শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics

4  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics

উমার জীবনযুদ্ধ

উমার জীবনযুদ্ধ

4 mins
469



সকাল থেকে আকাশ ঘন কালো মেঘের চাদরে ঢাকা, আর বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা অঝোর ধারায় ঝড়ে পরছে মাটির বুকে। আকাশের বুক ভেদ করে থেকে থেকে জ্বলে উঠছে তীব্র আলোর ঝলকানি, আর তারসাথে গর্জন। ছোট্ট ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘরের এক কোনে বসে আছে উমা। শতছিদ্র হয়ে যাওয়া ঘরের ছাউনির দিকে তাকিয়ে আছে শূন‍্য দৃষ্টিতে। ঘরের চারিদিকে জল পড়ছে, কোনক্রমে এক কোনে কোলের সন্তানকে আগলে বসে আছে উমা।

অর্ধেক ভিছে গেছে সে... নিজেও, কিন্তু ছেলেকে ভিজতে দেওয়া যাবে না...!!! এমনিতেই তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছে, এরপর ভিজলে আর রক্ষে নেই। এখনো উনুনে আগুন দিতে পারিনি!!কোথায় ছেলেকে শোয়াবে সেটাই ভাবছে। উমার স্বামী বিশু সকালে বৃষ্টি মাথায় করেই গেছে কাজে।

------যাওয়ার আগে উমা বলেছিল, আজকে কি... এই দুর্যোগের মাথায় যাওয়া.. খুব দরকার.. ছেলো???

----বিশু বলেছিল না... গেলে কেমনে চলবে বৌ...??? যেতে তো হবেই!!!

উমা চুপ করে গিয়ে ছিল কারন এর কোনো উত্তর নেই..!! সত‍্যি কাজে তো... যেতেই হবে!!! না... হলে চলবে কি করে সংসার??? উমার চোখটা জলে ঝাপসা হয়ে আসে, আজ ওদের এই রকম অবস্থা তার জন‍্য কাকেই বা দায়ি করবে। দায়ি করার উপায় নেই...!!

প্রকৃতিক দূর্যোগ এবং ঝড়ের কবলে পড়ে যেটুকু সহায় সম্বল ছিল সেটুকু চোখের সামনে গঙ্গা বক্ষে ভেসে যেতে দেখেছিল উমা আর বিশু, কোন ক্রমে নিজেদের প্রান বাঁচিয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিল একটা স্কুলে, উমা তখন আট মাসের পোয়াতি। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়াবে ভেবেছিল উমা আর বিশু, কিন্তু সেটাও হলো না...!!! বিশুর একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল বাসস্ট্যান্ডের কাছে, ভালোই বেচা কেনা হতো, কিন্তু হঠাৎ করে রাস্তা বড়ো করার জন‍্য সরকার থেকে সেই দোকান ভেঙ্গে দিল, একেবারে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছিল বিশু আর উমা।

সমস্ত খারাপের সাথে সাথে একটা ভালো হয়েছিল ওদের জীবনে, উমার কোল আলো করে এলো এক পুত্র সন্তান। উমা আর বিশু ওর নাম দিল আকাশ। কারন তখন ওদের জীবনে মাথার ওপর শূন‍্য.... আকাশ, আর পায়ের তলায় মাটি ছাড়া কিছুই নেই!!!! বিশু একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। তবে উমা এবং ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হকারি শুরু করেছিল। ট্রেনে ট্রেনে চা বিক্রি করতো, ভোরের ট্রেনে যেত আর দুপুরে কোনদিন রাত্রে ফিরত। কোনরকমে খরের ছাউনি বিছিয়ে একটা ঘর তৈরি করেছিল মাথা গোঁজার জন‍্য, কিন্তু তিনটে বর্ষা সহ‍্য করার পর সেও আজ আর নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে পারছেনা।

বৃষ্টিটা একটু খানি থেমেছে ছেলেকে ঘরের এক কোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে দিয়ে উমা কাদা জল পেড়িয়ে এল উনুনের কাছে, কতগুলো আধভেজা কাঠ জ্বালিয়ে একমুঠো চাল আর আলু দিয়ে চাপিয়ে দিল কিন্তু কাঠ আর জ্বলছে না... শুধুই ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। আর উমা ফুঁ দিয়ে দিয়ে নাকের জলে চোখের জ্বলে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। বেশ কিছুক্ষন যুদ্ধ করার পর শেষে ভাত নামাল উমা, ছেলের গা গামছা দিয়ে মুছিয়ে গরম গরম ফ‍্যানা ভাত খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল বিশুর ফেরার।

ছেলের জ্বরের ওষুধ কেনার ক্ষমতাও ছিলনা উমার। সেদিন গ্রামে কোন শহরের এনজিও থেকে দিদিরা এসেছিল তারাই ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে গেছিল। উমার কাছে সেদিন ঐ দিদিরাই ছিল ভগবান।

দিন গড়িয়ে সন্ধ‍্যা নেমে আসল তার সাথে বৃষ্টির বেগ এবং গর্জন বেড়ে চলল সমান তালে। উমা এখনও অপেক্ষায় আছে বিশুর ফেরার। বিশু এখনও ফেরেনি। উমা চিন্তায় ছটফট করছে কিন্তু ছেলেকে রেখে একটু এগিয়ে গিয়েও দেখতে পারছেনা। উমা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। সন্ধ‍্যা পেড়িয়ে রাত নেমে আসল প্রকৃতির বুকে, কিন্তু বিশু ঘরে ফিরলনা!!! সারাদিনের ক্লান্তি শেষে উমার চোখ একটু লেগে এসেছিল হঠাৎ উমা দেখতে পেল.....

"বিশু হাসি হাসি মুখে একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের বুকে, আর বলছে...., ভালো থাকিস বৌ...., ভালো থাকিস...!! আমি চল্লুম। আমি যে... মুক্তি পেয়গেছি দেহের খাঁচা থেকে"

উমার ঘুমের ঘোর কেটে গেল বুকটা ছ‍্যাৎ করে উঠল ভয়ে, উমা ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে ভগবানকে শরন করতে লাগল, ঠিক সেই সময় কিছু পুলিশ এবং গ্রামের লোক হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়াল উঠানে, উমা দুরু দুরু বুকে বলল.....কাকে চাই????

পুলিশের লোকগুলি বলল আজ সন্ধ‍্যের সময় এক ট্রেন থেকে আর এক চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে একটি হকার কাটা পড়েছে, তার ব‍্যাগ থেকে এইখানকার ঠিকানা পাওয়া গেছে, তাই খবরটা দিয়ে গেলাম।

উমা ধপ করে বসে পড়ল। উনুনে তখনও ভাতের হাঁড়িটা বসানো। উমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসল জলে আর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ‍্য.........

"বিশু হাসি হাসি মুখে একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের বুকে, আর বলছে..., ভালো থাকিস বৌ..., ভালো থাকিস... আমি চল্লুম। আমি যে... মুক্তি পেয়গেছি দেহের খাঁচা থেকে"।

শুরু হলো উমার আর এক নতুন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই। নিজের অস্তিত্ব কে... বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিতে লাগল উমাকে। উমা চিৎকার করে কেঁদে উঠল, সাথে সাথে তীব্র আলোর ছটায় দূরে কোথাও বাজ পড়ল। উমার কষ্টে বর্ষনমুখর প্রক‍ৃতিও যেন নিজেকে সামিল করে নিল।

................সমাপ্ত.............


✍শিপ্রা চক্রবর্তী



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy