বসন্ত প্রিয়া
বসন্ত প্রিয়া
বিশ্বকর্মা পূজো পাড়ার মোড়ে মাইকে সকাল থেকেই গান বাজছে। তার সাথে কচিকাচারা এবং বড়রা বাড়ির ছাদে আবার কেউ কেউ মাঠে নেমেছে ঘুড়ি ওড়াতে। এক প্রকার হার জিতের ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। আর যখন কারোর ঘুড়ির সূতো কেটে পড়ে যাচ্ছে, তখন উল্লাসে ভো...কাট্টা.....বলে চিৎকার করে উঠছে। আর এইসব চিলেকোঠার ঘরে বসে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখে চলেছে মুক্তি দেবী। না..... চাইতেও বারবার তার চোখটা আরও বেশি করে ঝাপসা হয়ে আসছে। সত্যি... স্মৃতি মধুর, তার সাথে বেদনাদায়ক। মনকে সময় অসময়ে ভারি করে তোলে। এইরকম বিশ্বকর্মা পূজোর সময় কত আনন্দ হতো ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে। মুক্তি দেবী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জলটা মুছে ভালো করে চশমাটা চোখে এঁটে ধীর পায়ে সাজানো বইয়ের তাকের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তাকের মাথার ওপর থেকে বহু কষ্টে একটা পুরনো কারুকার্য করা কঠের বাক্স পাড়লেন। এবং শাড়ির আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছে বাক্সটাকে সাথে করে নিয়ে আবার বসলেন।
খুব যত্ন সহকারে বাক্সটা খুললেন সাথে সাথে বাইরে থেকে আবার চিৎকার ভেসে আসল ভো.... কাট্টা.....। তার সাথে একটা ঠাণ্ডা হাওয়াও আসল এবং বাক্সের মধ্যে থাকা ময়ূর পালকটা হাওয়ার দুলে উঠল। মুক্তি দেবী আলতো ভাবে ময়ূর পালকটা হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। এবং টুকরো টুকরো স্মৃতিরা চোখের সামনে ভীড় করে আসতে লাগল..........
**********************
অয়ন----- মুক্তি এই মুক্তি মুক্তি শুনতে পারছিস দেখ কি এনেছি ?
মুক্তি------ কি হল তখন থেকে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করছো কেন অয়নদা? কি...... মূল্যবান জিনিস এনেছ দেখি...!
অয়ন------ দামের দিক থেকে মূল্যবান হয়তো নয়! কিন্তু অন্যকিছুর দিক থেকে এর মূল্য অনেক বেশি....!
মুক্তি------- কি তখন থেকে হেয়ালি করছো, পরিস্কার করে বলোতো......!!! তোমার এই হেয়ালি আমি কিছু বুঝিনা...., সব মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়!!
অয়ন------- (হাসতে হাসতে বলে উঠল), বুঝবি কি..... করে তার জন্য বুদ্ধি লাগে, আর সেটা তো.... তোর নেই!!!! আর এই মাথার মধ্যে আছে রাশি রাশি গোবর ভরা, কতবার করে বললাম বিকেল বেলা করে আমার কাছে পড়তে বস, তাতে যদি তোর মাথা থেকে গোবর কিছুটা হলেও আমি পরিস্কার করতে পারি, কিন্তু তোর এই গোবর ভর্তি মাথা পছন্দ, তাহলে আর কি..... করব বল!!! আমার কিছুই করার নেই!!!
