Ananya Podder

Classics Inspirational Others

3.3  

Ananya Podder

Classics Inspirational Others

গর্ব

গর্ব

7 mins
384


"খুব দেমাক ছিল, আর এখন দেখো, মুখ দেখাতেও লজ্জা!! "... আমার বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির অনিতাবৌদিকে দেখলাম কথাগুলি বলতে | শীতের দুপুরে এই সময় অনেকেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায় | যদিও আমার বারান্দায় এই সময় খুব একটা রোদ আসে না, তবুও দুপুরের পরে আমি পূবের এই বারান্দাটায় এসে বসি | বসে বসে আমার গাছগুলোদের সাথে গল্প করি | আমাকে দেখে অনিতা বৌদি বললেন, "কি গো তনিমা, আজ তোমার ছবি আঁকা নেই ?? "


আমি উত্তর দিলাম, "হ্যাঁ, আছে | একটু বাদে গিয়ে শুরু করবো | "


"তোমার তো অখণ্ড সময় !! ছেলে মেয়ে নেই,, বেশ মজাতেই আছো !! "


আমি এইসব প্রশ্নের খুব একটা উত্তর দিইনা | এই মজায় থাকা নিয়ে যে একটা তির্যক দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করা হয়, সেটা আমার জানা আছে | তাই, এই ধরণের মন্তব্যে খুব একটা প্রভাবিত হইনা | আমি প্রসঙ্গ বদলিয়ে বললাম, "খাওয়া হয়ে গেছে আপনাদের ?? "


অনিতাবৌদি হেসে হেসে জবাব দিলেন, "হ্যাঁ গো, খেয়ে উঠে এই শিপ্রার সাথে একটু গল্প করছি | তাই ওকে বলছিলাম, শ্রাবনীর কথা | কি দেমাকটাই না ছিল ওর মেয়েকে নিয়ে | কি হোলো শেষ পর্যন্ত ?? মুখ কালি করে আবার ফিরে এল তো বাপের ঘরে !! "


অনিতাবৌদিদের গল্পের যে এখন বেশ একটা রসদ হয়েছে শ্রাবনীদির মেয়ে, সেটা জানাই আছে আমার | একশো আশিটা ফ্ল্যাটের আবাসনে এখন অনেক মহিলার গল্পের কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে শ্রাবনীদের মেয়ে স্নিগ্ধা | লেখাপড়া, গান বাজনায় দুর্দান্ত স্নিগ্ধা মনের কাছে হেরে গিয়ে একটা ভুল করে ফেলেছিলো | ভুল করে ভালোবেসে ছিল ত্রিদিবকে | শ্রাবনীদির আপত্তি ছিল এই বিয়েতে | কিন্তু শ্রাবনীদির স্বামী স্বপনদা মেয়ের মতে মত দিয়েছিলেন, তাই বিয়েটা হয়ে ছিল সুষ্ঠভাবেই | আমরা সবাই স্নিগ্ধার বিয়েতে খুব আনন্দও করেছিলাম |


কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্নিগ্ধা ফিরে এল মায়ের কাছে | বলা যায়, শ্রাবনীদিই নিয়ে এল মেয়েকে নিজের কাছে | তারপর থেকেই আবাসনের অনেক ফ্ল্যাটেই শুরু হয়েছে গুঞ্জন | কারণ, সত্যিই মেয়েকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল শ্রাবনীদির | এডুকেশনে এম. এ করে নেট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো স্নিগ্ধা | সাথে স্নিগ্ধার আরও একটা গুণ ছিল -- স্নিগ্ধা চমৎকার গান গাইতো | রীতিমতো গুরুজীর কাছে তালিম নিত সে | ছোটোখাটো রিয়ালিটি শোতে অংশগ্রহণও করেছিল | তাই মেয়েকে নিয়ে শ্রাবনীদির গর্ব করাটা আমার কাছে কোনোদিন অযৌক্তিক মনে হয়নি |


সে যাই হোক, আমি অনিতাবৌদির আলোচনায় অংশগ্রহণ করা থেকে বেরিয়ে আসতে বললাম, "আমার ফোন বাজছে বোধহয় | একটু ঘর থেকে ঘুরে এসে কথা বলছি বৌদি |"


পরেরদিন সকালে রীতম অফিসের কাজে উড়িষ্যায় উড়ে গেলো সকালেই, ফিরবে সেই দুদিন বাদে | তাই ভাবলাম, শ্রাবনীদির ফ্ল্যাটে একবার হানা দেবো | মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনার পরে শ্রাবনীদি, স্বপনদা, কেউই খুব একটা কারোর সাথে মেলামেশা করেন না | আমি বুঝলাম, নিজে থেকে শ্রাবনীদিদের এই একাকিত্বকে যদি না ভাঙ্গি, তাহলে একটা অদৃশ্য বেড়াজাল থেকে কিছুতেই এই পরিবারটা বেরিয়ে আসতে পারবে না |


তাই রীতম বেরোনোর আগে ওকে সবটা খুলে বলে বললাম, "একবার যাবো নাকি গো ওদের ফ্ল্যাটে ?? "


রীতম বলল, "যাও | লোকের তির্যক কথা শোনার অভ্যেস আমাদের হয়ে গেছে, ওদের তো হয়নি এখনো, তাই বোধহয় এড়িয়ে চলছে সবাইকে | ঘুরে আসতে পারো তুমি, অসুবিধে তো কিছু নেই | "


রীতম বেরিয়ে যেতেই স্নান সেরে চলে গেলাম শ্রাবনীদির ফ্ল্যাটে | সাথে রেখেছি লোটে মাছের ঝুরি -- স্নিগ্ধা খেতে খুব পছন্দ করে | গিয়েই বললাম, "শ্রাবনীদি, আজ তোমাদের বাইরে বেরোনোর কোনো প্ল্যান আছে নাকি ?? "


শ্রাবনীদি বলল, "না রে, বাড়িতেই থাকবো সারাদিন |তা, তুই হঠাৎ, কি মনে করে এলি ?? "


হাতের টিফিনবক্সটা ডাইনিং টেবিলে রেখে বললাম, "স্নিগ্ধার জন্য লোটে মাছের ঝুরি বানিয়ে এনেছি | কি ভালো খায় মেয়েটা লোটে মাছ !! আর রীতম বেরিয়ে গেলো আজ দুদিনের জন্য অফিসের কাজে | ফাঁকা বাড়িতে হাঁপিয়ে উঠবো ভেবে রীতমই বলল, তোমার বাড়িতে চলে আসতে | তাই চলে আসলাম | তাড়িয়ে দেবে না তো আবার, না জানিয়ে আসলাম বলে ?? স্নিগ্ধা কই ?? স্নিগ্ধা.... স্নিগ্ধা .... "


দেখলাম, স্নিগ্ধা বারান্দায় বসে আছে চুপচাপ | ওর কাছে গিয়ে বললাম, "ওঠ তো স্নিগ্ধা, সেতারটা নিয়ে বোস | অনেকদিন তোর গান শুনিনি | একটা গান শোনা তো!! "


স্নিগ্ধা বলল, "এখন ইচ্ছে করছে না মাসিমণি | পরে গাইবো, তুমি তো আছো এখন | "


জোর করলাম না ওকে আর, গিয়ে বসলাম শ্রাবনীদির কাছে | শ্রাবনীদি আমাকে পেয়ে বলল, "খুব কি ভুল করলাম রে মেয়েটাকে নিজের কাছে এনে ?? বিয়ে দিয়ে দিয়েছি বলে কি সব দায়িত্ব থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া যায়, বল ?? ত্রিদিবের যে আবার মদের নেশা আছে, সেটা তো জানা ছিল না কারোরই!! শুধু একটা ছেলের ভালো চাকরি করাটাই কি সব, বল?? মেয়েটার ছোট ছোট স্বাধীনতাগুলো পর্যন্ত নষ্ট হচ্ছিলো ওই বাড়িতে | তবুও তো মেয়েকে চলে আসতে বলিনি | স্বামী -স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায়নি কোনোদিনই | নিজের পছন্দ মতো খাবার খাওয়া, জামাকাপড় পরা, সাজগোজ করা, এমনকি বন্ধুবান্ধবদের সাথে মেলামেশা -- সেটাও তো বন্ধ করে দিয়েছিলো স্নিগ্ধা শুধুমাত্র ত্রিদিবকে খুশি করবে বলে | নাক তো গলাইনি একটুকুও মেয়ের সিদ্ধান্তে | কিন্তু যখন গানের অডিশনে চান্স পাওয়ার পরেও ওকে যেতে বাধা দিলো ত্রিদিব, তখন আর মেয়ের পাশে না দাঁড়িয়ে পারিনি রে | ভুল কার না হয় বল তো?? মানুষ চেনা কি অতই সহজ !! আমরা যদি নিজেরা দেখে শুনে বিয়ে দিতাম স্নিগ্ধার, তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে কি ফেলে দিতে পারতাম মেয়েটাকে, বল ??


তাই, তোর স্বপনদার আপত্তি থাকার পরেও স্নিগ্ধা যখন বলল, " মা, ভালোবাসায় ত্যাগ কি শুধু আমিই করবো?? ত্রিদিব আমায় ভালোবাসে না | বোম্বেতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে আমার চরিত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে যে স্বামী আমার ক্যরিয়ার নষ্ট করে দিতে চায়, সেই স্বামীর সাথে আর ঘর করতে চাই না আমি |"... বল, তখন কি করে মেয়েকে ফেলে রেখে আসি সেই অনিশ্চিত জীবনের মাঝে ?? জানতাম, অনেক কথা হবে, তবুও নিয়ে এলাম আমি | মানুষ চিনতে ভুল করেছে, সেখানে ওর অপরাধটা কোথায় ?? একবার ঠকেছে বলে কি জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিতে হবে ?? সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় কেন সাহায্য করবো না স্নিগ্ধাকে, বলতে পারিস ?? আজও তো স্নিগ্ধাকে নিয়ে আমার গর্বই হয় | কটা প্রতিযোগী পেরেছে বল, অত বড়ো স্টেজ অবদি পৌঁছতে !! তাই, স্নিগ্ধা যখন সেই বস্তাপচা দাম্পত্য থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো, আমি সমর্থন করেছি মেয়েকে | সংসার করার নামে, ভালোবাসার নামে নিজের জীবন, নিজের ইচ্ছে, নিজের ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিতে হয় আমার মেয়েকে, তাহলে স্নিগ্ধাকে ম্যারেড বলার চেয়ে ডিভোর্সি বলতে আমি বেশি গর্ব বোধ করবো | অনেকেই হয়তো ভাবছে, স্নিগ্ধাকে নিয়ে আমার লজ্জার শেষ নেই এখন, কিন্তু বিশ্বাস কর তনিমা , স্নিগ্ধাকে নিয়ে আমার আজও দেমাক আছে | এখনো ওর ভবিষ্যত উজ্জ্বল | ওকে বলেছি, নেটের জন্য তৈরী হতে, সাথে গান তো রইলই | কে বলতে পারে বল, আজ একটু খানি সমাজের কথা ভুলে, লোকে কি বলবে সে কথা ভুলে ওর সিদ্ধান্তকে দাম দিলে যদি কাল কিছু একটা করার মতো কিছু করে উঠতে পারে, তখন এই সমাজটাই তো আবার ছুটে আসবে একগাল হাসি নিয়ে, তাই না বল !! "


আমি শ্রাবনীদির হাত দুটো ধরে বলি, "স্নিগ্ধার ভবিষ্যত সত্যিই খুব সুন্দর | কেন জানো?? কারণ, ও তোমার মতো একজন মা পেয়েছে!! সন্তানকে ভুল সংসারে মানিয়ে নিতে বলে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দাওনি তুমি | স্নিগ্ধা তোমার গর্ব ঠিকই, তবে তোমাকে নিয়ে স্নিগ্ধাও গর্ব করতে পারে |"


আমাদের কথার মাঝেই কখন স্নিগ্ধা এসে দাঁড়িয়ে গেছে, আমি, শ্রাবনীদি কেউই খেয়াল করিনি | দেখলাম, স্নিগ্ধা একরাশ জল ভরা চোখে দাঁড়িয়ে দেখছে শ্রাবনীদিকে | শ্রাবনীদি হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কাছে ডাকতেই স্নিগ্ধা ছোট বাচ্চার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো মায়ের বুকে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, "তোমার অবাধ্য হয়ে যে ভুল করেছিলাম মা, তার শাস্তি আমি পেয়েছি | আমি তোমায়, কথা দিচ্ছি মা, আমি এতো বড়ো উচ্চতায় উঠবো, যে, সবাই তোমায় দেখিয়ে বলবে, "ওই যে, স্নিগ্ধা সেনের মা, শ্রাবনী সেন যাচ্ছেন | "... "


মা মেয়ের সেই আবেগঘন মুহূর্তের সাক্ষী থাকলাম আমি | সন্তান নেই বলে আমাকেও সমাজের কম কটুকথা শুনতে হয়নি | আমি একজন প্রতিষ্ঠিত অঙ্কনশিল্পী | আমার আঁকা ছবি চড়া দামে বিক্রি হয় | তবুও কিছু মানুষ কানাঘুসোয় আমার মা হওয়ার অক্ষমতাকে নিয়ে চৰ্চা করেন | কিন্তু রীতম কোনোদিন আমার প্রতি ওর ভালোবাসার মাত্রা কমায়নি | আমার এই অক্ষমতা নাকি ওর কাছে নিতান্তই তুচ্ছ একটা ব্যাপার | রীতম বলে, "সন্তান পাবো বলে তোমাকে ভালোবাসিনি পিউ | তোমাকে ভালোবেসেছি বলে সন্তান পাবার ইচ্ছেটা তৈরী হয়েছিল | সন্তান না আসলে তোমায় ভালোবাসাটা কম করতে পারিনা আমি | ওটার প্রায়োরিটিটা সবচেয়ে বেশি আমার কাছে | "


আজ শ্রাবনীদির মানসিকতার সাথে রীতমের মানসিকতার মিল খুঁজে পেলাম | শ্রাবনীদি, রীতম -- এরা কেউই দুর্বলের হাত ছেড়ে পালিয়ে যায়নি | বরং, স্নিগ্ধা, আমার মতো দুর্বল মানুষগুলোকে আরও আঁকড়ে ধরে ভালোবেসেছে | ওদের দেখে তাই মনে হোলো, রীতমকে নিয়ে আমিও গর্ব করতে পারি | কজন স্ত্রীর ভাগ্যেই বা এমন স্বামী জোটে |


এই মুহূর্তেই আমি বুঝলাম, গর্ব শুধু মানুষের অহংকার নয়, গর্ব মানুষের আবেগও, যেটাকে আঁকড়ে ধরে জীবনের পরীক্ষা নির্বিদ্বিধায় টপকে যাওয়া যায়, হাসি মুখে জয় করা যায় অনেক যুদ্ধ | দুর্বলের হাত সবাই ধরতে জানে না, আর যিনি দুর্বলের হাত ধরে দুর্বলের পাশে দাঁড়াতে পারেন, তাকে নিয়ে সত্যিই গর্ব করা যায়, তিনি সত্যিই গর্ব করার মতো মানুষ !!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics