ওলটপালট
ওলটপালট


তিতাসদের দেশের বাড়ি গ্রামে হলেও সেখানে ওদের যাওয়া-আসার চল একেবারেই নেই। ওই বছরে একবার বড়জোর। তাও তিতাস একা এর আগে কখনোই আসেনি। মা বাবার সঙ্গে এসব জায়গায় আসার সুবিধে হলো আধচেনা লোকজনের সঙ্গে ডাইরেক্টলি কথা বলতে হয় না। মা বলল, "প্রণাম কর", ও-ও কোমর নিচু করে প্রণামের এক্সারসাইজ সেরে নিলো, রোজই দিনে তিনচারবার করে এরকম চলতে থাকে। তবে ওইটুকুই। কাকে প্রণাম করলো, তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করে না তিতাস। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দুতিনটে দিন পার করে বাবা মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যায়।
এবারের ব্যাপারটা একটু আলাদা। বাবার জেঠিমা মারা গেছেন ক'দিন আগে, আজ নিয়মভঙ্গ ছিল। মায়ের হাতে প্রচণ্ড ব্যথা, ডাক্তার সন্দেহ করছেন স্পণ্ডিলাইটিস। বাবার অফিসের একটা নতুন ব্রাঞ্চ খুলছে গুয়াহাটিতে, তাই বাবার এখন দম নেওয়ারও উপায় নেই, ছুটি তো দূরস্থান। তাই জেঠিমার, মানে বড়ঠাকুমার কাজে তিতাসকেই একা আসতে হয়েছে। রাগের মাথায় যদিও তিতাসের মনে হচ্ছিলো বাবা ইচ্ছে করে ছুটি নিলো না, তিতাসকে জব্দ করবে বলে। বাবার মা যদি মারা যেতেন, তবে কি বাবা ছুটি পেতো না? এই জেঠিমার নিজের ছেলেপুলে ছিল না, বাবাকে নাকি উনিই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, বাবা বারবার বলে। তা, তাঁর কাজে কি একবার বাবা আসতে পারতো না? স্রেফ তিতাসকে একা এই গাঁইয়া অ্যাম্বিয়েন্সে এম্ব্যারাসড ফিল করানোর ছুতো এগুলো!
আজ সকালেই একপ্রস্থ অস্বস্তিতে পড়েছিল তিতাস। এবাড়ির বাথরুমটা উঠোন পেরিয়ে, আর চান করতে যাওয়ার সময় কাচা জামাকাপড় বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার চল এবাড়িতে নেই। গ্রাম অঞ্চলে নাকি এটাই নিয়ম। সবাই চান করে ভিজে গামছা গায়ে তুরতুর করে দৌড়ে ঘরে এসে কাচা কাপড় পরে। মা সঙ্গে এলে তিতাসের কাচা জামা নিয়ে বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, তিতাসকে আর গামছা গায়ে দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। কিন্তু আজ তিতাসকে ভিজে নাইটি পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে একবাড়ি লোকের সামনে দিয়ে হেঁটে এসে ঘরে ঢুকতে হয়েছে। ও আজ ঠিক করে ফেলেছে, যাই হয়ে যাক, আজ বিকেলেই ও বাড়ি ফিরে যাবে। এরপর মা সঙ্গে না এলে এবাড়িতে ও পা-ই রাখবে না। এরকম প্রিমিটিভ নিয়মকানুন মেনে মানুষ থাকতে পারে? অশিক্ষিত লোকজন সব, একশো বছর আগের প্র্যাকটিস এখনও চালিয়ে যাচ্ছে!
"এটা কার বোনা গো মাইমা?" রিঙ্কি হাতে করে একটা নীল আসন এনে কাকিমাকে জিজ্ঞেস করল। আসনের কাজটা তিতাসেরও বেশ ভালো লাগল। একটা পেখম মেলা ময়ূর, নীলের ওপর সাদা উল দিয়ে বোনা। চোখ জুড়িয়ে যায় দেখে।
"ও মা এটা কোত্থেকে পেলি? এটা তো জেঠিমার বোনা।" কাকিমার সব খুঁটিনাটি মনে থাকে বেশ।
পিসিমণি এসে হাসতে হাসতে বলল,
"আরে এটা আমাদের প্রথম জামাইষষ্ঠীতে করেছিল না? তোমাদের জামাই প্রথমে বুঝতেই পারেনি হাতে বোনা। তারপর শুনে সে কী লাফালাফি! তখন ও তো সায়েবদের সঙ্গে কাজ করতো, বলে কিনা এসব কাজ হাজার হাজার টাকায় সায়েবরা লুফে নেবে। মনে আছে ছোটবউদি?"
পিসিমণি আর কাকিমা মেতে যাচ্ছিল পুরনো দিনের গল্পে, তিতাস আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
"এরকম কাজ আরও আছে বড়ঠাকুমার?"
"আরও বলছিস কী রে? গোটা গাঁয়ের সবকটা বাড়িতে জেঠিমার হাতের কাজ ছড়িয়ে রয়েছে। গাঁয়ের ছেলেপুলে তো জেঠিমার হাতের কাঁথা গায়ে দিয়েই বড় হয় সব। তুইও তো গায়ে দিয়েছিস। সেই যে রে, "ভোর হলো দোর খোলো" লেখা কাঁথাটা, পাখি উড়ে যাচ্ছে, একপাশে সূর্য উঠছে..."
"ওটা বড়ঠাকুমার করা, না?" তিতাসের মনে পড়ল, ছোটবেলায় মা ওই কাঁথাটা দেখিয়ে ছড়াটা পড়ে শোনাতো।
"হ্যাঁ রে। মা জেঠিমা এদের হাতে জাদুই আলাদা। মা একসময় কী অসাধারণ আল্পনা দিতো! এখন চোখের এই দশাতেও আমাদের চেয়ে অনেক নিখুঁত করে করতে পারে।"
"আর গয়না বড়ি! মায়ের মতো করে আমরা কেউ কোনওদিন পারলাম বলো ঠাকুরঝি? দাঁড়া তিতাস, এবার মা নিজে হাতে করেছে, তোদের জন্য তুলে রেখেছে এক কৌটো। জেঠিমা খুব করে খেতে চেয়েছিল, তাই মা নিজেই হাত লাগালো। বুড়ি বুঝেছিল বোধহয়, এখানের পাট চুকলো! নইলে ওরম ছোটছেলের মতো কান্না জোড়ে বড়ি খাবে বলে!"
কাকিমা ভাঁড়ারঘর থেকে একটা বড় কৌটো নিয়ে এসে খুলে ধরলো তিতাসের সামনে। একটা একটা করে বড়ি বের করে দেখছিল তিতাস। সত্যিই, গয়নাই বটে! লেটেস্ট ট্রেণ্ডের স্লিম অ্যাণ্ড স্লিক জুয়েলারির মতো ডিজাইন সব। কী নিখুঁত ডিটেইলিং! তিরাশি বছরের এক মহিলার হাতের কাজ এগুলো!
আজ সকালে চান করে বেরিয়ে রাগের মাথায় যেসব ভাবনাগুলো তিতাসের মনে খেলে যাচ্ছিল, সেগুলোর জন্য একটু লজ্জা লজ্জা করতে লাগলো এবার। সত্যি, প্রিমিটিভ আর অশিক্ষিতের ডেফিনিশন সময়ে সময়ে কেমন বদলে যায়, না?
বড়িগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তিতাস আস্তে আস্তে বলে উঠলো,
"কাকিমা, কাল সকালে কি ঠাকুমা এরকম বড়ি আবার তৈরি করতে পারবে? মানে, আমি যদি একটু শেখার চেষ্টা করি ঠাকুমার কাছে?"
(সমাপ্ত)