হালখাতা
হালখাতা
হালখাতা
আমাদের ছোটবেলার নববর্ষের সঙ্গে আজকের নববর্ষের বিস্তর ফারাক। মফস্বলে বাড়ি আমাদের। ঠাকুমার সঙ্গে সকালে গঙ্গাস্নান করে শিবের মাথায় জল দিয়ে বাড়ি আসতাম। আমার বাবা ছিলেন ব্যবসাদার, তাই নববর্ষে গণেশপুজো হতো বাড়িতে। প্রচুর মানুষের আনাগোনা হত সেদিন। এই পুজো উপলক্ষে বাবা কলকাতার বড়বাজার থেকে নানারকম ক্ষীরের মিষ্টি, শোনপাপড়ি, ভাল চানাচুর নিয়ে আসতেন। যেহেতু মফস্বলে কোনও দোকানে ঐধরণের মিষ্টি পাওয়া যেত না, তাই ঐসব মিষ্টিতে ছিল আমাদের দারুণ লোভ। কখন পুজো শেষ হবে সেই অপেক্ষায় থাকতাম। মা ওইসব মিষ্টি একটা মিটসেফে রেখে তালা দিয়ে দিতেন। আমার ছোটভাই তখন খুবই ছোট। মিটসেফের জাল সরিয়ে সরিয়ে ফাঁক তৈরি করে সেখান দিয়ে তার ছোট্ট হাত ঢুকিয়ে কখন যে চুপিসারে খানিক মিষ্টি খেয়ে ফেলেছে বাড়ির কেউ টের পায়নি। পুজোর দিনে মা মিটসেফের তালা খুলতে গিয়ে দেখতে পান। কিন্তু বকবেন কী, হেসেই খুন হলেন খানিক।
আমি আর আমার দিদি বড় বড় কাচের প্লেটে পুজোর প্রসাদ, পাঁচরকমের মিষ্টি, চানাচুর দিয়ে প্লেট সাজাতাম, আর ছোট দুইবোন সেগুলো বাইরের ঘরে যেখানে লোকজন এসে বসতেন সেখানে দিয়ে আসত। আমরা কি শুধু প্লেট গোছাতাম, টুপটাপ মিষ্টিও মুখে পুরতাম। সে বড় আনন্দের। এরপর পাড়ার ঘরে ঘরে দিয়ে আসতাম প্রসাদ, মিষ্টি। সন্ধেয় ছিল আরেক মজা। সমস্ত দোকানে সাধারণত ঐদিনই হালখাতা হত। নিমন্ত্রণ থাকতো বাবার। বাবার সঙ্গে ভাইয়েরা যেত সেইসব দোকানে হালখাতা করতে। আরো অনেক মানুষ সেখানে আসতেন। দোকানে টাকা জমা দিতেন বাবা। কোনও দোকান মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার ধরিয়ে দিত, আবার কোনও দোকান বসিয়ে লুচি, আলুরদম খাওয়াত। বাড়ি ফিরে ভাইয়েরা সেসব গল্প করত আমাদের। বড় হলে আমরা মেয়েরা বন্ধুরা মিলে নতুন ছাপাশাড়ি পরে গঙ্গার ধারে ঘুরতে যেতাম। ফুচকা, ঝালমুড়ি এইসব খেয়ে বাড়ি ফিরতাম।
এখন নববর্ষে তেমন জৌলুস নেই। এখন দোকানে দোকানে হালখাতা করতে যেতে মানুষ লজ্জা পায়। তবে কিছু দোকান এখন এলাহি কারবার করে। আলো দিয়ে দোকান সাজিয়ে, সামনে প্যান্ডেল করে, কোলড্রিংস, মিষ্টি, নানারকম, স্ন্যাক্স খাওয়ায়। আগে আমরা নববর্ষে বাড়িতে আসা বয়স্ক অতিথিদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম। এখন ফোন খুলতেই নানারকম মেসেজ আসে নববর্ষের শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে। টিভিতে চ্যানেলে চ্যানেলে আসর বসে। সেও ভালো লাগে দেখতে। এখন মানুষের আনাগোনা কম, দূর থেকে মোবাইলে বা হোয়াটসঅ্যাপে মানুষ শুভেচ্ছা বিনিময়ে অভ্যস্ত। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শে যে হৃদ্যতা, আন্তরিকতা গড়ে ওঠে তা আজ আগের মত আর নেই। বেশিটাই মেকি। তাতেই এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, মেনে নিয়েছি।