#রুপকথার_জন্য_চিঠি
#রুপকথার_জন্য_চিঠি
রুপকথা নামটা আমার মা দিয়েছিল।নামটা খুব অদ্ভুত আমার কাছে,আমি নিজে কোনোদিন রুপকথার গল্প শুনিনি।সেখানে নাকি এক রাজকন্যে থাকে,রাজপুত্তুর থাকে,এক বিশাল রাজ্য থাকে আর থাকে রাজা-রাণী।আমি প্রিন্সেস হতে চেয়েছিলাম আমার এই রাজ্যে।এই যে আমাদের পুরোনো বনেদী বাড়ি,যার ধ্বসে যাওয়া গা দিয়ে শেকড় গজিয়ে উঠেছে,শ্যাওলা ধরা নোনা দেওয়ালে ভেজা গন্ধ,খড়খড়ি তোলা জানলা,পেল্লাই দরজা আর বিশাল ফুলওয়ালা খাট।এটাই আমার রাজ্য,এটাই আমার রাজা-রাণীর ঘর ছিল।
কিন্তু আমার রুপকথা খুব অসম্পূর্ণ, আমার রাজা-রাণী আলাদা হয়ে গেলো।আমি তখন বছর সাত।কি কারণ তখন বুঝিনি,জানতে হবেই এমন বুদ্ধিও তখন আসেনি।শুধু একরাতে বাবা বলল,আমাকে নিয়ে কোথায় একটা যাবে...
- বাবা,মা যাবেনা?
- যাবে,তবে মা পরে আসবে,এখন না।
- মা কে ছাড়া ভালোলাগবেনা বাবা।
- যাও,মায়ের সাথে দেখা করে এসো।
সেই হয়তো মা কে শেষ ভালোভাবে দেখা,মা সেদিন খুব কাঁদছিল।মার ফর্সা গালটা লাল হয়ে উঠেছিল,সেখানে যেন রক্ত জমাট বাঁধা।
- ও মা,তুমি কেন যাবেনা?
- যাবো,এখন আমার শরীর ভালো নেই সোনা।
- কি হয়েছে?তোমার অসুখ করেছে বুঝি!
- হুম।
- কি অসুখ মা,আমাকে বলো।
মা আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিল সেদিন,সেই ছোঁয়া,সেই উম,সেই গন্ধ যেন কতজন্ম ধরে চেনা।সব মায়েদের শরীরে এক গন্ধ থাকে,সেই গন্ধে থাকে এক আশ্রয়। অন্ধকার সেই জঠর থেকে বেড়িয়ে আলোর পৃথিবীতে প্রথম আশ্রয়,প্রথম নিশ্চিত খাদ্যের আশ্রয়, প্রথম মুখ গুঁজে শান্তি পাবার আশ্রয়, মায়ের সেই কোল।
আজ মায়ের সেই উম নেই,কোলে সেই টান নেই,ঠান্ডা দেহটা কেমন নেতিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।মায়ের সেই গন্ধটাও মিলিয়ে যাচ্ছে,মা সরে যাচ্ছে একটু একটু করে...
মার চারপাশে আজ বড্ড ভীড়। কতলোক এসেছে,নামী লেখিকা,নামী লেখা।আজ সোস্যাল মিডিয়ায় মা কে নিয়ে খুব জোর আলোচনা,সাহিত্য জগতের এক তারা খসে পড়লো।সবাই বলে,মা নাকি মেয়েদের মনের কথা খুব পড়তে পারতো,অমন করে মেয়েদের কথা সহজে কেউ বলতে পারেনা।আমি নিজে মায়ের লেখা কোনদিন পড়িনি।বাবা কোনদিন পড়তে দেইনি,বলেছে মায়ের লেখা নাকি স্বেচ্ছাচারী মেয়েদের গল্প,মেয়েদের নষ্ট করে দেবে।আমি বাবার কথা বিশ্বাস করতাম,বলতে গেলে এখনো করি।বাবা মাকে খুব ঘেন্না করে,অনেকটা।মাকে শেষ দেখতেও আসেনি।জানিনা বাবার কিসের এতো রাগ!মা বুঝি এতোই খারাপ!
খারাপই তো,একই শহরে থাকলাম,অথচ মা ছাড়া পনেরো বছর,কেন?সেই রাতে মা কেঁদেছিল,আর কি কাঁদেনি আমার জন্য,মা সত্যি খুব বাজে,খুব..
- রেবতীদেবী সধবা ছিলেন না বেধবা,সেই মতো তো আচারগুলো করতে হবে নাকি!
- আরে,ওই তো ওনার মেয়ে, ওনাকে জিজ্ঞাস করো গে না।এত্তদিন পড়ে আছে,কাউরে আসতে দেখিনি,আজ আবার কোত্থেকে..
বুঝতে পারছি,আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে।মা তো একলাই থাকতো,এই এত্ত বড়ো বাড়ি মার কি ভাললাগতো,মা কি মস্ত বড়ো স্বার্থপর।বাবাকে বলতাম...
- ও বাবা,মা তো আসেনা।এই ফ্ল্যাটবাড়ি আমার ভালোলাগেনা।আমাদের বাড়ি চলনা।
- ওটা আর আমাদের বাড়ি নয়,ওটা মায়ের বাড়ি।
- ওমা,মায়ের হলে তো আমাদেরও বাবা।আলাদা আবার কিসের,ধুর চলনা।কাল রাতে ঘুম হয়নি।
- দেখো রুপ,আর যদি কথা বাড়িয়েছো তো।তোমার মা একলা থাকতে চান,আমাদের সাথে থাকলে ওনার কলম চলেনা,বড়ো লেখিকা কিনা!
- তবে যে মা কাঁদছিল! তুমি পচা,মাকে আলাদা করে দিয়েছো,তুমি মাকে ভালবাসোনা,একটুও না।
- রুপ!!যাও নিজের ঘরে যাও।
- রুপ, রুপ এই রুপ...
- হুম, আপনি!আপনাকে তো ঠিক...
- পড়ে চিনবেখন,এখন এসো,তুমি তো ওর সব ছিলে,অন্তিমকাজগুলো খেয়াল করবেনা!
আমিই সব ছিলাম! কি মিথ্যে,কি মিথ্যে...
মা কে সেই বিশাল ফুলওয়ালা খাট থেকে নিয়ে তুলসীমঞ্চে রাখা হয়েছে।এখন মাকে দেখছি,কি বিভৎস চেহারা হয়েছে!চামড়াগুলো ভীষণভাবে কোঁচকানো,হাত-পায়ে হাড় ছাড়া কিছু নেই,মা ঘুমোচ্ছে,চোখের ওপর তুলসীপাতা।মায়ের চোখটা খুব সুন্দর ছিল,আর হাসিটা আরো।সেই বিশালচুলগুলো এখন প্রায় নেই।পুরো দেহটা দুমড়ে একটুকু হয়ে গিয়েছে,ক্যান্সার নামের রোগটা এত বেশি ভয়ংকর!!
-ওনাকে সিঁদুর দেব কি..
- উনি সধবা,সিঁদুর দিন।
- বেঁচে থাকতে তো..
- তা হোক এখন দিন,আর বিয়ের লাল বেনারসীটা বুঝি আলমারিতে আছে,ওটাও দিয়ে দিয়ে দিন।
- আচ্ছা মা।
মায়ের বুকে গীতা রাখা হলো,ধীরে ধীরে খুলে নেওয়া হলো কানের দুল আর হাতের পাতলা চুড়িজোড়া।মায়ের হাতে বাবার দেওয়া বিয়ের আংটি,মা এখনো পড়তো!কিন্তু কেন?
মার ন্যাড়া সিঁথিতে সিঁদুর পড়ল,হঠাৎ মুখটা আবার চেনা মনে হচ্ছে,দশমীর দিনে মা এমন সাজতো।মা সত্যি চলে যাচ্ছে?বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠলো।মা তো পনেরো বছর ধরে থেকেও ছিলনা,তবে কেন চোখের পাতা ভিজছে,কেন বুকের বাঁদিকটা চিনচিন করছে।মায়ের পায়ে আলতা দিয়ে কাগজে ছাপ বসলো।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার,মাকে ছেড়ে যেদিন চলে যাচ্ছিলাম,এমন কষ্ট হচ্ছিল।মনে হচ্ছে আর একবার মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদি,কিন্তু মা তো আমায় আর জড়িয়ে ধরবেনা,মা চলে যাচ্ছে,মা...
- বলো হরি হরিবোল।বলো হরি হরিবোল...
খই ছড়াচ্ছে সবাই,মাকে ওরা বন্ধ কাচের বাক্সে করে নিয়ে চলেছে, আমার সত্যি খুব কান্না পাচ্ছে,আমি কাঁদতে পারছিনা...
কেন কাঁদবি তুই রুপ,যে মহিলা তোর কোনো খোঁজ রাখেনি,তোর কথা ভাবেনি, মা থেকেও এতোগুলো বছর মা ছাড়া তুই তার জন্য...কেন কাঁদবি?
আমি শুধু মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।অভিমান কি বিষাক্ত,আমার চোখ দিয়ে এতটুকুও জল গড়ালো না।
অনেকক্ষণ বসে আছি,কি মনে হলো,বাড়িটা একবার ঘুরে নিই।
আমার ঘরটা, ঠিক একই রকম আছে,কে গুছিয়ে রেখেছে এমন করে?হারমোনিয়াম,জামা-কাপড়ের আলনা,পড়ার বড়ো টেবিলটা,এমনকি আমার ফেলে যাওয়া খেলনাপাতি, পুতুলের বিয়ের ঘর,বর-কনে সবটা।
-রুপ একটু চা খাবে,অনেক ধকল গেলো সকাল থেকে।
কে এই লোকটা?যখন থেকে এসেছি,পুরো ব্যাপারটা সামলে যাচ্ছেন যেন এটা ওনার দায়িত্ব।
- সরি কাকু,আমি আপনাকে ঠিক..
- তাইতো কি কান্ড চিনবে কি করে,আমি নিবারণ। আমি রেবতীর প্রতিবেশী ছিলাম।এই বারো বছর ধরে তোমাদের ঘরের ওই উত্তর দিকের ঘরে ভাড়া আছি। আসলে রেবুতো খুব একা হয়ে পড়েছিল,তোমরা চলে গেলে...
- আহ,ওসব কথা বলবেন না।
- ওহ,বেশ।কিছু লাগলে বোলো।
- এই ঘরটা কে গুছিয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে যেন নতুন।
- কে আবার মামনি,তোমার মা, এই পরশু রাতেও নিজ হাতে সব নেড়েচেড়ে দেখেছে।অন্য কারো এ ঘরে ঢোকার সাধ্যি থাকলে হয়।
- মা! এ কেমন আদিখ্যেতা। কোনদিন খোঁজ করতে আসেনি,আর এসব...
- রেবু ঠিক বলতো,তুমি একদম ওর মতো।মাকে শুধু ভুলবুঝে গেলে,যদি মায়ের জায়গায় থেকে বুঝতে।
- কি বুঝবো আর বলুন,ওনার কাছে আমরা কিছু ছিলাম কি?থাক সেসব কথা আমার ভালোলাগছে না।
- হুম,এটা নাও রুপ।
- কি এটা?
- চিঠি।তোমার কথা মনে করে অনেক চিঠি লিখতেন,এটা শেষ চিঠি।পড়ে যদি কিছু বুঝতে..
- মায়ের চিঠি!
চিঠিটা পেয়ে খুব অদ্ভুত লাগছে।হলুদখামে মোড়া চিঠিটা খুলে কেমন মনখারাপ করা গন্ধ,মায়ের টেবিলের পাশে এক পুরোনো আতর রাখা থাকতো।একছুটে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখি,আতরটা আজও আছে...
"রুপু,
হয়তো যখন লিখছি আমি সামনে নেই তোর,না থাকাই ভালো, তোর কাছে জবাবদিহি করবার মতো সুযোগ যে আমার আর নেই!খুব রেগে আছিস না সোনা,বেশ করেছিস রেগেছিস,আমি হলে আমিও খুব রাগতাম।এত্তদিন কতবার কিসব ছাইপাশ লিখেছি,তোকে দিতে চেয়েও তা টুকরোটুকরো করে জমেছে ডাস্টবিনে।কিন্তু আজ যে সময় খুব কম,কাঁপা কাঁপা হাতে কিছুটা বলে যাওয়া।
মেয়েদের জীবনটা খুব সহজ নয়রে। আমাকে নারীবাদী বলে লোকে,আচ্ছা মেয়ে হয়ে যদি মেয়েদের কথা না বলি,সেটা যে বড় অন্যায়, সবাই তো আর আমার মতো মুখ খুলে চলেনা!
রুপু,তোর বাবা আর আমি আলাদা হবার কথা কথা কোনদিন ভাবিনি।যেদিন আমাকে প্রথম দেখতে এসেছিল অবিনাশ,আর আমাদের বিয়ে ঠিক হলো সেদিন থেকেই মনকে মানিয়ে নিয়েছি উনি এখন আমার স্বামী,ওনার মতোই চলবো,কথা শুনবো।মা যেমন বাবার কথামতো পা ফেলতো,তেমনভাবেই।
আমাদের বিয়ে হলো।সংসার সামলানো শুরু করেছি কিনা,আবিষ্কার করলাম,আমার ভেতরে আরেকজন কেউ বাড়ছে।হঠাৎ এমন পরিস্থিতি,আমি কিছু বুঝতে পারছিলামনা।
অবিনাশ আমার খুব যত্ন নিতো,এতো যত্ন হয়তো আমার বাবাও আমার নেননি কোনদিন।তুমি আসবে শুনে কি খুশিই ছিল লোকটা,কোনকিছু মুখ ফুটে চাইতে হয়নি।এই যে বাড়িটা,এটা কিন্তু আমার শ্বশুরের,অথচ ডিভোর্সের পর আমার নামে করে দিয়েছিল,অবিনাশের মতো ভালোলোক হয়না।
এতো কিছু পড়ার পর তুই হয়তো ভাবছিস কী ভীষণ খারাপ ছিল মা টা,নইলে অমন লোকের সাথে ঘর করেনা! ঠিকই রে,আমিই খারাপ।আসলে বাকি পাঁচটা মেয়ের মতোন যে কেন হইনি?চুপ করে যে থাকতে পারিনি।মেয়েদের বুকের ভেতরটা যদি কেউ খুলে দেখতে চায় তবে দেখতিস,কত শূন্যতা সেখানে।আমি আমার মা কে দেখেছি অযথা কাঁদতে,অবাক হতাম।তারপর যখন নিজে অযথা ঘুম নেই নামক রাতগুলোতে এপাশ ওপাশ করতাম অবাক হতাম।কি এই শূন্যতা, কেন?
কি মনে হলো একরাতে নিজের পুরনো ডায়েরীগুলো খুললাম।হঠাৎ পুরনো উত্তেজনা আবার ফিরে পেলাম, পাতার পর পাতা উল্টোচ্ছি আর এক আহ্লাদে ভাসছি।
তারপর লুকিয়ে লেখা শুরু করি,নিজের নামে লেখার সাহস আর আত্মবিশ্বাস ছিলনা প্রথমে।দেখি লোকের ভালোলাগছে,আমার উৎসাহ আরও বাড়তে লাগলো,রাতের পর রাত জেগে চলল লেখা,কেউ জানলো না,কেউ বুঝলোনা।
তোমার বাবার তখন পোস্টিং জব দার্জিলিং-এ,চা বাগানের ম্যানেজার। তোমাকে আর ওকে নিয়ে আমার সংসার,কিন্তু অলক্ষ্মী আমি সংসার-এ মন নেই,দার্জিলিং-এর কুয়াশাঘেরা ম্যালে রাস্তা,সোনায় মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা-সব কিছু এতো চুপচাপ,কতো গল্প যে সেখানে।খুব কাছ থেকে পাহাড়ি মেয়েদের দেখেছি,তাদের শক্তি দেখে অবাক হয়েছি,খুব সাহসী হলাম,এবার নিজের নামে গল্প লিখলাম।তখনো নেহাৎ লিটল ম্যাগাজিন-এ দিচ্ছিলাম।এবার কি মনে হলো,সোজা দেশ পত্রিকায়।
সেই সকালটা আজো মনে পড়ে,সবে আড়মোড়া ভেঙে সকালটা শুরু হলো,জানলা দিয়ে রোদ ঝলমলে দিনটা,তুমি পাশেই ছিলে।তোমায় আদর না করে আমার দিন শুরু হতোনা।
হঠাৎ মুখের ওপর ম্যাগাজিন ছুঁড়ে মারলো অবিনাশ,ওর এমন মূর্তি আগে দেখিনি,আমি স্তম্ভিত,বোবাস্বপ্ন দেখছি যেন!
- লেখিকা হবার এতো শখ,কই আগেতো শুনিনি।এসব নোংরা লেখা তুমি লিখেছ!
- নোংরা!
- তা নয়তো কি,দার্জিলিং-এর হোটেলে দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে-ছেলের গল্প।ছিঃ, এসব তোমার মনে,লজ্জা করেনা।
- কি নিয়ে লিখতে হবে তবে?
- লেখার কি দরকার,কোন অভাব রেখেছি আমি তোমার,যা চাইছো সব পাচ্ছো।তবে?এসব লিখলে আমি মুখ দেখাবো কোথায়?
- তোমার মুখ দেখানোর ঠিকেতো আমি নিয়ে রাখিনি,আমার লিখতে ভালোলাগে আর আমি লিখবো।আর ঠাকুরের ব্রতকথা যদি লিখতে বলো তা লিখতে পারবোনা।আমি এসবই লিখবো,খুব খারাপ সত্যিগুলোই লিখবো।
- রেবতী!
বিশ্বাস কর রুপু,আমি ভেবেছিলাম অবিনাশ বুঝি আমাকে বুঝবে,কত্ত খুশি হবে লেখা দেখে।অথচ কি পেলাম!
অবিনাশের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি ধীরে ধীরে কমতে লাগল।আমরা মেয়েরা জীবনে খুব অল্প পাই,তাই সেই অল্পতেই আমরা আমাদের জীবনটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিই।অবিনাশ ছিল আআমার সেই অল্প পাওয়া।সেই অবিনাশ আমাকে অপমান করার কোন অবকাশ ছাড়তো না,আমি নাকি মেয়েদের নষ্ট করবার পন্থা তৈরি করছি।তুই আমার সবটা ছিলি,তোকে নিয়ে আমার ঘরটা আগলে রাখার শেষ চেষ্টা করেছি।কিন্তু থামিনি,লেখা থামেনি,আমার জিদ যে খুব বেশি...
হঠাৎ নিবারণের সাথে দেখা দার্জিলিং-এ।আমরা একই সাথে বড় হয়েছি,একই স্কুল পেরিয়ে একই কলেজ,হঠাৎ আমার বিয়ের পর নিবারণের আর খোঁজ পাইনি।হঠাৎ দেখা।প্রথমে কত সংকোচ,তারপর ধীরে ধীরে পুরোনোদিনগুলি ফিরতে লাগলো।সেই কলেজ ষ্ট্রীট, সেই স্টার থিয়েটার,কলেজের স্টেজ শো,লুকিয়ে সিনেমা দেখা,বই নিয়ে বির্তক-আরো কত কি!
আমি আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছিলাম,যেন এটাই জীবন।মেয়েদের বিয়ের পর যে একটা গন্ডি থাকে,সেটা মানতে আর মন সায় দিচ্ছিলনা।এ যে কি দুরাচার!
নিবারণের ফিরে যাওয়ার সময় হলো কোলকাতা,দার্জিলিং -এ ওর স্টেজ শো শেষ। কিন্তু কথা দিলাম ওর চিত্রনাট্যের একটা গল্প আমি লিখবো।
ও চলে যাওয়ার পর ফাঁকা লাগছিলো, অবিনাশ আর আমি অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিলাম।অনেক ভাবলাম,এভাবে চললে সম্পর্ক টিকবেনা।তাই আমাদের সপ্তম বিবাহবার্ষিকীতে জেদ ধরে এই কোলকাতায় এলাম।পুরনো বাড়িতে আমি তখন অনেক স্থির,সেই চাঞ্চল্য নেই,ভাবলাম অনেক হলো,আর লিখবোনা।থাক,অবিনাশ আর রুপকথা নিয়েই কাটিয়ে দিই বাকি জীবনটা।
সেই রাত তোর মনে আছে রুপু,বাবা তোকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।তুই খুব কেঁদে বলেছিলি মা যাবেনা,
মা আসেনি রুপু।সেই রাতটা যে কি যন্ত্রণার,যতটা তোর বাবার কাছে ততোতাই আমার কাছে।নতুন লাল শাড়িটা পাট ভেঙে পড়েছি,কোনদিন সিঁদুর, শাখা দিয়ে সাজিনি, সেজেছিলাম।সবটা নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু...
- কোলকাতায় হঠাৎ আসার কারণ!
- ওমা,বললাম না।আজকে কি বলোতো,ভুলে গেলে।এ জন্যই তো আসা!
- তাই বুঝি,তা আমার জায়গায় নিবারণ থাকলে বেশি খুশি হতে না!
- অবিনাশ!
- চুপ,একদম চুপ।ওকে ভালবাসতে তো আমার জীবন কেন নষ্ট করেছিলে,বিয়ের পরও,ছিঃ। আর কত নীচে নামবে রেবতী!
বিশ্বাস কর রুপু,আমি সেদিন ভেঙে গিয়েছিলাম,দুমড়ে গিয়েছিলাম।যে মানুষটার সাথে নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি,সে...
- লোকে ছিঃ ছিঃ করছে,তোমাকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে।আর লিখছেন না মহারাণী, কেন?না ওনার স্বামী-এর বিরুদ্ধে।সোজাসুজি বলনা,আমাকে আর ভালোলাগছে না,নিবারণ...
-হ্যাঁ তাই,তাই।আর পারছিনা আমি অবিনাশ,আর পারছিনা।আমি বড় ক্লান্ত,আমাকে একা থাকতে দাও,আমাকে বাঁচতে দাও,অবিনাশ প্লিজ...
- বেশ,তবে তাই হোক।
তোকে আমি রাখতে চেয়েছি,অবিনাশের পা অব্দি ধরেছি,ও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে।অবিনাশের দোষ আমি কোনদিনই দিইনা,আসলে সব দাম্পত্যে ভালোবাসাটা থাকেনা।বুকে হাত দিয়ে বলুক প্রতিটি স্ত্রী ভালোবেসে তারা সংসার করছে!প্রতিটি স্বামী বলুক,স্ত্রীর প্রতি তাদের শরীর বাদেও আত্মার টান আছে।হয়না রুপু হয়না।পৃথিবীতে বেশিরভাগটাই অভিনয়,আমি অভিনয়ে দক্ষ ছিলামনা।বাপের বাড়িতে তাই ছিলাম আপদ,আর স্বামীর কাছে নষ্টা।
আমি জানি,এই মিথ্যে লড়াইয়ে তুই হারিয়েছিস অনেকটা।মা-কে মা হিসেবে পাওয়া হয়নি তোর।এ যে বড়ো পাপ।প্রতি রাতে তোর এই ঘরটা জুড়ে তোকে খুঁজতাম।তোর পুরনো ড্রইংবুক, শ্লেট,দেওয়ালজুড়ে আঁকা,পুরনো ফিতে,উলেবোনা সোয়েটার সবটা আলমারিতে যত্ন করে রাখা।মাঝে মাঝে ভাবি,এই যে এতো নামডাক কি হবে এতে?একজন ব্যর্থ মা হয়ে আমি কি জিতেছি?একজন শিল্পীকে বুদ্ধির চেয়েও বেশি আবেগ নিয়ে চলতে হয়।অসভ্য না হলে শিল্পী হওয়া যায়না।আমি কোনদিন ঘরবন্দী হয়ে আকাশ দেখতে চাইনি,আমি আকাশের ধার ঘেঁষে উড়তে চেয়েছি।যে বৃষ্টিকে আর পাঁচজন হাতদিয়ে ছোঁয় আমি তা গায়ে মাখতে চেয়েছি,ভুল আর ঠিককে নিয়মমতো বদলাতে শিখিনি।আমার জেদ, বড়ো জোড়ালো।তাই মা হয়েও মা হতে পারিনি।হয়তো এটাই আমার খামতি!
