Sucharita Das

Classics Crime Inspirational

4  

Sucharita Das

Classics Crime Inspirational

তিথির ডায়েরি

তিথির ডায়েরি

7 mins
377


 তিথি হলো আমাদের পাশের বাড়ির দত্ত কাকিমার ছেলের বউ। সেই সূত্রে আমার সঙ্গে তার আলাপ। পাশের বাড়িতেই যেহেতু তাই ছাদে উঠলে বা বাড়ি থেকে বেরোলে দেখা তো হতোই। এই তিথি সেদিন কথায় কথায় আমাকে জানতে চাইলো ডায়েরি লিখেছো দিদি কখনও? আমি বললাম অনেক ছোটবেলা থেকেই লিখতাম,আজও লিখি। এটা আজও আমার খুব প্রিয় কাজের একটা। ওকে বললাম, জানো তিথি মুঠোফোনে আজ আমাদের দুনিয়া বন্দী হয়ে, আমরা সবদিক থেকে ডিজিটাল হয়ে গেলেও, মনের এই দিকটায় আমি আজও ডিজিটাল হতে পারলাম না। ফোনে মনের কথা লিখতে ঠিক ভালো লাগেনা যেন। বছরের শুরুর নতুন ডায়েরি হাতে পেয়ে তাই আজও আমি তার আঘ্রান নিই। কি আনন্দ যে হয় তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না"। তিথি বললো, "দিদি আমিও তাই। তিথি বললো, রোজ রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তিথি নাকি নিজের ডায়েরি আর পেন নিয়ে বসে। শোভনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে ঘরে আলো জ্বললে, তাই ও নিজের মোবাইলের আলোয় বসে বসে লেখে নিজের মনের দুঃখ, কষ্ট, ভালোলাগা, মন্দলাগা সব। আর তারপর সে তার ডায়েরিটা নাকি লুকিয়ে রাখে। তিথির ভয় হয় যদি ওর মনের না বলা কথাগুলো কেউ পড়ে ফেলে ওকে ভুল বোঝে। তখন তো ও কোনো উত্তর দিতে পারবে না কাউকে! কি করে ও বলবে ওদের যে এই কথাগুলো ও শুধুমাত্র ওর নিজের সঙ্গেই বলতে পারে। 


সেদিন সকালে হঠাৎই কাজের মেয়েটির কাছে শুনলাম তিথি নাকি খুব অসুস্থ। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এই তো গত পরশুদিনই তিথির সঙ্গে ছাদে কতো কথা বললাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। দেরি না করে দত্ত কাকিমার বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজালাম। দত্ত কাকিমাই দরজা খুলে দিলেন। জানতে চাইলাম তিথির কথা। ইশারায় কাকিমা তিথির ঘরের দিকে যেতে বললো। দেরি না করে তিথির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ঘর, সর্বত্র তিথির হাতের যত্নের সুস্পষ্ট ছাপ। বিছানায় তিথি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মুখটা কেমন যেন ম্লান।আমি গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ও চোখ মেলে তাকালো। আমাকে দেখেই ওর মুখটা খুশিতে উজ্বল হয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গেল ও। একটু অবাক হয়ে গেলাম আমি ওকে দেখে। এই তো গত পরশুদিন বিকালেই ওকে দেখলাম ছাদে। কথাও বললো আমার সাথে, কই তখন তো তিথিকে দেখে একবারও মনে হয়নি যে ওর শরীর এতটা অসুস্থ। অথচ আজ ওর বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। এই একদিনে কি এমন হলো ওর? আমিই ধরে বসিয়ে দিলাম ওকে। হঠাৎই তিথির বাঁ দিকের গালের দিকে চোখ পড়লো আমার। চমকে উঠলাম ওর গালের কালশিটে দাগ দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, " কি হয়েছে তোমার গালে তিথি? "

ও কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ওর বালিশের তলা থেকে একটা ডায়েরি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো, "এটা কদিন তোমার কাছে রাখবে দিদি? আমি সুস্থ হয়ে তোমার থেকে এটা নেব। ততদিন তুমি এটা তোমার কাছেই রেখে দিও যত্ন করে। "

আমি বললাম "তোমার জিনিস আমি সযত্নে আমার কাছে রেখে দেব তিথি, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমার থেকে ফেরত নিও তোমার জিনিস "। 

সেদিন আর কোনো কথা সেভাবে হয়নি। দত্ত কাকিমা এরপর পাপাইকে তিথির কাছে নিয়ে এসেছিল। আমিও সেদিনের মতো তিথিকে বলে উঠে পড়েছিলাম। তিথির ডায়েরিটা সঙ্গে নিয়ে ওদের বাড়ি থেকে ভারাক্রান্ত মনে নিজের বাড়িতে ফিরেছিলাম। কেন জানি না তিথিকে দেখে মনটা ঠিক ভালো লাগছিল না আমার। মনে শুধু একটাই জিজ্ঞাসা ছিল অমন সুন্দর প্রাণবন্ত মেয়েটা হঠাৎ এতটা অসুস্থ কি করে হয়ে গেল। 



এর পরদিনই তিথিকে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়েছিল। কারণ ওর অবস্থার নাকি ক্রমাগত অবনতি হচ্ছিল। আর তার ঠিক একদিন পরই কাজের মেয়েটি সকালবেলা এসে বললো, তিথি নাকি কোমায় চলে গেছে।আমার মনে হচ্ছিল সারা শরীর আমার অবশ হয়ে আসছে কষ্টে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। অত সুন্দর প্রাণবন্ত অল্পবয়সী একটা মেয়ের এই পরিণতি ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিলো। 



সেদিন রাতে ড্রেসিং টেবিলের কাবার্ড খুলে তিথির ডায়েরিটা কেন জানিনা নিজের অজান্তেই বের করেছিলাম। দু চোখ আমার জলে ভরা, শুধু তিথির সঙ্গে আমার দেখা করবার দিনটার কথা আর ওর কথাগুলো বড় বেশি করে মনে পড়ছিল। ও তো বলেছিল ও এসে ওর জিনিস আমার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে যাবে, তাহলে ও কেন শেষপর্যন্ত ওর কথা রাখলো না? আমি তো ওর জিনিস সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম ওকে ফিরিয়ে দেব বলেই । কিছুতেই নিজের চোখের জল আটকাতে পারছিলাম না। তিথির ডায়েরিটা যে তিথির বড়ো প্রিয় ছিল। মনে মনে ভাবলাম, কাল ওদের বাড়ি গিয়ে ওর স্বামীর হাতে ওর প্রিয় জিনিসটা তুলে দিয়ে আসবো। ওর জিনিস ওর প্রিয় মানুষটার কাছেই ভালো থাকবে হয়তো । যদি তিথি ফিরে আসে তখন ওর প্রিয় জিনিসটা আবার ওর ঘরেই পাবে ও। ডায়েরিটা টেবিলে রেখে উঠতে যাব হঠাৎই হাত লেগে ডায়েরিটা নীচে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে ওঠাতে গিয়ে দেখলাম ডায়েরিটা পড়ে গিয়ে খুলে গেছে আর পাতাগুলো হাওয়ায় উড়ছে। ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে দিতে যাবার সময় হঠাৎই চোখে পড়লো ডায়েরিতে লেখা তিথির কয়েকটি কথা------

"আমি তো তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম শোভন। অথচ তুমি কথায় কথায় আমার গায়ে হাত তোলো, মারধর করো আমাকে। আমার কি দোষ ছিল বলোতো? সবসময় তোমাদের কথাই ভেবেছি, তোমার সংসারকেই ভালোবেসেছি। বাবা, মায়ের কাছে গিয়ে কয়েকটা দিন থাকতে চেয়েছিলাম শুধু। তুমি যা নয় তাই বলে আমার বাবা, মাকে অপমান করলে। বললে ওই ভিখিরিদের বাড়ি গেলে পাপাই নাকি খেতে পাবে না। ওর যত্ন হবে না। কথাগুলো বলার আগে একবারও ভাবলে না যে আমার কতো কষ্ট হবে আমার বাবা মাকে এভাবে অপমান করছো বলে। "


আমার দু চোখ তখন তিথির ডায়েরির পাতায় আবদ্ধ। এসব কি লিখেছে তিথি? তবে কি শোভন ওকে মারধর করতো নাকি? তিথির আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী তবে কি শোভনই ? ------নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দত্ত কাকিমার ছেলে শোভনকে আপাতদৃষ্টিতে ভদ্র, সভ্য একজন মানুষ বলেই মনে হয়। অথচ তিথির লেখানুযায়ী সে তো সম্পূর্ণ বিপরীত এক চরিত্র দেখছি। জানি কারুর ডায়েরি তার অনুমতি ছাড়া পড়া উচিত নয় হয়তো। কিন্তু আমার মাথায় তখন তিথির ডায়েরির লেখাগুলো ঘুরছে। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বেড সাইট লাইটটা অন করলাম। শুরু করলাম তিথির ডায়েরি প্রথম থেকে পড়া------


"কতো আশা নিয়ে এসে শ্বশুরবাড়িটাকে নিজের বাড়ি বলে ভাবতে শুরু করেছিলাম। প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকলেও ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম আমার গরীব বাবা মায়ের কোনো সম্মান নেই তোমাদের বাড়িতে"। 



"আজ বাবা, মা আমার প্রথম সন্তানসম্ভবা হবার খবর পেয়ে কত আনন্দ নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিল। ওদের কতো ইচ্ছা ছিল ওরা কয়েকটা দিন আমার কাছে থাকবে। অথচ তোমরা পছন্দ করো না বলে আমি ওদের বিকালেই ফেরত পাঠিয়ে দিলাম বাড়িতে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার বাবা, মায়ের করুন মুখ দুটো দেখে। সত্যি আমরা মেয়েরা কিছু ক্ষেত্রে আজও বোধহয় খুব অসহায়"। 


"আমার ন মাসের সাধ ভক্ষণের অনুষ্ঠানে মা নিজের শেষ সম্বল কানের দুল জোড়া দিয়ে আমাকে আশীর্বাদ করেছিল। সেখানেও সকলের সামনে কতো অপমান করলে আমার মা বাবাকে তোমরা এই বলে যে, এই পিতপিতে সোনার দুল দেওয়া আর না দেওয়া নাকি দুই সমান। তোমরা শুধুমাত্র সোনার ওজন আর মুল্য নিয়েই ভাবলে, আমার মা বাবার ভালোবেসে দেওয়া আশীর্বাদের কোনো মুল্য তোমাদের কাছে হয়তো ছিল না। অথচ দেখো আমি সব দেখেও কোনো প্রতিবাদ করতে পারলাম না। নির্বাক শ্রোতার মতো আমার বাবা, মায়ের সব অপমান দেখে গেলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার বিশ্বাস করো, কিন্তু এক্ষেত্রেও বাবা, মায়ের ভালোর জন্যই কোনো প্রতিবাদ করতে পারলাম না। যদি আমাকে মা, বাবার সঙ্গে পাঠিয়ে দাও চিরকালের মতো এই আশঙ্কায় । আমার গরীব বাবার অত সামর্থ্য কোথায় দু জনকে রাখবে। আসলে বাবা, মা তো এটা জানতো না যে তুমি কথায় কথায় আমাকে শাসিয়ে এটা বলো যে, তোমাদের কথা না শুনলে আমাকে তোমরা বাপের বাড়ি বসিয়ে দিয়ে আসবে। গরীব বাবা, মায়ের মেয়ে হবার অনেক জ্বালা যে"। 



"আজ পাপাইয়ের অন্নপ্রাশনে তোমাদের বাড়ির সবাই মুল্যবান উপহার দিয়েছে। তোমরা কত খুশি আজ। চারিদিকে সবাই কতো আনন্দ করছে পাপাইকে নিয়ে। অথচ তোমরা আমার বাবা, মাকে আসতে বারণ করে দিলে। মোটা সোনার হার নাতিকে উপহার না দিতে পারলে যেন আমার মা বাবা এই অনুষ্ঠানে না আসে, এরকম কথাও বলেছিলে তোমরা। কোথায় পাবে বলোতো ওরা? যেটুকু সঞ্চিত ছিল আমার বিয়েতে তোমাদের দাবিদাওয়া মেটাতেই সব শেষ । শুধু মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ছাড়া আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ওদের কাছে"। 



আমি পরপর এরকম অজস্র ঘটনা এক নিঃশ্বাসে তিথির ডায়েরি থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, এর অর্থ তো এটাই দাঁড়াচ্ছে যে দত্ত কাকিমার বাড়িতে তিথি ভালো ছিল না। ওর উপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করা হতো ওর বাপের বাড়ির অবস্থা খারাপ বলে। 

আমি আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে তিথির লেখা ওর ডায়েরির শেষ পাতায় গেলাম---

--------------

"আজ খুব কষ্ট হচ্ছে লিখতে। জানিনা এরপর আবার কবে লিখতে পারবো। আজ শোভন ধাক্কা মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়েছে আমাকে। ও জানতো আমি দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা। পড়ে গিয়ে কি হয়েছিল আমার মনে নেই। জ্ঞান ফিরতে নিজেকে বিছানায় দেখতে পেয়েছি। শরীরে আর কোনো জোর নেই। এটা বুঝতে পেরেছি আমার গর্ভের সন্তান আর হয়তো বেঁচে নেই। ধীরে ধীরে রক্তের স্রোত নামছে বিছানায়। মা, বাবার কথা খুব মনে পড়ছে । ওদের অসহায় মুখদুটো শেষবারের মতো একবার দেখতে ইচ্ছা করছে, জানিনা আর কখনও দেখতে পাব কিনা। যদি বেঁচে থাকি এ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নতুনভাবে নিজের জীবনকে সাজিয়ে মা, বাবাকে আর সন্তানদের নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবো"এতদিন যা করতে পারিনি এবার সেটা করতে চেষ্টা করবো।"



আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ডায়েরি হাতে বসে আছি। চোখের জল আটকাতে পারছিনা যে কিছুতেই। মেয়েটা এত কষ্ট ভেতরে চেপে রেখেছিল অথচ কখনও জানতে পারিনি। শেষপর্যন্ত মেয়েটাকে এভাবে একপ্রকার মৃত্যুর দিকেই তো ঠেলে দিলো ওরা। ভাগ্যিস ডায়েরিটা হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, নাহলে কখনও জানতেই পারতাম না এসব ঘটনা। ওই খুনীগুলোর হাতে তিথির প্রিয় জিনিসটা ভাগ্যিস তুলে দিইনি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, তিথির এই ডায়েরি কালই তার বাবা, মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেব। অপরাধীদের শাস্তি দেবার সবরকম যোগ্য ব্যবস্থা করতে ওর বাবা, মাকে সাহায্য করবো আমি। তিথিকে এভাবে আমি হেরে যেতে দেব না কিছুতেই। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে তিথির আমার কাছে রেখে যাওয়া তার এই প্রিয় ডায়েরির যথাযোগ্য মর্যাদা দেব আমি। তিথির চিকিৎসার সবরকম ব্যবস্থা যাতে ভালোভাবে হয় সেটাও দেখতে হবে । এভাবে তিথিকে হেরে গিয়ে কিছুতেই চলে যেতে দেব না আমি। ওকে সুস্থ করে ওর প্রিয় ডায়েরিটা যে ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে আবার। যে ডায়েরিতে ও এবার শ্বশুরবাড়িতে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবার কথা লিখবে না, লিখবে ওখান থেকে বেরিয়ে নিজের নতুনভাবে বাঁচার কথা, নিজেকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার কথা, লিখবে এক স্বাবলম্বী তিথির জীবন যুদ্ধে জিতে যাবার কথা। 


          


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics