দৌড়
দৌড়


রেডি,স্টেডি গো....
বুধন দৌড়চ্ছে,উর্দ্ধশ্বাসে,একজন,তিনজন,তারপর দশজন...বুধন সবাইকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে।সামনে এখন শুভ, শুভ ভালো দৌড়োয়।ওকে হারাতেই হবে,বুধনকে জিততেই হবে।জিতলে বুধন পাঁচশ টাকা পাবে,টাকা,টাকা,টাকার গন্ধ এখন ভাতের গন্ধের মতো।টাকা,টাকা...
পুরো চাবাগানের সব স্কুলগুলোর মধ্যে এই প্রতিযোগিতা। বুধনও তাই এসেছে।
এখনো এগিয়ে শুভ,ফাস্ট হয়ে যাবে ও,ফাস্ট হবেইবা না কেন?ও রোজ ডিম খায়,ইয়া বড়ো গেলাসে দুধ খায়,মাখন দিয়ে ভাত খায়,ওর পায়ে শহরের জুতো।বুধন শেষ কবে ভাত খেয়েছে মনে করতে পারেনা,রোজ ওই চা বাগানের জলার কাছে শাকপাতা,অথবা কচি চা-পাতা সেদ্ধ।বুধনের পায়ে হাওয়াই চটি,তারকাঠি দিয়ে জোড়া লাগানো।বুধন পারবে কেন শুভর সাথে?
না পারলেও যে চলবেনা,টাকা যে খুব দরকার বুধনের,মাকে শহরে নেবে,বড়ো ডাক্তার দেখাবে।মায়ের খুব কাশি হয়,সারারাত হয়।ঘুমায় না,বুধনও ঘুমোয়না।মাকে জড়িয় থাকে,খুব জোরে।মায়ের গন্ধ ছাড়া বুধনের রাতে বেজার ভয়।
শুভ এগিয়ে যাচ্ছে,অনেকটা।দূরে ওই লাল ফিতেটা,বুধনকে ওটা ধরতে হবে।বুধনের কাছে সব ঝাপসা ঠেকে,শুভ আর লাল ফিতে,পেছন থেকে অনেক আওয়াজ" শুভ, শুভ "....বুধন বলে কেইবা ডাকবে।
"দাদা,দাদা...দাদা..."
রানির গলা।দাদা করে চেঁচাচ্ছে। বুধনের মধ্যে কি যেন ভর করে,চোখ বোজে,আর শ্বাস টেনে দৌড় লাগায়।যেন জীবনের শেষ দৌড় এটাই,কানে রানির আওয়াজ আর চোখে মায়ের মুখটা।
হুইসেল বেজে ওঠে।
বুধন পারেনা লালফিতেটা সবার আগে ছুঁতে।
বুধন হেরে যায়,তারকাটা জোড়া দেওয়া চটিটা গড়াগড়ি খাচ্ছে লাল ফিতার পাশে।
বুধনের রক্ত ফোটে,কিন্তু আওয়াজ ফোটেনা।
বাগানের ম্যানেজারের ছেলে শুভম পাঁচশো টাকা পায়।বুধন রানার্স আপ, পায় দুশো টাকা।
- অই দাদা,মন খারাপ করিস কেন? দুশো টাকা কি কম?
- তর জুতা ত হবেক না?
- তা না হলই বা।বাড়িত চল,মায়ের কাশি বাড়ছে।
বুধন দৌড় লাগায়,মাকে নিয়ে বেবাক চিন্তা।বাপে তো আর খোঁজ রাখেনা,মদ গিলে কোন নালার ধারে থাকে পড়ে ,সকাল হলেই খোঁজ মেলে।
-মায়ের টান বাড়ছে,এবার শহরে নেবার লাগেই।
- ক্যান?
- কেমন খালি কাশে,এম্নে ত চলেনা।
- পয়সা তুর মায়ের বাপে দিবেক?
- আমি নে যাব শহরে ব্যাস,পরশু যেতেছি।
- মর হারামজাদী,শালা জেবন আমার খতম করলেক।
বুধনের আবার রক্ত ফোটে কিন্তু মুখ ফোটে না।
- অ মা,আজ স্কুলে যাব না।কেমন করিস তুই।
- না গেলে চলবেক না বাপ,পড়ালিখা করবি নে।
- না মা না,কেমন করে বুকের ভিতর।
- হা রে বাপ আমার,রানিরে নে যা সাথ করি।
- মা,কাল শহরে যাবি।অখানে বড়োসব ডেক্তর আছে।তুর আর কাশি হবে না।
- না বাপ,আমি ভিটায় মরবো।তদের সামনে মরবো।
- আহ মা,তুই কেনে বলিস?
- অই ঘন্টা পড়লেক ইস্কুলের ,রানি অ রানি,দাদার সাথে যা।
বুধন দৌড়ায় আবার,রানি ওর সাথে দৌড়ে পাড়েনা।
- আবার দেরি করলে বুধন।কতবার বলেছিনা লেট করবে না।
- আর হবেনা স্যার।বাড়িত মা একা.. মায়ের কাশিটা...
- তোমাকে না বলেছি ডাক্তার দেখাতে।
- কাল যাবই ত শহরে।
- আচ্ছা বোসো এখন,পড়ে কথা আছে।
বস্তা আনতে ভুলে গেছে বুধন।ইশ মা মনে না করলে মনেই থাকে না কিছু।মাটির মেঝেতে পিঁপড়ে কামড়ায় খুব।তবুও আশুয়া,হেদু,মহুয়া,নিমু আরো অনেক ছেলেমেয়ে আসে,ওরা বুধনের বন্ধু।পড়তে ভালোবাসে,তাই মাটিতেও অসুবিধা নেই।স্যারের চক ঘষা নামতা,আদর্শ ছেলে,এ ফর এপেল ভালো লাগে ওদের।শুভদের মতোন শার্ট-প্যান্ট পড়তে হয়না।ওদের মতন অতো নিয়ম নেই,ফটফট করে ইংলিশ বলতে হয়না।বুধনের স্কুলই ভালো।স্যারও খুব ভালো বকে না,আদর করে,হপ্তান্তে চকলেট দেয়,আলাদা করে সবার বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয়।
তবে স্যার বুধনকে বেশি ভালোবাসে,ও ভালো দৌড়োয় তো,তাই।
- বুধন কাল তোমার দৌড় দেখে আমার এক বন্ধু খুব খুশি।আমি তোমার খুব প্রশংসা করেছে,ওনারা আলাদা করে তোমাকে দেখতে চায়,তুমি কেমন দৌড়োও।তুমি যাবে?
বুধনের চোখ চকচক করে ওঠে।ওর দৌড় দেখবে সত্যি না স্বপ্ন।
স্যার আরো বলতে থাকেন,
- বুধন,তুমি যদি ভালো দৌড়োতে পারো তবে ওনারা তোমাকে আলাদা করে শেখাবেন,তোমাকে তৈরি করবেন যাতে তুমি স্টেট লেভেলে দৌড়োতে পারো।তোমার থাকা খাওয়ার খরচা দেবে,পড়াশোনা করতে পারবে,আর মাসে মাসে একটা অংকের টাকা পাবে?যাবে বুধন!
- টাকা!কত দিবেক!
- পাঁচশো,হাজার তো দেবেই।
- এতো।
- হুম,যাবে।তাহলে আমি কালই যাবার ব্যবস্থা করবো তোমার।
- কাল!কিন্তু মা...
- একদিনের ব্যাপার বুধন,কাল সিলেক্ট হলে পরশু তোমায় পৌঁছে দিয়ে যাবে।কিছু টাকাও পাবে,তারপর তো শহরই তোমার সব,যেও তখন মাকে নিয়ে!
- আচ্ছা....
বুধন একছুটে বাড়ি আসে।দরজায় আসতেই দম ফুরোয়।হাঁপাতে হাঁপাতে বুধন দেখে মা শুয়ে আছে,রানি কচু সেদ্ধ দিয়েছে উনুনে।
- রানি,পরশুতে চাল আনবো দেখিস।নতুন চাল,মুরগি আনবো,পেট ভরি খাবি।
- কেন রে,কি হবেক অইদিন।কারু বিয়া?