জীবনের শেষদিকটায় নিবারণ আমার খুব খেয়াল রেখেছে,আমাকে কোনদিন থামতে দেইনি।আমি জানিনা এই একটা মানুষ কেন এতটা করে আমার জন্য,ও কি আমায় ভালোবাসে?না কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি,সব ভালবাসাতো আর নাম চায়না।ওর এই শুধু শুধু দিয়ে যাওয়াটা আমার কাছে ভগবানের আশীর্বাদ। আমরা দুজন মিলে অনেক কাজ করেছি,এই পুরোনো বাড়ি আজ সংস্কৃতির আড্ডা। নিবারণকে আমি যত দেখি,ততো ভাবি এমন কি করে হওয়া যায়,আমার মতন একজন খারাপ মেয়ের জন্য নিজেকে বদনাম করার সাহস কি করে দেখায় ও? কিন্তু বিশ্বাস কর কোনদিন কিছু চায়নি বিনিময়ে!এ যে কি বোঝা আমার কাছে!
অবিনাশ আমার সাথে আর দেখা করেনি কোনদিন,কি জানি আর হয়তো দেখাও হবেনা।কিন্তু এই বাড়ির দাবিও কোনদিন করেনি আমার থেকে।কেন?আমি কি অবিনাশকেও তবে বুঝতে পারিনি!
জীবনের শেষে এসে অতীতগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।আজ শয্যাশায়ী প্রায়,তবুও লিখছি।তুই হয়তো কিছুটা বুঝবি,মেয়েদের একসময় নিজেদের চোখ ফোটে,সেই চোখ দিয়ে দেখলে দুনিয়াটা খুব যুক্তিহীন,একতরফা আর অদ্ভুতুড়ে ঠেকে।চোখ বুজে চলাই হয়তো ঠিক!
তোর খোঁজ কিন্তু ঠিকই রেখেছি,তোর মাধ্যমিকে ৮৯% পাওয়া থেকে সায়নের সাথে সম্পর্ক অব্দি সবটা।শুধু ছুঁয়ে দেখিনি অনেকদিন,আর হয়তো হবেনা।
পারলে ক্ষমা করিস,যদি বেঁচে থাকি তো একবার বুকে জড়িয়ে নিস,আর মরে গেলে...থাক।
ভালো থাকিস রুপু,জীবনে শুন্যতা খুব অভিশাপ।যাকে ভালোবাসিস তাকে আঁকড়ে রাখিস,সময় দিস অনেকটা।তবে নিজের পরিচয়টা বিকোসনা,সম্মান ছাড়া বাঁচা মৃত্যুর শামিল,আশীর্বাদ করি অনেক বড়ো হ,কিন্তু আমার মতন না। "
আজ অনেকদিন পর রুপকথা নামের মেয়েটার চোখে তার মা সুয়োরানী হলো।হাতড়ে হাতড়ে মায়ের চেয়ারটায় বসি,ভেতরটা সব গলে যাচ্ছে,শক্তিহীন আমি। মায়ের বিছানা আঁকড়ে সেই গন্ধটা খুঁজে মরি।কোত্থাও কি নেই সেই গন্ধ!মায়ের গায়ের গন্ধ!
- রুপকথা!
ঘোর কাটে,তাকিয়ে দেখি বাবা!
- নীচে এসো,কিছু নিয়ম রয়েছে!
- তুমি!
- নীচে যাও রুপ আমি আসছি।
চোখ মুছতে মুছতে বেড়িয়ে যাচ্ছি,কোথায় সেই না কাঁদার জেদ!
আড়াল থেকে দেখি,বাবা সেই আংটিটা নেড়েচেড়ে দেখছে মায়ের চেয়ারে বসে,আর শরীরজুড়ে মাখছে সেই আতর।
আতরের গন্ধটা খুব তীব্র,আমি চোখ বুজি।ভেতর দিয়ে শীতলস্রোত,লালপেড়ে শাড়ি পড়ে আমার মা,সিঁথিভরা সিঁদুর,হাতে লাল পলা,সোনাবাঁধানো শাখা।আজ তিনি বিখ্যাত লেখিকা রেবতী রায়চৌধুরী নন,আজ তিনি রুপকথার মা,শুধু আমার মা।
আলতা রাঙা পায়ের ছাপে মা হারিয়ে যাচ্ছে,ধীরে ধীরে....
যদি একবার ছুঁতে পেতাম!!