Ananya Podder

Inspirational Others

4  

Ananya Podder

Inspirational Others

মুখদর্শন

মুখদর্শন

7 mins
530


প্রত্যেক দিনের মতো আজও সিঞ্জিতার সকালটা একইরকম ভাবে মায়ের চিৎকার দিয়ে শুরু হোলো | সেই ভাঙা টেপের মতো গর্জে উঠল শর্মিলা, "কিরে, মিতু, উঠলি কি এবার বিছানা ছেড়ে ?? আর কত ঘুমাবি ?? বেলা যে বয়ে যায় !! "


মায়ের চিৎকারটাকে না শোনার জন্য কোলবালিশ দিয়ে নিজের কানটা চেপে ধরে সিঞ্জিতা ওরফে মিতু | এর পরেরটুকু কি হবে মিতুর জানা আছে | শ্যামলী এর পরেই বলে বসবেন, " গিয়ে দেখ ত্রিপর্ণাকে, কি ভালো মেয়ে !! ওর মাকে কোনো চিন্তাই করতে হয় না ওকে নিয়ে | একই ক্লাসে পড়িস, একই বাসে যাতায়াত করিস | ওকে দেখেও তো কিছু শিখতে পারিস, নাকি !! "


তারপরে সারাদিন মায়ের সামনে গেলেই মায়ের মুখে শুনতে হবে ত্রিপর্ণার স্তুতি | একেক সময় মিতুর মাকে বলতে ইচ্ছে করে, "আমার জায়গায় ত্রিপর্ণা তোমার মেয়ে হলেই ভালো হোতো বোধহয় | "


কিন্ত ত্রিপর্ণা মেয়েটি সত্যিই খুব ভালো মেয়ে | লেখাপড়ায় সে ভালো বটে, তবে তার নিজস্ব মতামত, তাকে তার বন্ধুরা লেখাপড়ার জন্য যতটা সমীহ করে, ততটাও লেখাপড়ায় সে ভালো নয় | তবুও, ক্লাসের সব বন্ধুদের কাছে ত্রিপর্ণা শুধু মেধাবী ছাত্রীই নয়, ত্রিপর্ণা একটা ফুল প্যাকেজ যেন!!


ত্রিপর্ণাকে বাসে যেতে যেতে মাঝেমধ্যেই সিঞ্জিতা বলে, "আমার কি মনে হয় জানিস ?? তোকে খুন করে ফেলি আমি | তুই আছিস বলেই আমার মা সারাদিন আমার পিছনে লেগে থাকে | আমার মা দিনে যতবার না আমার নাম নেয়, তার চেয়েও বোধহয় বেশি তোর নাম নেয় | তুই এক কাজ কর না রে ত্রিপর্ণা, তুই আমার মায়ের মেয়ে হয়ে যা না রে, আর নয়তো তোর মাকে আমায় দিয়ে দে !! "


ত্রিপর্ণা বন্ধুর কথা শুনে জোরে জোরে হাসে আর বলে, "পাগল হয়েছিস নাকি ?? আমার মাকে আমি ছেড়ে দিলে এই যে আমার নামে এতো প্রশংসা হচ্ছে এসব কিছুই হোতো না | আমার মা আছে বলেই তো আমার সাথে তোদের তুলনা করা হয় !! সব দিতে পারবো ভাই, শুধু আমার মাকে দিতে পারবো না | "


সিঞ্জিতা বন্ধুর কথার জবাবে পাল্টা জবাব দেয়, "তাহলে তোর ব্রেনটা দিয়ে দে আমায় | "


বন্ধুর কথায় হেসে ওঠে ত্রিপর্ণা | বলে, "সেটা কি সম্ভব রে !! অবাস্তব জিনিস নিয়ে কথা বলছিস কেন ?? তোর সমস্যাটা কি হয়েছে সেটা বল ?? "


সিঞ্জিতা দুঃখের সাথে বলে, "এই যে আজ পরীক্ষা আছে , জানিস কাল রাত চারটে পর্যন্ত পড়েছি | তারপর আজ সকাল আটটায় উঠেছি | তাও মায়ের চিৎকার থামে না | তুই কাল কত রাত অবদি পড়েছিস, বল তো ?? "


"আমি রাত দুটোর পরে আর পড়তে পারিনি রে | ইচ্ছে ছিল অন্ততঃ তিনটে চারটে অবদি জাগবো | কিন্তু মা দুটোর পরে তাড়া মেরে তুলে দিলো আমায় | বলল, এর চেয়ে বেশি রাত জাগলে নাকি শরীর খারাপ করবে আমার !! "


"তাহলে আজ অনেক সকালে উঠেছিস বল ?? "


"ধুর, কি যে বলিস তুই !! আজ সকাল দশটায় উঠেছি | একঘন্টার মধ্যে তৈরী হয়ে স্কুলের বাস ধরার জন্য বেরিয়ে পড়েছি | "


সিঞ্জিতা একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলল, "বেলা দশটা!! তোর মা চেঁচাল না তোর ওপরে ?? "


ত্রিপর্ণা হেসে বলল, "মা চেঁচাবে কি রে !! মা-ই তো ডাকে না আমাকে | বলে, ভালো করে ঘুমোতে হয় পরীক্ষার আগে | তাতে পরীক্ষা ভালো হবে | "


সিঞ্জিতা মুখটা বেজাড় করে বলল, "তোর কি ভাগ্য রে !! অনেক কপাল করে এমন মা চেয়েছিস তুই, ত্রিপর্ণা !! "


ত্রিপর্ণা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বলল, "এটা তুই ঠিকই বলেছিস | আমার মায়ের মতো মা সবাই পায় না | আমাকে দিয়ে আমার মা যথেষ্ট পরিশ্রম করায়, তবে আমার সাথে আমার মাও পরিশ্রম করে | এতো সুন্দর করে পড়ায়, যে, পড়াটা আর পড়া মনে হয় না আমার কাছে | আসলে বলতে পারিস সিঞ্জিতা, আমার ভালো হওয়ার পিছনে আমার মায়ের একটা বিশাল ভূমিকা আছে | "


পরীক্ষার শেষে হিসেব মতো ত্রিপর্ণার পরীক্ষাই তুখোড় পর্যায়ে ভালো হয় | ক্লাসের সবাই বলছে, "এতো বড়ো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যেকজন জোনাল রাউন্ডের পরীক্ষায় বসবে, তাদের মধ্যে ত্রিপর্ণা থাকবে সবার আগে | কারণ, প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর যথেষ্ট কনফিডেন্সের সাথে দিয়েছে সে |"


বাড়ি ফেরার সময় সিঞ্জিতা ত্রিপর্ণাকে বলল, "বাস থেকে নেমে তোর কোনো চিন্তা থাকবে না বল, ত্রিপর্ণা | "


"মানে ?? ",, ত্রিপর্ণা অবাক হয় বন্ধুর প্রশ্নে |


সিঞ্জিতা বলে, "না, মানে বাস থেকে নামার পরে আন্টি যখন জিজ্ঞেস করবে তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে, তুই তো তখন বেশ নিশ্চিন্তেই বলতে পারবি তোর পরীক্ষার কথা | "


বাসের সিটে বসে ব্যাগটাকে ভালো করে কোলের মধ্যে নিয়ে ত্রিপর্ণা বলল, "ওহ, এই কথা !! কিন্তু মজার কথা হোলো, বাস থেকে নামার পরে আমার মা আমাকে প্রথম প্রশ্ন করে, আমি টিফিন পুরো শেষ করেছি কিনা | শেষ করলে কখন করেছি | "


"সত্যি ?? আন্টি তোকে পরীক্ষা, কয়েশ্চেন নিয়ে কোনো কথা জিজ্ঞেস করেন না ?? "


"না রে, নিজে থেকে কিছু বলেও না, জিজ্ঞেসও করে না | আমি কথা তুললে তবে বলে, নাহলে নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করে না | "


সিঞ্জিতা বাসের জানলা থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবল, "মা শুধু ত্রিপর্ণার সাথে আমার তুলনা করে | আমার মাও কি কখনো ত্রিপর্ণার মায়ের মতো হতে পারবে ?? ত্রিপর্ণার মায়ের যে গুণগুলো আছে একজন ভালো মা হওয়ার, আমার মায়ের মধ্যে তো সেইসব গুনের একটাও নেই | নিজের দিকে কি মা কখনো তাকিয়েছে ?? সে নিজে কতটা পিছিয়ে আছে ত্রিপর্ণার মায়ের থেকে !! "


সেদিন বাড়ি ফিরতেই শ্যামলীর প্রথম প্রশ্ন, "কি রে মিতু, পরীক্ষা কেমন হোলো তোর ?? "


মায়ের প্রশ্ন শুনেই মেজাজটা বিগড়ে গেলো সিঞ্জিতার | এই হচ্ছে পার্থক্য | একজন মা তার মেয়ে বাস থেকে নামলে জিজ্ঞেস করে, টিফিন শেষ করেছে কিনা... আরেকজন মা জিজ্ঞেস করছে, পরীক্ষা ভালো হয়েছে কিনা !!


মায়ের প্রশ্নে জুতোর লেস খুলতে খুলতে সিঞ্জিতা জবাব দিলো, "হয়েছে মোটামুটি | "


মেয়ের মুখে "মোটামুটি" শব্দটা শুনে শ্যামলী যেন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে | চেঁচিয়েই বলে, "মোটামুটি হবে না ?? ফাঁকি দিলে তো মোটামুটিই হয় পরীক্ষা | চেয়ে দেখ একবার ত্রিপর্ণাকে !! ওর নিশ্চয়ই ফাটাফাটি হয়েছে পরীক্ষা | যা, ওর পা ধোওয়া জল খেয়ে আয়, তবে যদি মানুষ হতে পারিস | "


আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না সিঞ্জিতা | এই প্রথম মায়ের গলা ছাপিয়ে সে বলে উঠল, "আমাকে ত্রিপর্ণার মতো বানাতে গেলে আগে তুমি ওর মায়ের পা ধোওয়া জল খেয়ে এসো | তুমি সঠিক মা হলে তবেই না আমি ত্রিপর্ণার মতো ভালো মেয়ে হতে পারবো | "


শ্যামলী মেয়ের কাছ থেকে এমন উত্তর পাবে, স্বপ্নেও ভাবেনি | একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, "কি বললি, কি বললি তুই মিতু ?? আমি, আমি ত্রিপর্নার মায়ের পা ধোওয়া জল খেতে যাবো !! মাকে এভাবে অপমান করতে তোর একটুও জিভে আটকালো না !! "


সিঞ্জিতাও সমান তর্কে উত্তর দিলো, "কি করে আটকাবে মা | তোমার কাছ থেকে শুনে শুনে এমন বলতে মুখে আটকায় না আমার | তুমি বললে যদি আমার অপমানে না লাগে, তাহলে সেই একই কথা আমি বললে তোমার অপমানে লাগছে কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না | তোমরা সবাই ত্রিপর্ণার রেজাল্টটাকেই দেখো, ওর ভালো হওয়ার পিছনে ওর মায়ের ভূমিকাটাকে দেখো না কোনোদিনও | ত্রিপর্ণা কেন এক্সট্রাঅর্ডিনারি জানো, কারণ ওর মা এক্সট্রাঅর্ডিনারি!! আমাকে কিছু শেখানোর আগে ওর মায়ের কাছে গিয়ে তুমি শিখে আসো, মেয়েকে সবকিছু কি করে শেখাতে হয় | তারপরে এসে আমাকে শিখিও | তুমি যদি ত্রিপর্ণার মায়ের মতো হতে পারো, আমারও তবে ত্রিপর্ণার মতো হতে খুব বেশি সময় লাগবে না | "


মেয়ের কথায় স্তম্ভিতো হয়ে যায় শ্যামলী | এই মিতু আজ তার কাছে সত্যিই অচেনা হয়ে উঠছে | ঘরে গিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে, তারপরেই ডুকরে কেঁদে ওঠে |


ল্যাপটপে নিজের কিছু কাজ দেখছিলেন শ্যামলীর স্বামী অনিন্দ্য | তিনি মা মেয়ের পুরো বার্তালাপটারই সাক্ষী ছিলেন | স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে ল্যাপটপ থেকে উঠে এসে স্ত্রীয়ের পাশে বসলেন | স্ত্রীয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "কষ্ট হচ্ছে বলো খুব !! এমন কথা শুনতে সত্যিই কি কারোর ভালো লাগে !! কিন্তু একটু ভেবে দেখো শ্যামলী, যে কথা তুমি একদিন মিতুর মুখে শুনে কেঁদে দিলে, সে কথা তুমি রোজ মিতুকে শোনাও | ভেবে দেখো, তোমার কথায় মিতু তাহলে কতটা কষ্ট পায় !! "


বালিশের থেকে এবার মুখ তুলে বসলো শ্যামলী | চোখের জল মুছে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো, " আমি কি মা হিসেবে খুবই খারাপ গো ?? মিতু তাহলে আমাকে এমনভাবে কেন বলল কথা গুলো !! "


অনিন্দ্য একটু হাসলেন, বললেন, "তুমি মিতু কেউই খারাপ নও | তুমি যেমন মিতুকে অন্যের সাথে তুলনা করছিলে, আজ ঠিক একই ভাবে মিতু তোমাকে অন্য কারোর সাথে তুলনা করলো | প্রত্যেকটা মানুষই স্বতন্ত্র হয়, শ্যামলী | তোমাকে এতদিন কিছু বলিনি, কারণ আমি বললেও তুমি আমার কথা শুনতে না | আজ মিতু তোমাকে আয়না দেখাতেই তোমার কাছে সবটা কেমন স্পষ্ট হয়ে উঠল দেখো | তাই বলছি, মিতু যেমন, তেমন করেই ওকে বড়ো হয়ে উঠতে দাও | মিতু যেমন ত্রিপর্ণা হয়ে উঠতে পারবে না, ঠিক ত্রিপর্ণাও কোনোদিন মিতু হয়ে উঠতে পারবে না | আর সত্যি বলতে কি, একে অপরের মত হয়ে ওঠারও তো কোনো দরকার নেই | এটা ত্রিপর্ণার মা বুঝে গেছেন অনেক আগেই, কিন্তু তুমি বুঝতে পারোনি | তুমি বদলাও, দেখো মিতুও বদলে যাবে আস্তে আস্তে | "


শ্যামলী বিছানা থেকে নেমে পড়লো, স্বামীকে বলল, "দেখি, মিতু কি খাবে | তার ব্যবস্থা করি গিয়ে | "


রান্নাঘরে যাবার সময় শ্যামলী দেখলো, মিতুর ঘরের দরজা তখনও ভিতর থেকে বন্ধ | সত্যিই মেয়েটাকে ওভাবে অপমান করা ঠিক হয়নি তার | মেয়েটা আজ তাকে তার চরিত্রের আয়নাতেই মুখদর্শন করিয়ে দিলো | একেই বলে বোধহয় ঈশ্বরের দেওয়া শিক্ষা | নাহ, সত্যিই ত্রিপর্ণার মায়ের কাছে অনেক কিছু শিখতে হবে তাকে | কারণ, আদর্শ মা হওয়ার চেয়েও ভালো মা হওয়া যে আরও বেশি কঠিন, সেটা আজ সে তার মেয়ের কাছ থেকেই শিখে গেলো |


রান্নাঘরে গিয়ে মেয়ের জন্য কফি বসালো শ্যামলী, তবে মিতুর জন্য একা নয়, এক কাপ তার জন্যও বানাচ্ছে সে | কফি খেতে খেতে আজ মেয়ের সাথে গল্প করবে, আজ স্কুলটা মিতুর কেমন কেটেছে | দুধের মধ্যে কফি দিতেই দুধের রঙ বদলালো, যেমন মিতুর কথায় শ্যামলীর মনের রঙ পাল্টে যাচ্ছে একটু একটু করে |



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational