সিনেমার মতো
সিনেমার মতো
'করবী-ভিলা'র সামনেটায় এলেই বিতানের কেমন একটা অদ্ভুত লাগে! জংধরা গেটের গায়ে প্যাঁচানো শেকল আর তালাটা দেখে মনে হয় এগুলো এখানে বেমানান। বাড়িটা এখনও অতটা অতীত হয়ে যায়নি। গেটটা বেশ খোলা থাকবে, গেটের পাশে একজন চওড়া-গোঁফ রাশভারী দারোয়ান বসে থাকবে, বিতানের মতো উটকো লোক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখলেই সে হাঁক পাড়বে, "কৌন হ্যায় রে? কাম ধান্ধা কুছ হ্যায় নাহী ক্যা!" ব্যস, অমনি বাড়িটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।
বিতান যদিও মোটেই উটকো লোক নয়, রীতিমতো এস এস সির যুদ্ধে জিতে এখানকার সরকারি বয়েজ ইস্কুলে বাংলার বি ডি স্যার হয়ে এসেছে। তবে চিরকালই বিতান নিজেকে নগণ্য তুচ্ছ প্রায় অদৃশ্য এক মানুষ ভাবতে ভালবাসে। বাংলা অনার্সে ভর্তি হয়ে যখন দেখেছিল ক্লাসে ও একা ছেলে আর উনিশটা মেয়ে, আর তারা সবাই ওকে ভালবেসে রাখী পরাতে চায়, তখন থেকেই ওর নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করার অভ্যেসটা আরও পোক্ত হয়েছে!
তবে এই রসিকপুরে চাকরি নিয়ে আসার পর থেকে বিতান নিজের গুরুত্বটা হাল্কা বুঝতে পারছে, বা বলা ভালো 'এলিজিবল ব্যাচেলর' কথাটার অর্থ অনুধাবন করতে পারছে। রাস্তাঘাটে বেরোলেই রসিকপুরের কাকা জ্যাঠা মেসোমশাইরা সব বিতানের যত্ন-আত্তি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, পরে বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে পাওয়া খবরে জানা যায় এঁরা সবাই বিবাহযোগ্যা কন্যাদের বাবা। আজকাল থেকে থেকেই রঞ্জিত মল্লিক-মিঠু মুখার্জীর সেই 'মৌচাক' সিনেমাটার কথা মনে পড়ে যায় বিতানের। তা, 'হতে ইচ্ছুক' অভিভাবকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিতান মাঝেমাঝেই করবী ভিলার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। এই ব্যাপারটা যদিও ওই অভিভাবক হতে চাওয়া মানুষজনের একেবারেই পছন্দ নয়, বেশ কয়েকজন কাকাবাবু বিতানকে তা বুঝিয়েও দিয়েছেন,
"বাবাজীবন, ওই পোড়ো বাড়িটার আশেপাশে না গেলেই কি নয়? ওখানকার হাওয়া গায়ে লাগা ভালো না মোটে। এখন অবিশ্যি অল্প বয়েস, এসব কথা ভাল্লাগবে না, তাও যদি এই বুড়োর কথাটা শোনো..."
এসব কথা শুনলে বিতানের রাগ হয়। বরাবরের মুখচোরা, তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না কাউকেই, শুধু করবী ভিলার আশেপাশে যাতায়াতটা বাড়িয়ে দেয় আরও।
আজ বিকেলেও করবী ভিলার উল্টোদিকের মেহগনি গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে বসে ছিল বিতান। গাছটা সত্যিই মেহগনি কিনা বিতান জানে না। ছোটবেলায় শুনেছিল মেহগনি গাছের খুব দাম। ওর মামাদাদু ওর দিদির নামে একটা মেহগনি গাছ কিনতে বলেছিলেন ওর বাবাকে, ওই গাছ নাকি বড় হয়ে মেয়ের বিয়ের খরচা জোগাবে। তারপর থেকে লম্বাচওড়া চেহারার কোনো গাছ দেখলেই বিতানের মনে হয় ওটা মেহগনি গাছ। সে যাকগে, এখন এই গাছের নিচে বসে একটু ঢুলুনি মতন এসেছিল, হঠাৎ একটা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে চটকাটা ভেঙে গেল। সামনে তাকিয়ে যা দেখল তাতে বিতান তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। করবী ভিলার গেট খোলা, গেটের পাশে টুলে বসে আছে গোঁফওয়ালা দারোয়ান, আর তার কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করছে একটা ছোকরামতো লোক। দারোয়ান উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে দেখালো। লোকটা মাথা নেড়ে হেঁটে চলে গেল ভেতরের দিকে। লোকটার হাঁটাচলা, দাঁড়ানো খুব চেনা ঠেকছিল বিতানের। কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না বলে অস্বস্তিও হচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত সব অস্বস্তি দোলাচলের উর্ধ্বে উঠে ও ঠিক করলো ও-ও ঢোকার চেষ্টা করবে ভিলার ভেতরে। যদি দারোয়ান হাঁকিয়ে দেয় তো হয়ে গেল, নইলে ভেতরে ঢুকে একবার বাড়ির চৌহদ্দিতে টহল দিয়ে আসবে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে? চট করে ভেবে নিলো বিতান, পুরোনো বাড়ি নিয়ে রিসার্চ করছে বলা যায়।
ভেবেটেবে নিয়ে বিতান গেটের কাছে গিয়ে দারোয়ানকে ডাকতে যাবে, দেখলো দূর থেকে সেই লোকটা ফিরে আসছে। লোকটা যত এগিয়ে আসছে, আয়না দেখার মতো একটা ভাব হতে লাগলো বিতানের ভেতরে। আজ সকালে কি দাড়ি কামিয়েছিল? মনে পড়ছে না। হাল্কা খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখা যাচ্ছে, বাঁদিকের গোঁফটা এবার একটু ছোট হয়ে গেছে মনে হচ্ছিলো, এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ইস্তিরিটাও ভালো হয়নি, পকেটের কাছে একটা ভাঁজ পড়েছে। বাড়িতে আয়নায় এতকিছু চোখে পড়ে ঠিকই, মনে ঢোকে না। এখানে বিকেলের আলোয় নিজের চেহারাটাকে নিজের সামনে দেখে সব খুঁটিনাটি মনে ঢুকে পড়ছিল বিতানের।
লোকটা, অথবা বিতান নিজেই, বিতানকে পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে, ইতস্তত করে বিতান ডেকে উঠলো, "বিতান, শোন।"
গলার আওয়াজ নিজের কানে পৌঁছোতেই অপ্রস্তুত হলো ও, খানিকটা সচেতনও হয়তো। নিজেকে নিজের নাম ধরে ডাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়! এর পরে যেটা ঘটলো সেটা এতক্ষণ ধরে ঘটে চলা ঘটনাগুলোর চেয়েও অদ্ভুত। গোঁফওয়ালা দারোয়ান, বিতানের মিরর ইমেজ, খোলা গেট সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা হয়ে আসতে লাগলো। চোখের পলক একবার ফেলতেই বিতান দেখল জংধরা তালাবন্ধ গেটটা আবার ফিরে এসেছে, লতানে আগাছাগুলো গেটটাকে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে, যেমন রোজ থাকে। এসব দেখেটেখে অজ্ঞান হবে কি হবে না ভাবতে ভাবতে একটা কথা মাথায় এলো। পুরোনো বাড়ি, অযৌক্তিক গোলমেলে সব ঘটনা দেখা, সিনেমায় যেমন হয়, ব্যাপারটা অনেকটা ঠিক তেমনই না? আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বিতানের মনে হলো, নিজেকে যতটা তুচ্ছ আর গুরুত্বহীন ও মনে করে ততটা বোধহয় ও নয়। তেমন হলে কি আর সিনেমার মতো ব্যাপারস্যাপার ওর সঙ্গে ঘটতে পারতো?
(সমাপ্ত)