Arpita Pal

Crime

4  

Arpita Pal

Crime

অন্তরাল - একাদশ পর্ব

অন্তরাল - একাদশ পর্ব

5 mins
326


টেবিলের উপর এলোমেলো ভাবে ছড়ানো অর্জুন ও সরুজিনীর খুনের দৃশ্যের কিছু ছবি। দেবজিত খুব মন দিয়ে এই ছবি গুলোকে দেখে যাচ্ছে। অর্জুন এবং সরুজিনীর দুজনেরই বুকের বাঁ দিকে একটা করে মোট দুটো গুলি খুনির বন্দুক থেকে খরচ হয়েছে। যে গুলি চালিয়েছে তার হাত এই বিষয়ে ভালোই অভ্যস্ত। তা নাহলে এক শটে নিশানা অব্যর্থ হয় না। এক্ষেত্রে দুটো বিষয় সামনে আসে। এক, যিনি খুন করেছে তার সাথে অর্জুন আর সরুজিনীর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে এবং খুনি ও নিহতরা এরা সবাই ক্রিমিনাল জগতের সাথে যুক্ত। দুই, খুনি একজন ভাড়া করা কিলার। এমন সময় দেবজিতের ফোনটা বেজে ওঠে। ছবি গুলো হাতড়ে সেগুলোর তলা থেকে ফোনটা বের করে দেখে থানার কনস্টেবেল অমরেশ মজুমদার কল করেছেন। ফোনটা রিসিভ করার পর দেবজিত জানতে পারে থানায় এখন অর্জুনের মা বাবা উপস্থিত হয়েছে। খবরটা জানার পর প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যে সে থানায় হাজির হয়। আজকে থানায় ভিড়টা একটু বেশি। হয়তো কোনো নতুন কেস এসেছে। কিন্তু এখন সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার সময় নেই। ভিড় ঠেলে সামনে নিজের ডেস্কের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে দুজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন। দেবজিতকে দেখে তারা দুজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করতেই হাতের ইশারায় তাঁদেরকে বসতে বলে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-


 " আপনারাই কি অর্জুনের মা বাবা? "


এই কথাটার পরেই মহিলা যেন কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পাশে বসা লোকটিও মাথা নিচু করে নীরবে কাঁদতে লাগলেন। দেবজিত এই অবস্থায় টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অমরেশ বাবুকে দু গ্লাস জল আনতে বলে ওনাদের উদ্দেশ্যে বলল-


 " দেখুন আমি অত্যন্ত দুঃখিত। এই অবস্থায় আপনাদের এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে। "


মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন-


 " আমার ছেলেকে কেন যে কেউ মারতে গেল? "


এরই মধ্যে অমরেশ বাবু দুটো গ্লাস জল নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন। দেবজিত গ্লাস দুটো অর্জুনের মা বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-


 " সেটার তদন্ত করব বলেই তো আপনাদের এখানে ডাকা। আপনাদের সাহায্য ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। "


এবার অর্জুনের বাবা এতোক্ষণে মুখ তুলে চোখ মুছে নিয়ে বলল-


 " দেখুন স্যার আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। আমরা এইসব ব্যপারে কিছুই জানি না। "


 " অর্জুনের বডির পাশে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে সেটা জানেন কি? তাও আবার নগ্ন অবস্থায়। "


দেবজিত একটা ছবি তাদের দিকে এগিয়ে দিল। সেই ছবিতে অর্জুন আর সরুজিনীর নিথর দেহ দুটি বিছানার উপর পড়ে রয়েছে। ছবিটা দেখে মহিলাটি রীতিমত আঁতকে উঠলেন।


দেবজিত বলল-


 " দুনিয়াতে এমন কিছু যা সম্ভব নয়। তাই বলছি কিছু লুকবেন না। সবার আগে আপনাদের নাম গুলো বলুন। "


এরপরেই শুরু হয়ে যায় অসংখ্য প্রশ্ন উত্তরের ভিড়। যে ভিড়েই মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল সত্য জগতের কিছু অংশ।


সরুজিনী ছিল অর্জুনের স্ত্রী। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়াকালীন অর্জুনের সাথে এক চায়ের দোকানে সরুজিনীর দেখা হয়। সরুজিনী ছিল সেই চায়ের দোকানের মালিকের ভাগ্নি। গরিব ঘরের হলেও মেয়েটাকে বেশ সুন্দর ছিল। তাই প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায়। এরপর প্রায় দিনই চায়ের দোকানে অর্জুনের যাতায়াত লেগে থাকত। পরিচয় হওয়ার দু মাসের মধ্যে তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। সরুজিনী ছিল এইট্ পাশ। তারপর মামা তাকে আর পড়াশুনো করায়নি। বাপ-মা মরা মেয়ে। মা-র মতো কে-ই বা এতো খেয়াল রাখবে? পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে মামার দোকানে ঠিকের কাজ করতো। তার মামাও বিয়ে করেনি। রাত হলেই সে পড়ে থাকত মদ আর জুয়ার আড্ডায়। আর এদিকে সরুজিনী খুঁজছিল একটা আশ্রয়। ভালোবাসার আশ্রয়। অর্জুন সেই আশ্রয়টাই তাকে দিয়েছিল। স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই তাদের মধ্যে তৈরি হয় শারীরিক সম্পর্ক। এরপরেই সরুজিনী হয়ে যায় সন্তান সম্ভবা। অর্জুন চায়নি তাদের প্রথম সন্তান নষ্ট হোক। তাই কালীঘাটে গিয়ে গিয়ে দুজনে বিয়ে করে অর্জুন বৌকে নিয়ে হাজির হয় নিজের বাড়িতে। কিন্তু খুব সহজ হিসেব অনুযায়ী সমাজ তাদের এই চরম সাহসিকতাকে মেনে নিতে পারেনি।


অর্জুনের মা-বাবার থেকে এর বেশি কিছু জানা যায়নি। সরুজিনীকে তারা কোনোদিনই বাড়ির বউ হিসেবে মর্যাদা দেয়নি। আর অর্জুনও কখনও এই বিষয়ে বাড়িতে কোনো কথা বলেনি। যদিও প্রথম দিকে অনেক অশান্তি হলেও হঠাৎ করেই সব কিছু কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। অর্জুনের মা, অনামিকাদি ভেবেছিলেন তার ছেলের মাথা থেকে ভূত তাহলে বেড়িয়েছে। কিন্তু ভূত যে অন্য ভাবে বাসা বেঁধেছেৎ সেটা তিনি ভ্রুনাক্ষরেও টের পাননি এবং তার স্বামী, নিলাঞ্জন বাবু। উচ্চমাধ্যমিকে ছেলের কাণ্ড দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন ওনারা। বিশ্বভারতীতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার জন্য এমন ভাবে পড়াশুনো করতো যেন এখানে যদি তার সুযোগটা হাতছাড়া হয় তাহলে তার স্নাতক পাশ করা হবে না। মা বাবার পীড়াপীড়িতে কোলকাতার দু-একটা কলেজের ফর্ম তুললেও সেখানকার নামের লিস্ট পর্যন্ত সে দেখতে যায়নি। অর্জুন যেদিন বিশ্বভারতীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে যাওয়ার খবরটা পেল সেদিন সে আনন্দে এতটাই উৎফুল্ল ছিল যে যেন মনে হচ্ছিল কোনো বড়ো লটারি জিতে গেছে। কিন্তু এই সব কিছুর পিছনে কতো বড়ো ষড়যন্ত্র ছিল সেটার খবর কে-ই বা রেখেছিল।


রিক্সায় বসা অবস্থাতেই দূর থেকে বাড়িটার সামনে জনা কয়েক লোকজনের জটলা চোখে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে কিছু অনুমান করার চেষ্টা করল। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে এগোতেই কিছু গুঞ্জন কানে এলো শিঞ্জিনীর। গেতের ভেতরে বাড়ির সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে কোণের দিকে ৫-৬ জন বয়স্ক লোকের একটা জটলা। তাদের মধ্যে একজনের কথা কানে এলো। 


 " আজকাল তো কাউকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। সবাই এখন ভদ্রলোকের মুখোশ পড়ে থাকে। "


আবার আরেকজন বলছে-


 " তা যা বলেছ। ইসস্! কি-ই বা বয়স বল। "


এসব শুনতে শুনতে শিঞ্জিনী প্রবেশ করল বাড়ির ভেতরে। লম্বা উচ্চতার সাদা পোশাকের দুজন পুলিশ প্রথমেই তাকে ঘিরে ধরে বলল-


 " ভেতরে এখন যাওয়া যাবে না। দুটো লাশ পাওয়া গেছে বাড়ির ভেতরে। "


এরকম একটি অপ্রত্যাশিত কথা যে শুনবে সেটা সে অনুমানও করতে পারেনি। হাত পা কেরকম ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কম্পিত গলায় সে জিজ্ঞেস করল-


 " কা-কা-কাদের লাশ পাওয়া গেছে? "


একজন পুলিশ শিঞ্জিনীকে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো-


 " আপনার সাথে এই বাড়ির সম্পর্ক কি? "


কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। গলাও কেরকম যেন শুকিয়ে আসছে। পুলিশটার এই প্রশ্নের উত্তর সে কি ভাবে দেবে? বলবে কি এখানে তার প্রেমিক থাকে? পুলিশটা এবার একটু জোর গলায় বলল-


 " কি হল? উত্তর দিন। চুপ করে আছেন কেন? "


চিন্তার জালে ছেদ পড়ল পুলিশের পুনরায় প্রশ্নে। ভীষণ ইতস্তত ভঙ্গিতে উত্তরটা এলো।


 " আমার বন্ধু এখানে থাকে। "


পুলিশটা এবার চোখ দুটোকে ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-


 " বন্ধুর নাম? "


আবার আগের মতই অনিচ্ছাকৃত পথে জবাব আসলো।


 " অর্জুন। "


এরপরেই পুলিশটা যেন একটু সজাগ হয়ে গেল। সে বলল-


 " আপনাকে এখনি আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। "


শিঞ্জিনী যেন চমকে উঠল। সে মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল-


 " কেন? আমি কেন থানায় যাব? "


পুলিশটা শিঞ্জিনীর সামনে এগিয়ে এসে বলল-


 " এই বাড়িতে যে দুটি লাশ পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটি আপনার বন্ধুর। "



                                                                         ক্রমশ......  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime