শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Inspirational

4.1  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Inspirational

এখানে আকাশ নীল

এখানে আকাশ নীল

6 mins
1.5K



--------হ‍্যালো... হ‍্যালো.... শুনতে পাচ্ছেন মিস্টার সেন??? আমি রঞ্জনা বলছি.....!!! টু... টু.... শব্দ করে ফোনটা কেটে গেল। কান থেকে ফোনটাকে নামিয়ে বিরক্তি নিয়ে রঞ্জনা বলে উঠল, উফ্..... এই নেটওয়ার্কের প্রবলেম আর ভাল্লাগেনা!!দরকারের সময় একটা কথাও শুনতে পাওয়া যায় না....!!! রঞ্জনা নিজের মনের সাথে নিজের কথা বলার মাঝেই ফোনটা আবার বেজে উঠল, রঞ্জনা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল রঞ্জন..... নামটা জ্বল জ্বল করছে। যদিও সেটা ট্রু... কলারের দৌলতে। রঞ্জনা ফোনটা ধরে সাথে সাথে বলে উঠল, হ‍্যালো.... হ‍্যালো..... শুনতে.... পাচ্ছেন মিস্টার সেন???

---------ওপাশ থেকে আওয়াজ আসল, হ‍্যাঁ.... শুনতে পাচ্ছি, আপনি কি... এসে গেছেন...??

---------রঞ্জনা বলে উঠল, এই তো.... দশ মিনিটের মধ‍্যে পৌঁছে যাব। আর আপনি...????

---------রঞ্জন বলে উঠল, আমি অলরেডি এসেগেছি, আপনি আসুন আমি অপেক্ষা করছি।

--------রঞ্জনা বলে উঠল, ওকে..... বাই।

ফোনটা রেখে রঞ্জনা ট‍্যাক্সির জানলা দিয়ে মুখটা বার করে হাওয়াটাকে উপভোগ করতে লাগল। তার সাথে দেখতে লাগল পশ্চিমাকাশের বুকে লাল রঙ ছড়িয়ে সূর্যের পাটে যাওয়া। ব‍্যস্ত শহর হাজার হাজার গাড়ি তীব্র হর্ন ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে চলেছে রাস্তার বুক চিরে। রঞ্জনার বাড়ি থেকে বেড়নোর সময় মনের মধ‍্যে একরাশ বিরক্তি ছিল। কিন্তু এই ব‍্যস্ত শহরের ব‍্যস্ততায় নিজের বিরক্তিকে মিশিয়ে দিল, তাছাড়া কিছু করার নেই!!! মাদার ইন্ডিয়ার করা নির্দেশ আজ এই পাত্রর সাথে দেখা করতেই হবে, না.... হলে মাদার ইন্ডিয়ার মান সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে, কারন পাত্র হল মায়ের খুড়তুতো দাদার, মাসতোত বোনের, পিসতুতো দেওরের ছেলে।

এর আগে এই রকম হাজারটা সম্বন্ধ এসেছে, কিন্তু বিয়ে অবধি গড়ায়নি!!! কারন রঞ্জনার একটার পর একটা শর্তের সামনে পরে তারা অবাক হয়েছে, সাথে এও ভেবে নিয়েছে এই মেয়ে যে..... সংসারে যাবে সেই সংসার সুখের হবে না....!!! কিন্তু রঞ্জনার তাতে কোন আক্ষেপ নেই, এমন কি.... হাজার বার মায়ের বোঝানো এবং বারন করা সত্বেও, রঞ্জনা নিজের শর্তের পরিবর্তন করেনি। রঞ্জনার একটাই মত যদি বিয়ের আগে থেকেই স‍্যাক্রিফাইস করা শুরু হয়ে যায়, তাহলে বিয়ের পর সংসারে ঢুকে গেলে আর ওর কোন মূল‍্যই থাকবে না...!! তাই যা... করতে হবে সব বিয়ের আগে। তবে এই বার রঞ্জনার মা.... আগে আর বাড়িতে আসতে বলেননি!!!প্রথমে ছেলের সাথে দেখা করে রঞ্জনাকে সমস্ত শর্ত বলে নিতে বলেছেন, ছেলে যদি রাজি হয় এবং রঞ্জনাকে পছন্দ হয়, তাহলে বাড়ি গিয়ে মা.... বাবার সাথে কথা বলে তবেই রঞ্জনাকে অনুষ্ঠানিক ভাবে দেখতে আসবে।

---------রঞ্জনা রেস্টুরেন্টের সামনে নেমে ট‍্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে একবার ভালো করে নিজেকে দেখে নিল এবং নিজের মনে মনে বলে উঠল.......না.... ঠিকই আছে। যদিও মাদার ইন্ডিয়া ভালো করে সেজে শাড়ি পড়ে আসতে বলেছিল, কিন্তু না... তাতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। রোজ যা... পড়ি, এবং ভবিষ্যতেও যা... পড়ব, সেটা পড়াই বেটার!!! আর তাছাড়া সেজে, মুখে রঙ চড়িয়ে কি.... হবে!!! সব সময় তো.... আমি রং চড়িয়ে সেই মানুষটার সামনে যাব না....!!! তাহলে নরমাল এবং ন‍্যাচারালটাই বেস্ট। নিজের সাথে নিজে কথা বলে রঞ্জনা এগিয়ে গেল ভিতরের দিকে। ভিতরে ঢুকে দেখল প্রত‍্যেকটা টেবিলে কেউ না... কেউ বসে আছে!!! কোথাও জোড়া জোড়া আবার কোথাও দলবেঁধে, শুধুমাত্র কর্নারের একটা চেয়ারে একজন একা বসে আছে। রঞ্জনা সাহস নিয়ে এগিয়ে গেল সেই দিকে এবং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল.... মিস্টার সেন???

---------ছেলেটি মাথা তুলে রঞ্জনার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল!!!

---------রঞ্জনা আবার বলে উঠল, আপনি কি..... মিস্টার রঞ্জন সেন...???

---------রঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, হ‍্যাঁ.... হ‍্যাঁ.... আমি রঞ্জন, আর আপনিই তাহলে রঞ্জনা!!! বসুন.... বসুন....

---------রঞ্জনা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে উঠল, হ‍্যাঁ.... আমি রঞ্জনা, তা আপনি ঐ ভাবে কি দেখছিলেন??? আমাকে কি অন‍্য গ্রহের প্রানি লাগছে???

---------রঞ্জন ধীর স্বরে বলে উঠল, স‍্যরি...... আসলে..., আপনি এইভাবে আসবেন আমি ভাবতে পারিনি!!!

---------রঞ্জনা বলে উঠল, তা... কি... ভেবেছিলেন বিয়ের কনে সেজে আসব!!!

---------রঞ্জন বলে উঠল, না.... না... তা... কেন হবে??? আসলে......

---------রঞ্জনকে আর বলতে না.... দিয়ে, রঞ্জনা বলে উঠল, তাহলে ভেবেছিলেন শাড়ি চুড়িদার পড়ে সেজে গুজে আসব, দেখুন আমি শাড়ি পড়িনা, বা... পড়তে পারিনা, সে... কথা বলবো না!!! বরং শাড়ি পড়তে ভালোবাসি অকেশনে, সব সময় নয়, আর জিন্স টপ সব সময় পড়ি তাই এটা পড়েই এসেছি, যদি আমাদের সম্পর্ক এগোয়, তাহলে আমাকে এইভাবেই দেখতে পাবেন রোজ, তাই আলাদা করে সাজার কিছু নেই!!!

-----------রঞ্জন বলে উঠল, বুঝতে পেরেছি, কফি অর্ডার দিই???

