Manasi Ganguli

Others

4  

Manasi Ganguli

Others

অন্য পুজো

অন্য পুজো

7 mins
244


অন্য পুজো

   বর্ষার মেঘ ভরা কালো আকাশ যখন শরতের রোদে হেসে ওঠে পেঁজা তুলোর মত মেঘের ফাঁক দিয়ে, আপন-মনে কাশফুল মাথা দোলায়, ভোরের শিশির ভেজা শিউলি ইতস্তত ছড়িয়ে যায় মাটির পরে, চারিদিক তখন পুজো পুজো গন্ধে ম ম করে। বাংলার আকাশে বাতাসে শুরু হয় জোরদার তোড়জোড়। যদিও তোড়জোড় শুরু হয় পুজোর পর থেকেই পরের পুজোর লক্ষ্য নিয়ে। এ যে আমাদের বাঙ্গালীদের প্রধান উৎসব, শুধু মা দুর্গার পুজো নয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আমরা শোক-দুঃখ ভুলে আনন্দে মাতি, কত মানুষের সঙ্গে মিলিত হই। খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটা, কত উৎসাহ, কত খরচ। আবার এই খরচের হাত ধরে কত মানুষের আয়ের সংস্থান হয়। পুজোকে কেন্দ্র করে বহু ব্যবসা হয় ছোট বড়। কত বেকার মানুষ কিছুদিনের জন্য হলেও কিছু আয়ের মুখ দেখে। কুমোরপাড়ায় ঠাকুর গড়া, প্যান্ডেল তৈরি, ইলেক্ট্রিকের কাজ, দোকানে লাগে বাড়তি সেলসম্যান। বিউটি পার্লারে এই পুজোকে কেন্দ্র করে বাড়তি মেয়েদের লাগে কাজে। এছাড়া যানবাহন, অটো, টোটো, রিক্সা ট্যাক্সি এরাও কিছু বাড়তি রোজগার করে এই উৎসবের মরশুমে। পুজোর দিনগুলোতে রাস্তার দু'ধারে নানারকম খাবারের স্টল বসে। যারা সারাবছর করে না, এসময় কিছু বাড়তি কামিয়ে নেয়। এছাড়া ফুচকা, ঝালমুড়ি, চাটের নতুন দোকানও বসে যায়, ডাকাডাকি করে, একজনের কাছে খেলে অন্যদের মনখারাপ হবে ভেবে আমার মত কিছু মানুষ পাশাপাশি সবার দোকানেই কিছু খাবার খেয়ে তাদের মুখে একটু হলেও হাসি ফোটাতে চেষ্টা করে। আর আছে ঢাকিরা, তাদের কথাই একটু বিশদে বলব এবার।

ছোট থেকে দেখেছি পাড়ার পুজোয় তিনজন বিভিন্ন বয়সী ঢাকির সঙ্গে একজন ছোট ছেলে থাকত যে কাঁসর বাজাত। এরা একই পরিবারের বাবা, ছেলে, নাতি, পুতি, বর্ধমানের অনেক ভিতরে কোনও গ্রামে থাকত, আমরা যাকে বলি অজ পাড়া-গাঁ। ছোট ছেলেটি প্রায় আমার মতন হওয়ায় আমি তার সঙ্গে বেশ ভাব করে নিয়েছিলাম। ওর কাছ থেকে কাঁসরটা নিয়ে একটু বাজাবার চেষ্টা করতাম কিন্তু ওর মত ওই "ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন" বোল তখন কাঁসরে তুলতে পারতাম না। আবার ওর বাবা ও দাদুর কাছে ঢাকের কাঠি চেয়ে একটু বাজাবার চেষ্টা করতাম কিন্তু বাজত না, ঢ্যাবঢ্যাব করে একটা বিশ্রী আওয়াজ হতো, ওরা হাসত। ঢাকের তালে তালে পা ফেলে ওরা নাচত যখন কী যে ভাল লাগত। পুজোর মূল আনন্দই ছিল ঢাক। ঢাকে কাঠি পড়লেই ভেতরটা গুরগুর করে উঠত। ঢাকের সঙ্গে ছোট ছেলেটির কাঁসরটা সঙ্গত করত খুব সুন্দর। বাজনা থামলেও তার রেশ থেকে যেত অনেকক্ষণ। পাড়ায় পাড়ায় দুর্গাপুজো। এপাড়ার ঢাক থামলেও দূর থেকে ভেসে আসত ঢাকের আওয়াজ। এই আওয়াজে সুন্দর পুজো পুজো গন্ধ।

ছোট ছেলেটি তো আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। ওর কাছে ওদের গ্রামের গল্প শুনতাম। আবার একটু বড় হবার পর খুব ওদের কথা জানতে ইচ্ছা করত আর সেটার সুযোগ হতো নবমীর দুপুরে ওরা যখন আমাদের বাড়ি ভাত খেতে আসত। সাধারণত পঞ্চমীর সন্ধ্যায় ঢাকিরা আসত আর এসেই ঢাক বাজিয়ে পাড়া মাত করে দিত। আর আমরা ছোটরা সব বাড়ি থেকে মণ্ডপে ছুট লাগাতাম, এমনকি বড়রাও অনেকে। আর ওরা তখন দ্বিগুণ উৎসাহে বাজনা বাজাত আর আমাদের বুকের ভেতরও গুরগুর করে ঢ্যাংকুরাকুর বাজতে শুরু করে দিত। সে কী আনন্দ, কী উত্তেজনা। ইচ্ছে হয় সেই নির্ভেজাল আনন্দের দিনগুলো আবার ফিরে পেতে। এরপর ক্লাবের বড়রা ওদের সঙ্গে নিয়ে ঠাকুর আনতে যেত। মুখে কাগজ চাপা দিয়ে ঠাকুর এলে আর এক চোট জোরদার বাজনা। এ বাজনা যে দুর্গাপুজোকে, বাঙালির প্রধান উৎসবকে সঙ্গত করে, তাই ঢাক ছাড়া দুর্গাপুজো হয় না, হতে পারে না, মানায় না। আবার ষষ্ঠীর ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙত ঢাকের বোলে, "এ বোলে সত্যিই ছন্দপতন নেই"। কিছু সময় পরপরই ঢাকে কাঠি পড়ত আর সেসময় তো আমরা সর্বদা মন্ডপেই থাকতাম কেবল খাবার সময়টুকু ছাড়া। আরতির সময় যখন ওরা ঢাক বাজাত মনে হত যেন ভক্তিভাবে সমাহিত। তার মধ্যেই তালে তালে নাচের ছন্দে থাকত ঠিক। হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম। আর জম্পেস নাচ হতো নবমীর রাতে, পাগল করা। তখন সমাজ অনেক গোঁড়া ছিল, মেয়েদের বাইরে নাচার চল ছিল না, ছোট হলেও না, তবে বুকের ভেতরটা নাচত সেই ছন্দে। ছেলেরা ঢাকীদের সঙ্গে নাচত। রাত এগারোটা, বারোটা বেজে যেত, আমরা খেতেও যেতাম না এমন সকলকে মোহাবিষ্ট করে ফেলত এই ঢাকিরা, যাদের প্রতিদিনের জীবনে পেটভরা খাবার জোটে না। বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছি, জেনেছি ওদের কাছে, গ্রামের ভাগচাষী ওরা, প্রতিদিন কাজও পায় না, সারাবছর তাকিয়ে থাকে এই পুজোকে পাখির চোখ করে, কিছু বাড়তি রোজগারের আশায়। এই পুজোতে একটু ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া, কিছু শহরের মানুষের বাতিল কাপড়-চোপড়, কিছু মিষ্টান্ন এই ওদের ক'দিনের পুঁজি নিয়ে হাসিমুখে রওনা দিত ওরা। ভাবতাম এত যাদের অভাব তারা এত খুশি থাকে কী করে, এত হাসি ওদের মুখে কে জোগায়? ওদের কাছেই শুনেছি, যেখানে ওরা থাকে সেখানে সবাই গরীব, বাড়ির বউরা যে লোকের বাড়ি কাজ করে দু'পয়সা আনবে তারও সুযোগ নেই। সাকুল্যে দু'একটা ঘর আছে যারা কাজের লোক রাখে। আর তাই ওদের দিন গুজরান হয় আধপেটা খেয়ে। তবু ঢাকে কাঠি দিয়ে এরা যখন নাচে, এক অপূর্ব ছবি দেখতে পাওয়া যায় ওদের মুখে। আর শুধু নাচে না, সকলকে নাচায়। "ঢাকের তালে, কোমর দোলে, খুশিতে নাচে মন", কিন্তু যারা ঢাক বাজিয়ে আমাদের মন খুশিতে নাচায় তাদের মন কতটা খুশিতে নাচে তার খবর আমরা জানি না। পুজো আসার আগে থেকেই তারা পুরনো ঢাক নামিয়ে মেরামতির কাজ শুরু করে যাতে ঢাকের তালে আমরা নেচে উঠতে পারি। এই ঢাকের বোলেই তো মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তিতে প্রাণ সঞ্চার হয়। অথচ একটা ঢাক সারাই করাবার মত সামর্থ্যও এদের সবার থাকে না। কেউ আবার অন্যের ঢাক ভাড়া করে পুজোয় বাজাতে আসে, ফিরলে রোজগারের অর্ধেক তাকে দিয়েও দিতে হয়। ঢাকের তালে শহরের মানুষের মন ভরলেও মা দুগ্গার একটু দৃষ্টি পড়ে না তাদের দিকে, তাই ঢাকিরা সকলকে খুশি করে করেও যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। বলতে গেলে বিলুপ্তপ্রায় এই পেশাটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। ঢাক কিন্তু ঢাকিদের প্রাণ। ঢাক বাজাতে ঢাকিরাও ভালোবাসে এতে ওরা প্রাণের ছন্দ খুঁজে পায়। আজকাল বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্রে নতুনত্ব আনতে ঢাকিদের কদর কিছু কিছু জায়গায় কমেছে।

পুজোর দিনে উমা যেমন আসেন বাপের ঘরে, তেমনি সবাই চায় নিজের মানুষের সঙ্গে একত্রে কাটাতে, একসঙ্গে পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে। আর এরা আসে দুটো বাড়তি আয়ের আশায় স্বজন-বান্ধব ছেড়ে, নিজেদের ঘর ছেড়ে। ছোট ছেলেটিও পুজোর দিনে মায়ের কোল ছেড়ে আসে আমাদের আনন্দ দিতে। পেট বড় বালাই।

পুজোয় বিভিন্ন বাড়িতে তখন ওদের খাবার ব্যবস্থা হত, একেকবেলা একেকজনের বাড়ি। আমাদের বাড়ি নবমীর দুপুরে ওরা খেত। আমার ঠাকুমা মানুষজনকে খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন আর গরিব মানুষদের জন্য ছিল তাঁর অসীম দয়া। নিজে হাতে পরিবেশন করে ওদের খাওয়াতেন পঞ্চব্যঞ্জনে, দই-মিষ্টান্ন সহযোগে। ওদের মুখের হাসি আমাদের সকলকে বিশেষ করে ঠাকুমাকে খুব তৃপ্তি দিত। একবার আমরা তখন একটু বড়, তখন মাটিতে আসন পেতে কাঁসার থালায় খাবার চল ছিল বাড়িতে। আমাদের ঘরে খেতে দেওয়া হয়েছে আর ওদের দালানে। দালান থেকে দরজা দিয়ে ঘরে আমরা খাচ্ছি দেখা যাচ্ছে। এবার ওরা একবার ভাত নেবার পর আর নিতে চাইছে না। ঠাকুমা অভিজ্ঞ মানুষ, ঠিক বুঝতে পেরেছেন। বললেন, "ওরে, ছেলেমেয়েদের পাতের দিকে তাকাস না, ওরা খায় না। তোরা তৃপ্তি করে খা। আমি একহাঁড়ি ভাত রান্না করেছি যে তোদের জন্য, খেতে হবে তো।" ওরা লজ্জা পেয়ে মাথা নেড়ে, "না মা,না মা" করতে করতে শেষে মাপ মতই খেল। ঠাকুমাও খুশি তাতে। খাবার পর ওরা জানাল, "আপনার বাড়িতে বড় তৃপ্তি করে খাই মা, আর সবথেকে বড় পাওনা আপনি নিজে হাতে যত্ন করে আমাদের খাওয়ান।"

সেই ঢাকিরা বংশপরম্পরায় আজও এসে চলেছে, সেই ছোট ছেলেটি আজ আমারই মত বুড়ো হয়েছে। সেই এখন তার দাদুর জায়গায়, ছেলে, নাতি নিয়ে আসে। পুজোর সময় দেখা হলে আবদার করে, "সামনে নাতনির বিয়ে", কখনওবা বলে, "পুতির অন্নপ্রাশন", ওরা জানে বঞ্চিত হবে না। আমরা হাসিমুখে নিজেদের সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করি। এছাড়াও পুরনো শাড়ি জামাকাপড় দিই ওদের। ছোটবেলায় জিজ্ঞেস করতাম, "সব তো তোমাদের গায়ে হবে না, তাহলে কী করবে?" ওরা বলত, "গ্রামের সবাই গরিব, আমাদের বায়েন পাড়ায় যার গায়ে যেটা হবে তাকে সেটা দিয়ে দেওয়া হবে। আবার অন্যেরা যা নিয়ে আসবে আমাদের গায়ে হলে আমাদের দেবে। এভাবেই মিলেমিশে আমরা অভাবের মোকাবিলা করি হাতে হাত ধরে।" হিংসা-বিদ্বেষ দূরে রেখে আমাদের শহুরে মানুষদের এ ব্যাপারে ওদের কাছে শিক্ষা নেওয়া চলে।

পণ্ডিতরা বলেন সংস্কৃত 'ঢক্কা' থেকে ঢাক শব্দটি এসেছে। আগে যুদ্ধে ঢাকের ব্যবহার ছিল সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে। কলকাতা ঢাকুরিয়াতে নাকি ঢাক তৈরীর কেন্দ্র ছিল। গ্রামীণ জীবনে ঢাক ও ঢাকি বহুকাল থেকে একাত্ম হয়ে গেছে। বিশেষ করে দুর্গাপুজো এলেই এদের ডাক পড়ে, বায়না হয়। ঢাকিদের জীবন কিন্তু পড়ে থাকে সেই অন্ধকারে। পুজোয় আসার জন্য শুরু হয় তালিম একমাস আগে থেকে। যন্ত্র ঠিক করা, সারাদিন দিনমজুরি বা জমিতে চাষের কাজ করেও এই তালিমে তাদের ফাঁক পড়ে না কিছু বাড়তি উপার্জনের আশায়। দুঃখের বিষয় পুজোয় এত খরচ করে বারোয়ারীগুলো, বাড়ে না ঢাকিদের পারিশ্রমিক।

তবে বর্তমানে হয়তো ওদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে ওদের পরিবার পিছু কিছু ভাতার ব্যবস্থা হয়েছে। পুজো ছাড়াও বিভিন্ন মেলা উদ্বোধনে ওদের ডাক পড়ে আজকাল। তাই পুজো থেকে জগদ্ধাত্রী পুজো কেবল নয়, মাঝেমধ্যেই ওরা ডাক পায় বিভিন্ন অঞ্চলে। তাছাড়া এখন এরা ঢাকের সঙ্গে তাশাও বাজায় আর নিজেরা ব্যান্ড তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিয়েতে বরাত পায়, তবু কিছু বাড়তি উপার্জনের মুখ দেখে আজ কিছুটা হলেও ওরা সুখে আছে, ভালো আছে।


Rate this content
Log in