Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

4.7  

Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational

প্রাণের নীড়

প্রাণের নীড়

9 mins
2.1K



ভোর পাঁচটায় উঠে মর্নিংওয়াকে বেরোনো বসুধার বহুদিনের অভ্যাস। বহুদিন বলতে সেই সাম্য যখন হয়েছিল তখনকার। তার আগে অবশ্য ছোটবেলার থেকে মা বাবা এবং বিয়ের পর স্বামী সুভাষের শত বলা সত্ত্বেও ভোর ভোর উঠে শারীরিক পরিশ্রম করতে তিনি নারাজ ছিলেন। কিন্তু সাম্য হওয়ার পর শরীরটা অদ্ভুত ভাবে ফুলে উঠতে থাকে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে যেন আর চিনতে পারতেন না। ক্রমশ একটা হতাশা এসে গ্রাস করছিল তাঁকে। সুভাষই তখন আবার বলেন মর্নিংওয়াকে বেরোনোর কথা। সুভাষ বলেন বসুধা নিজের কেরিয়ারে যদি অপ্রতিরোধ্য হতে পারে, এত লড়াই করতে পারে, তাহলে এখন সামান্য ঘুমের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছে কেন! সুভাষের ভোকাল টনিক মন্ত্রের মত কাজ করে। এবারে আর আপত্তি করেননি বসুধা। সুভাষের সঙ্গে রোজ ভোর পাঁচটায় শুরু হয় তাঁর মর্নিং ওয়াক। সেই শুরু, আজও চলছে এই অভ্যেস। আজকাল মর্নিংওয়াকে বেরোলে সুভাষের কথা ভীষণ মনে পড়ে তাঁর। মর্নিংওয়াকের অভ্যাসটা রয়ে গেলেও আজ প্রায় সাত বছর এই অভ্যাসের সঙ্গীটা হারিয়ে গিয়েছে। পরের দিন রিটায়ারমেন্ট ছিল মানুষটার, রাতে আচমকা বুকে ব্যথা ওঠে, কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সব শেষ। রোজ ভোরে মর্নিংওয়াক সেরে ফিরে এসে নিজের বাগানে যান, শিউলি ফুল তুলে এনে রাখেন বসার ঘরে থাকা সুভাষের বড় ছবিটার সামনে। তারপর চা করে নিয়ে টিভির সামনে বসেন, খানিক্ষণ গান শোনেন। পেপার এলে পেপার পড়েন। ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে ঘরের টুকিটাকি কাজকর্ম করেন, দুপুরের খাবার বানান। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে গল্পের বই পড়তে পড়তে বিকেল হয়ে যায়। বিকেলে বাগানে কিছুটা সময় কাটাতে না কাটাতেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পড়তে চলে আসে তাঁর কাছে। একসময় যারা তাঁকে দিদিমণি বলে সম্বোধন করত আজকে সময়ের স্রোতে তাঁদের কাছে 'দিম্মা' হয়ে উঠেছেন তিনি। কচিকাঁচাগুলোর সঙ্গে সময়টা ভারী আনন্দে কাটে তাঁর। বাকি সারাটা দিন এই বাড়িটাই তাঁর একমাত্র সঙ্গী। প্রথম জীবনে সুভাষের সঙ্গে গায়ের রক্ত জল করে এই বাড়িটা গড়ে তুলেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন, "প্রাণের নীড়"। আজও বাড়ির আনাচে কানাচে তিনি অনুভব করেন সুভাষ আর সাম্যর স্পর্শ। প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর মনে হয় এই বাড়িটারও প্রাণ আছে। 



    আজকে মর্নিংওয়াক সেরে ফেরার সময় বাড়ির কাছাকাছি এসেই অবাক হলেন তিনি। দেখলেন দু'জন লোক তাঁর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। লোকদুটো এই সকাল বেলাতেও সানগ্লাস পরেছিল, তাই চেনা কেউ কিনা ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না বসুধা। দ্রুত পা চালিয়ে তিনি বাড়ির কাছাকাছি চলে এলেন। তাঁকে আসতে দেখেই লোকদুটোর একজন হাত জোড় করে বলে উঠল, "ভাল আছেন দিদিমণি?"

"কে? ঠিক চিনতে পারলাম না তো।" তাঁকে দিদিমণি বলে সম্বোধন করছে যখন তখন তাঁর ছাত্রদের কেউ হওয়া উচিৎ, কিন্তু লোকটাকে ঠিক চেনা চেনা ঠেকছে না বসুধা দেবীর। লোকটা এবার তাঁর পায়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল, চমকে উঠে দু'পা পিছিয়ে গেলেন বসুধা। লোকটা মাথা তুলে বলল, "দিদিমণি, আমি অনিমেষ। চিনতে পারছেন?"

"অ...নি...মেষ।" ঠিক মনে করতে পারলেন না বসুধা। অনিমেষ বলে লোকটা আবার মনে করানোর চেষ্টা করল, "আমার ভাইঝি অনুমালা এখন আপনার কাছে পড়ে, ক্লাস এইট।"

  "অনুমালা… মানে অনিকেতের মেয়ে!" চকিতে বসুধার মনে পড়ে যায় পুরোনো কিছু স্মৃতি, মনে পড়ে যায় অনিমেষকেও। অনিকেত পড়াশুনায় আহামরি না হলেও ছেলেটা ভদ্র সভ্য ছিল কিন্তু ওর দাদা অনিমেষ ছোটর থেকেই একটু দুর্বিনীত ছিল। নাহ, ওর কথাবার্তায় কোনো অসঙ্গতি বা খারাপ ব্যবহার কেউ পেত না কিন্তু কাজকর্মে সে ছিল গুন্ডাদের মত। মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা কিন্তু কাজের বেলায় যত অসৎ কাজ ছিল তার বাঁ হাতের খেলা। পরীক্ষার সময় টুকলি করতই। কয়েকবার ধরাও পড়েছিল। বকা দিয়ে, গার্জেন কল করেও শুধরানো যায়নি। তবে অনিমেষ তার আসল খেলাটা খেলে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় সময়। হেড স্যারের ঘর থেকে প্রশ্নপত্র চুরি করে টাকার বিনিময়ে ফাঁস করে দেয়। ব্যাপারটা জানাজানি হলেও কে এই কান্ডটি করেছে তা বোঝা যাচ্ছিল না, তখন বসুধাই নিজের দায়িত্বে তদন্ত করে ছেলেটাকে ধরে ফেলে। স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় অনিমেষকে, মাধ্যমিক দিতে দেওয়া হয় না। তারপর থেকে বসুধা ওর খোঁজ জানতেন না, জানার চেষ্টা করলে অবশ্যই জানতে পারতেন কিন্তু চেষ্টা করেননি, ইচ্ছে হয়নি তাঁর। আজকে তাই অনিমেষকে দেখে তাঁর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেল। তিনি গলাটা যথা সম্ভব কঠিন গলায় বললেন, "তুমি এখানে?"

অনিমেষ মুখে একটা বিগলিত ভাব এনে বলল, "এদিকে এসেছিলাম তাই ভাবলাম দেখা করে যাই আপনার সঙ্গে। যতই হোক আপনার জন্য আমার জীবনটাই পাল্টে গিয়েছিল।"

মুখটা আরও শক্ত হয়ে গেল বসুধার। অনিমেষ খুব সম্ভবত সেটা খেয়াল করেই বলল, "মানে আপনি সেদিন যে চড়টা মেরেছিলেন তাতে সাময়িক রাগ হলেও পরে আমার জ্ঞান চক্ষু খুলে যায়। আমি বুঝতে পারি আমি এতদিন কত অন্যায় করেছি। তারপর নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি। এর জন্য আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।"

  অনিমেষের কথা শুনে বসুধার মুখটা এবার খানিকটা নরম হয়। তিনি বলেন, "এখন কী করা হয় তাহলে?"

"ব্যবসা করি। উচ্চমাধ্যমিকের পর আর পড়া হয়নি।"

"কিসের ব্যবসা?"

"ইট বালি সাপ্লাই দিই। তাছাড়া একটা ছোটখাটো কাপড় দোকানও আছে, আমার ওয়াইফ বসে সেখানে।"

"বাহ শুনে ভাল লাগল।"

অনিমেষ মৃদু হাসল। তারপর নিজের গলার কাছে হাত নিয়ে গিয়ে বলল, "একটু জল হবে দিদিমণি? আসলে অনেকটা রাস্তা এলাম তাই গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে।"

পুরাতন ছাত্রের কথা শুনে বসুধা এবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ভেতরে ডাকলেন ওদের। অনিমেষরা আপত্তি করল না। ভেতরে এসে সোফায় বসতে অনিমেষের চোখ গেল সুভাষ বাবুর ছবির দিকে। ছবিটা দেখে আফসোস ঝরে পড়ল অনিমেষের গলায়, "কাকাবাবু আর নেই!"

