অন্তরাল - সপ্তম পর্ব
অন্তরাল - সপ্তম পর্ব
কলিং বেলের আওয়াজ হতেই মিনা চায়ের কাপটা প্লেটে রেখে দিয়ে বলল-
" বৌদি তুমি বসো। আমি দেখছি। " বলেই সে উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর মিনা নিচের তলা থেকে চিৎকার করে বলে উঠল-
" বৌদি? শিঞ্জিনী দিদি এসেছে। "
শিঞ্জিনী নামটা শুনেই অনুপমা দেবী মুখে এক রাশ হাসি আর মনে বুক ভরা আনন্দ নিয়ে হাঁটু ব্যথা সত্ত্বেও যতটা দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন।
" কাকিমনি একটু আসতে নামো। তোমার না হাঁটুতে ব্যথা। "
অনুপমা দেবী শিঞ্জিনীর সামনে গিয়ে তার গালে হাত দিয়ে স্নেহের স্পর্শ মাখিয়ে বললেন-
" তোকে দেখলে আমার সব কষ্ট ব্যথা দূর হয়ে যায় রে মা। "
শিঞ্জিনীকে আদর করতে করতে তাঁর চোখটা জলে ভোরে যায়।
" এ কি কাকিমনি? তুমি কাঁদছো? আমি তো তোমার সামনেই আছি। "
" সেই জন্যই তো তোকে এতদিন পর দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। চল্ আমার ঘরে। ওখানে বসে তোর সাথে দুটো সুখ দুঃখের কথা বলি। কতদিন মন খুলে কথা বলা হয় না। "
শিঞ্জিনীকে নিয়ে তিনি উপর তলায় চলে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন-
" কবে এলি? "
" এই তো গতকাল দুপুরে। আবার আগামীকাল চলে যাব। "
" কেন রে? আর কটাদিন থেকে যা। এই তো সবে এলি। বাবানও একটু পরেই কলেজ থেকে চলে আসবে। "
" না গো কাকিমনি। সোমবার কলেজে একটা সেমিনার আছে। যেটা আমিই হোস্ট করছি। "
এরপর তারা দুজনে ঘরে গিয়ে বসে। মিনা ঘরে ঢুকতেই অনুপমা দেবী তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
" মিনা জানিস্ তো কি করতে হবে? "
মিনা এক গাল হেসে নিয়ে বলে-
" জানি গো বৌদি। তুমি শিঞ্জিনী দিদির জন্য পোলাও আর আলুর দম বানাবে তো? আমি এক্ষুণি সব জোগাড় করে দিচ্ছি। "
" আর যদি কিছু লাগে তাহলে দোকান থেকে আনিয়ে নিবি। "
মিনা ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতেই শিঞ্জিনী বলল-
" ভেবেছিলাম তোমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেই বেড়িয়ে যাব। কিন্তু এখন দেখছি পুরনো ভাবনায় নতুন কিছু অ্যাড করতে হবে। রাতের খাওয়াটা একেবারেই মিস্ করা যাবে না। "
এরপর তারা দুজনেই হাসি আর গল্পে মেতে ওঠে। এরা যতক্ষণ গল্প করছে ততোক্ষণ কিছু কথা এই বেলা আপনাদের বলে রাখা ভালো। অনুপমা দেবী হলেন মহিতের মা। নিজের সন্তানের থেকে শিঞ্জিনীর উপর তাঁর ভালবাসা স্নেহ মায়া যেন পরিমানে একটু বেশি। মহিত এই নিয়ে কোনোদিনও হিংসে করেনি। কারণ সে বোঝে তাঁর মায়ের কষ্টটা। অনুপমা দেবীর প্রথম সন্তান ছিল একটি মেয়ে। নাম রেখেছিলেন লিলি। তিন বছর বয়সে এক কঠিন অসুখে মায়ের কোল ত্যাগ করে সে চলে যায়। এর দুবছর পর আবার তাঁর কোল আলো করে মহিত আসলেও কোথাও যেন লিলির স্মৃিতি তাঁকে কষ্ট দিত। মহিত যেদিন প্রথম শিঞ্জিনীকে নিয়ে বাড়িতে এসেছিল সেদিন তার মধ্যে অনুপমা দেবী লিলিকে দেখতে পেয়েছিলেন। আর তারপর যা হয়। মহিতের ভাগের অনেকটা ভালবাসাই শিঞ্জিনীর জন্য বরাদ্দ হয়ে যায়। তাই এতদিন পর শিঞ্জিনী আসায় তার পছন্দের পোলাও আর আলুর দম অনুপমা দেবী নিজে হাতে বানিয়ে খাওয়াতে চান। আর সেও ছাড়ার পাত্র নয়।
দরজায় আবার কলিং বেল বাজতেই অনুপমা দেবী বলে উঠলেন-
" ঐ বুঝি বাবান আসলো। তুই বস্। আমি একটু নীচে গিয়ে দেখি। "
কিন্তু এদিকে শিঞ্জিনী শুধু ভাবছে কি করে সে মহিতের সামনে দাঁড়াবে? গত কয়েকদিনের ঘটনা তাকে একেবারে অস্থির করে তুলেছে। বাস্তব আর স্বপ্ন এই দুটোই যেন এক লাইনে দাঁড়িয়ে শিঞ্জিনীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। যদি পারো তো সত্যিটা খুঁজে বের করো। এখন এইসব কথা কি মহিতকে বলা উচিৎ? এমন কি তার বিশেষ বন্ধুটির কথাও তো মহিত জানে না। এমন সময় হঠাৎ এক গলার আওয়াজে তার চিন্তার জালে ছেদ পড়ে।
" কি রে? কখন এলি? "
শিঞ্জিনী তৎক্ষণাৎ মুখে হাসি ফুটিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে উত্তর দেয়।
" এই তো আধ ঘণ্টা হল। কেমন আছিস্? "
মহিত শিঞ্জিনীর এই প্রশ্নে ব্যাঙ্গাত্মক মুখে বলে-
" হুমম্......Good question। ভালোই। তুই বস্। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি। "
তার এরকম ব্যবহার শিঞ্জিনীর কাছে একদম অচেনা। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিঞ্জিনীর মনের উত্তেজনা যে আরও এক ধাপ বেড়ে গেলো। না জানি ফিরে এসে কেরকম ব্যবহার করবে? কি কথা বলবে? একা ঘরে নিজেকে আরও অস্থির লাগছে তার। তাই নীচে চলে যায় অনুপমা দেবীকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে।
" কি রে শিনু? তুই এখানে যে? মহিত যে উপরে। "
" হ্যাঁ ওর সাথে দেখা হয়েছে। ফ্রেশ হতে গেছে। আর আমারও একা ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই নীচে চলে এলাম। "
" বেশ করেছিস্। আর বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিস্ তো যে তুই আজ রাতে আমাদের এখানে খেয়ে যাবি। "
" সেটা আর বলতে হবে না কাকিমনি। মা জানে এতদিন পর যখন তোমার কাছে এসেছি তখন নিশ্চয়ই তুমি না খাইয়ে ছাড়বে না। "
" সে তো ছাড়বই না। যা তুই ঐ চেয়ারটায় গিয়ে বস্। "
" না বসব না। তুমি বলো কি করতে হবে আমি করে দিচ্ছি। আমি তো তোমার মেয়ের মতো। "
এই কথাটার পরেই অনুপমা দেবীর চোখের কোণায় জল চলে আসে। শিঞ্জিনী সেটা দেখে ফেলে।
" এ কি? তোমার চোখে জল কেন? "
তিনি আড়াল হয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে বললেন-
" ওহ্......ওও কিছু না। পেঁয়াজ কাটছি তো তাই। তোর কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু আমার সাথে থাক তাহলেই হবে। "
এমন সময় উপর থেকে মহিতের গলা শোনা গেলো।
" মাআআআ...... শিনু কি তোমার কাছে? "
মহিতের মাও গলা উচিয়ে উত্তর দিলেন-
" হ্যাঁ। কেন? "
" ওকে একটু উপরে পাঠিয়ে দাও তো। "
শিঞ্জিনীর মনটা যেন আবার ধরাস করে উঠল। মহিতের ডাকের মধ্যে কেমন একটা রাগের সুর ভেসে এসেছে।
অনুপমা দেবী বললেন-
" যা শিনু তোর ডাক পড়েছে। " বলেই তিনি একটু হেসে ফেললেন। এদিকে মিনাও মুখ টিপে হাসতে থাকে।
শিঞ্জিনী ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে এবং মনে মনে ভাবতে থাকে এখন যা কিছু হবে সেটার জন্য সে প্রস্তুত না থাকলেও কিন্তু এর জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী।
ক্রমশ......।