- না রে পাগলি,দৌড়ে আনবো,দৌড়ে।
তারপর বুধনের খুব আনন্দ।আনন্দে সে মাকে ঘুমাতে দেয়না,আনন্দে সে রানিকে লালফিতে কিনে দেয়,মায়ের জন্য লাল চুড়ি এনে দেয়।হরি ডাক্তারের থেকে আরো একটা সিরাপের বোতল আনে,আর সেই দুশো টাকার বাকি টাকা দিয়ে একটা ভালো জুতা কেনে,এই জুতার জন্যই হেরে গিয়েছিল শুভর কাছে।
সারারাত ঘুমোয় না বুধন।বড়ো আনন্দ তার,কাল শহরে যাবে,এখন থেকে শহরেই থাকবে।কি মনে হলো একটু বাইরে ঘুরে আসতে চাইলো সে।আবার কবে দেখা হবে এই গ্রামের রাতটা।একবার শহরে গেলে মাকেও নিয়ে যাবে,রানিকেও।রানির সবে পাঁচ বছর,তাই কত কষ্ট ওর।কত কাজ করে। বুধনই বা কত বড়ো,মোটে এগারো, কিন্তু ওর যে অনেক দায়িত্ব।
এসব ভাবতে ভাবতে বুধন চলে এসেছে জলাটার কাছে,জলাটার কাছাকাছি টিলাটায় বসে আছে বুধন।রাতটা কেমন যেন?চাঁদ নেই,তারাগুলোও ছাড়া ছাড়া,ছোপড়া ছোপড়া মেঘ দিয়ে ঢাকা আকাশ।কেমন যেন লক্ষ্মীছাড়া রাতটা।এর আগেও তো কত্তবার টিলাতে বসেছে বুধন।তখন কেমন বাতাস বয়,কেমন একটা শিস বাজানো আওয়াজ আসে বড়ো বড়ো গাছগুলোর পাতাগুলো দিয়ে।নালার জলগুলোও তো আজ নড়েনা।একটা জোনাকীও নেই কোত্থাও।শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা।এত্ত ঠান্ডা লাগছে বুধনের,আগে তো লাগতো না?
কেমন যেন ভয় ভয় লাগে বুধনের।একটু আগেও শহরের স্বপ্ন দেখা বুধনের কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে।এই প্রকৃতি কি বোঝে যে বুধন চলে যাবে,তাই বুঝি মন খারাপ করছে?
নাকি প্রকৃতি অন্য কিছু জানান দিচ্ছে।
অশনি সংকেত?
ও কি দূরে একটা বড়ো সুমো গাড়িনা।আরে ওতো শুভর বাবার গাড়ি।এত্ত রাতে আবার টহল দিচ্ছে নাকি?এতো কুয়াশায় কি করে গাড়িটা,গাড়িটা ওদিক থেকে আসে কেন,বুধনের বাড়ি তো....
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে বুধনের।ঠান্ডা রক্ত আবার গরম হতে শুরু করেছে,বুধন দৌড়োয় আবার বাড়ির দিকে,কুয়াশা কাটিয়ে দৌড়োয় বুধন।
দরজায় এসে দম ফেলে।
মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত।
দুপুরের লাল চুড়িগুলো ছড়িয়ে এদিকওদিক,
মায়ের মুখটা হা করে খোলা,বুধনের বালিশটাও ভিজেছে রক্তে....
বুধনের শ্বাস গরম হচ্ছে,হাত পা ঝাড়া দিয়ে ওঠে বুধন।
মায়ের মুখ আর চোখটা বন্ধ করে দেয়,তারপর ঠান্ডা শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে শেষবার।
মায়ের মাথার পাশেই হাঁসুলিটা।
তাতে মায়ের গলার নলি সদ্য কাটা হয়েছে।
বুধনের রক্ত আবার ফুটছে,কিন্তু মুখ ফুটছে না।
পাশের ঘরে উনুনের পাশে মদ গিলছে বুধনের বাপ।
বুধন দেখে রানির বিছনা ছড়ানো,পাশে ছেঁড়া জামা।
বুধনের পায়ের পাশে গড়াগড়ি যাচ্ছে লালফিতে জোড়া।
একপা,দুপা...
মদ গিলেই যাচ্ছে,আজ অনেক মদের বোতল কিনেছে,মোটা দাম পেয়েছে কচি মেয়ের।
হারামজাদীটাও চুপ,সারাজীবনের মতো।
এখন শান্তি,আর....
আর ভাবতে পারেনা মাতালটা,গলা ছিঁড়ে দুফাক হয়ে যাচ্ছে,শ্বাস বন্ধ হচ্ছে।
আরো একবার....
বুধন মুখ চেপে রেখেছে বাপের,
নলি চিরে চলেছে অবিরত।
চোখ ঠিকরে,হা করে পড়ে আছে লাশটা।
থুঃ।
বুধন ঘেন্নায় মুখ ফেরায়।
রক্ত এখনো ফুটছে, আরো ফুটছে।
মায়ের গায়ে চাদর জড়িয়ে, কপালে চুমু খায়।
দূর থেকে বুধন শুনতে পায়।
দাদা...দাদা...দাদা....
হাঁশুলিটা হাতেই ধরা...
বুধন উঠোন থেকে দৌড় শুরু করে...
আজ বুধনকে জিততেই হবে,আজ টাকার গন্ধ চাইনা,আজ রানিকে চাই,
উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়োচ্ছে ও।
কুয়াশা কাটছে,মেঘগুলো সরে সরে আলো ফুটছে অল্প অল্প,হাওয়া বইছে শান্ত শীতল হাওয়া।
বুধন আজ হাওয়ার চেয়েও তেজ দৌড়োয়,
কাঁচা রাস্তার খোয়াইগুলোতে পা কাটছে,
তাও থামেনা বুধন...
উঁচু রাস্তাটা ধরে বুধন,ওদিক দিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়,ঢালু জমির পাশ দিয়ে আরো জোড় লাগায়...
বুধন সেই বড় গাড়ির ছাপ দেখে দৌড়োয়।
রক্তের ছাপ পড়ছে...
একে একে জলা,সেই টিলা পেরোয়...
ওই যে সেই বাগানবাড়িটা...
বুধনকে আজ কেউ আটকাতে পারবেনা,আজ লাল ফিতেটা ছুঁতেই হবে....
দাদা...দাদা...দাদা...
বুধনের দম ফুরোচ্ছে, নিস্তেজ পা হঠাৎ হড়কে পড়ে...
হোঁচট খেয়ে হুমড়িয়ে সে পড়লো ঢালু জায়গাটায়...
গড়াতে গড়াতে বুধনের মাথা আছড়ে পড়ে সেই টিলাতেই...
সেই জলার পাশেই পড়ে থাকে বুধন।
ধীরে ধীরে ভোর হয়,আর ভিড় বাড়তে থাকে..
তারপর অনেক কথা হয়,আলোচনা হয়,লেখালেখি হয় পত্রিকায় আর মিডিয়ায়।
কেউ বলে শহরে যাবার লোভে বাপ মাকে খুন করেছে বুধন।
কেউ বলে বাপ মাকে খুন করে বোনকে পাচার করেছে বুধন।
চা বাগানের দুর্দশা নিয়ে বড়ো বড়ো বুদ্ধিজীবীরা আলোচনায় বসে।
নেতা-নেত্রীরা প্রতিশ্রুতি দেয়।
বুধনের স্কুল একদিন বন্ধ হয়,সবাই এখন কাজ করে।স্যারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদায় নেয়।
এভাবেই শীতটা চলে যায় সেবার।
বুধনের নাম সবাই ভুলে যায় আস্তে আস্তে।
এভাবে শীত যায় আর আসে।
বুধনের দৌড়ের সাক্ষী থাকলো শুধু সেই জলাটা।
ওটা আজ শুকিয়ে গেছে।
প্রকৃতি তো সব বোঝে!!