অন্তরাল - নবম পর্ব
অন্তরাল - নবম পর্ব
আজ রাতে কিছু না খেয়ে বুকে এক রাশ জমাট বাঁধা অন্ধকার নিয়ে শিঞ্জিনী শুয়ে আছে নিজের ঘরের মেঝের উপর। বাইরে থেকে এসে জামাকাপড়ও চেঞ্জ করেনি। দুচোখ ফুলে গিয়ে প্রায় বুজে আসার মতো অবস্থা যা গত কয়েক ঘণ্টার একটানা কান্নার ফল। এই মুহূর্তে সমস্ত পৃথিবীটাকে তার মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে। কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে করবে না এই সব কিছুর হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে তার মনের ভেতর। এত বড়ো প্রতারনার শিকার কেনই বা হতে হল তাকে? মানুষ চিনতে কি সে এতটাই ভুল করল যে এক মুহূর্তের জন্যও সে বুঝতে পারেনি তার সহজ বিশ্বাসের আড়ালে কতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতার জাল বোনা হচ্ছে। যখন অর্জুনের বিছানায় অর্ধ নগ্ন অবস্থায় সরুজিনীকে দেখতে পায় তখন সমস্ত শরীর ঘৃণায় ভরে যাচ্ছিল শিঞ্জিনীর। অর্জুনও হতভম্ব হয়ে কিছু বলতে পারছিল না। এমন সময় হঠাৎ শিঞ্জিনীর মনকে ঘিরে ধরল দগদগে আগুনের মতো রাগের প্রাচীর। মেঝে থেকে উঠে রাগের আগুনে ফুসতে থাকা শরীরটা ধির পায়ে এগিয়ে চলে ঘরেতে রাখা আলমারিটার দিকে, যেটার দরজা খোলার পর জামাকাপড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা চকচকে কালো রঙের পিস্তলটার দিকে চোখ পড়তেই শিঞ্জিনীর মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল।
মোবাইলের লক্ স্ক্রিনের উজ্জ্বল আলোয় বড়ো হরফে লেখা 10:17 a.m. জগন্নাথবাবু চিন্তিত মুখে সময়টা দেখে নিয়ে একটা চুক্ শব্দ করে মোবাইলটা পকেটে ভরে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলেন। এমন সময় ভেতর ঘর থেকে জবা এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল-
" বাবু আমার কিন্তু খুব ভয় করছে। আমরা কোনোভাবে জড়িয়ে যাব না তো? "
এই কথা শুনে জগন্নাথবাবু একবার জবার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে পায়চারি বন্ধ করে বারান্দার রেলিং ধরে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়েন। এরপর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে জবার উদ্দেশ্যে বললেন-
" ভয় পাস্ না। আমরা তো এর মধ্যে ছিলাম না। পুলিশ আসুক। দেখি কি করা যায়। "
জবা আর কোনো কথা না বলে চায়ের কাপটা জগন্নাথবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। বেলা ১১ টা নাগাদ পুলিশ এসে হাজির হয়। ইন্সপেক্টর দেবজিৎ চক্রবর্তী, উচ্চতায় প্রায় ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি, বেশ স্বাস্থ্যবান, দেখলে মনে হয় সে একাই প্রায় ১০ জনকে মেরে স্বর্গের টিকিট হাতে ধরিয়ে দিতে পারে। এদিকে গায়ের রঙ বেজায় কালো। তবে চিরাচরিত প্রথায় তার গোঁফখানা নেই। এরকম একজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সাড়ে চার ফুট উচ্চতার জগন্নাথ বাবুর পক্ষে একটু ঘাবড়ে যাওয়াই যেন যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সেটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কারণ দুজনের মধ্যে গুরু শিষ্যের সম্পর্ক।
দেবজিৎ বলল-
" আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার উপরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি গিয়ে দেখে আসছি। "
এই বাড়িতে দেবজিতের যাতায়াত গত তিন বছর ধরে প্রায়শই হয়ে আসছে। জগন্নাথ বাবুর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করাকালীন যেই তিন বছর দেবজিৎ ছাত্র হিসেবে ছিল সেই তিন বছর সে জগন্নাথ বাবুর চোখের মণি ছিল। ছেলেটা ছিল অনাথ। তবে পড়াশুনোয় ছিল অসাধারণ মেধা। স্যারের বাধ্য স্টুডেন্ট ছিল। আজ সে যে জায়গায় পৌঁছেছে তার অনেকটাই অবদান তার স্যারের। যে বছর দেবজিৎ চাকরিতে বদলি হয়ে শান্তিনিকেতন চলে আসে তার দু বছর পর অধ্যাপনা জীবনের অবসান ঘটিয়ে নিজের পৈত্রিক ভিটেতে চলে আসেন জগন্নাথ বাবু। একবার এক কফি শপে দুজনের দেখা হওয়ার পর থেকে গুরু-শিষ্যের পুরনো সম্পর্কটা ফিরে আসে। জগন্নাথ বাবুর স্রী মারা যায় কোলকাতায় থাকাকালীন আর একমাত্র ছেলে, সেও দিল্লীতে চাকরি করতে গিয়ে এক পথ দুর্ঘটনায় অল্প বয়সে জীবনের মাঝ পথে ইতি টানে। এখন তার একাকিত্ব জীবনে কোনরকম ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চান না। নেহাত দেবজিৎ আছে বলেই এক্তু স্বস্তি।
এদিকে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে পাশাপাশি তিনটে ঘর একটা পরিবারকে ভাড়া দিয়েছিলেন জগন্নাথবাবু। সেই পরিবারের মধ্যে ছিল এক ছেলে এবং তার মা-বাবা। বাঁ দিকে একদম শেষের ঘরে এখন সেই ছেলে বিছানার উপর মৃত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। গায়ে জামা কাপড় বলতে শুধুই একটা হাফ্ প্যান্ট। ছেলেটার পাশে একটি অল্প বয়সের মেয়ে একদিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। কিন্তু সেই মেয়েটার শরীরে বস্রের কোনো চিহ্ন নেই। দেবজিৎ ঘরের মধ্যে ঢুকতে গিয়ে চোখ যায় বিছানার সামনে মেঝেটায়। সেখানে ছোট প্যাকেটের মতো কিছু একটা পরে ছিল। সেটা হাতে তুলতেই তার মনের হল
" মরার আগে জীবনের শেষ সুখটা তাহলে উপভোগ করে গেছে। "
এরপরেই দেবজিতের মুখে একটা চাপা হাসি খেলে যায়।
ক্রমশ......