উড়ান
উড়ান
কিছুক্ষন আগে আমাদের ফ্লাইটটা কলকাতার মাটি ছুঁয়েছে | বিমানবন্দরে পা রাখা মাত্র গ্রাউন্ড স্টাফরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আমায় লক্ষ্য করে পুষ্পবৃষ্টি করতে | এই ধরনের অভ্যর্থনা করার পিছনে অবশ্যই একটা কারণ আছে | কয়েক ঘন্টা আগে যখন পুনে থেকে আমাদের ফ্লাইটটা ওড়ে, তখনও আমরা কেউ জানতাম না যে, আমাদের ফ্লাইটের প্রধান পাইলট হঠাৎ করেই আকাশ পথে বুকের প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে বিমান চালানো থেকে বিরত হবেন | মাঝ আকাশে যখন এই দুর্যোগ হয়, তখন কো-পাইলট আকাশ খুরানাও বেশ ঘাবড়িয়ে যান, কারণ প্লেনের ফুয়েল পাম্পের প্রধান ইঞ্জিন-পাম্পটাকে সেসময়ই বিগড়োতে হয়েছে | যখন এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে প্যাসেঞ্জারদের সিট বেল্ট বেঁধে বসার অনুরোধ করা হয়, তখন আমি সিট ছেড়ে এগিয়ে যাই | একজন এয়ার হোস্ট্রেস আমাকে বসতে অনুরোধ করলে আমি তাকে আমার পরিচয় পত্রটি দেখিয়ে বলি, " আমি একজন পাইলট, ভারতীয় বিমান বাহিনীতে কাজ করি | "
এয়ার হোস্ট্রেস আমার পরিচয়ে রীতিমতো খুশি হয়ে আমাকে ককপিট অবদি পৌঁছে দেন | কো-পাইলট আকাশ খুরানা আমার নামের আগে উইং কমান্ডার দেখে বেশ আস্বস্ত হন, অকপটে স্বীকার করেন, "আমি খুব বেশিদিন যোগ দিইনি | আমার অভিজ্ঞতা কম| তাই প্রধান পাইলটের আসনটি আপনিই গ্রহণ করুন| " ... ককপিটে বসে প্লেন ওড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে আমি মনের জগতে ভেসে গেলাম |
ছোটবেলা থেকেই খোলা আকাশের প্রতি আমার বিশাল টান !! দাদুর দুপুরুষ আগে বানানো ভাঙা একতলা বাড়িটার ছাদে দাঁড়িয়ে আমি আকাশের বুকে উড়ন্ত পাখি গুলিকে দেখতাম | হাত দুটোকে দুপাশে মেলে ভাবতাম, "ইশ, আমি যদি পাখি হতে পারতাম!! "
পাখি হয়ে উড়তে পারবো না বলে আকাশের এই বাহনটাকে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর মতো বড়লোকি ইচ্ছেটা আমার নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল সেই ছোটো বেলা থেকেই | বাবা পেশায় প্রাইমারি স্কুল টিচার ছিলেন | দুই দাদার পরে আমি | বাবার মাইনেতে পাঁচটা পেট চালিয়ে তিন সন্তানের লেখাপড়া করানো, একটু কঠিনই ছিল আমার বাবার কাছে | তবুও আমরা তিনজনই নিজেদের স্বপ্নের তাড়ণাতেই লেখাপড়াটা মন দিয়ে করতাম |
আমার একমাত্র পিসি বেশ বড়োলোক ছিল, আরেকটু বিস্তৃত ভাবে বলতে গেলে বলা যায়, বড়োলোকের বউ ছিল | ঠাকুমার কাছে শুনেছিলাম, যে, পিসির বিয়ের পরে পিতৃঋণের বোঝা নিজের কাঁধে নিতে গিয়েই গ্রাজুয়েশন শেষ না করেই আমার বাবা স্কুলের মাস্টারিতে যোগ দেয় | আমার দাদু অনেক অর্থ খরচ করে ও প্রচুর পণের মাধ্যমে বড়লোকি, শিক্ষিত ও ভালো চাকুরে জামাই কিনেছিলেন | কিন্তু তাঁকে সেই বৈবাহিক সম্পর্ক কেনার জন্য প্রচুর ঋণের বোঝা কাঁধে নিতে হয়, কন্যাদায় গ্রস্ত পিতা বলে কথা !! .... পরবর্তী কালে আমার দাদুর সে দায়বদ্ধতা এসে পড়ে আমার বাবার কাঁধে, কারণ সেই সময় আমার বাকি জেঠ্যুরা সবাই বিবাহিত এবং নিজেদের স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিজেদের সংসারে ব্যস্ত | তাই অগত্যা আমার কলেজ পড়ুয়া বাবা আমার দাদুর সুপুত্র হয়ে পিতৃ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় আর লেখাপড়া মাঝ পথে বন্ধ করে রোজগারে নামে |
পরে অবশ্য, বাবার এই ত্যাগের ফল বাবা হাতে নাতে পেয়েছে বারেবার | আমার বাবা জ্যাঠারা পাঁচ ভাই, সবার মধ্যে আমার বাবারই অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন, বাকিরা সবাই আমার পিসির সাথে তাল মিলিয়ে সচ্ছল জীবনযাপনে অভস্ত্য | তাই ভাইফোঁটায়, আমার একমাত্র পিসি আমার বাবাকেই সবচেয়ে কম দামের শার্টের পিস্ টা দিতো | বাবা তাঁর সেই লজ্জা আমাদের কাছে ঢাকার চেষ্টা করলেও আমার সবটাই বুঝতাম, শত হলেও গরীবের সন্তান তো !!
আমার সেই বড়লোকি পিসির বাড়িতে গিয়ে আমি একবার এক কান্ড করে বসলাম | আমার পিসতুতো দিদি এয়ার হোস্ট্রেস এর ট্রেনিং নিতে শুরু করেছে শুনে আমিও আপ্লুত হয়ে সবার মাঝেই সেদিন বলেছিলাম, " আমিও পাইলট হতে চাই | আমার স্বপ্ন, আমি বড়ো হয়ে এরোপ্লেন চালাবো | "
প্রাইমারি মাস্টারির চাকরি করা ভাইয়ের সন্তান বড়ো হয়ে পাইলট হবে, এই বড়লোকি চালটা মানতে পারলো না আমার বড়োলোক পিসি ও জ্যেঠুর দল | উপহাস আর পরিহাসে সেদিন আমার বাবা মাকে এমন ভাবে স্নাত করেছিলো ওরা, যে, আমার বাবা বাড়ি এসে হাউহাউ করে কেঁদে ছিল | আমার বড়দা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, "এমন কথা না বললেই তো পারতিস বুবাই | আমাদের ঘরে এমন স্বপ্ন দেখতে নেই যে রে !! "
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, " কেন বড়দা ?? স্বপ্নও কি গরীব, বড়োলোক বিচার করে দেখতে হয় ?? "
আমার কথায় সেদিন দাদা কোনো উত্তর দিয়েছিলো না, শুধু নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো |
সেদিনের ঘটনায় আমার পরিবারের সবাই মর্মাহত হলেও আমি ভেঙে পড়েছিলাম না | নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, " পাইলট আমি হবোই|"
উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পরে আমার সবচেয়ে প্রিয় পত্রিকা হয়ে উঠল কর্মক্ষেত্র | দাদারা নিয়ম করে কিনে আনতো গরীব বাঙালির সেই কর্মের দিশারীকে | আমি চুপি চুপি পড়তাম | খোঁজ খবর নিয়ে যা বুঝলাম, সেটা হোলো, সি. পি. এল. ট্রেনিং নেওয়া আমার দ্বারা হবে না | আমার বাবা নিজেকে বেচে দিলেও ট্রেনিং এর টাকা জোগাড় করতে পারবেন না | কিন্তু কাগজের কাজের বিজ্ঞাপনে যখন পাইলট এর চাকরির কথা পড়তাম, তখন মনে হতো, "হয় আকাশে উড়বো, নয়তো মরে যাব | "
তাই ঠিক করলাম, কমার্শিয়াল পাইলট না হতে পারি, বিমান বাহিনীর পাইলট তো হতে পারবো | তাই চাকরির বিজ্ঞাপনে যখন দেখি, উচ্চতর এন. সি. সি. করে প্রথম বিভাগে "সি সার্টিফিকেট " অর্জন করতে পারলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর চাকরি পাবার জন্য কিছু সুবিধা পাওয়া যায়, তখন মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিই | উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে অঙ্কে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম, সাথে এন. সি. সি ইউনিটে ভর্তি হলাম | এই প্রথম বাড়ির সবার সাথে আমার মতের বিরোধ হোলো | একজন শিক্ষক মশায়ের সন্তান ওসব কাজে যোগ দেবে, বাইরে গিয়ে ক্যাম্প করবে, এসবে আপত্তি উঠল | বাবা বললেন, " আমার দিদি আর দাদারা কি বলবে বুবাই ?? "
আমি কঠিন বাক্যে জবাব দিই এই প্রথম, " তোমার দাদা, দিদিরা আমাকে নিয়ে কি বলবেন, তা শোনার অপেক্ষায় আমি নেই বাবা | "
বড়দা আমায় খুব স্নেহ করতো | তাঁর আদর আমি ছোটবেলা থেকে বরাবর একটু বেশিই পেয়ে এসেছি | সেও আমায় কাছে বসিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো, " তুই পড়াশুনায় এত ভালো| বি. এস. সি. আর এম. এস. সি. করে না হয় স্কুলের চাকরি নিস্ | "
আমি আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, " না দাদা, আমি পাইলটই হবো | "
মা রেগে গিয়ে বলেছিল, " স্বপ্নের জগতে বাস করছিস বুবাই | এন. সি. সি. করেই যদি পাইলট হওয়া যেত, তবে সবাই পাইলট হওয়ার জন্য ওই রাস্তাই ধরতো | ওখানকার সব ছেলে মেয়েই কি পাইলট হয় না কি?? "
আমি জবাব দিয়েছিলাম, " সবাই হয় না, কিন্তু আমি হবো | "
শুধু আমার সাথে সবসময় লড়াই করা ছোড়দাই বলেছিল , " লড়াইটা চালিয়ে যা বুবাই | ওদের সবাইকে দেখিয়ে দে, স্বপ্ন দেখতে ক্ষমতা লাগে, অর্থ লাগে না | ওরা জানুক, আমরা গরীব হলেও আমাদের স্বপ্ন সার্থক করতে পারি আমরা | তোর যদি কখনো কিছু লাগে, আমায় বলিস | আমি আমার টিউশনির মায়নায় তোকে কিনে দেবো| "
আমার সেই ছোড়দাই আমাকে কলেজস্ট্রিট থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বই কিনে দিতো | অবশ্যই চুপি, চুপি|
ইউনিটে ঢুকেও যে খুব সুদিন দেখেছিলাম আমি, তা নয় | বাংলা মাধ্যম থেকে পাশ করার খেসারত দিতে হতো পদে পদে, কারণ সেখানে হিন্দী আর ইংলিশটাই চলতো | হিন্দীটা বুঝতে পারলেও ভালো বলতে পারতাম না, আর ইংলিশে বলা - শোনায় তো 'ক অক্ষর গো মাংস ' ছিলাম !!
খুব কষ্ট হতো প্রথম প্রথম| ইউনিটের বাকি ছেলে মেয়েদের কাছে উপহাসের খোরাক ছিলাম | তবুও ইউনিট ছাড়িনি | কান খাঁড়া করে শুনতাম, ওরা কি ভাবে কথা বলে | একদিন অনুভব করলাম, ভুল বলতে বলতেই আমি হিন্দী আর ইংলিশ দুটোই বলা শিখে গেছি |
ইউনিটের স্যাররা আমায় খুব ভালো বাসতেন| তার কারণ, তারা আমার চোয়ালটা শক্ত দেখেছিলেন | আমার স্বপ্নের রাস্তায় তাঁরাও সহযোগীতা করতেন মাঝে মধ্যে |
ইউনিটে ঢুকে জানতে পারলাম, পাইলট হতে গেলে পি. এ. বি. টি. দিতে হয় | বছরে একবার করে পরীক্ষা হয়, আর এই পরীক্ষা জীবনে একবারই দেওয়া যায় | প্রথম বারে ফেল করে গেলে সারাজীবনের জন্য পাইলট হওয়ার রাস্তা বন্ধ |
গ্রাজুয়েশনের শেষ বছরে সবে প্রবেশ করেছি | এমন সময় আমার বাবা অতর্কিত ভাবে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান | একটা বাইক ছাচ্ড়াতে ছাচ্ড়াতে প্রায় ৩০ ফুট রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়েছিলো বাবাকে | বাইক আরোহী ঘটনাস্থলেই মারা গেলেও আমার বাবা প্রায় পঁচিশ দিন বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়েছিল | কিন্তু শেষ হাসিটা যমরাজই হেসে ছিলেন|
বাবা মারা যাবার তিন দিনের মাথায় ইউনিট থেকে ফোন আসে যে দুদিন বাদে পি.এ. বি. টি পরীক্ষা আছে | ফোন করে জানতে চাওয়া হয় যে, আমি পরীক্ষায় বসছি কিনা | আমি জানিয়ে দিই, যে, আমি পরীক্ষায় বসবো |
আমার সিদ্ধান্তে আমার মা ভীষণ কষ্ট পায় তখন | বাবার শ্রাদ্ধ না মিটতেই আমি অশৌচ থাকা কালীনই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইউনিফর্ম পরে নিজের মতো করে পরীক্ষা দিতে যাব, এটা নামঞ্জুর ছিল আমার মায়ের কাছে | আমার পিসি আর জ্যেঠুরা জানতে পারলে যে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আমার মাকে!! ... সেই ভয়েই মা তখন অস্থির !!
কিন্তু আমি স্থির আমার সিদ্ধান্তে | আমার বাবার সেদিনের হাউহাউ করে কাঁদার দৃশ্যটা আমার বাবার চিতায় জ্বলার চেয়েও বেশী স্পষ্ট ছিল | আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জীবনের চরম মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি | মনের সব বেদনাকে ছাই চাপা দিয়ে আমি পরীক্ষায় বসেছিলাম সেদিন|
তিন মাস বাদে রেজাল্ট বেরোয়, আমি পি.এ. বি. টি. উর্ত্তীর্ণ হয়েছি | এই তিন মাসে বাবার চাকরির মাইনে বন্ধ | বাবার ফ্যামিলি পেনশনের জন্য আর চাকরির জন্য বাবার পেনশনের ফাইল তখন এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে ঘুরে চলেছে |
তবুও ভগবান সেদিন আমাদের মারেননি | বাবার একটা ছোট্ট জীবন বীমা আর দাদাদের টিউশনির মায়নায় আমরা চালিয়ে নিয়ে ছিলাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে | গরীব ভাইয়ের অভাবী পরিবারের যাতে কোনো দায়িত্ব নিতে না হয়, তাই আমার পিসি, জ্যাঠারা সেই যে বাবার শ্রাদ্ধের পরে আমাদের সাথে সম্পর্কের ইতি টানলো, সেই সম্পর্ক নতুন করে তৈরী করলো আমার দুই দাদা, আমার বাবা মারা যাবার ঠিক পৌনে তিন বছর বাদে |
মাঝখানের এই আড়াই বছরে আমি আর আমার দুই দাদা শুধু জীবনের সাথে লড়াই চালিয়ে গিয়েছি | বাবা মারা যাবার আগে থেকেই আমার দুই দাদা বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বসতো | ওদের সাথে আমিও যোগ দিলাম | দিনরাত এক করে তিনজনে পড়াশুনা করতাম | কিন্তু আমার দাদারা কখনো আমাকে টিউশনি করতে দেয়নি |
আমি একবারেই শর্ট সার্ভিস কমিশনে উত্তীর্ণ হলাম | মেডিক্যাল টেস্ট আর ইন্টারভিউ এর জন্য আমাকে নাগপুর ডিফেন্স একাডেমিতে ডাকা হয় | আমার তেজ সেদিন এয়ার ফোর্সের অফিসারদের বুঝিয়ে ছিল, যে, আমি হারতে আসিনি |
যেদিন আমার সিলেকশন লেটার বাড়িতে আসে, ঠিক তার আগের দিন আমাদের বাড়িতে আরও দুটো এপয়েন্টমেন্ট লেটার আসে - প্রথমটা, আমার ছোড়দার জন্য ব্যাঙ্কের চাকরি, আর দ্বিতীয়টা ছিল আমার বড়দার জন্য পোস্ট অফিসের চাকরি | এই তিনটের চাকরির একটিও কিন্তু কন্ট্রাকচুয়াল ছিল না | আমার গরীব মাস্টার বাবার তিন সন্তান তাদের নিজেদের দমে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি জুটিয়ে ছিল |
কিন্তু বিধাতারও কেমন লীলা !! আমাদের তিন জনের লড়াইটাকে সম মর্যাদা দিতেই বোধহয় তিনি একসঙ্গে একই দিনে তিন জনকেই আত্মনির্ভর করে তোলেন | এমনটা তো হয় না!! কিন্তু তবুও হয়ে গেল| দুঃখ গুলি যদি অতর্কিতে আসতে পারে, তবে সুখগুলিও আসবে না কেন??.....আমার মাও কিন্তু সেদিন হাউহাউ করেই কেঁদে ছিল, ঠিক বাবার মতো, তবে বাবার কান্নার সাথে সে চোখের জলের পার্থক্য ছিল বিস্তর |
আমার বড়দা ঠিক আমার বাবার মতো, খুবই সাধারণ প্রকৃতির, কোনো লড়াই - ঝগড়া, বাকবিতণ্ডায় থাকে না | আমার সেই বড়দাই সেদিন বুক চওড়া করে ছোড়দাকে বলেছিল, " আচ্ছা, টুবাই, একটা পার্টি রাখলে কেমন হয়!! "
ছোড়দা বড়দার মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে বলেছিল, " কিসের পার্টি রে বড়দা?? "
"বাঃ রে!!,আমাদের ছোটো বোনটার জন্য একটা অনুষ্ঠান করতে হবে না!! তুই আর আমি তো চাকরি পেলাম রে, আমাদের বুবাই তো ওর স্বপ্ন ছুঁলো | আমাদের ছোটো বোনটা নিজের জেদ দিয়ে আমাদের শিখিয়ে দিলো, যে, মনের ক্ষমতায় গরীবও নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে | ডাক সবাইকে, ডেকে দেখা, যে, আমরা কন্যাদায়গ্রস্ত নই, আমাদের বোন একবছর ট্রেনিং এর পরে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের ফ্লাইং অফিসার হবে | "
সেদিন বড়দার চেহারায় আমি আমার বাবাকে দেখতে পেয়েছিলাম | আমাদের ছোট্ট অনুষ্ঠানে সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার পিসি আর জ্যেঠুরা মাথা নিচু করে বসেছিল | যারা ভেবেছিলো, বাবা চলে যাবার পরে আমরা ভিক্ষে করবো, তারা সেদিন জীবনে প্রথম বুঝেছিলো যে, তাঁদের উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা ছোটো ভাইটা ছেলে মেয়েকে তাঁর লড়াইটা দিয়ে যেতে পেরেছে, এখানেই বোধহয় শিক্ষকতা করার সার্থকতা |
তারপর এই আট বছরে আমি পদোন্নতি করে ফ্লাইং অফিসার থেকে উইং কমান্ডার হয়েছি | ভারতীয় বিমান বাহিনীর এ. এন. -৩২ আমার পরিচালনাতেই ওড়ে | আমি রোজ আকাশ পথের পাখি হই , কিন্তু তবুও যাত্রীবাহী বিমান চালানোর ইচ্ছেটা মনের মধ্যে গোপনে লুকিয়েই ছিল, যা আজ ভগবানের অফুরান কৃপায় বাস্তব হয়ে গেলো !!
বিমান বন্দর থেকে বেরোবার সময় দেখলাম, আমার পুরো পরিবার আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে | আমার মাও কিন্তু চাকুরীরতা এখন| কারণ, বাবার চাকরিটা এখন মায়ের বরাদ্দে | আমরা সবাই এখন সুখী পরিবার | আমার পাঁচ বছরের ভাইঝিটা আমাকে দেখেই আমার কোলে ঝাঁপ দিলো, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাতের খেলনা এরোপ্লেনটা দেখিয়ে বলল, " এই দেখো পিপি আমার উড়ান, আমিও তোমার মতো পাখি হবো, ডানা মেলে ওই আকাশে উড়বো | "
আমাদের সেই গরীব মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই দেখছেন সেই উড়ানকে | ঈশ্বরই বোধহয় জানেন সেটা |