রূপান্তর
রূপান্তর
রূপান্তর
সৌমি আজও সমাজের চোখে এক অদ্ভুত জীব। নারীরূপে এখনও সে স্বীকৃতি পায়নি, অথচ এখন সে আর পুরুষও নয়। এই নারী-পুরুষের দ্বন্দ্বে তাই আজও সে সঙ্কটমুক্ত হতে পারল না। মনে মনে কষ্ট পায়, অথচ সে কষ্ট সে কারো সাথে ভাগ করতে পারে না, কারো কাছে সে নিজের মনটাকে হালকা করতে পারে না। নিজেই নিজের সঙ্গে আপস করে, নিজেই নিজেকে বোঝায়, "কীই বা করতাম আমি! সারাজীবন দ্বৈত সত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম! নিজের মনের বিরুদ্ধাচারণ করতাম সারাক্ষণ!"
যত বড় হচ্ছিল সোহম বিষণ্ণতায় ছেয়ে যাচ্ছিল তার মন অথচ ছোটবেলাটা কত সুন্দর ছিল তার। ছোট থেকেই খুব ডানপিটে ছিল সে, সামলানো দায় ছিল। গাছে ওঠা, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া, কী না করত ও। ছেলেদের সঙ্গে মারপিটও করত খুব আর জিতেও যেত। কিন্তু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ল এক অস্তিত্ব সঙ্কটে। নিজেকে তার নারী ভাবতেই ভাল লাগে তখন, গলার স্বরও মেয়েলি হয়ে ওঠে ক্রমে। বড়রা ভাবেন এবয়সে অনেকেরই গলার স্বরের পরিবর্তন হয় পরে তা কেটেও যায়, তেমনই হবে হয়তো। কিন্তু না, ক্রমেই চলনেবলনে প্রকট হয় তার মেয়েলি ঢঙ। বন্ধুরা তাকে খেপায় 'বৌদি' বলে। সোহম কী করে বোঝাবে ওদের যে মনেপ্রাণে ও একজন নারী হয়ে উঠছে, দেহটাই কেবল পুরুষের। কোনো পুরুষ বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরলে তার যে ভারী তৃপ্তি হয়। তাদের কারো হাত নিজের হাতে নিলে যে ছাড়তে ইচ্ছে করে না তার, ঠিক যেমন একজন পুরুষ নারীকে ছুঁয়ে তৃপ্তি পায়, এ ঠিক তেমনই।
একদিন একা পেয়ে প্রিয়বন্ধু রাণাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল সোহম। রাণা কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিয়েছিল সোহমের গালে। গালি দিয়ে বলেছিল, "শালা হিজড়ে কোথাকার,ভাবতেও ঘেন্না হয় তুই আমার বন্ধু, থুঃ"। তারপর থেকে আর মিশতও না ওর সঙ্গে তবে একসময় প্রিয়বন্ধু ছিল বলে কাউকে সে বলেনি একথা। সেইবয়সে একদিন মায়ের লিপস্টিক ঠোঁটে ঘষায়, মারও খেয়েছিল সোহম মায়ের হাতে। মা যদিও এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবেননি কিন্তু সোহম এসব ঘটনায় ঘা খেত বড় মনে মনে।
কাউকে বলতে পারে না সোহম এই বয়ঃসন্ধিক্ষণে মেয়েদের ঋতুস্রাবের মত প্রতি মাসে তার পুরুষাঙ্গ থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তক্ষরণ হয়। এসব সযত্নে সে লুকিয়ে রাখে সবার কাছ থেকে। রাতে সে একাই শোয় আর তখন তার নারী হয়ে ওঠার প্রবণতাটা বড্ড বেড়ে যায়। চুপিচুপি মায়ের শাড়ী, সাজের জিনিস ঘরে এনে রাখে সে। তারপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ও মায়ের মত করে শাড়ী পরে, কপালে টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে, আবার কখনও মাথায় একটু ঘোমটা দিয়ে হাসি হাসি মুখে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বড্ড ভাল লাগে ওর নিজেকে তখন কিন্তু নারী-পুরুষ এই দ্বৈতসত্ত্বায় সে ক্রমে অবসাদের শিকার হয়ে ওঠে। বাইরে পুরুষ, অন্তরে নারী-এ চরম অস্তিত্ব সঙ্কটের কথা কাকে বলবে সে? তার ফুলের মত কোমল হৃদয়টা দ্বিসত্ত্বায় দ্বিধাবিভক্ত। নিজের সাথে চলে তার অহরহ যুদ্ধ, ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হয় সে রোজ, প্রতিদিন।
তবু ওকে পুরুষ সেজেই বড় হতে হয় আর অন্যদিকে রাতের আঁধারে নারী সেজে মনের তৃপ্তি খুঁজে চলতে থাকে। কখনও বা হতাশ হয়ে পড়ে, মরে যেতে ইচ্ছে করে, কেবল ছোট থেকে শুনে এসেছে 'আত্মহত্যা মহাপাপ' তাই তা থেকে বিরত রাখে নিজেকে। নারী হবার তীব্র আকাঙ্খা ওকে এক অলীক স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে ডাকে, মনে হয় বুঝি পাগল হয়ে যাবে ও। পড়াশুনোর প্রয়োজনে যে কম্পিউটার এসেছিল ওর জন্য, সেটাই হল ওর রাতের সহচর। গভীর রাতে বিভিন্ন সাইট খুলে ও দেখত পুরুষের নারী হয়ে ওঠার ভিডিও আর নারী হবার প্রবণতা ওর ততই বাড়তে থাকে।
এভাবেই চলল কয়েক বছর। ইংলিশে অনার্স নিয়ে ভাল মার্কস পেয়ে পাশ করল সোহম। এই ক'বছরে বাড়ী ছেড়ে একদিনের জন্যও অন্য কোথাও গিয়ে থাকেনি ও। বেড়াতে যাবার সময় বাবা-মা জোর করলে পড়াশুনোর অজুহাতে কোথাও যেতে রাজী হত না। পড়াশুনোয় ভাল ছিল বলে তাঁরাও জোর করতেন না। রাতটুকু যে ভীষণ দামী ওর কাছে, ও যে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় ঐ রাতেই। নারী হয়ে ওঠে তখন সবার অলক্ষ্যে, কোথাও গেলে যে তা সম্ভব নয়। এভাবে চলতে চলতে কখনও কিছু ভুল তো হতেই পারে, সোহমেরও তাই হল, মায়ের হাতে ধরা পড়ল সে একদিন। ছেলের কান্ড দেখে মা বিস্ময়ে হতবাক, তারপর কান্নাকাটি। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটি মেয়ে ছেলেদের মত আচরণ করলে তাকে 'টমবয়' বলে বাহবা দেওয়া হয় কিন্তু একটি ছেলে মেয়েদের মত আচরণ করলে সে যে জাতে নেমে যায়। তার মজবুত মেরুদণ্ডটা তখন ভাঙ্গতে থাকে সমাজের ব্যঙ্গবিদ্রূপে।
একটাই ভাল যে মনের কোনো অবস্থাতেই তার পড়াশুনার কোনো ক্ষতি হয় না, তবে মায়ের কাছে ধরা পড়ার পর এখন সে বাড়িতে অনেক খোলাখুলি হয়ে গেছে। সে জানে মায়ের কাছে বাবা সবটাই জেনেছেন আর তাই সে একদিন বাবার মুখোমুখি হয়। বয়স তার ২২ বছর, বাবা-মাকে এক জায়গায় ডেকে সে জানায়, "অনেকদিন থেকে আমি অস্তিত্বসংকটে ভুগছি, নিজে কষ্ট পাচ্ছি কিন্তু তোমরা মেনে নিতে পারবে না বলে এতদিন তোমাদের কিছু বলিনি। আমি প্রচুর খবর নিয়
ে জেনেছি আমার মত পুরুষ, যারা মানসিকতায় নারী তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী হওয়া সম্ভব। তাতে আমি এই অস্তিত্ব সংকটের হাত থেকে মুক্তি পাব, মানসিক শান্তি পাব"। বাবা-মা প্রথমে তার প্রস্তাবে রাজি হন না বরং বলেন, "এটা তোর মানসিক রোগ, চল, কোনো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাই, যিনি তোর চিকিৎসা করবেন, কাউন্সেলিং করে এই অসুস্থ মানসিকতাকে সংশোধন করবেন"। সোহম রাজী হয় না। এই নিয়ে বাড়ির পরিবেশ কিছুদিন বেশ উত্তাল হল। সোহম এখন দৃঢ় তার মানসিকতায়, সে লিঙ্গ পরিবর্তন করাবেই কিন্তু তাতে খরচও প্রচুর আর এটা একটা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ চিকিৎসা পদ্ধতি। বাবা-মায়ের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয় কারণ তার নিজস্ব কোনো রোজগার নেই।
সোহমের মানসিকতা জেনে বাবা-মা ছেলের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন। যে যার মত বাড়িতে থাকে, বাতাস সেখানে ভারী হয়ে ওঠে। সোহম দিনদিন অবসাদে ডুবতে থাকে, বাবা চিন্তিত, মায়ের নিত্য কান্নাকাটি। বাড়িতে কেউ যখন শান্তিতে নেই, সোহমের বাবা রতনবাবু তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে সব খুলে বলে পরামর্শ চান। তিনি রতনবাবুকে তাঁর এক সাইক্রিয়াটিস্ট বন্ধুর কাছে নিয়ে যান। রতনবাবুর কাছে সব শুনে সেই সাইক্রিয়াটিস্ট ভদ্রলোক তাঁকে বোঝান, "নিজের সন্তানকে যখন আপনি ভালবাসেন, তার কষ্টে কষ্ট পাচ্ছেন, তার চাইতে মেনে নেয়াই তো ভাল। বিশেষ করে আপনার যখন অর্থ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই আর সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারটাকে মান্যতা দিয়েছে"। বাবা ধীরে ধীরে মানতে শুরু করেন নিজের সন্তানের কথা ভেবে কিন্তু মাকে কিছুতেই মানানো যাচ্ছে না। সমাজ, পড়শি, আত্মীয়-স্বজন এই নিয়ে তাঁর মাথাব্যাথা কিছুতেই কমে না। সর্বোপরি তিনি ভাবেন এতদিন যাকে নিজের ছেলে ভেবেছেন তাকে হঠাৎ কিভাবে মেয়ে বলে মেনে নেবেন! রতনবাবু রোজই স্ত্রীকে বোঝাতে থাকেন, "মেনে নাও, কি করবে বল নাহলে? আমারই কী মন মানতে চাইছে, কিন্তু ছেলের মুখ চেয়ে মানতে হচ্ছে। দিনদিন ছেলেটা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে, সেটাই কী ভাল লাগছে? ভয় হয় কোনদিন না আত্মহত্যা করে বসে"। এইসব চলতে চলতে সোহমের এম.এ কমপ্লিট, সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, এই আনন্দেও মায়ের বিষণ্ণতা কাটে না।
বাবা এতদিন ধরে সব খোঁজ-খবর চালাচ্ছিলেন, ছেলেকে নিয়ে এবার চললেন তিনি ডাক্তারের কাছে। প্রথমে হবে তার সাইকোলজিকাল কাউন্সেলিং, সেটা ঝোঁকের মাথায় করতে চাইছে নাকি সত্যি সে অস্তিত্বসংকটে ভুগছে, যাতে লিঙ্গ পরিবর্তন না করাটা তার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছে! তারপর হরমোন চিকিৎসা, সবশেষে হবে অপারেশন। এই অপারেশনে তার লিঙ্গ অপসারণ করতে হবে, ভ্যাজাইনা তৈরি করতে হবে, যদিও অনেক সময় হরমোন চিকিৎসায় ব্রেস্ট ডেভেলপড হয়ে যায়, না হলে ইমপ্লান্টের মাধ্যমে তা তৈরি করা হয়। প্রথমে গিয়ে এসব জানা হল, যদিও সোহম সবই জানত অনেকদিন আগে থেকেই। শুরু হল চিকিৎসা, এই চিকিৎসায় যেমন অর্থের প্রয়োজন তেমনি কষ্টকর, তবু সোহম মেনে নিল। মাও নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে শেষে ছেলের পাশেই থাকা স্থির করলেন কারণ সোহমের তখন মানসিক সহযোগিতার বিশেষ দরকার ছিল।
দীর্ঘ চিকিৎসার পর সোহম আজ সুন্দরী সৌমি, তার সমস্ত সার্টিফিকেট, সব ডকুমেন্টসের সোহম নাম চেঞ্জ করে সৌমি করার প্রক্রিয়া চলছে। মানসিকভাবে সৌমি এখন খুশি তার অস্তিত্বসংকট অতিক্রম করায়, এখন আর তাকে লুকিয়ে মেয়ে সাজতে হয় না। সে এখন এক পরিপূর্ণ নারী, তবু কিছু কাঁটা তাকে বিঁধছে এখনও। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি তার বন্ধুরাও তার সাথে কথা বলে না আর, যেন চেনেই না এমন ভাব করে সরে যায়। মনে মনে কষ্ট পায় সৌমি, তার চেনা বৃত্ত কেমন অচেনা হয়ে গেছে তার কাছে। তবে বাবা-মা সবসময় তার পাশে থেকেছেন, মানসিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। এম.এ পাশ করার পর সে বি.এড ট্রেনিং নিতে থাকে, আর সাথে চাকরির সন্ধান। এরই মধ্যে কালিম্পং-এ এক মিশনারী স্কুল থেকে তার ডাক আসে। সৌমি সেখানে দেখা করে কয়েক মাস সময় চায় বি.এড কমপ্লিট করার জন্য। কর্তৃপক্ষ সৌমির রেজাল্ট ও পরে তার দর্শন ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাকে কয়েক মাসের সময় দেয়। নির্দিষ্ট সময়ে সৌমি স্কুলে জয়েন করে। পাহাড়ের কোলে, নৈসর্গিক শোভার মাঝে, তার চেনা গণ্ডির বাইরে বড় শান্তি পায় সৌমি এখানে এসে। ভোরের বেলা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় বরফের আস্তরণ সূর্যের আলোয় যখন রঙের খেলায় মাতে সৌমি সে অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে করতে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে তার স্কুলে।
কয়েক মাস পরে স্কুলেরই অংকের শিক্ষক নীলাদ্রির সঙ্গে তার ভালবাসা হয়। সৌমি কোনো গোপনতার আশ্রয় নেয়নি। সব শুনেও নীলাদ্রি তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়। বাবা মাকে সব জানায় সৌমি, তারা নিজেদের বাড়িতে সামাজিক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করে বিয়ের ব্যবস্থা করতে চান না, তাই কালিম্পংয়েই হল তাদের বিবাহবাসর।
আজ সৌমি ও নীলাদ্রি তাদের একটি কন্যা সন্তান নিয়ে হিমালয়ের কোলে, অরণ্যের ঘেরাটোপে, সবুজের সমারোহে, সুখের ঘরে, শান্তিতে আছে।