---------রঞ্জনা বলে উঠল, হ‍্যাঁ.... কোল্ড কফি।

-------রঞ্জন ওয়েটারকে ডেকে দুটো কফি এবং কিছু স্ন‍্যাকসের অর্ডর দিল। রঞ্জনা বলে উঠল, তা.... আপনিতো বেশ মাঞ্জা দিয়ে এসেছেন।

---------রঞ্জন মুখে হাসি এনে বলে উঠল, যদি জানতাম আপনি এইভাবে আসবেন, তাহলে আমিও রেগুলারের পোশাকে চলে আসতাম।

---------রঞ্জনা বলে উঠল, এবার আসল কথায় আসা যাক, যার জন‍্য এই ছুটির একটা দিন রবিবারেও আমাকে এখানে আসতে হল।

-------রঞ্জন বলে উঠল, বিরক্ত হলেন বুঝি!!!

---------রঞ্জনা বলে উঠল, বিরক্ত হওয়ারই তো.... কথা, সপ্তাহে একটাদিন নিজের মত কাটানো যায়। না.... হলে বাকিদিন গুলোতা দশটা পাঁচটা ডিউটি করতেই কেটে যায়। তবে এখানে এসে এখন খুব একটা খারাপ লাগছেনা। তা.... আপনি বিরক্তি হননি??, সত‍্যি করে মন থেকে বলুন তো....।

---------রঞ্জন বলে উঠল না...... বিরক্ত হয়নি!!!আসলে আমার এইভাবে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বাড়িতে বলতে পারনি, কিন্তু যখন আপনাদের বাড়ি থেকে এই রকম দেখা করার প্রস্তাব আসল, তখন বেশ ভালো লাগল। রঞ্জনের কথা শেষ হতে না... হতেই ওয়েটার এসে কফি স্ন‍্যাকস সব দিয়ে গেল। রঞ্জন, রঞ্জনার দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল, নিন খেতে খেতে বলুন, আপনার কি... জানার আছে???

-----------রঞ্জনার এই রকম অকপট স্বীকারোক্তি শুনে বেশ ভালো লাগল, কফিতে চমুক দিয়ে রঞ্জনা বলে উঠল, আমার কিছু শর্ত আছে সেগুলো শুনে মেনে নিলে আমি রাজি। আর আপনিও বলবেন আপনার কি... জানার আছে???

---------রঞ্জন বলে উঠল, বলুন শুনি আপনার শর্ত!!

---------রঞ্জনা বলে উঠল, আমার প্রথম শর্ত, "সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে" এই মতটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, কারন সংসার যখন দুজনের, তখন দুজনকে সমান অংশীদার হতে হবে, সুখ, দুঃখ, আনন্দ, এবং স‍্যাক্রিফাইস সবেতেই। আমার মনে হয় তবেই সংসার সুখের হবে। দ্বিতীয় শর্ত,হলো আমি মেয়ে বলে বয়স কালে আমার মা... বাবা বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে সেটা হবেনা, আমি যেমন আপনার মা.. বাবাকে, মা...বাবার চোখে দেখব, তেমনই আপনাকেও দেখতে হবে আমার বাবা মাকে, কারন আমি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, তাই তাদের দায়িত্ব আমার। তৃতীয় শর্ত, আমি যেমন চাকরি করছি তেমনই করব, যেভাবে এতদিন চলে এসেছি সেভাবেই চলব, তবে দায়িত্ব নেব সংসারের, সেটা অস্বীকার করছি না...। রঞ্জন গভীর মনযোগ দিয়ে প্রত‍্যেকটা কথা শুনছে। রঞ্জনের কোনরকম বিরুপ পতিক্রিয়া না..... দেখে রঞ্জনা কিছুক্ষন থেমে বলে উঠল, কি....ভাবছেন মিস্টার সেন??? কেন আসলেন এইখানে তাই তো....!!!

---------রঞ্জন কফিতে চমুক দিতে দিতে বলে উঠল, এই তিনটে শর্ত মোটে আর কিছু নেই!!! আমিতো ভাবলাম আপনার অনেক লম্বা লিস্ট আছে!!

----------রঞ্জনা বলে উঠল আর একটা আছে, সত‍্যি করে বলুন আপনি কি আমাকে ব‍্যাঙ্গ করছেন!!

