বলে দিতে পারতো। এ বাড়িতে তো কতবার এরকম সন্ধ্যেবেলার জলখাবার, বা কারুর যদি রাতে বিরিয়ানি খাবার ইচ্ছা হয় তো, বাইরে থেকে আনা হয়। যদিও তা সত্ত্বেও মৃন্ময়ীর কাজ একটুও কম হয় না।যাই হোক, বড় মামী চায় মৃন্ময়ী পুরোটাই সামলাক। রাতে নিজের ঘরে গিয়ে হাতের কাজ করতে করতে নিজের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল মৃন্ময়ী। হঠাৎই বড় মামীর ডাকে চমকে ওঠে ও। এ সময় এখানে এভাবে বড় মামীকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে মৃন্ময়ী বলে,"কি হলো মামী কিছু চাই তোমার? আমাকে ডাকলে না কেন নীচে? বড়মামী হেসে বললো ,"কেন রে আমার এখানে আসা বারণ নাকি? এলাম তোর মা'কে দেখতে।" বড়মামীর এহেন কথাবার্তায় মৃন্ময়ী একটু অবাকই হল। কই এর আগে কখনও তো বড়মামী মাকে দেখতে আসেনি। মৃন্ময়ী মুখে কিছু না বললেও এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল যে, বড়মামীর এই ঘরে এত রাত্রিতে আসার পিছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল। আর সেটা যে কি তা কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃন্ময়ী বুঝতে পারলো। বড়মামী যখন মৃন্ময়ীকে বললো,ওর হাতের বানানো কিছু জিনিস বড়মামীকে দেখাতে। মৃন্ময়ী নিজের সুটকেসে সযত্নে রেখে দেওয়া সব হাতের কাজ করা জিনিস বড় মামীকে দেখালো। ওর মধ্যে থেকে বেশ কয়েকটা বড়মামী একটা ব্যাগে ভরে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে বললো। মৃন্ময়ীর খুব কষ্ট হচ্ছিলো ওগুলো হাতছাড়া করতে। কিন্তু ও অসহায় ,বড় মামীকে মুখের উপর না কি ভাবে বলবে ও। আসলে মৃন্ময়ীর কষ্টের কারণ,এই প্রত্যেকটি জিনিস ও পরম যত্নে , ধৈর্য্য ধরে সৃষ্টি করেছে। ওর এই প্রত্যেকটি শিল্পকর্ম ওর কাছে ওর সন্তানের মতো। 



পরদিন তো সকাল থেকেই মৃন্ময়ীর নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই। দুপুরে ভাতের সঙ্গে তিন রকমের ভাজা, মাছের তিনটে পদ, কষা মাংস, চাটনি,পায়েস সবই ও নিজের হাতে রান্না করেছে। বড়দির শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুব ভালো। বড়দি আজ একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পড়েছে,আর নীল রঙের ব্লাউজ।কি সুন্দর দেখতে লাগছিল বড়দিকে আজ। মৃন্ময়ীই তো বড়দিকে শাড়ি পড়তেও সাহায্য করে দিলো। তখন অবশ্য বড় মামী একটু রান্নাঘরে গিয়ে পায়েসটা নেড়ে দিচ্ছিলো, যাতে পুড়ে না যায়। বড়দি অবশ্য মৃন্ময়ীকেও নিজের একটা পুরোনো সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি পড়তে দিয়েছিল । মৃন্ময়ীর দুধে আলতা রঙে খুব সুন্দর মানিয়েছে শাড়িটা। বড়দি বলেছে রান্নাবান্না হয়ে গেলে যেন মৃন্ময়ী শাড়িটা পড়ে নেয় , বড়দির শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসবার আগেই। মৃন্ময়ী তাই রান্নাবান্না সেরে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে শাড়িটা পরে নেয়। তারপর নিজের মনে ছোট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা আলগা খোঁপা করে নিল, আর। কপালে একটা ছোট্ট টিপ পড়লো। মৃন্ময়ী দেখলো মা ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে। তারপর বললো, "কি সুন্দর লাগছে মা তোকে,এত রূপ তোর, অথচ সংসারের কাজ করতে করতেই তোর সারাদিন চলে যায় মা। তোর এই রূপের কদর তোর মা এ জন্মে মনে হয় আর করতে পারবে না। না লেখাপড়া শেখাতে পারলাম তোকে, আর না ই একটা ভালো বিয়ে দিতে পারলাম।" কথাগুলো বলে মা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৃন্ময়ী মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, "আমার তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবার নেই মা। সব মেয়ের কি বিয়ে হয় নাকি। কতো মেয়ে তো বিয়ে না করেও থাকে, আমিও থাকব।" মা আবার বললো,"তারা হয়তো লেখাপড়া শিখে ভালো কাজকর্ম করে, চাকরি করে। তোর মতো পরের সংসারে কাজ করে না মৃন্ময়ী।" মৃন্ময়ী এবার মাকে জড়িয়ে বললো, " এত ভেবো না মা, আমি ভালো আছি এখানে। তুমি এবার বিশ্রাম করো মা, আমি নীচে যাই। অনেক কাজ আছে।"




মৃন্ময়ী তাড়াতাড়ি নেমে রান্নাঘরে ঢুকলো। ঢুকতেই বড়মামী আড়চোখে মেজমামীকে ইশারা করে ওকে দেখালো। তারপর বড়মামী বললো,"বাবা মৃন্ময়ী তুই আজ এতো সাজগোজ করেছিস কেন? পাকা কথা তো তোর দিদির বিয়ের ঠিক হবে। " মৃন্ময়ী শুনে বললো, "না গো মামী কোথায় আর সেজেছি। ওই বড়দিই তো একটা তাঁতের শাড়ি দিয়ে বললো, মৃন্ময়ী আজ তুই এটা পড়িস। সেজন্যেই পড়লাম গো মামী শাড়ীটা।" বড়মামী আর মেজমামী দুজনেই একসাথে বলে উঠলো,"ঠিক আছে, ঠিক আছে, অতো অজুহাত না দেখিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি চা, জলখাবারের ব্যবস্থা কর দেখি। ওরা এসে গেছে কখন।" মৃন্ময়ী তাড়াতাড়ি সকলের খাবার সাজিয়ে দিলো। তারপর ট্রে তে সাজিয়ে হলঘরের দিকে নিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গেই বড়মামী বলে উঠলো," তুই শুধু নিয়ে চল, ওখানে তোর বড়দি সবাইকে দিয়ে দেবে।" মৃন্ময়ী ঘাড় নাড়লো। হলঘরে মৃন্ময়ীর পেছন পেছন বড়মামী আর মেজমামীও গেল। ছোটমামী, বড়দি, মামারা সবাই তো ওখানেই ছিল। বড়মামী বড়দিকে ইশারা করে বললো খাবার গুলো ধরে দিতে মৃন্ময়ীর হাত থেকে নিয়ে। বড়দি সবাইকে ধরে দিতে লাগলো খাবারগুলো। বড়দির বর সুমিতদাকে কি সুন্দর দেখতে। মৃন্ময়ী মনে মনে ভাবলো দু'জনকে খুব সুন্দর মানাবে । মৃন্ময়ী খাবারগুলো দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। হঠাৎই সুমিতদাদের বাড়ির কোনো মহিলা মৃন্ময়ীকে দেখে বললেন,"বাঃ ভারি মিষ্টি দেখতে তো মেয়েটিকে। কে হয় আপনাদের? কি নাম তোমার"? মৃন্ময়ী কথার উত্তর দেওয়ার আগেই বড়মামী বলে উঠলো,"ও আমাদের বাড়িতে থাকে।ওর নাম মৃন্ময়ী"। ভদ্রমহিলা আবার বললেন,"সত্যি মৃন্ময়ীর মতই দেখতে । কি সুন্দর প্রতিমার মতো মুখশ্রী।" এবার মেজমামী কথা ঘোরানোর জন্য বললো, " আপনারা মিষ্টিটা খেতে শুরু করুন। মৃন্ময়ী যা চা করে নিয়ে আয়।" মৃন্ময়ী রান্নাঘরে গেল চা বানাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা নিয়ে যখন এলো, তখন মৃন্ময়ী দেখলো বড়মামী ওর সব হাতের কাজ বড়দির হাতের কাজ বলে ওদের দেখাচ্ছে। এবার আর মৃন্ময়ীর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে গতকাল রাতে বড়মামী কেন ওর হাতের কাজগুলো নিয়ে এসেছিল। মৃন্ময়ী লক্ষ্য করলো সুমিতদার এক বন্ধু হাতের কাজ দেখে খুব মুগ্ধ হয়ে জানতে চাইছে বড়দির থেকে কিছু। অথচ বড়দি কিছুই বলতে পারছে না এ ব্যাপারে। সুমিত দা বড়দিকে বললো,"আমার এই বন্ধু হাতে তৈরি জিনিস বাইরে সাপ্লাই করে। ও তো খুঁজে বেড়ায় এইসব শিল্পীদের।" মৃন্ময়ী অবাক চোখে শুনছিলো ওদের কথা। তারপর ও আর থাকতে না পেরে সুমিতদাকে বললো,"এগুলো সব আমার তৈরি করা জিনিস সুমিত দা। বড়দি কেমন করে বলতে পারবে। ও তো কখনও দেখেইনি এগুলো তৈরি করবার সময়।" মৃন্ময়ীর কথা শুনে সুমিতদার বাড়ির সবাই অবাক। ঘরের মধ্যে যেন কেউ বোমা পাঠালো। বড়মামী ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বললো,"এখানে এত বকবক না করে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা কর রান্নাঘরে গিয়ে।" মৃন্ময়ী নিজেও বুঝতে পারেনি ও এভাবে সকলের সামনে বলতে পারবে যে , এগুলো ও বানিয়েছে। আসলে এই হাতের কাজটাই তো ওর একমাত্র সম্বল জীবনে। এই একটা কাজই তো ও নিজের জন্য করে। সেখানে বড়মামী যদি ওর হাতের কাজগুলোকে বড়দির হাতের কাজ বলে চালাতে চায়, তাতে ওর আপত্তি হবে বৈকি। বড়দি তো স্কুলে চাকরি করে, ওর বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। একটা স্বাবলম্বী মেয়ের বিয়ের জন্য হাতের কাজ দেখাতেই হবে এ ধারণা অমূলক ছাড়া আর কিছুই না। তাও বড়মামী কেন যে হাতের কাজ নিয়ে ওদের দেখাতে চাইছে কে জানে। মৃন্ময়ীকে সুমিতদার বন্ধু ওর সব কথা শুনে জানতে চাইলো, আর কি কি হাতের কাজ মৃন্ময়ী জানে, সেগুলো যেন একটু এনে দেখায়। মৃন্ময়ী বড়মামীর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে উপরে নিজের ঘরে গিয়ে ওর সেই সুটকেস খুলে , সমস্ত হাতের কাজ একটা ব্যাগে ভরে নীচে নিয়ে এলো। বড়দির শ্বশুরবাড়ির সবাই অবাক ওর হাতের অসামান্য কাজ দেখে। ওর মূর্তি তৈরির অসামান্য প্রতিভা দেখে সুমিতদার বন্ধু বিমান অবাক হয়ে ওর থেকে জানতে চাইলো ,ও কোথায় শিখেছে এই কাজ। শুধুমাত্র দেখে দেখে এধরণের কাজ যদি কেউ করতে পারে, তার যে কি অসামান্য প্রতিভা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেদিন ওরা খাওয়া দাওয়া করে চলে গিয়েছিল। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ওরা চলে যাবার পর মৃন্ময়ীর মামারবাড়ির লোকজন মৃন্ময়ীকে অনেক কথা শুনিয়েছিল। কেন ও নিজের হাতের কাজ সবাইকে আগ বাড়িয়ে দেখাতে গেছে, সেটা নিয়ে বড়মামী আর মেজমামী ওকে যারপরনাই হেনস্থা করেছে। 



এর ঠিক সাতদিন পর সকালের দিকে মৃন্ময়ী তখন রান্নাঘরে কাজ করছে। কলিং বেলের আওয়াজে বড়মামী নিজেই দরজাটা খুলতে গেল। দরজা খুলেই সামনে সুমিত আর ওর বন্ধু বিমানকে দেখে বড়মামী অবাক হয়ে গেল। ওদের ভেতরে বসতে বলে, বড়দিকে ডাকতে গেল। বড়দিও দেখে অবাক ওদের। বড়দি তো সুমিতকে জিজ্ঞেসও করে ফেললো, যে সে যে আজ এ বাড়িতে আসবে সকালে তা জানায়নি কেন। সুমিত বললো, সে নিজেও নাকি জানতো না যে সে আসছে এ বাড়িতে আজ। বিমান হঠাৎই সকালে ফোন করে বললো, তার নাকি কি জরুরি দরকার আছে মৃন্ময়ীর সঙ্গে কাজের ব্যাপারে। আর ঠিক সেকারণেই এত সকালে তাদের এখানে আসা। সুমিত রমিতাকে বলে সে যেন মৃন্ময়ীকে একবার ডেকে দেয় এখুনি। রমিতা মৃন্ময়ীকে ডেকে আনলে বিমান মৃন্ময়ীকে বলে, সে যেন তার হাতের কাজগুলো নিয়ে এখনই বিমান আর সুমিতের সঙ্গে যায়। বড়মামী সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানিয়ে বলে, এখন মৃন্ময়ীর এ বাড়ি থেকে বেরোনো সম্ভব না। কিন্তু সুমিত সামনে আছে বলে রমিতা তার মাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে, "একদিন তোমরা একটু করে নাও না মা সবাই মিলে। ওরা মৃন্ময়ীকে নিতে এসেছে যখন কোনো দরকার নিশ্চয়ই আছে। রমিতার কথায় বড়মামী আর আপত্তি করতে পারলো না মৃন্ময়ীর ওদের সঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে। মৃন্ময়ী তৈরি হয়ে ওর মাকে বলে বেরোলো ওদের সঙ্গে। সে তো নিজেও জানে না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা তাকে। তার এই হাতের কাজ নিয়ে এরা কি করবে। বিমান বাবু আর সুমিতের সঙ্গে মৃন্ময়ী একটা বড় বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলো। ওরা মৃন্ময়ীকে বাড়িটির ভেতরে নিয়ে গেল। দোতলায় একটা বড় হলঘরে মৃন্ময়ী দেখলো কত মেয়ে হাতের বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। কত হাতের কাজের জিনিস যে সেখানে রাখা আছে, তা বলার না। মৃন্ময়ী বড় বড় চোখ করে চারদিক দেখছিল। হাতের কাজেরও যে এত কদর তা মৃন্ময়ীর জানা ছিল না। হলঘরটি পার করে ওরা একটা সুসজ্জিত অফিসে প্রবেশ করলো। অফিসটাও কি সুন্দর রুচিসম্মতভাবে সাজানো। আর প্রত্যেকটা জিনিসই কিন্তু হাতে তৈরি করা। চেয়ারে এক মাঝবয়সী সুদর্শনা ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। বিমান বাবু মৃন্ময়ীকে দেখিয়ে সেই ভদ্রমহিলাকে বললেন,"দিদি তোমাকে এনার হাতের কাজের কথাই বলেছিলাম। সুমিতের হবু শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, আর সেখানেই ওর হাতের অসামান্য কাজ দেখি। আর শুধুমাত্র এমব্রয়ডারির কাজ না, ইনি খুব সুন্দর মূর্তি, পুতুল এইসবও তৈরি করতে পারেন। তোমাকে দেখাচ্ছি সব। আর এর নাম মৃন্ময়ী।" ভদ্রমহিলা মৃন্ময়ীকে ইশারায় বসতে বললেন। তারপর ওর হাতের কাজ দেখাতে বললেন। মৃন্ময়ীর নিজের হাতের তৈরি সব জিনিস দেখে, ভদ্রমহিলা অভিভূত। বললেন, "এত সুন্দর প্রতিভা নিয়ে তুমি এতদিন ঘরে বসেছিলে"? বিমান বাবু হেসে বললেন,"সেজন্যই তো তোমার কাছে নিয়ে এলাম দিদি। আমি জানতাম এই গুনের কদর তুমিই একমাত্র করতে পারবে।" 




না এরপর আর মৃন্ময়ীকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সে দু দিন পরই এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল ট্রেনার হিসাবে একটা সম্মানীয় মাসিক অর্থমূল্যে। তার মামার বাড়িতে যে এটা নিয়ে খুবই অশান্তি‌ হয়েছিল, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ বিনে পয়সার কাজের লোক যে তারা আর পাবে না। তারা এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিল যে, মৃন্ময়ী আর তার মা যেন অন্যত্র থাকার জায়গা দেখে নেয়। এ বাড়িতে আশ্রিতা চিরকাল কাজের লোক হয়ে থাকা মেয়েটি ব্যাগ দুলিয়ে অফিস যাবে, এ ব্যাপারটা তাদের মেনে নিতে অসুবিধা আছে। মৃন্ময়ী কয়েক মাস সময় চেয়েছিল মামীদের থেকে একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবার জন্য। যদিও এই ক মাস তাকে এ নিয়ে যথেষ্ট কটূক্তি শুনতে হয়েছে। সত্যি কি বিচিত্র আমাদের এই সমাজ। যে মেয়েটা ছোটবেলা থেকে বিনা স্বার্থে এই বাড়ির সেবা করে গেল, আজ তার একটু সফলতা এ বাড়ির লোক মেনে নিতে পারছে না। কোথাও যেন প্রচ্ছন্ন একটা হিংসার ভাব লুকিয়ে আছে তাদের এই মেনে নিতে না পারার মধ্যে। যদিও তাতে মৃন্ময়ীর সফলতা একটুও বাধাপ্রাপ্ত হবে না। হ্যাঁ , সাময়িক অসুবিধার সম্মুখীন হয়তো তাকে হতে হবে। কারণ অসুস্থ মাকে নিয়ে একটা নিশ্চিত আশ্রয়ের খোঁজ তো তাকে করতে হবে। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিল তার অফিসের বস বিমান বাবুর দিদি আলপনা দেবী। মাঝবয়সী এই ভদ্রমহিলা এই কয়েক মাসেই মৃন্ময়ীকে নিজের বোনের মতো ভেবেছিলেন। আসলে আমাদের চারপাশে কিছু সম্পর্ক এমন তৈরি হয়, যা রক্তের সম্পর্ক না হয়েও জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। এটাও অনেকটা সেরকমই একটা সম্পর্ক। মৃন্ময়ী তার যোগ্যতা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে নিজের একটা আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল।



মাকে নিয়ে এখন সে বিমানবাবুদের অফিস থেকে দেওয়া একটা ফ্ল্যাটে থাকে। মায়ের সুবিধার জন্য একটা সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে ঠিক করে দিয়েছে মৃন্ময়ী। মাকে ভালো ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রেখে অনেকটাই সুস্থ করতে পেরেছে সে।এখন মা অল্প অল্প করে হাঁটাচলা করে। আর মাকে কষ্ট পেতে সে দেবে না কিছুতেই। সেই অল্পবয়স থেকে সে দেখেছে, তার মাকে অন্যের জন্য প্রাণপাত করে খাটতে। কখনও নিজের জন্য কোনো সুখ দাবি করেনি তার মা। আজ তাই মৃন্ময়ী যখন সুযোগ পেয়েছে, তখন মাকে সে সমস্ত দিক থেকে ভরিয়ে রাখবে আনন্দে, সুখে। রাতে মায়ের পাশে শুয়ে মৃন্ময়ী দেখে মায়ের মুখে এত বছর পর কি সুন্দর প্রশান্তির ছাপ। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে সস্নেহে। ঠিক যেমন করে মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো ছোটবেলায়। মৃন্ময়ী খুব আস্তে তার ঘুমন্ত মাকে বলে,"অনেক কষ্ট পেয়েছো তুমি। আর কখনও তোমায় কোনো কষ্ট পেতে দেব না মা। যতো কষ্ট তুমি পেয়েছো, তার দ্বিগুণ খুশি আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেব মা। এটা তোমার মৃন্ময়ীর প্রতিজ্ঞা তোমার কাছে। কষ্টকে হারিয়ে দিয়ে খুশিকে জয় করে নেওয়ার মন্ত্রটা এবার তোমার মৃন্ময়ী শিখে গেছে।"



এবছর মৃন্ময়ীর উপর দায়িত্ব পড়েছে সংস্থানের জন্য দুর্গা প্রতিমা তাকেই নির্মাণ করতে হবে। তার অফিসের বস আলপনা দেবীর তার উপর অগাধ বিশ্বাস। মৃন্ময়ী নতুন উদ্যমে অনেক বছর পর আবার প্রতিমা নির্মানের কাজে হাত লাগালো। আর দূর থেকে দাঁড়িয়ে আলপনা দেবী বিমান বাবুকে বললেন," মৃন্ময়ী দুর্গার হাত ধরেই তবে শুরু হোক এ যুগের মৃন্ময়ীর নতুন যাত্রা।"----


      

         


Rate this content
Log in