প্রথম ভয়
প্রথম ভয়
ভয় নামক জিনিসটির সাথে ছোট থেকেই আমার কোন পরিচয় ছিল না। দু বছর বয়সে মা যখন আমায় মামারবাড়ি রেখে দিদি ও বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন মামা মাসিরা দামাল আমাকে সামলাতে অন্ধকার ঘর দেখিয়ে বলতো, 'রাক্ষসী আছে', যাতে ভয় পেয়ে আমি শান্ত থাকি। তা আমি তাদের কোল থেকে ঝুঁকে পড়ে বলতাম 'আমি নাক্কুসী দেখব'। এই হল আমার ভয়ের নমুনা সেই ছোট্ট থেকে।
কিন্তু ভয় যে কত রকমের হয় বা কত কারণে হয় বা কার যে কিসে ভয় হয় তার হদিস মেলা ভার। ভীতু না হলেও ভয় একবার ভীষণভাবে পেয়েছিলাম আমিও, আর সেই গল্পই বলব। মামার বাড়ি থেকে তার বছর খানেক বাদে আমাকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। শুরু হলো লেখাপড়া, স্কুল। বাবার খুব প্রিয় ছিলাম কিন্তু পেতাম না বিশেষ কাছে। মা ব্যস্ত থাকতেন ছোটটিকে নিয়ে তাই আমরা সব ঠাকুমাকেই আঁকড়ে থাকতাম, আর তিনিও আমাদের নিয়ে মহাসুখে থাকতেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১বছর ৪ মাসের আমার বাবাকে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন তাই আমরাই ছিলাম তাঁর জগত। আমরাই তাঁর প্রাণ। তা আমরা বাবা মায়ের খোঁজ যত না করতাম ঠাকুমাকে একটুসময় দেখতে না পেলেই অস্থির হয়ে যেতাম। বাবা-মা সিনেমা গেলে কী কোথাও গেলে আমাদের কোনো তাপ উত্তাপ ছিল না কিন্তু ঠাকুমার আমাদের কাউকে বাদ দিয়ে কোত্থাও যাবার উপায় ছিল না। আর উনি যেতেনও না।
একবার পাড়ায় মাটির রাস্তা ভেঙ্গে শোনা গেল পিচ রাস্তা হবে, তাই খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, খোয়া ফেলে দুরমুশ করা হচ্ছে। অবাক হয়ে দেখতাম কেমন খোয়া গুলো গুঁড়িয়ে পেস্ট হয়ে রাস্তার সাথে মিশে প্লেন হয়ে যাচ্ছে। বয়স তখন বছর আটেক এর মধ্যে ঠাকুমার শরীরটা একটু খারাপ হলো একদিন, আমাদের সব খুব মন খারাপ, ঠাকুমাকে আমরা শুয়ে-বসে বিশেষ থাকতে দেখিনি সারা জীবন, সে মানুষটা বিছানায় শুয়ে থাকলে কেমন লাগে! আমি আর দিদি ছোট ছোট কুঁচোকুঁচো হাতে ঠাকুমার মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে একটু আরাম দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম, ঠাকুমা অতিকষ্টে চোখ খুলে তাকালেন, মৃদু হাসলেন। বেলায় বাড়ির ডাক্তার এসে দেখে গেলেন, ওষুধ দিয়ে গেলেন। ঠাকুমার দুপাশে তখন আমি আর দিদি শুতাম, সেদিনও রাতে তাই শুয়ে ছিলাম। রাতে হঠাৎ ভীষণ ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ, আড়ষ্ঠ হয়ে গেছি। প্রথমে তো ভয়ে নড়তেও পারছি না, স্বপ্ন না সত্যি বুঝতেই পারছি না। তারপর অন্ধকার ঘরে উঠে বসেছি বিছানায়, বুকের ভেতর কান্না আছড়ে পড়ছে তখন। স্বপ্নে দেখলাম "কিছু দুষ্টু লোক ঠাকুমাকে রাস্তায় ফেলে দুরমুশ করছে আর ঠাকুমার দেহটা রাস্তায় পেস্ট হয়ে মিশে গেছে, মাথাটা কেবল আস্ত রয়েছে, ব্যথাতুর চোখ দুটো তাকিয়ে রয়েছে আর মাথার চুলগুলো আলুথালু হয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে আছে"। অসুস্থ ঠাকুমা ঘুমের মধ্যেই টের পেয়েছেন আমি উঠে বসেছি। উনিও তখন উঠে বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালিয়ে আমায় জল খাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ঠাকুমাকে জীবন্ত দেখে ধড়ে প্রাণ এলো যেন।
এ কথা জানত কেবল আমার দিদি, দুই পিঠোপিঠি বোনে বড় ভাব ছিল, সব কথা ওকে বলতে না পারলে শান্তি হত না। সকালবেলা ওকে ঘুম থেকে উঠেই বলেছিলাম আর দুই বোনে মিলে খুব কেঁদেছিলাম। এ ভয় আসলে প্রিয় মানুষের অসুস্থতার উদ্বেগ থেকে এসেছে। এ ভয় প্রিয়জনকে হারাবার ভয়, যাঁকে পারলে আমি আজও হারাতাম না, ধরে রাখতাম। সেই প্রথম ভয়ের স্মৃতি আমায় এখনো কষ্ট দেয়, চোখের সামনে ভাসে, আমি মনে করতে না চাইলেও কখনো কখনো চলে আসে মনের মাঝে। একথা আর কেউ জানতো না দিদি ছাড়া, যে আজ আর ইহলোকে নেই আর আজ এই শ্রমণে জানবে সবাই যারা এ লেখা পড়বে তারা কেবল।