STORYMIRROR

Manasi Ganguli

Tragedy Others

3  

Manasi Ganguli

Tragedy Others

নুড়িপাথরের ভাত

নুড়িপাথরের ভাত

3 mins
247


মায়ের অনেক জ্বালা। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে কত কি-ই করতে হয় যা করার জন্য তিনি আদৌ প্রস্তুত নন। আদ্যন্ত সৎ হয়েও কখনও-বা করতে হয় মিথ্যাচার। এমনই এক মা হল এই নুপুর। পিঠোপিঠি তিন সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় গ্রাম ছেড়ে তপন পা রাখল শহরে, পরে সেখান থেকে বিদেশের মাটিতে। গ্রামে রইল তার যুবতী স্ত্রী ও তিনটি শিশুকন্যা। প্রতিমাসে তপনের পাঠানো টাকায় বেশ ভালই চলছিল নুপুরের, পোশাকে-আশাকে চেহারায় চাকচিক্য দেখলেই তা বোঝা যেত। বড়টাকে গ্রামের স্কুলে দিয়েছে কেবল, বাকিদুটো তো নেহাতই শিশু। বাচ্চারা বাবার কথা জানতে চায়, বায়না করে বাবার জন্য। তাদের শান্ত করা দায় হয়ে দাঁড়ায় নুপুরের। তবু চলছিল ভালই খেয়েপরে। এমন সময় বিদেশে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে হাজারে-হাজারে মানুষ মারা যেতে লাগল। একদিন জানা গেল তপনও করোনার বলি হয়েছে।


গ্রামের লোক শুনল নুপুরের বুকফাটা আর্তনাদ। সান্ত্বনা দিতে এল তারা। কিন্তু শুকনো কথায় তো চিঁড়ে ভেজে না, ক'দিন পরেই তপনের পাঠানো টাকা শেষ হয়ে গেল। কিছু টাকা জমিয়েছিল নুপুর অনেক আশা করে। আর কিছু জমাতে পারলেই একটা আলমারি কিনবে সে, তার পাল্লাজুড়ে লাগানো থাকবে একটা বড় আয়না,সেজেগুজে সেই আয়নায় নিজেকে দেখবে সে। এ তার অনেকদিনের স্বপ্ন। সে টাকাও শেষ। স্বপ্ন ভেঙ্গে পেটপুজো হয়ে গেছ। ক'দিন নিজে আধপেটা খেয়ে, না খেয়ে কোনোরকমে তিন শিশুকন্যার জন্য খাবার মজুত রাখছিল সে কিন্তু সে আর ক'দিন? নিজেরও যে দেহ চলে না, স্বামীর জন্য শোক করবে কি? সে তো দূর অস্ত। নেই কোনো সঞ্চয়। ভাবে বাচ্চাগুলোকে বিষ খাইয়ে নিজেও বিষ খেয়ে মরবে,কিন্তু বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ভরে ওঠে জলে। পড়শীদের পরামর্শে লোকের বাড়ি কাজ নেয় সে যা স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি। গ্রামেগঞ্জে অল্পশিক্ষিত মহিলা নুপুরের দ্বারা অন্য কোনো কাজও আর সম্ভব ছিল না। কাজের বাড়ি থেকে পাওয়া জলখাবারটুকু তিন সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে নিজে জল খেয়ে থাকছিল। ফলে ক'দিন পর কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড

়ে সে। তারা জিজ্ঞেস করলে সে কেঁদে ফেলে। দয়াপরবশ হয়ে তারা তাকে পেট ভরে খাওয়ায়, বাচ্চাদের জন্যও কিছু খাবার দিয়ে দেয় আর মাইনের টাকার কিছুটা আগাম দিয়ে দেয় যা দিয়ে সে কটা দিন অন্তত চালিয়ে নিতে পারে। এরপর আরো দুটো বাড়ি এক এক করে কাজ নিলে সে বাচ্চাদের দুটো খেতে দিয়ে নিজেও খেতে পায়। গ্রামেগঞ্জে কাজের মানুষকে সবাই দুটো খেতে দেয়, তাই তার একবেলা রান্না করলেও চলে যায়।


ক্রমে করোনা থাবা বসালো এদেশেও। ঘোষিত হল লকডাউন। সব কাজের বাড়ি থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। জলখাবারটুকু বন্ধ হয়ে গেল। মাস গেল, দু'মাস গেল মাইনের টাকা পুরো পেলেও তাতে মাস চলে না। তিনমাস পার হলে কাজও গেল, কদ্দিন আর মানুষ বসিয়ে বসিয়ে পয়সা গুনবে?এদিকে বাচ্চারা খিদেয় কাঁদতে থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার নামগন্ধ নেই। পেট চলে কি করে? আগান বাগান ঘুরে শাকপাতা এনে সেদ্ধ করে খাওয়ায় তাদের। তাতে কি হয়? কি করে ভোলাবে বাচ্চাদের? মনে পড়ে ছোটবেলার কথা, মিছিমিছি রান্নাবাটি খেলার কথা। সবটাই তখন ছিল মিছিমিছি, খাওয়াটাও মিছিমিছি। এও কিছুটা সেইরকম, কিন্তু খাওয়াটা তো মিছিমিছি সম্ভব নয়! তবু সেই পথই অনুসরণ করে নুপুর। তবে কিছুটা ফারাক রয়েছে। এখানে খেলার আনন্দ নয়, বরং খিদেয় কাঁদতে থাকা সন্তানদের ভোলাতে মিছিমিছি রান্নাবান্নার আয়োজন মায়ের। উপকরণ বলতে নুড়িপাথর, সেগুলিই হাঁড়িতে চাপিয়ে চোখের জল সংবরণ করে ফোটাতে থাকে মা। উনুনে কাঠকুটো গুঁজে দেয়, সন্তানরা যেন ভাবে খাবার তৈরি হচ্ছে, মিলবে অল্পক্ষনেই। ভাবতে ভাবতে পেটে খিদে মনে আশা নিয়ে উনুন ঘিরে বসে থাকে তারা। মায়ের ভাঁওতাবাজি কাজ দেয় সাময়িকভাবে। মিছিমিছি রান্নায় পেট ভরে না, তবু ক্লান্ত অবসন্ন দেহে অনেক আশা বুকে নিয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে তারা উনুনের আশপাশে।

এই ঘটনা প্রতিবেশীদের নজরে পড়লে কিছু সাহায্যের হাত এগিয়ে আসে। কথাটা ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য আসতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে। ঘোর কাটে না মায়ের। সরল মনে প্রশ্ন করে, "মানুষ এখনও এত ভালবাসতে পারে?"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy