রাখিবন্ধন
রাখিবন্ধন
মালতি সকাল বেলায় কাজে এসে থেকেই রাগে গজগজ করছে। একবার বাসন হুড়মুড় করে ফেলছে তো..., একবার জল, ঝাট দিতে গিয়ে ধূলো পড়ে থাকছে পিছনে, মুছতে গিয়েও কিছু অংশ বাকি থেকে যাচ্ছে ঘরের। সকাল থেকে মালতির এই রকম করাটা ভালো মতই লক্ষ্য করেছে রূপা। সব কাজ প্রায় হয়েই এসেছে, মালতী শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বাড়ি যাবার জন্য পা বাড়াল, ঠিকই তখনই রূপা বলে উঠল
-----মালতি এই তোর দাদাবাবু মাছটা এনেছে ধুয়ে দিয়ে যা.... লক্ষী বোন আমার।
----মালতি রাগে গজগজ করে বলে উঠল, পারবনা, আমার সব কাজ হয়েগেছে এখন বাড়ি যাবো।
-----রূপা বলল এই রকম করে বলিসনা বোন আমার, জানিস তো... আমি গোটা মাছ কাটতে পারিনা, তোর দাদাবাবুকে বারবার বারন করি গোটা মাছ নিলে বাজার থেকে কেটে আনবে, কিন্তু কে... কার কথা শোনে।
মালতি রাগে গজগজ করতে করতে আবার রান্নাঘরে ঢুকল। বঁটি নিয়ে মাছ কাটতে বসল। প্রথমে মালতি মাছ দেখে অবাক, এত বড় ইলিশ তারপর চিংড়িও আছে। ইলিশ মাছের মাথাটা বঁটিতে ঠেকাতেই মালতির চোখটা ঝাপসা হয়ে এল।
-----মালতি মনে মনে বলে উঠল, লিলি যে... বড্ড ভালোবাসে ইলিশ মাছ খেতে, কিন্তু আমাদের সংসারে ইলিশ মাছ খাওয়ার মুরোদ কোথায়!! পাশের বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ির রান্নাঘরের জানলা দিয়ে যখন ইলিশ মাছের গন্ধ ভুরভুর করে ভেসে আসে, তখন মেয়েটা হাসিমুখে প্রানভরে সেই গন্ধটা টেনে নিয়ে, হাসিমুখে আলুভাতে ভাত মেখে খেয়ে নেয়।
-----রান্নাঘরে এসে মালতিকে চুপচাপ মাছ নিয়ে বসে থাকতে দেখে, রূপা বলে উঠল কি... হয়েছেরে তোর? সকাল থেকেই দেখছি মেজাজটা বিগড়ে আছে? বর আবার নেশা করে পিটিয়েছে নাকি? কতবার বলি ছেড়েদে ঐ... লোকটাকে, কিন্তু তোর এত ভালোবাসা ছাড়তে আর পারলিনা। কি... সুখ পাস মার খেয়ে, যে...পরে আছিস ঐ লোকটার সাথে।
-----মালতি চোখের জলটা লুকিয়ে মুছে নিয়ে বলল, না....না দুদিন ধরে সে... তো.. বাড়ি ফেরেনি, মাল বোঝাই লরির সাথে গেছেতো, ফিরতে কটাদিন দেরি হবে। আচ্ছা তোমাদের ঘরে কেউ কি... আসবে নাকি? এত মাছ এনেছে দাদাবাবু??
-----রূপা বলে উঠল হ্যাঁ...., তোর দাদাবাবুর বোন, মেয়ে, বোনের বর আসবে, দুপুরে এইখানে খাওয়া দাওয়া করবে, আজকে রাখি পূর্নিমা তাই। ওর জন্য তোর দাদাবাবু বোনের পছন্দের সব জিনিস নিয়ে এসেছে। আজ বিকেলে কিন্তু তাড়াতাড়ি আসিস, আর কামাই করিসনা আমি তাহলে শেষ হয়ে যাব।
-----মালতি ইলিশ মাছ কেটে, চিংড়ির খোসা ছাড়াতে ছাড়তে অল্প হেসে বলল, হুম... আসব।
---রূপা বলে উঠল, কি.... হয়েছে বললিনাতো? বলতে পারিস যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।
-----মালতি বলল আর বলোনা মেয়েটাকে আজ দুঘা দিয়ে এসেছি, অভাবের সংসার কোনমতে দিন চলে যায়, তাদের এত শখ আহ্লাদ ইচ্ছে থাকতে নেই!
----রূপা বলে উঠল আহা হয়েছেটা কি? আবার লিলিকে মারতে গেলি কেন?? তোর মেয়েটাতো বড্ড লক্ষী।
----মালতি বলল সে... পুতুল দিয়ে সুন্দর করে ঝুলন পেতেছে, আমি প্রথমে বারন করেছিলাম কিন্তু পরে নিজেই সবকিছু এনে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলাম। কিন্তু আজ আবার তার বন্ধুদের নিমন্ত্রন করছে লুচি খাওয়াবে বলে। বলি তা কোথা দেখে খাবার জোগাড় হবে, আমার তো আর টাকার গাছ নেই, যে গাছে নাড়া দেব আর টাকা ঝড়ে ঝড়ে পরবে। সেটাতো ওকে বুঝতে হবে।
-----রূপা বলল ছোট মেয়ে বন্ধুদের সাথে আনন্দ করবে বলে যখন নিমন্ত্রন করেই ফেলেছে, কি আর করবি!!! আমার কাছ থেকে না... হয় কটা টাকা নিয়ে যা... পরে শোধ দিয়েদিস।
----মালতি বলে উঠল, না... দিদিমনি গরিব ঘরের মেয়ে, আজ ওর ইচ্ছে পূরন হলে আবার এই রকম কাজ করবে, তাই ওর শিক্ষা হওয়া উচিত এই রকম করার আগে তখন দশবার ভাববে। আমাকে ক্ষমা করো আমি আজ কিছুই করবনা।
-----মালতি মাছকটা ভালো করে ধুয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে রেখে বলল, এখন আসি ওবেলায় তাড়াতাড়ি চলে আসব।
----রূপা বলল, হ্যাঁ... আয় আজ আমারও অনেক রান্না আছে কাজ আছে।
***********************
মালতি বাড়ি এসে দেখল লিলি স্নান সেরে রাধা কৃষ্ণকে জল বাতাসা দিচ্ছে ভক্তিভরে। ছোটবেলার রঙিন কাল্পনিক জগতে ভেসে বেড়ানোর সুযোগ পায়নি লিলি, তাই ছোটবেলা থেকেই বড় বাস্তববাদী হয়ে উঠেছে। আসলে কঠিন বাস্তবের সাথে লড়াই করেইতো ওদের টিকে থাকা। মালতি কোন কথা না... বলে নিজের কাজে লেগে পড়ল।
-----লিলি ধীর পায়ে মালতির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, মা.... আমার ভুল হয়ে গেছে, এই রকম কাজ আর হবেনা... কোনদিন, আমি জানি আমার দুবেলা খাবার জোগাড় করতে তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়, তুমি রাগ করোনা মা... ওরা আসুকনা এসে আমার সাজানো রাধা কৃষ্ণের ঝুলন দেখে যাক। আর ওদের হাতে তখন জল বাতাসা দিয়ে দেব না... হয়।
মালতি মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর মালতির চোখের কোন বেয়ে পড়তে থাকে নোনা জলের ধারা।
***********************
রূপা ওদিকে ইলিশ মাছের ভাপা, চিংড়ির মালাই কারি, পাঁচ রকমের ভাজা, তরি তরকারি, চাটনি রাঁধতে ব্যস্ত। এখন শুধু ননদের আসার অপেক্ষা। হঠাৎ রূপার স্বামী স্বরূপের ফোনে ফোন আসে।
------স্বরূপ ফোন ধরে বলে, কিরে কখন আসছিস বোন?? তোর বৌদিতো অপেক্ষা করে বসে আছে কখন থেকে, তারসাথে বিল্টুও পাগল করে তুলছে কখন আসবে পিমনি, বুনি।
-------ওপার থেকে স্বরূপের বোন সৃজার গলা থেকে ভেসে আসে কয়েকটা শব্দ, আমরা যেতে পারছিনারে দাদা। হঠাৎ করে রঞ্জনের বস আসবে বলল, তাই কি... আর করা যাবে বসের মুখের ওপর না... তো আর বলা যায়না।
----স্বরূপ মিয়ানো স্বরে বলে উঠল ও... তোরা আসতে পারবিনা! কতকি প্ল্যানিং ক
রেছিলাম আসবি বলে।
------সৃজা বলে উঠল, তোর রাখি আর গিফ্টটা আমি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি, আর কিছু মনে করিসনা বুঝলি, পরে সময় করে যাব একদিন, এখন রাখি অনেক কাজ বাকি আছে।
------স্বরূপ ফোনটা রেখে গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে বলল, রূপা আর কষ্ট করে অত রান্না করতে হবেনা বোনরা আসছেনা।
-----রূপা বলে উঠল, সেকি কেন কি হয়েছে?
-------স্বরূপ বলল রঞ্জনের অফিসের বস আসবে বলেছে, তাই বোন আর আসতে পারলনা। বলল রাখি গিফ্ট পাঠিয়ে দেবে। তুমি মোটামুটি সাধারণ রান্না করে বাকি ফ্রিজে ঢুকিয়ে দাও।
------রূপা বলল হুম ঠিক আছে। অথচ রূপার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। যে হাসির ভাষা অন্য।
***********************
কালের নিয়মে প্রকৃতির বুকে সন্ধ্যা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে। পূর্নিমা তাই আকাশের বুকে গোল থালার মত চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। মালতি সব বাড়ির কাজ করে এসেছে অনেকক্ষন। তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরে ধূনো দিচ্ছে মালতি, আর লিলি রাস্তার দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে আর মনে মনে ভাবছে এই বুঝি ওর বন্ধুরা সব দল বেঁধে এল। হঠাৎ ধূনোর ধোঁয়ার মাঝে লিলি দেখতে পেল কারা যেন আসছে ওদের বাড়ির দিকে কিন্তু ওর বন্ধুরা নয়।কয়েক মুহুর্তের মধ্যে লিলির চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল তাদের মুখ।
-----লিলি চিৎকার করে উঠল, মা... মা দেখো কারা এসেছি।
-----মালতি ধুনচিটা ঘরের এককোনে রেখে বেড়িয়ে আসতে আসতে বলল, কে... এসেছি লিলি তোর বন্ধুরা।
-------লিলি বলল না মা...!
------মালতি বলে উঠল তবে কে..., তারপর সামনে তাকিয়ে বলল, আরে দিদিমনি, দাদাবাবু বিল্টু সোনা যে...।
----রূপা বলে উঠল তুইতো আর আসতে বললিনা তাই আমরাই চলে এলাম তোর মেয়ের ঝুলন দেখতে।
------মালতি সাথে সাথে বলে উঠল, ঘরে চলো দিদিমনি, দাদাবাবু আসুন। লিলি ততঃখনে বিল্টুকে নিয়ে চলে গেছে ঘরের ভিতরে।
------বিল্টু মাকে দেখে বলে উঠল, ওয়াও মা... লিলি কি সুন্দর সাজিয়েছে, পাহাড়, ঝর্না, গ্রাম, পুকুর কতকি আর কি সুন্দর রাধা কৃষ্ণ দেখ দোলনায় দুলছে।
------রূপা লিলির মাথায় হাত দিয়ে বলল, হ্যাঁ... খুব সুন্দর হয়েছেরে মা। আমরাও ছোটবেলায় যেতাম এরবাড়ি ওরবাড়ি ঝুলন দেখতে।
-------মালতি বলে উঠল গরিবের ঘর তোমাদের যে কি....খেতে দিই, বলছি দিদিমনি চা... করব?
-------পাশ থেকে স্বরূপ বলে উঠল, চায়ে হবেনা আজ, আমরা তোমার বাড়িতে খাব।
------মালতি ঠোঁটের কোনে অল্প হাসি আনল ঠিকই, কিন্তু সেই হাসির মধ্যেও একটা চিন্তা এবং কষ্ট লুকিয়ে আছে।
-------রূপা মালতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,তোকে অত চিন্তা করতে হবেনা, আমার সাথে চল তোর রান্নাঘরে।
মালতি আর রূপা ঘর থেকে বেড়চ্ছে ঠিক সেইসময় লিলির বন্ধুরা হই হই করতে করতে এসে হাজির। লিলিও ওদের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে চলে এসেছে বাইরে।
---মালতি অবাক শূন্য দূষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে, আর ভাবছে এখন কি করবে?? ঘরে অত তেল আটা নেই যে... দুটো লুচি ভেজে দেবে। মালতি ঈশ্বরের নামে মনে মনে প্রনাম করে নিল।
-----রূপা মালতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল, কি... হল চল।
-----মালতি বলল হ্যাঁ... চলো।
---রূপা উঠোন পেরিয়ে বাইরে যেতে লাগল। মালতি বলল ওদিকে কোথায় যাচ্ছ দিদি আমার রান্নাঘর এইদিকে।
----রূপা হাসতে হাসতে বলল, খাবারগুলো সব গাড়িতে আছে, আগে নিয়ে আসি।
-----মালতি অস্ফুট স্বরে বলল, খাবার....!!
------রূপা বলল হ্যাঁ.... তোর দাদাবাবুর বোন তো আসতে পারেনি তোকে বললাম না, তাই রান্নাগুলো কি... হবে, নিয়ে এলাম একসাথে সবাই মিলে খাব।
-----মালতির চোখ দিয়ে তখন খুশির জল পড়ছে, সত্যি এখনও এই পৃথিবীতে ভালোমানুষ আছে।
*********************
মাটির উঠোনে সবাই গোল হয়ে বসেছে খেতে আর সবার পাতে খাবার পরিবেশন করছে মালতি আর রূপা, বাসমতি চালের ভাত, পাঁচরকমের ভাজা, ডাল, তরকারি, ইলিশ ভাপা, চিংড়ির মালাইকারি, চাটনি, দই, মিষ্টি। লিলির পাশাপাশি সবার মুখেই তখন আনন্দের হাসি।খাওয়া দাওয়া মিটতেই স্বরূপ বলে উঠল.....
----একটা কাজ যে....এখনও বাকি থেকে গেল!!!
রূপা আর মালতি দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল স্বরূপের দিকে।
-----স্বরূপ পকেট থেকে রাখি বার করে মালতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা এখনো যে বাঁধা হয়নি পকেটেই পরে আছে।
-----রূপা হাসিমুখে বলে উঠল, হ্যাঁ... আমিতো ভুলেই গেছিলাম, মালতি চট করে তোর দাদাবাবুর হাতে রাখিটা বেঁধে দেতো।
মালতি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে।
----স্বরূপ বলে উঠল আমি মনে হয় ভুল কিছু বলে ফেলেছি রূপা, মালতিতো কাঁদছে!!
-----মালতি হাসিমুখে বলল, দাদাবাবু আপনি আমার কাছ থেকে রাখি বাঁধতে চাইবেন এটা আমি কোনদিনও কল্পনাও করিনি।
------স্বরূপ বলে উঠল দাদাবাবু নয়, শুধু দাদা। আর কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এসে তাড়াতাড়ি রাখিটা বাঁধ।
মালতি স্বরূপের হাতে রাখি বেঁধে দিল।
----পাশ থেকে বিল্টু বলে উঠল, আমিও রাখি পড়ব হাতে।
লিলি বিল্টুর হাতে রাখি বেঁধে দিল। মালতি স্বরূপের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল।
------স্বরূপ মালতির মাথায় হাত রেখে বলে উঠল তোর এই দাদাকে সবসময় তোর পাশে পাবি।
মালতির ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল হাসি। আর এই সুন্দর সময় এবং রাখি বন্ধনের সাক্ষী রইল আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করতে থাকা পূর্নিমার রুপোলি চাঁদ।