মোহন----- (পিছন থেকে আর একটা আওয়াজ ভেসে আসল,) একদম ঠিক কথা বলেছ অয়নদা....দিদির মাথাটা পুরো গোবরে ঠাসা।
মুক্তি------ একদম ভালো হচ্ছেনা কিন্তু অয়নদা! তুমি আমাকে এভাবে বলছো তো...., ঠিক আছে যাও....তোমার সাথে আমি আর কথা বলবোনা...., তুমি তোমার এই বুদ্ধিতে ভরা মাথা নিয়ে থাকো, আর ভাই তোকে আমি পরে দেখছি বাবা আসুক এমন নালিশ ঠুকবো যে.... একটা মারও বাইরে পরবেনা, সব পরবে তোর পিঠে।
মোহন------ (মুখ কালো করে বলে উঠল), এই দিদি..... দিদি... এই রকম বলিস না...., আমি না.... তোর একমাত্র ছোট্ট আদরের ভাই, তুই আমার সাথে এই রকম করতে পারিস!!! আমি আর বলবোনা...., আর তাছাড়া আমিতো কিছু বলিনি....,,, ঐ... অয়নদা বলল বলে.....
মুক্তি------ থাক আমার যা.... বোঝার বোঝা হয়ে গেছে, এখন আর কিছু বলে লাভ নেই!!! আর অয়নদা বলছে বলে তোকেও বলতে হবে, আমি তোর দিদি... সেটা ভুলে গেলে চলবে...!!
অয়ন------- (পাশ থেকে বলে উঠল,) ঠিক..... একেবারে খাঁটি কথা, সত্যি মোহন, মুক্তি তোর দিদি হয়, আমি যা.... খুশি ওকে বলতে পারি, তাই বলে তুই... বলবি!!! না.... না সেটা ঠিক নয়!!! তোর অন্যায় হয়েছে মস্ত বড় অন্যায়।
মুক্তি------ থাক এখন আর আমাকে কথার জালে ভোলানোর দরকার নেই, তবে অয়নদা তুমি আমাকে যা..... খুশী তাই বলতে পারো না....
অয়ন----- পারি....!!! আমি তোকে যা..... খুশি তাই বলতে পারি, আর বলবও... সেই অধিকার আমার আছে,
মুক্তি------- অধিকার...,...!!! কিসের অধিকারের কথা বলছো তুমি....???
অয়ন------ (গলার স্বর নামিয়ে বলে উঠল) ভালোবাসার।
মুক্তি----- কি বিড়বিড় করছো বলতো, অধিকার কিসের অধিকারের কথা বলছো তুমি......???
অয়ন------ সেই অধিকারের ব্যাপারটা তুই..... বুঝলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম, কিন্তু ঐ.... যে.... মাথার মধ্যে গোবর পোরা!!!!
মোহন---- হাসি আটকাতে না.... পেরে জোড়ে শব্দ করে হেসে উঠল।
মুক্তি----- ঠিক আছে ঠিক আছে আমাকে নিয়ে খুব হাসা হচ্ছে.... তো!!!! দাঁড়াও আমারও সময় আসবে, তখন আমি হাসব, আর ভাই তোর যে.... কি অবস্থা করব আমি, তুই ভেবেও কুল কিনারা পাবি না...।
মোহন----- গোবর.... গোবর... করতে করতে ছুটে পালালো
অয়ন------ (মুক্তির সামনে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে হাতটা সামনে এনে বলে উঠল) আর মুখ ফুলিয়ে রাখতে হবে না....., এই দেখ তোর জন্য নিয়ে আসলাম।
মুক্তি---- (আনন্দে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলে উঠল) ময়ূরের পালক কি..... সুন্দর দেখতে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, কোথা থেকে আনলে গো..... অয়নদা???? জানো আমার বান্ধবীরা বইয়ের ভাঁজে ময়ূর পালক দিয়ে রাখে, এই বার আমিও রাখব। আর ঠাম্মি বলতো বইয়ের মধ্যে ময়ূর পালক রাখলে সময়ের সাথে সাথে পালক বড়ো হয়।
অয়ন----- (হাসতে হাসতে বলে উঠল) এর... জন্য তোকে আমি মূর্খ বলি। পালক বইয়ের মধ্যে রাখলে বড়ো হয়!!! সত্যি তুই এই কথাটা বিশ্বাস করিস....। তুই আর বড়ো হলিনা ছোটই থেকে গেলি।
মুক্তি------ (গম্ভীর মুখে বলে উঠল) সেই.... আমিতো মূর্খ, আমার মাথায় গোবর পোরা, এইনাও তোমার ময়ূর পালক আমার চাইনা....., বুদ্ধিমান কাউকে পেলে দিও, আমাকে দিতে হবেনা.....!!! আমি চললাম..... চোখের জল ফেলতে ফেলতে ছুটে ঘরে চলে গেল।
অয়ন------ পিছন থেকে চিৎকার করে..... উঠল, এই মুক্তি.... মুক্তি.... দাঁড়া, আমার পুরো কথাটা শোন, উফ্.... রাগ করিসনা, আমি মন থেকে বলিনি..... তোকে রাগাচ্ছিলাম বিশ্বাস কর।
কিন্তু অয়নের কথা আর মুক্তির কান অবধি পৌঁছালনা। অয়ন নিজেই নিজেকে বলে উঠল সত্যি দিলিতো মুক্তিকে কাঁদিয়ে কত খুশি হয়েছিল ময়ূর পালক পেয়ে ধূর........
*********************
ভো....কাট্টা...... চিৎকারের মুক্তি দেবী আবার বাস্তবে ফিরে এলেন এবং ময়ূর পালকটা রেখে আবার বাক্সর দিকে চেয়ে রইলেন। এবং যত্ন সহকারে তুলে নিলেন হাতে একটা কাগজের মোড়ক এবং সেটা খোলার সাথে সাথে নাকে এসে লাগল শুকিয়ে যাওয়া ফুলের গন্ধ। মুক্তি দেবীর চোখের কোনে জমা জলটা আর বাঁধ মানলো না....., টপটপ করে পড়ল শুকনো ফুলের মালার ওপর। মুক্তি দেবী আলতো হাতে মালাটাতে হাত বুলিয়ে আবার হারিয়ে যেতে লাগলেন ফেলে আসা অতীতের স্মৃতির বাঁকে...........
*******************
সরস্বতী পূজো তাই পাড়ার মন্ডপ সেজে উঠেছে। কচিকাচারা দল করে ভীড় করেছে। তাদের আনন্দ, চিৎকার, হই... হুল্লোড়ে চারিদিক গমগম করছে। সবাই বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে সেজে উঠেছে। এত আনন্দের মধ্যেও মুক্তির মনে মন খারাপের কালো মেঘ বাসা বেঁধেছে।
মুক্তি----- অয়নদা সত্যি তুমি চলে যাচ্ছ দূরে.....!!! থাকতে পারবে সবাই কে.... ছেড়ে??? তোমার কষ্ট হবে না....??
অয়ন------ কষ্টতো হবে.... মুক্তি, কিন্তু কিছু করার নেই!!! নিজের পায়ে যে... দাঁড়াতে হবে, আর এটা আমার জীবনে প্রথম সুযোগ তাই হাতছাড়া করতে চাইনা। দুটো বছরেরতো ব্যাপার দেখতে দেখতে কেটে যাবে, তারপর ঠিক চলে আসবো আর দূরে যাব না....!!
মুক্তি---- দুটো বছর অনেক অয়নদা, জ্যেঠিমার কি.... হবে???? একা একা এত বড় বাড়িতে থাকতে পারবে...!!!
অয়ন---- কি আর করা যাবে বল তুই থাকলি তো.... কাছে, মাকে দেখে রাখতে পারবিনা!!! আর মা.... তো এত বছর ধরে, এত কষ্ট করে আমাকে বড় করল এই দিনটা দেখার জন্য আমি একজন সফল মানুষ হবো, আর আজ যখন সেই সুযোগ এসেছে, আমাকে যে..... মায়ের স্বপ্ন পূরন করতেই হবে।
মুক্তি---- আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব জ্যেঠিমাকে দেখে রাখার। আমার খুব কষ্ট হবে অয়নদা......!!!
অয়ন----- কেন কষ্ট হবে তোর....!!! আমিতো তোর কেউ হইনা....!!! তাছাড়া আমি না... থাকলে তোর পিছনে কেউ লাগবে না...., তোকে কেউ রাগাবেনা, তাহলে কাঁদছিস কেন...???আনন্দ কর।
মুক্তি----- সেই.... তুমি তো... এই রকম কথাই বলবে!!! তুমি আর কি.... বুঝবে!!! এখনতো মনে হচ্ছে আমার, তোমার মাথাটা বিজ্ঞানে ভরে গেছে, তাই সেখানে আর কোনকিছু ঢোকার জায়গা নেই...!!!
অয়ন---- কেন কি... ঢুকবে আমার মাথায়???? সেটাই তো.... বুঝতে পারছিনা...???
মুক্তি---- (অভিমানের সুরে) ও... তোমাকে বুঝতেও হবেনা!!! আমি চললাম থাকো... তুমি তোমার বিজ্ঞান নিয়ে।
অয়ন----- (মুক্তির হাতটা শক্ত করে ধরে ) চললাম বলেই চলে যাওয়া যায় বুঝি!!! যায় না....!! আর তাছাড়া আমার অনুমতি ছাড়া তুই কোথাও যেতে পারবি না...। একটু আমার সাথে এদিকে আয় দরকার আছে।
মুক্তি----- (নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে) যাবো না.... আমি, তোমার কোনো কথা শুনবো না....!!
অয়ন----- (মুক্তির ঠোঁটের ওপর নিজের আঙ্গুল রাখে মুক্তি চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অয়ন মুক্তির হাত ধরে মন্ডপের পিছনে নিয়ে যায়।)
মুক্তি---- (রাগী স্বরে) এখানে কেন... নিয়ে আসলে আমাক অয়নদা....??? অঞ্জলি দেবেনা... চলো....
অয়ন----- অঞ্জলি দেব একসাথে, তার আগে একটা কাজ বাকি আছে, সেটা সেরে নিই,আর তুই.... একটু চুপ করে দাঁড়া, বেশি কথা বলিস না...। এত বকবক করিস,আমার মাথা ধরে যায়। তোর মুখ ব্যাথা হয়না.... তাই না.. রে!!!
মুক্তি----- (ঠোঁট ফুলিয়ে) এতই... যখন আমি তোমার মাথা ব্যাথার কারন, তাহলে আমাকে ছাড়ো, যেতে দাও!!! নিজেই আমার ওপর জোড় দেখাবে, আবার নিজেই কথা শোনাবে।
অয়ন মুক্তির এলোমেলো চুলো গুলোকে যত্ন সহকারে এক সাইডে নিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ অয়নের এই রকম আচরনে মুক্তি অবাক হয়ে চেয়ে আছে অয়নের দিকে, কি...বলবে বুঝতে পারছেনা...!!! অয়নের আলতো ভাবে ছুয়ে যাওয়া প্রতিটি আঙ্গুলের স্পর্শ, মুক্তির হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
মুক্তি--- (অস্ফুট স্বরে বলে উঠল) অয়নদা.......
অয়ন------ (মুক্তির কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে বলে উঠল) ইসসসস.... একদম চুপ একটাও কথা নয়...!!! তারপর নিজের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ফুলের মালা বার করে যত্ন সহকারে মুক্তির চুলে লাগিয়ে দিল। এবং মুক্তির চোখে চোখ রেখে বলল, এইবার সাজ পূর্ণ হল আমার বসন্ত প্রিয়ার। আর আমি সব বুঝি মুক্তি। সব সময় সবকিছু মুখে বলতে হয়না....!!! কিছু কিছু অনুভূতি মনের গোপন কথাগুলো নিজে থেকেই জানান দিয়ে যায় । আমারও খুব... কষ্ট হবে, কিন্তু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না... করে যে... আমি তোকে চাইতে পারবোনা কাকুর কাছ থেকে। এমনিতেও আমাদের মধ্যে একটা উঁচ নিচের পার্থক্য আছে। তাই একটু কষ্টতো আমাদের সহ্য করতে হবে মুক্তি। যাতে সারা জীবন আমরা একসাথে থাকতে পারি। আর বিরহে ভালোবাসার গভীরতা বাড়ে।
মুক্তি----- (অস্ফুট স্বরে বলে উঠল) অয়নদা.......
অয়ন----- (মুক্তির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে উঠল) অয়নদা... না... শুধু অয়ন। আমি আমার বসন্ত প্রিয়ার মুখ থেকে দাদা ডাক শুনতে চাইনা, অনেকদিন ধরে শুনে আসছি আর না... এবার থেকে শুধু অয়ন মনে থাকবে।
মুক্তি---- (লজ্জা রাঙ্গা মুখে বলে উঠেছিল) থাকবে।
অয়ন----- (মুক্তির হাত ধরে বলে উঠেছিল) চল... অঞ্জলি দেব একসাথে।
মুক্তি অয়ন একসাথে অঞ্জলি দিয়ে মা...সরস্বতীর কাছে প্রার্থনা করেছিল একে অপরের জন্য।
***********************
মুক্তি দেবীর স্মৃতির তাল কেটে যায় একটা আওয়াজে
---------- ও..... পিমনি তুমি এখানে বসে কি করছ। আর এগুলো কি গো..... নিচে একজন লোক এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে!!!
---------মুক্তি দেবী সবকিছু যত্ন সহকারে কাঠের বাক্সে ভরে বলে উঠলেন মূল্যবান কিছু উপহার সাঁজি সুন্দরী, তা.... কে... এসেছে শুনি???
---------সাঁজি বলে উঠল আমি চিনি না....!!! বাপি তোমাকে ডাকতে বলল. তাই আসলাম। তা..... আমাকে দেখাও তোমার সেই মূল্যবান উপহার, তা... কে.... দিয়েছিল তোমায় এই.... উপহার বয়ফ্রেন্ড..???
-----------মুক্তি দেবী বলে উঠলেন, তুই... দেখে কি... করবি তোর কাছে এগুলোর কোন মূল্য নেই মনে হবে অাবর্জনা!!!
-----------সাঁজি আদুরে কন্ঠে বলে উঠল, ওহ.... পিমনি দেখাও না... আমি দেখব...
--------পিছন থেকে মোহন বাবু বলে উঠলেন সাঁজি তুমি এখন এখান থেকে যাও, দিদির সাথে আমার কিছু দরকারি কথা আছে।
--------সাঁজি বলে উঠল, আমি এখন চললাম কিন্তু... পরে এসে সব দেখবো।
----------মুক্তি দেবী হেসে বলে উঠলেন, পাগলি মেয়ে একটা, তা.... কে.. এসেছে আমার সাথে দেখা করতে ভাই???
------মোহন বাবু বলে উঠলেন, অয়নদা....
-----------মুক্তি দেবী নামটা শুনে দু... পা... পিছিয়ে গিয়ে বলে উঠলেন কেন?????
-------মোহন বাবু বলে উঠলন, কারন আমি ডেকেছি, দিদি মানুষটা আর কতদিন অপেক্ষা করবে তোর জন্য, মানছি মা.... বাবার কথা রাখতে তুই সেইদিন অয়নদাকে ফিরিয়ে দিয়ে ছিলিস, কিন্তু আজ তো.... মা, বাবা আর কেউ নেই, তাছাড়া মা... শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত অনুশোচনার আগুনে পুড়ে মরেছে, সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করা যায় না... দি.....!!!
--------মুক্তি দেবী বলে উঠলেন, এখন এই বয়সে এসে আর নতুন করে কি... শুরু করব বলতো, যে.... দিন চলে গেছে সে... তো আর আসবে না....!!!
---------মোহন বাবু বলে উঠলেন, দেখ অয়নদাকে আমি ডেকে এনেছি, এইবার তুই আর মানুষটাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিসনা...। অয়নদার কথা একবার ভাব, তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে জীবনের পঞ্চাশটা বছর কাটিয়ে দিল, আর কত অপেক্ষা করাবি তুই অয়নদাকে, এইবার যদি তুই অয়নদার সাথে নতুন করে জীবন শুরু না.... করিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি.....!!!
---------মুক্তি দেবী চিৎকার করে বলে উঠলেন, কি.... বলছিস ভাই তুই এসব, আর এখন এই বয়সে এসে লোক হাসিয়ে কি... লাভ।
----------মোহন বাবু, মুক্তি দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে হাতদুটো ধরে বলে উঠলেন, লোকের কথা ভাবছিস তুই...., আর যে... মানুষটা তোকে এত ভালোবাসে, তার কথা ভাববিনা...., আর সব থেকে বড় কথা এই বয়সে এসে মানুষটা পুরো একা হয়ে গেছে, কে.... দেখবে মানুষটাকে শরীর খারাপ হলে? সেই দিন আমি কিছু করতে পারিনি, মা... বাবার মুখের ওপর বলতে পারিনি জাত, পাত, উঁচ, নিচ, বিচার করে কি.... হবে!!! ভালোবাসা সব কিছুর উর্দ্ধে। বাবার অদম্য জেদের কাছে তোদের বিয়েটা সেদিন হয়নি ঠিকই!!! কিন্তু তোদের ভালোবাসা হেরে যায়নি। তুইও জেদ করে তোর জীবনে অয়নদার জায়গাটা ধরে রাখলি কাউকে দিলিনা। আমার কথা শোন দি.... এইবার নতুন করে তোরা আবার একসাথে চলা শুরু কর।
---------মুক্তি দেবী বলে উঠলেন, তা.... আর হয়না ভাই... অনেক দেরি হয়েগেছে....!!
-----------পিছন থেকে আওয়াজ আসল কেন হয়না মুক্তি???? আমাদের বয়স হয়েছে বলে???? ভালোবাসার কখনও বয়স হয়না। জীবনের অর্ধেক অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে সমাজ আর লোকজন, জাত পাতের কথা ভেবে, বাকি অধ্যায় টুকু না.... হয় নিজেদের কথা ভেবে নতুন করে শুরু করি আমরা। সেই দিন চাইলে সবকিছু ছেড়ে আমরা আমাদের জীবন শুরু করতে পারতাম, কিন্তু সবাইকে কষ্ট দিয়ে আমরা সেটা করতে চাইনি!!! তাই অপেক্ষা করে গেছি, কিন্তু আজ তো... কেউ কষ্ট পাবে না... আমাদের এক হওয়া নিয়ে তাহলে!!!
-----------মোহন বাবু, বলে উঠলেন প্লিজ দি.... আর না করিস না....
--------অয়ন বাবু মুক্তি দেবীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, চলো.... পাল্টাই এই সমাজের পুরনো চিন্তা ধারাকে একসাথে মিলে। সৃষ্টি করি ভালোবাসার এক অনন্য কাহিনী।
----------মুক্তি দেবী অয়ন বাবুর হাতের মধ্যে হাত রাখলেন। পাশ থেকে মোহন বাবু বলে উঠলেন দির মাথা থেকে কিছুটা গোবর পরিস্কার হয়েছে মনে হচ্ছে অয়নদা!!!!
----------অয়ন বাবু হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, হ্যাঁ....., আর বাকিটা আমি দায়িত্ব সহকারে পরিস্কার করে দেব।
--------মুক্তি দেবী ঠোঁটে ফুলিয়ে বলে উঠলেন, ভালো হচ্ছেনা কিন্তু। তিনজন মিলে একসাথে হেসে উঠল। আর বাইরে থেকে তখন একসাথে সবার চিৎকার ভেসে আসলো, ভো...কাট্টা....... আমরা জিতে গেছি।
*********************
----------সাঁজি বলে উঠল, ওহ্...... পিমনি তোমাকে কি..... সুন্দর লাগছে দেখতে। আজকে পিসোর চোখ ধাঁধিয়ে যাবে তোমার রূপের ছটায়।
---------মুক্তি দেবী লজ্জায় আবির রাঙা হয়ে উঠলেন।
---------সাঁজি মুক্তি দেবীর থুঁতনিতে হাত দিয়ে বলে উঠল ও..... আমার লজ্জাবতী লতা, আর লজ্জা পেতে হবেনা। আচ্ছা ঐ..... মূল্যবান উপহার গুলো তোমাকে পিসো দিয়েছিল তাইনা!!! সত্যি দাদু ঠাম্মির ভুলের জন্য তোমাদের জীবনের কতগুলো দিন নষ্ট হয়ে গেল। আমি সব শুনেছি পিসোর মুখে, আই লাভ পিসো।
পিছন থেকে একটা খুকখুকে কাশির আওয়াজ আসল। সাঁজি সাথে সাথে পিছন ঘুরে দেখল দরজার কাছে অয়ন বাবু দাঁড়িয়ে আছে। সাঁজি ঝটফট উঠে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে অয়ন বাবুর হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভিতরে নিয়ে এসে মুক্তি দেবীর পাশে বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল.........
----------ওহ্..... তোমাকেও তো হিরো হিরো লাগছে পিসো। সাঁজি দুইহাত মাথার দুইসাইডে রেখে হাসতে হাসতে বলে উঠল ওয়ে... হোয়ে... আমার হীর-রাঞ্ঝা জোড়িকো.... কিসি কি... নজর না...লাগে।
---------মুক্তি দেবী সাঁজির কান ধরে বলে উঠলেন, খুব পেকেছিস, পিমনির সাথে ইর্য়াকি করা হচ্ছে।
-------সাঁজি আআআআ করে চিৎকার করে বলে উঠল পিসো বাঁচাও।
---------অয়ন বাবু মুক্তি দেবীর হাত থেকে সাঁজিকে ছাড়িয়ে বলে উঠলেন, ওহ.... মুক্তি সাঁজি এখন আমাদের বন্ধু। আমরা এখন একটা টিম।
----------সাঁজি অয়ন বাবুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ইউ... আর... গ্রেট... পিসো। তা.... কি স্পেশাল গিফট দেওয়া হবে, স্পেশাল নাইটে পিমনি কে...।
---------অয়ন বাবু বলে উঠলেন, এখন বললে তোমার পিমনি জেনে যাবে, ওটা সারপ্রাইজ। কাল সকালে না.... হয় তোমাকে বলব।
-------সাঁজি বলে উঠল ওকে ডান..., আমি তাহলে এখন আসি, গুড... নাইট।
অয়ন বাবু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মুক্তি দেবীর দিকে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে হাতে শাঁখা পলা মাথা ভর্তি সিঁদুর সেই সরস্বতী পূজোর দিনের মতই লাগছে যেন।
-------মুক্তি দেবী বলে উঠলেন, ঐ.... ভাবে কি.... দেখছো???
--------অয়ন বাবু বলে উঠলেন তোমাকে!!!
--------মুক্তি দেবী বলে উঠলেন, দেখছো কতটা বুড়ি হয়েছি বয়সের সাথে??
---------অয়ন বাবু মুক্তি দেবীর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে বলে উঠলেন, আমার চোখে তুমি সেই একই আছো আমার বসন্ত প্রিয়া। অয়ন বাবু নিজের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফুলের মালা বার করে মুক্তিদেবীর খোঁপায় সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন। মুক্তি দেবী নিজের মাথাটা অয়ন বাবুর বুকে রাখলেন। অয়ন বাবু মুক্তি দেবীকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন। চারিদিক জুড়ে নীরবতা ছেয়ে আছে, চোখ বন্ধ করে দু...জন ভালোবাসার মানুষ দুজনের ভালোবাসার অনুভূতি কে.... উপলব্ধি করছে। যে ভালোবাসা এত দিন ধরে বিরহ আর বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে তবেই পূর্নতা এবং স্বীকৃতি পেয়েছে।