"নাহ, সাত বছর হল চলে গিয়েছেন।" জল দিতে দিতে জবাব দিলেন বসুধা। তারপর বললেন, "তোমরা একটু বোস, আমি চা করি।" 

অনিমেষ আপত্তি করতে যাচ্ছিল কিন্তু বসুধা শুনলেন না। তিন কাপ চা করে এনে বসলেন বসার ঘরে। তারপর ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি এখানে আর থাকো না?"

"না। বাবার বাড়িতে এখন ভাইয়ের ফ্যামিলি থাকে। আমি ফ্যামিলি নিয়ে খড়কার দিকে থাকি।"

  এরপর অনিমেষ বিস্কুটে কামড় দিতে দিতে বলল, "আপনার ছেলে কোথায়? ওকে তো দেখছি না।"

"সাম্য এখন সিডনিতে আছে।"

"ওরে বাবা, বিশাল ব্যাপার তো।"

অল্প হাসলেন বসুধা, তারপর বললেন, "দূতাবাসে কাজ করে।"

"দারুণ ব্যাপার। ও তো ছোটর থেকেই ব্রিলিয়ান্ট ছিল। তা দিদিমণি আপনি তাহলে এই বাড়িতে একা?"

"নাহ, একা নয়।"

"একা নয়?" বিষম খেল অনিমেষ। বসুধা বললেন, "আহা সাবধানে খাও। একা নয় বলতে এই বাড়িটাই তো আমার সঙ্গী।"

অনিমেষের সঙ্গী এবার খুক করে হেসে উঠল। ভ্রূ কুঁচকে বসুধা তাকালেন লোকটার দিকে। 

"আপনার সঙ্গে তো আলাপ করা হল না।"

অনিমেষ বলল, "ওহো সরি। ও রঞ্জন সামন্ত। আমার পার্টনার "

"আচ্ছা।" 

"তা দিদিমণি ছেলে থাকতে একটা নির্জীব বাড়িকে সঙ্গী করে থাকার কী দরকার?"

"সাম্য বলে ওর কাছে চলে যেতে, ওর স্ত্রীও ভাল মেয়ে। কিন্তু আমারই এই বাড়ি, এই দেশ ছেড়ে গিয়ে পোষাবে না।"

"কিন্তু আপনি একলা মানুষ, এত বড় বাড়িতে থাকাটা একটু রিস্কি হয়ে যাবে না?"

"রিস্কি কেন? এই তো দিব্যি আছি।"

"না, ধরুন হঠাৎ শরীর খারাপ হলে তখন?"

"হলেই বা কী! যেদিন মৃত্যু রয়েছে সেদিন তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমার তো পায়ের বেড়ি বলতে কিছু নেই, তাই মৃত্যুকে ভয় পাই না।"

অনিমেষের সঙ্গী আবারও খুক করে হেসে বলল, "মাফ করবেন, এরকমটা ওই মনেই হয়। কিন্তু মৃত্যু সামনে এলে তখন সবার হাওয়া ফুস হয়ে যায়।"

এই ধরণের ভাষা বসুধা একদম পছন্দ করেন না। কিন্তু অতিথিকে মুখের ওপর কী আর কিছু বলা যায়, তাই তিনি উত্তর দিলেন না। 

"সে আপনি যাই বলুন দিদিমণি, এটা কিন্তু আপনার জেদ হচ্ছে", বলল অনিমেষ, "তার থেকে ভাল বাড়িটারী সব বেচে ছেলের কাছে চলে যান। নতুন নতুন দেশ দেখার মধ্যেও তো একটা মজা আছে।"

"না বাপু, এই দেশের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া আমার পক্ষে হবে না। নিজের দেশে নিজের কোনো মাটি থাকবে না।"

"আহা কেন থাকবে না? এত বড় বাড়ি, জায়গা যে কোনো প্রমোটার লুফে নেবে। আপনিও তো তার থেকে ফ্ল্যাট পাবেন।"

কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলেন বসুধা, তারপর বললেন, "আমি এই সব প্রমোটারদের ব্যাপার অত বুঝি না বাপু।"

"আপনি চাপ নিচ্ছেন কেন দিদিমণি, আপনি চাইলে আমরা এক্ষুণি সব ব্যবস্থা করে দেব। আপনি শুধু একবার বলুন।"

অনিমেষের কথা শুনে একটা চওড়া করে হাসলেন বসুধা, "তাই বলি, হঠাৎ এত বছর পর দিদিমণিকে তোমার মনে পড়ল কেন। যাইহোক, এবার তোমরা এসো। আমার কাজ রয়েছে।"

অনিমেষের সঙ্গী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অনিমেষ ঈশারায় তাকে চুপ করে যেতে বলল। 



    আরও দু'দিন অনিমেষ এসেছিল। বোঝানোর চেষ্টা করছিল বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া কতটা মঙ্গলজনক। তাকে আর বাড়ির ভেতর অবধি ডাকেননি বসুধা দেবী। হুমকি ভরা ফোনটা পেয়েছেন গতকাল। বসুধার ধারণা অনিমেষের সঙ্গী করেছিল ফোনটা। ইতিমধ্যেই অনুমালার থেকে জেনেছেন অনিমেষের সঙ্গীটি নিজেই আসলে ছোটখাটো প্রমোটার। এতদিন তিনি সাম্যকে কিছুই বলেননি কিন্তু গতকাল ফোনটা পাওয়ার পর ছেলেকে ফোনে জানিয়েছেন সবটা। সাম্য ভয় পেয়ে গিয়েছে খুব। ছেলেটা বরাবরই মা অন্তপ্রাণ। সে বারবার করে বলছিল বসুধাকে সিডনি চলে যেতে। তিনি জবাব দেননি। আজকে তাই সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছেন তিনি। সুভাষের অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বসুর মেয়ে মেঘশ্রীকে এখন ল' পাস করে প্র্যাকটিস করছে কয়েক বছর। আজকে মেঘশ্রীকে ডেকেছেন উইলটা করেই ফেলবেন বলে। কিন্তু মেঘশ্রী আসার আগেই এল অনিমেষ। বাইরের দরজাটা খোলা ছিল। অনিমেষ সটান ঘরে ঢুকে পড়ল। হতভম্ব বসুধা কিছু বলার আগেই অনিমেষ বলে উঠল, "কেন শুধু শুধু জেদ করছেন দিদিমণি! এত বড় বাড়ি নিয়ে কী করছেন একলা?"

"সে কৈফিয়ৎ তো আমি তোমাকে দেব না অনিমেষ।"

"কৈফিয়ৎ চাইছি না, সাবধান করছি। আপনাকে রেসপেক্ট করি বলেই আজকে এলাম।"

"সাবধান করছ? মানে?"

"মানে আপনার হয়ত মনে হচ্ছে আমি বা রজত এর পেছনে আছি। কিন্তু সত্যিটা হল আপনার পেছনে আসলে অন্য লোক লেগেছে। শহরের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ীর মেয়ের এই প্লটটা দারুণ পছন্দ হয়েছে। সে বড় পার্টিকে টাকা দিয়েছে, তারা রজতকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার সঙ্গে ডিল করার।"

"আর তুমি এদের মাঝের দালাল, তাই তো?"

"এই শব্দটা আমার হেব্বি অপছন্দ দিদিমণি কিন্তু আপনি বললেন তাই কিছু বলছি না। তবে আপনাকে আবারও বলব ভেবে দেখুন।"

"শোনো অনিমেষ, আমাকে আর বিরক্ত কোরো না। আমার জীবদ্দশায় এই বাড়ি তোমরা পাবে না। তোমাদের ওই ব্যবসায়ীর মেয়েকে বলে দিও তার শখ মেটানোর জন্য আমি আমার প্রাণের নীড় ধূলিসাৎ হতে দেব না। আর আমার মৃত্যুর পর এই বাড়ি আমি অনাথ আশ্রম তৈরীর জন্য দান করব। আজকেই উইল তৈরী হয়ে যাবে।" দাঁতে দাঁত চেপে বলেন বসুধা। 




    মেঘাশ্রী আজকে আসতে পারেনি। জ্যোতির্ময় বাবু এক্সিডেন্ট করেছেন। বিষণ্ণ মনে শুতে গেলেন বসুধা। এই বাড়িটাকে বিক্রি করে দেওয়ার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। একটা বাড়ির সঙ্গে সেই বাড়ি যে তৈরী করে তার যে কী আবেগ জড়িয়ে থাকে তা বাইরের কেউ কক্ষনও বুঝবে না। ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিতেই বসুধা খেয়াল করলেন রাস্তার আলোটা জ্বলছে না আজ। অন্যদিন তাঁর পেয়ারা গায়ের ফাঁক দিয়ে ঐ রাস্তার আলোটা এমনভাবে পড়ে যে তাঁর বেডরুমটা অনেকাংশে আলোকিত হয়ে যায়, নাইট বাল্ব জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ে না। আজকে আলোটা জ্বলছে না দেখে নাইট বাল্বটা জ্বালালেন তিনি। তারপর শুয়ে পড়লেন বিছানায়। 


   রাতের অন্ধকারে কালো পোশাকে শরীরটা মুড়ি দিয়ে খুব সন্তর্পণে প্রাণের নীড়ের পেছন দিকের দরজার একটু অংশ মেশিন দিয়ে কেটে ফেলল ছায়ামূর্তি। তারপর হাত গলিয়ে এসিড ঢেলে তালাটাকে গলিয়ে দিল। তারপর পা টিপে টিপে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। গোটা ঘর এখন নিস্তব্ধ। বাইরে থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ আসছে না। ছায়ামূর্তি এগিয়ে গেল বেডরুমের দিকে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ঠোঁট কামড়াল ছায়ামূর্তি। তারপর একটা এস এম এস করল বাইরে অপেক্ষারত সঙ্গীকে। মিনিট দুয়েক পরেই বাইকের আওয়াজ উঠল রাস্তায়। আওয়াজের সুযোগে চট করে হাতের মেশিনটা চালিয়ে দরজার খানিকটা কেটে ফেলল সে, ছিটকিনিটা এরপর খোলা কোনো ব্যাপার ছিল না। এই কাজ তাদের আগেও কয়েকবার করতে হয়েছে, তাই হাতের স্পিড বেড়ে গিয়েছে এখন। নিজের মনেই একবার হাসল সে। তারপর দ্রুত পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। কী সুন্দর একটা হাত পেটের উপর আর অন্যটা বালিশের তলায় ঢুকিয়ে বৃদ্ধা খাটের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। একে মারার জন্য চুরির দরকার পড়বে না। তাই সে নিজের কালো দস্তানা ঢোকা হাত গুলো নিয়ে গিয়ে চেপে ধরল বৃদ্ধার গলা। অতর্কিতে শ্বাস আটকে আসতেই চোখ খুললেন বৃদ্ধা। ছায়ামূর্তি ব্যঙ্গের হাসি হাসল কিন্তু বৃদ্ধা দেখতে পেলেন না কারণ ছায়ামূর্তির মুখটা কালো মুখোশে ঢাকা। আরও একটু চাপ দিতে গেল ছায়ামূর্তি কিন্তু তার আগেই আচমকা বৃদ্ধা বালিশের তলা থেকে হাতটা বের করে ক্ষিপ্র গতিতে কিছু একটা করলেন। বৃদ্ধার গলা ছেড়ে বিকট আর্তনাদ করে মেঝেতে ছিটকে পড়ল ছায়ামূর্তি। তার কালো মুখোশ ভেদ করে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। এদিকে ছায়ামূর্তির চিৎকারে তখন পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন আরও দুজন। এরা বসুধা দেবীর প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী, সীমা আর কার্তিক। সীমা পুলিশকে ফোন করতে গেল আর কার্তিক এসে ছায়ামূর্তির মুখোশটা খুলে ফেলল। চমকে উঠলেন বসুধা দেবী, তাঁর হাত থেকে ছুরিটা খসে পড়ল, "অনিকেত, তুই…!"

কোনো জবাব দিতে পারল না অনিকেত, তার বাঁ চোখ দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত পড়ছে। 



   গতকাল পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গিয়েছে অনিকেতকে। বাইরে থাকা অনিমেষ আগেই চম্পট দিয়েছিল, পুলিশ তাকে খুঁজছে। আজকে সীমা আর কার্তিকের উপস্থিতিতে উইলটা করেই ফেললেন বসুধা দেবী। মনটা যদিও খুবই ভারাক্রান্ত তাঁর। এই চক্রান্তে অনিকেতের মত ছেলেও যে সামিল থাকতে পারে তা তিনি একবারের জন্যও ভাবেননি। তবে ওরা দুই ভাই ভুলে গিয়েছিল বসুধা দেবী কোনোদিনও অন্যায়ের কাছে হারও মানেননি, আর ভয়ও পাননি। কাল আবেগের বশে অনিমেষকে উইলের কথাটা বলে ফেলেই তাঁর মনে হয়েছিল ওরা এত সহজে ছাড়বে না। তাই সীমা আর কার্তিককে সবটা বলে রাতে থাকতে বলেন। সেই সঙ্গে নিজেও ছুরি নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। কার্তিক আগেই পুলিশকে জানাবে বললেও তিনি রাজি হননি কারণ পুলিশও অনেক সময় এদের হাতে থাকে, তার একদম হাতে নাতে ধরতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া বয়স্ক মহিলা মানেই যে অসহায়, দুর্বল নয় তা প্রমাণ করে দিলেন তিনি। 



#InspiringWoman


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational