Manasi Ganguli

Others

4  

Manasi Ganguli

Others

চাঁদিপুর-অন-সি

চাঁদিপুর-অন-সি

3 mins
407



চাঁদিপুর-অন-সি


    ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে গিয়েছিলাম চাঁদিপুর বেড়াতে। ভোর ৫.৩০টায় রওনা দিলাম, পথের দৈর্ঘ্য ২৮৪ কি.মি প্রায়। রাস্তা বেশ ফাঁকা। ভাল লাগছিল গাছপালা, ঘরবাড়ী সব পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে। আমি প্রকৃতি প্রেমিক, দু'চোখ ভরে প্রকৃতির শোভা দেখছিলাম। এতদিন আগের ঘটনা তবু এত ভাল লেগেছিল যে ভালোলাগায় অন্তর ভরে আছে আজও। চোখবুজে, চোখখুলে, সে দৃশ্য আমি বারংবার দেখি।

   প্রায় ৯টা নাগাদ রাস্তার ধারে এক ধাবায় গাড়ী থামল কিছু জলযোগের জন্য। আবার শুরু হল পথচলা, ওড়িশা পড়তেই দেখলাম রাস্তাঘাট তেলঢালা। পথের দুপাশের বড় বড় গাছেরা দুপাশ থেকে এসে রাস্তার ওপর মিলেছে, আমরা যাব বলে বুঝি ছায়ার ঘেরাটোপ তৈরি করেছে তারা। স্নিগ্ধশীতল ছায়ার ভেতর দিয়ে গাড়ী চলল। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল তাই আমাদের অনেক সময় লেগেছিল। ২টো বেজে গেলে সবারই আবার খিদে, বেশ ক্লান্তিও লাগছে তখন, অতটা গাড়ীতে যাবার পর। ২.৩০ নাগাদ নামলাম একটা রেস্টুরেন্টে। খেয়েদেয়ে ওখান থেকে বেরবার সময় হঠাৎ করে বৃষ্টি এল, যদিও রোদই ছিল। তখন প্রায় চাঁদিপুরের কাছে পৌঁছে গেছি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল সমুদ্রে যেতে পারব না বলে। চাঁদিপুরে পৌঁছতেই বৃষ্টি থেমে একেবারে ঝকঝকে রোদ উঠে গেল।

    লাগেজ রেখেই ছুটলাম সমুদ্রের ধারে। হোটেলের পিছনদিকে পার্ক, তারপরই বিচ। পার্ক থেকেই দেখা যাচ্ছে সমুদ্র, আমরা এগোলাম। কিন্তু ও মা, এ তো সমুদ্র নয়, গলানো সোনার ধারা। পড়ন্ত সূর্যের সোনামাখা আলো পড়েছে সাগর জলে, তাইতেই যে সাগরের জল সোনার রঙ ধরে। ঢেউ ভাঙ্গছে আর রাশি রাশি সোনা ঝিকমিক করে উঠছে। এমন অপরূপ দৃশ্য দেখিনি কখনও আগে। সোনার স্রোত। ওই দেখে এতটাই আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে ভাবিনি আরো কত অপরূপ দৃশ্য অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। সূর্যের আলো একটু পরে নিভু নিভু হলে দূরে চোখ মেলে তাকাই আর অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখি প্রকৃতির বিচিত্র লীলা। বিশাল এক রামধনু দূরে সমুদ্রের জল ছুঁয়ে, দুদিকে তার বিস্তৃতি। অবাক হবার আরো ছিল বাকী। ঠিক তার ফুট দশেক নীচে আরেকটা অপেক্ষাকৃত একটু ছোট রামধনু (নাকি লক্ষ্মণধনু দাদাকে অনুসরণ করে)। আর বলব কী, এই দুটো রামধনুরই ছায়া পড়েছে সাগর জলে। অবাক বিস্ময় সবার চোখে। সেই দেখা, আজও চোখে লেগে আছে। তারপর আমরা একটু জলে নামি, আস্তে আস্তে জল পিছিয়ে যাচ্ছে, আমরা এগোচ্ছি। প্রায় ১কি.মি চলে গেছি, দিনের আলো আবছা হচ্ছে, তাই ফিরে আসি। একটু বসতে যাই বিচে কিন্তু ছোট ছোট লাল কাঁকড়া ভর্তি, বালির ভেতর পুক পুক করে গর্তে ঢুকছে, বেরচ্ছে। জানলাম একমাত্র ওখানকার সমুদ্র দিনে দু'বার ভাঁটার সময় ৫-৬ কি.মি পিছিয়ে যায়, আবার জোয়ারে এগোতে থাকে। ভাঁটার সময় অনেকে গাড়ী, বাইক নিয়ে অনেক ভেতরে চলে যায়। অনেকটা খুশী নিয়ে হোটেলে ফিরলাম, রাতে কিছু করার ছিল না আর সবাই খুব ক্লান্ত ছিল তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সারা হল হোটেলে খুব সুন্দর ইলিশ, চিংড়ির পদ সহযোগে। তারপর শয়নে পদ্মলাভ। পরদিন যদিও সূর্যোদয় দেখা হয়নি, তাও সমুদ্রের ধারে খানিক ঘুরলাম, মেয়ের সঙ্গে নাচলাম। মেয়ে তো দিনের আলোয় কাঁকড়ার লুকোচুরি খেলা দেখায় মত্ত। একটু বেলা বাড়লে ব্রেকফাস্ট করে, আমরা গাড়ী নিয়ে ঘুরতে বেরলাম, তখন দেখলাম রাস্তার দু'ধারে কুঁড়ে ঘর, বেশিরভাগের মাথার ওপর চাল নেই। গরীব মানুষ, কষ্ট করে ঘর ছাইবার পর ঝড় এলেই তা উড়ে যায়, সমুদ্রের ধারে ঝড়ের দাপটও খুব তীব্র হয়। খুব কষ্ট হল দেখে। এরপর দেখলাম, রাস্তার ধারে বসে ঘরের বউরা আধময়লা কাপড় পরে ইলিশের পেট চিরে নুন ভরছে। নোনা ইলিশ বানাচ্ছে, কোনো মৎস্য ব্যবসায়ীর জন্য। এদের স্বামীরা বেশিরভাগ সমুদ্রে মাছ ধরার কাজ করে, কখনো ঝড়ের কবলে পড়লে তাদের কেউ কেউ আর ঘরে ফেরে না।

    এরপর আমরা হুইলার আইল্যান্ডে যেতে চাইলাম, যার বর্তমান নাম আবদুল কালাম আইল্যান্ড যেখান থেকে অগ্নি, পৃথ্বী, আকাশ, সূর্য প্রভৃতি মিশাইল লঞ্চ হয়েছে। তখন বোধহয় শুধু অগ্নিই লঞ্চ হয়েছিল কিন্তু সেখানে যাবার ছাড়পত্র মেলেনি, সুরক্ষিত অঞ্চল। এটা মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্সের ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট রেঞ্জ(ITR)। চাঁদিপুর এমন একটা জায়গা, যার একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্যদিকে এটা এক মিশাইল লঞ্চ সাইট। এক ইউনিক কম্বিনেশন। 

    পরদিন ফেরা, তাই বিকালটা সমুদ্র সৈকতে কাটালাম প্রাণমন ভরে। পরদিন হোটেলে দারুণ সব সি-ফিসের বিভিন্ন পদ সহযোগে লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ীর উদ্দেশ্যে।

    


Rate this content
Log in