--------রঞ্জন বলে উঠল, ছিঃ ছিঃ কি বলছেন যেটা বাকি আছে সেটা বলে ফেলুন, থামলেন কেন...?? আমি সত‍্যি শুনতে চাই!!

---------রঞ্জনা বলে উঠল, আমার শেষ শর্ত হল আমি ঘুরতে আর খেতে খুব ভালোবাসি, তাই এই দুটোতে বাঁধা দিলে চলবে না...!!! আর সমুদ্র আমার খুব প্রিয়। ঐ বিস্তৃর্ন জলরাশি আমাকে মোহিত করে। একটার পর একটা উত্তাল ঢেউ যখন তীরে আছড়ে পড়ে তখন তার গর্জন আমার খুব ভালো লাগে। সত‍্যি জীবনটা যেন গভীর এক সমুদ্র। উফ্ দেখেছেন কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। এবার আপনি বলুন কি.... বলবেন???

---------রঞ্জন হাসি মুখে বলে উঠল, আমারও একটা শর্ত আছে?? মানতে পারলে আমিও রাজি!!!

--------রঞ্জনা উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল, বলুন শুনি....??

--------রঞ্জন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রঞ্জনার চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, আমার একটাই শর্ত, আর সেটা হলো সব সময় আপনি এই রকম থাকবেন,নিজেকে একদম পাল্টানোর চেষ্টা করবেন না...!!! আপনার প্রত‍্যেক শর্তে আমি রাজি, তবে এগুলো ঠিক শর্ত নয়!!! যখন দুটো অচেনা মানুষ একসাথে সংসার করা শুরু করে তখন দুজনের মতকে গুরুত্ব দেওয়া, মনোভাবকে বোঝা উচিৎ বলে আমার মনে হয়, আর সত‍্যি তো.... আমার বাবা মাকে যদি আপনি আপন করে নিতে পারেন, তাহলে আমি কেন পারবনা...!!! আর সংসার সুখের হয় চারহাত একজায়গায় হলে শুধুমাত্র দুটোহাতে নয় এটা আমারও বিশ্বাস।

রঞ্জনা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সত‍্যি মানুষটা অদ্ভুত। এতদিন এতজন এসেছে ওকে দেখতে সবাই প্রথম শর্ত শুনে আর দ্বিতীয়তে যায় নি!!! কেউ কেউ আবার দ্বিতীয় শর্ত শুনে এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলেগেছে আর সেইখানে এই মানুষ সব শর্তে সহমত পোষন করছে। রঞ্জনার চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠল জলে।

----------রঞ্জন একটু ইতঃস্তত করে আলতো ভাবে রঞ্জনার হাতের ওপর হাত রেখে বলে উঠল, আমাদের নামের যেমন মিল আছে, তেমনই আমাদের মনের মিল হোক এটা আমার ইচ্ছা, বাকিটা আপনার ওপর নির্ভর করছে।

--------রঞ্জনা হাসি মুখে বলে উঠল, এখনও আমার শেষ শর্তের উত্তর পাইনি....!!!

--------রঞ্জন হাসতে হাসতে বলে উঠল, ওটা উত্তরে নয় কাজে করে দেখব। রঞ্জন ওয়েটারকে ডাক দিল। ওয়েটার কাছে আসতেই রঞ্জন বলে উঠল বলুন আপনি কি... খাবেন??? আজকে খাওয়ায় আর সামনের রবিবার না... হয় আপনাকে নিয়ে লং... ড্রাইভে যাব সমুদ্রসৈকত দেখতে।

--------রঞ্জনা হাসিমুখে বলে উঠল, আমার জন‍্য একপ্লেট মটন বিরিয়ানি আর আপনার....

--------রঞ্জন বলে উঠল এক প্লেট চিকেন চাপ, না হলে বিরিয়ানিটা ঠিক জমবে না।

..............সমাপ্ত...............

💕💕💕💕💕💕💕💕💕


✍শিপ্রা চক্রবর্তী



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance