আরশির আতঙ্ক 🧟♀️ পর্ব ১
আরশির আতঙ্ক 🧟♀️ পর্ব ১
যুক্তির আতসকাঁচের মাধ্যমে সব কিছুর বিশ্লেষণ করা সবসময় সম্ভবপর নয় । ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ যেমন আছে তেমনই আছে অতিন্দ্রিয় জগৎ । সে জগতে সবকিছু বিচিত্রময় ও রহস্যাবৃত । সবসময় সব কিছু যুক্তির মাধ্যমে যাচাই করা চলে না । এই অতিপ্রাকৃত জগতকে গায়ের জোরে অস্বীকার যারা করে তারা পৃথিবীর বারোয়ানা রহস্যেরই খোঁজ পায় না । অনেক সময় আমরা মনকে বুঝিয়ে থাকি এটি চোখের ভুল , মনের ভুল , যা ঘটছে বা ঘটেছে তা নিছকই কল্পনা বা অবচেতন মনের হাতছানি অথবা হ্যালুসিনেশন । কিন্তু সংগোপনে নিজের মনের মুখোমুখি বসলে এইসবকে অবজ্ঞা করা নিতান্তই দুরুহ মনে হয় । ভূমিকা ছেড়ে এবার ফিরে আসি আমার মূল গল্পে ।
গল্পের প্রধান চরিত্রে :
নায়িকা আরশি ব্যানার্জী
অন্যান্য চরিত্রে :
নায়ক তৃষানজিৎ মুখার্জী
নায়িকার বান্ধবী মোনালি বাসু রায়
বান্ধবীর স্বামী উজান রায়
প্রতিবেশী মিস্টার ও মিসেস কর
নায়িকার পরিচারিকা তারা
সর্বপ্রধান ও অন্যতম চরিত্রে :
আত্মা আন্দ্রেয়ানা মারিনো
দুপুর বারোটায় বিমানবন্দরে নেমে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে ভীষণ রেগে গেল আরশি । প্রায় আধঘণ্টা পর দেখলো একজন লোক তার দিকে ছুটতে ছুটতে আসছেন । লোকটি এসে বললেন ,
" Are you Miss Banerjee ? " আরশি উত্তর দিলো " Yes . আমি সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আর আপনার কোনো পাত্তাই নেই ! " মিঃ রবার্ট অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে বললেন , " I'm extremely sorry Miss Banerjee . " এই বলে আরশির ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলে রওনা দিলেন । সারা রাস্তা রীতিমতো রাগে গজগজ করতে থাকে নায়িকা আরশি ব্যানার্জী । বিমানবন্দর থেকে পৌনে দুই ঘন্টার সফর শেষে গাড়িটি এসে থামলো এক বিশাল অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো আরশি । সাথেই সাথেই মায়ের ফোন । ফোনটা রিসিভ করতেই যেন আরশির কানে তুফান
উঠলো । এটা যে সে তুফান নয়, মায়ের রাগের সাইক্লোন । " আরে মা কি হোলো ? এতো চীৎকার করছো কেন ? Be cool my dear mom " । ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আরশির মা চীৎকার করতে লাগলো , " সেই দু ঘন্টা ধরে সমানে ফোন করে যাচ্ছি , রিং হয়ে হয়ে কেটে যাচ্ছে । চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে , তোকে ফোনে পাচ্ছি না । বাধ্য হয়ে জিৎকে ফোন করলাম । ও বললো তোর ফোন বেজে বেজে কেটে
যাচ্ছে । ও খুব চিন্তায় আছে । আমার তো চিন্তায় হাত - পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, আর তুই বলছিস cool থাকতে । তা কি করে cool থাকবো শুনি । এখন কোথায় তুই ? ফোন ধলছিলি না কেন ? " উর্ধশ্বাসে এতো কথা বলতেই আরশি বললো , " আরে মা তোমার মেয়ে এখন বড়ো হয়েছে আর ছোটো বাচ্চাটি নেই । আর ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল তাই শুনতে পাইনি । তবে এখন অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি । তুমি চিন্তা কোরো না । আমি আগে আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে তোমাকে আবার ফোন করছি । " এই বলে আরশি ফোন কেটে মিঃ রবার্টের সাথে চলে যায় ।
অ্যাপার্টমেন্টের লিফ্টে করে আরশি আর মিঃ রবার্ট উঠে গেল সাততলায় । ফ্ল্যাটের দরজার সামনে যেতেই আবার আরশির ফোন বেজে উঠলো । ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে শুনতে পেলো জিৎয়ের কন্ঠস্বর । আরশি বললো , " হ্যাঁ বলো " বলার সাথে সাথেই আরেক প্রস্থ তুফান উঠলো । জিৎ অর্থাৎ আরশির হবু স্বামী তৃষানজিৎ মুখার্জী রীতিমতো চীৎকার করছে । সে বললো , " তোমার কি ব্যাপার বলোতো ? সেই দুই ঘণ্টা ধরে আমি , তোমার মা আর মোনালি সমানে তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি । ফোন বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে অথচ ফোন তুলছো না । আমাদের তো চিন্তায় পাগল হবার মতো অবস্থা । নতুন জায়গা , তার উপর প্রথমবার বিমান সফর । আমরা ভাবছি তুমি কি কোনো বিপদে পড়লে না অন্য কিছু । " এই কথা শেষ না হতেই আরশি জবাব দিলো, " আরে না না কোনো বিপদে পড়িনি , আসলে ফোন সাইলেন্ট করা ছিল তাই শুনতে পাই নি । আমারই ভুল হয়েছে ফোনটা সাইলেন্ট না করে ভাইব্রেশনে রাখা উচিত ছিল । Sorry Sorry রাগ কোরো না । আমি ভালোভাবে পৌঁছে এখন অ্যাপার্টমেন্টে আমার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি । দাঁড়াও ঘরে ঢুকি " । আরশি কানে ফোন ধরেই মিঃ রবার্টকে বললো , " আপনি দরজা খুলুন । "
আরশির কথা মতো রবার্ট দরজা খুলতেই দুজনেই একসাথে প্রবেশ করলো ঘরের ভেতরে । ঘরে ঢুকেই আরশি আনন্দের সাথে ফোনে জিৎকে জানালো , " জিৎ ফ্ল্যাটটা দারুণ সুন্দর । সামনে কি সুন্দর ব্যালকনি , সারা ঘরে আলোর ছড়াছড়ি । আমার দারুণ ভালো লেগেছে । তুমি এসে দেখে অবাক হয়ে যাবে এতো সুন্দর । " আরশির আনন্দের কথা শুনে জিৎ বললো , " আচ্ছা, আচ্ছা বুঝেছি । ঠিক আছে তুমি তোমার নতুন বাড়ির সৌন্দর্য উপভোগ করো আমি পরে আবার ফোন করবো । " এই বলে জিৎ ফোন কেটে দিল । জিৎ ফোন রাখতেই আরশি মিঃ রবার্টের সাথে ঘুরে এ ঘর
সে ঘর , রান্নাঘর , বাথরুম দেখে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো । ফ্ল্যাটটিতে মোট তিনটি ঘর , একটা বিশাল বৈঠকখানা , মোটামুটি বড়ো মাপের রান্নাঘর ও ডাইনিং আর সবচেয়ে সুন্দর বাথরুমটা । বাথরুমটা দেখে খুশিতে একেবারে নেচে উঠলো
আরশি । বাথরুমের একটা ছোট্ট বর্ননা দেওয়া খুব প্রয়োজন । বাথরুমটা বেশ বড়ো , সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে , সাদা মধ্যে সোনালী কারুকার্য করা দেওয়াল । ছাদের উপরে সাদা - লাল - নীল আলো লাগানো , এক কোণে একটা বেশ বড়ো বাথটাব । বাথটাবের পাশের দেওয়ালে একটা বিশাল বড়ো আরশি ( আয়না ) । আরশিটা এতোটাই বড়ো যে বাথটাবে স্নানরত অবস্থায় নিজেকে সম্পূর্ণ দেখা
যায় । বাথটাবের পাশেই স্নানের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখার ব্যবস্থা করা
আছে । এছাড়াও দেওয়ালে আরেকটি বড়ো আরশি সাথে লাগোয়া বেসিন । জলের নলগুলো খুব সুন্দর কারুকার্য করা । যদিও বেসিন লাগোয়া আরশি আর বাথটাবের পাশের আরশি দুটোই বড়ো বড়ো কাপড় দিয়ে ঢাকা । এরকম বাথরুম আরশি সিনেমায় দেখেছিল কিন্তু এখন ওর নিজের বাথরুমটাও সিনেমার মতো দেখেই আনন্দে সে আত্মহারা । আরশি হঠাৎ রবার্টকে প্রশ্ন করলো , " আচ্ছা বাথরুমের আরশিগুলো ওরকম ঢাকা কেনো ? " রবার্ট উত্তর দিলো ,
" না ! আসলে যাতে ধূলো পড়ে নোংরা না হয়ে যায় তাই ঢেকে রাখা " । আরশি
নীচুস্বরে " ও আচ্ছা " বলে চুপ করে যায় ।
আরশি ব্যালকনি ছেড়ে আবার একবার বাথরুমটা দেখতে গেল । সেই সময় বান্ধবী মোনালির ফোন আসে । ফোনটা রিসিভ করেই প্রচন্ড উচ্ছাসে আরশি বলে ওঠে, " জানিস মোনা আমার ফ্ল্যাটের বাথরুমটা দেখার মতো সুন্দর , ঠিক যেমন সিনেমায় দেখায় । আমি একদম প্ল্যান করে নিয়েছি কি করবো । " একথা শুনে মোনালি বললো ,
" কি বিষয়ে কি ঠিক করেছিস ? দেখিস চাকরি ছেড়ে সারাদিন বাথরুমে পড়ে থাকিস না যেন !! " বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো । আরশি বললো , " না না, চাকরি ছাড়বো কেনো ? কিন্তু হ্যাঁ , অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে সোজা গিয়ে বাথটাবে শরীরটা এলিয়ে দেবো । উফ্!! আমার ভেবেই যা আনন্দ হচ্ছে তোকে কি বলবো । " মোনালি বললো , " আচ্ছা তুই আনন্দ কর , ঘর ভালো করে গুছিয়ে রাখ । আমি আবার পরে ফোন করবো । সাবধানে থাকিস " এই বলে ফোন কেটে দিলো । আরশি এবার রবার্টকে বললো , " আচ্ছা তাহলে আপনি রান্না করা আর ঘরের কাজের জন্য লোকের কিছু ব্যবস্থা করেছেন ? আমিতো আপনাকে আগেই বলে রেখেছিলাম । " রবার্ট বললো ," হ্যাঁ হ্যাঁ লোক ঠিক হয়ে গেছে তবে ... "
আরশি বললো , " তবে কি ? "
রবার্ট আবার বললো , " তবে রান্না আর ঘরের কাজ একজন লোক করবে । দুটো আলাদা লোক পেলাম না । আর একটু পরেই আসবে , তবে..... " এই বলে আবার চুপ করে যায় রবার্ট ।
আরশি এবার বিরক্ত হয়ে বললো , " আবার তবে ? তবে কি ? "
রবার্ট আবার বলতে শুরু করলো , " তবে সেই মেয়েটি মানে তারা এখানে থেকেই কাজ করতে চাইছে । ওর বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে , এছাড়া বাড়িতে বুড়ো মদখোর বাবা ছাড়া কেউ থাকে না । ও আমাকে অনেকবার করে অনুরোধ করেছে আপনাকে বলার জন্য । "
সব শুনে আরশি বললো , " হুম , সবইতো বুঝলাম কিন্তু মেয়েটি কেমন , স্বভাব-চরিত্র কেমন সেসব না জেনে তো থাকতে বলতে পারি না । ঠিক আছে সে আসুক , আগে কথা বলে দেখি । " কথা শেষ হতে না হতেই
কলিংবেল বেজে উঠলো । রবার্ট বললো ,
" ঐ বোধহয় মেয়েটা এসেছে , দরজা খুলে আসছি " বলেই গিয়ে দরজা খুলে দিলো ।
ঘরে এসে ঢুকলো একটি অল্প বয়সি একটা মেয়ে । বেশ রোগাটে গড়ন , গায়ের রং একটু চাপা কিন্তু মুখটা ভারী মিষ্টি ।
মেয়েটি ঘরে ঢোকার পর রবার্ট আরশির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো । আরশি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলো , " তোমার নাম কী ? এখান থেকে বাড়ি কতদূর ? " মেয়েটি বললো , " মেমসাব আমার নাম তারা । বাড়ি কনকপুরাতে । এখান থেকে অনেক দূর । " আরশি বললো , " রবার্ট বললো , তুমি নাকি এখানে থাকবে বলেছো ? কেন আমি যতটুকু শুনলাম তোমার বাবা তো বুড়ো হয়েছে তা ওনার একা থাকতে অসুবিধা হবে না ? " একথা শুনে তারা ডুকরে উঠে দৌড়ে গিয়ে আরশির পা জড়িয়ে ধরে বললো , " দোহাই মেমসাব আমাকে আপনার কাছে থাকার অনুমতি দিন । নাহলে মদের নেশায় বাবা কোনদিন আমাকে নোংরা লোকের হাতে তুলে দেবে । দয়া করে থাকতে দিন । " সব শুনে আরশি তারাকে থাকার অনুমতি দিয়ে দিলো । অন্যদিকে রবার্টকে বললো , " শুনুন তারার বাবা যেন না জানতে পারে তারা এখানে আছে । আর হ্যাঁ আমি পরশু থেকে অফিস যাবো । " সব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে রবার্ট চলে যায় । মিঃ রবার্ট যখন গেলেন তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে । ঘরের আসবাবপত্র থেকে রান্নাঘরের যাবতীয় সরঞ্জাম সব কিছুই আরশির কথামতো রবার্ট আনিয়ে রেখেছিল । কাজেই আরশি আর তারা ঘর গুছানো শুরু করে দিলো । মিঃ রবার্ট বেরিয়ে যাওয়ার আধঘণ্টা পর আরশির মোবাইলে ফোন করে জানায় , " মিস ব্যানার্জী , আমি আপনাদের দুজনের মতো ডিনার দিতে বলে দিয়েছি হোটেলে । ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাড়িতে দিয়ে দেবে । আপনারা সময়মতো খেয়ে
নেবেন । " আরশি বললো , " অনেক ধন্যবাদ মিঃ রবার্ট । আপনিও সাবধানে যাবেন " বলে ফোন রেখে আবার কাজে মন দিলো । রাতে ডিনার করে শোবার ব্যবস্থা হয়ে গেল । প্রথমে তারার শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল বৈঠকখানায় । কিন্তু নতুন জায়গা , নতুন বাড়ি বলেই বোধহয় আরশির একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো তাই আবার তারাকে ডেকে এনে নিজের বেডরুমের সোফাতে শুতে বললো । সারাদিনের যাত্রার ধকল, তারপর আবার ঘর গোছানোর ধকল কাজেই কিছুক্ষণের
মধ্যেই আরশি ঘুমিয়ে পড়লো । পরের দিন আরশির ঘুম ভাঙলো তারার ডাকে " ও মেমসাব, মেমসাব চা এনেছি । ও মেমসাব উঠে চা খেয়ে নাও " । তারার ডাক শুনে উঠে বিছানায় বসে চা খেতে খেতে ভাবলো, " বাড়িতে মা রোজ সকালে চা এনে ঘুম ভাঙাতো । কিন্তু তারাকে এইসব কিছুই বলতে হয়নি , নিজের থেকেই করছে " ভেবে একটু আলতো হাসি দিয়ে আরশি তারাকে বললো, " তারা চল, আজকে একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি অনেক কিছু কিনতে হবে । " তারা জবাব দিলো " আচ্ছা মেমসাব , আগে জলখাবার খেয়ে নাও তারপর বেরোনো যাবে । জলখাবার খেয়ে আরশি এবং তারা ঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজায় তালা দিচ্ছে ঠিক সেসময় একটা বাঙালী নারীকন্ঠ শুনে চমকে উঠলো । " একি ভয় পেলেন নাকি ? সত্যি আমার খুব ভুল হয়ে গেছে , আচমকা এভাবে ডাক দেওয়া ঠিক হয় নি । যাইহোক,আমি আপনার প্রতিবেশী মিসেস সুমনা কর । এখানে আমি আর আমার স্বামী থাকি । আমার স্বামীর নাম মিঃ প্রদীপ কর । " আরশি অবাক হয়ে বললো , " ওহ! ওহ! আপনি তো বাঙালী , তাহলে এখানে বাঙালীও আছে ? "
মিসেস কর বললো , " হ্যাঁ এখানে প্রায় বারোটা বাঙালী পরিবার আছে বহু বছর ধরে । কর্মসূত্রে এসে এখানেই থেকে যায় , আপনি কি ভেবেছিলেন ব্যাঙ্গালোরে বাঙালী নেই ? কোরামঙ্গালার এই পাড়ায় অনেক বাঙালী , আপনাকে দেখতে পেলেই দেখবেন সব আসছে একে একে আলাপ জমাতে । তা কোথাও বেরোচ্ছেন ? ঠিক আছে সাবধানে যাবেন , পরে কথা হবে " বলে নিজের ঘরে ঢুকে যেতেই আরশি আর তারা লিফ্টে করে সোজা নীচে যায় ।
আরশি ও কাজের মেয়ে তারা অ্যাপার্টমেন্টের নীচে নেমে তাড়াতাড়ি একটা গাড়ি ডেকে বেরিয়ে যায় । এটা ওটা নানারকম জিনিস কিনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ফিরে আসে । ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঢোকার সময় আবার মিসেস করের সাথে দেখা হয় । একথা সেকথা বলতে বলতে হঠাৎ মিসেস কর বলে ওঠেন , " এই ফ্ল্যাটটা প্রায় সাত বছর খালি পড়েছিল । কেউ কেনা তো দূরের কথা কেউ ভাড়াও নিতে
চাইতো না । তাই তোমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে যাই । " কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলো আরশি আর তারা , খানিকটা সময় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপরেই হঠাৎ তারা মিসেস করকে জিজ্ঞাসা করলো, " কেনো আপনি একথা বলছেন ? এ ফ্ল্যাটে কেউ থাকতে চাইতো না কেনো জানতে পারি ? কি অসুবিধা আছে এই ফ্ল্যাটে , বেশ সুন্দর তো । "
তারার কথা শুনে মিসেস কর বললেন, " না না কিছু না, এমনি বললাম " বলেই তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন । আবার আরশি ও তারা অবাক হয়ে দুজনের মুখ চাওয়াচায়ি করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে গেল । ঘরে ঢুকে আরশি বললো,
" তারা আমাকে একটু ঠান্ডা জল দিবি, খুব তেষ্টা পেয়েছে । " হাতের ব্যাগপত্র নামিয়ে রেখে তারা একটা ঠান্ডা জলের বোতল এনে দিল আরশিকে । জল খেয়ে আরশি বললো, " শোন তারা তুই ব্যাগ থেকে খাবারগুলো বের করে গরম করতে থাক ততোক্ষণে আমি স্নান সেরে আসি " এই বলে আরশি নিজের ঘরে গিয়ে জামাকাপড় বদলে বাথ গাউন পরে বাথরুমে চলে গেল । বাথটাবে জলের মধ্যে নিশ্চিন্তে বসে গুনগুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে ---
ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।
যায় যেন মোর সকল গভীর আশা
প্রভু তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে।
চিত্ত মম যখন যেথা থাকে সাড়া যেন দেয় সে তব ডাকে,
যত বাঁধন সব টুটে গো যেন
প্রভু তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে।
বাহিরের এই ভিক্ষা-ভরা থালি এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি,
অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে
প্রভু তোমার দানে, তোমার দানে, তোমার দানে।
হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর, এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর
সকলই আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।
চোখ বন্ধ করে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ বাথটাবের পাশের আরশির দিকে তাকিয়ে চোখ খুলতেই আৎকে ওঠে । বাথটাবের পাশের আয়নার দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠলো আরশি । আয়নাতে যাকে দেখা যাচ্ছে সেটাতো ওর নিজের প্রতিবিম্ব নয় ! এটা কে ? ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে নেয় , তারপর আস্তে আস্তে হাতের ফাঁক দিয়ে আবার তাকায় আয়নার দিকে । এবার অবাক হয়ে নিজেই হাসতে শুরু করে । কোথায় কে ? এটাতো আমি নিজেই , তাহলে বোধহয় মনের ভুল । এই বলে নিজের মাথায় একটা হালকা চাপড় মারে । স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়েই তারাকে বলে , " ওরে তারা তাড়াতাড়ি খেতে দে । খুব ক্ষিদে পেয়েছে , ক্ষিদের জ্বালায় যতোসব ভুলভাল দেখছি । "
আরশির কথা শুনে তারা হেসে বললো ,
" দিদি খাবার তৈরি আছে তুমি এসে বসে পড়ো । " তারার কথা শুনে আরশি তাড়াতাড়ি ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো । তারা একটা থালায় খাবার গুছিয়ে আরশির সামনে দিতেই আরশি বলে উঠলো ,
" কিরে এটাতো আমার , তোরটা কোথায় ? "
তারা উত্তর দিলো , " দিদি তুমি খেয়ে নাও তারপর আমি খাবো । " এই কথা শুনে আরশি রেগে যায় । তারপর বলে , " পরে খাবো মানে ? কিসের জন্য পরে খাবি ? একদম না, তাড়াতাড়ি খেতে বসে পড় । নাহলে আমিও খাবো না "।
আরশির কথা শুনে তারা হেসে ওঠে । তারপর নিজের খাবার গুছিয়ে নিয়ে আরশির পাশের চেয়ারে বসে পড়ে । "
দুজনেই খাওয়া শুরু করে । খেতে খেতে আরশি বলে , " জানিস তো আমি না একা একা খেতে পারি না । বাড়িতে আমি, মা, বাবা একসাথে খেতাম । এবার থেকে তুই আর আমি একসাথে খাবো । "
তারা সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লো । দুজনে মিলে খেতে খেতে অনেক গল্প করলো ।
খাওয়া শেষ করে আরশি নিজের ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে পড়লো । তারা থালা-বাসন ধুয়ে টেবিল পরিস্কার করে সোফায় যেখানে আরশি বসেছিল সেখানে আরশির পায়ের কাছে নীচে বসে পড়লো । নীচে বসতেই আবার আরশির ধমক , " কিরে নীচে কেনো ? উপরে উঠে বস তাড়াতাড়ি । আর যেন কোনোদিন বলতে না হয় । " ধমক খেয়ে তারা সোফায় আরশির পাশে উঠে বসে পড়লো । কাজ করতে করতে আরশি দেখলো তারা মন দিয়ে ল্যাপটপে ওর কাজ দেখছে । তখন তারাকে বললো , " তারা তুই পড়াশোনা করেছিস ? মানে লিখতে পড়তে পারিস ? " আরশির কথা শুনে তারা দুদিকে মাথা নাড়লো , মানে না শেখেনি । আরশি হঠাৎ বললো , " তুই পড়াশোনা শিখবি ? অন্ততপক্ষে নিজের নাম যাতে লিখতে পারিস । " আরশির কথা শুনে তারা খুব অবাক হয়ে বললো, " দিদি তুমি আমাকে লেখাপড়া শেখাবে ? আমি রোজ সব কাজ শেষ করে নেব , তারপর তোমার কাছে পড়বো । শেখাবে দিদি ? "তারার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আরশি ঠিক করলো সে নিজেই তারাকে সব
শেখাবে । যেই ভাবা সেই কাজ । আর এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে তখনই একটা খাতা আর পেন্সিল নিয়ে আসলো বেডরুম থেকে । তার মধ্যে হিন্দি অ - আ - ই - ঈ এসব লিখে তারার হাতে দিয়ে বললো , " নে এবার প্রথমে আমার লেখাগুলোর উপর থেকে হাত বুলিয়ে অভ্যাস কর তারপর দেখে দেখে নিজে লেখার চেষ্টা কর । " এই বলে আরশি আবার ল্যাপটপে নিজের কাজে মন দিলো । আড়চোখে তাকিয়ে আরশি খেয়াল করলো তারা একমনে লিখে যাচ্ছে । হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ঝনঝন করে বাসন পড়ার শব্দ শুনে দুজনেই হকচকিয়ে গেল । তারপর দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে । রান্নাঘরে গিয়ে দুজনেই অবাক , না কোনো বাসনতো পড়েনি । তাহলে বাসন পড়ার শব্দ হোলো কেনো ? কিছু না বুঝতে পেরে আবার দুজনেই সোফায় গিয়ে বসে পড়লো । কিন্তু দুজনের কেউ কাজে মন বসাতে পারলো না । দেখতে দেখতে তখন সন্ধ্যা ছয়টা । আরশি তারাকে বললো , " তারা যা দু কাপ কফি করে নিয়ে আয় । আর ফ্রিজে পেস্ট্রি আছে, ওগুলো নিয়ে আসিস । " আরশি বলা মাত্র তারা রান্নাঘরে চলে গেল কফি করতে । তারা নিজের মনে কফি বানাচ্ছে হঠাৎ তারার মনে হোলো ফ্রিজের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে । পিছন ঘুরে কাউকে না দেখতে পেয়ে মনের ভুল ভেবে আবার কাজ করতে শুরু করলো । কয়েক সেকেন্ড পরেই তারার আবার মনে হোলো ওর পাশেই কেউ দাঁড়িয়ে আছে , ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো না কেউতো নেই । যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কফি আর পেস্ট্রি নিয়ে তারা চলে গেল রান্নাঘর থেকে । আরশি কফি খেতে খেতে আচমকা তারার দিকে তাকিয়ে দ্যাখে তারা রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে আছে । দুবার " তারা " " তারা " করে ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে হাত দিয়ে পিঠের উপর হালকা করে চাপড় মেরে বললো, " কিরে! তোকে কখন থেকে ডাকছি ? " পিঠের উপর একটা চাপড় খেয়েই তারার সম্বিৎ ফিরে আসে । তারা বলে , " দিদি কিছু বলছো ? " আরশি বলে , " তোর কি হোলো হঠাৎ ? আর রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিস ? " তারা মনে মনে একবার ভাবলো আরশিকে
রান্নাঘরের কথা জানাবে , কিন্তু যদি ভয় পেয়ে যায় এই ভেবে আর কিছু জানালো না । শুধু বললো , " না দিদি কোই কিছু ভাবছি নাতো । ও কিছু না , বলো তুমি কি
বলছো ? " আরশি বললো , " একটু পরে তুই আর আমি দুজনে মিলে হাতে হাতে কিছু রান্না করে নেবো । আচ্ছা কি রান্না করা যায় বলতো ? ও ফ্রিজে তো চিকেন আছে , তাহলে আজকে রাতে চিকেন কষা আর গরম গরম রুটি । কি বলিস , চলবে তো ? " তারা বললো , " দিদি শুধু চলবে না জমে যাবে " এই বলেই দুজনেই সজোরে হেসে উঠলো । ঘন্টাখানেক পর দুজনেই গেল রান্নাঘরে । তারা আটা মেখে রুটি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে আর আরশি চিকেন কষা করছে গান করতে করতে -
Every night in my dreams
I see you, I feel you
That is how I know you go on
Far across the distance
And spaces between us
You have come to show you go on
Near, far, wherever you are
I believe that the heart does go on
হঠাৎ তারা বলে ওঠে , " দিদি তুমিতো খুব সুন্দর ইংরেজি গান করতে পারো । এটা কি সিনেমার গান ? " তারার কথা শেষ হতে না হতেই আরশির ফোন বেজে উঠলো । আরশি ফোন ধরে বললো , " হ্যাঁ , মা বলো ? এই তো আমি আর তারা দুজনে মিলে রাতের ডিনারের জন্য চিকেন আর রুটি বানাচ্ছি । " কথা বলতে বলতে আরশি হঠাৎ চুল্লিতে বসানো কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে চীৎকার করে উঠলো । তারা বললো , " কি হয়েছে দিদি ? তুমি চীৎকার করে উঠলে কেনো ? " আরশি কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো , " তারা কড়াইয়ের মধ্যে টগবগ করে ফুটছে রক্ত , এক কড়াই রক্ত । " তারা কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু না দেখতে পেয়ে বললো , " কোথায় রক্ত ? এতো চিকেন ? কি সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে । " ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আরশির মা সমানে বলে যাচ্ছে , " কিরে কি হয়েছে ? তুই চীৎকার করলি কেনো ? কি হয়েছে ? " তারার কথায় নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ফোনটা কানে নিয়ে মাকে বললো , " না মা কিছু না এমনি । ওই তারার সাথে একটু মজা করছিলাম । ঠিক আছে এখন রাখলাম " এই বলে ফোনটা কেটে দিলো । তারা দেখলো আরশি তখনো সভয়ে কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে আর দরদর করে ঘামছে । তারা আর কিছু না বলে রুটি বানাতে শুরু করলো । আসলে তারার বলার মতোও কিছু নেই কারণ সন্ধ্যার সময় কফি করতে এসে ওর নিজেরও ভয়ে এরকমই হয়েছিল ।
🧟♀️******* ক্রমশঃ প্রকাশ্য