নোনা জল....
নোনা জল....
প্রকৃতি আজ কোনো কারনে ভীষণ রুষ্ট হয়েছে তাই আকাশ আজ ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে। তীব্র বেগে মাটির বুকে ঝড়ে পড়ছে অজস্র বারিধারা, তার সাথে ক্ষনিকের ব্যবধানে তীব্র আলোর ঝলকানি দিয়ে গর্জে উঠছে মেঘ।মুর্হু মুর্হু এই রকম তীব্র মেঘের গর্জনে মানুষ থেকে শুরু করে পশুপাখি গাছাপালার হাড়হীম করা অবস্থা। কতক্ষনে যে..... এই ধ্বংসলীলা শেষ হবে তা... কেউ জানেনা!!! দোতলার চিলেকোঠার ঘরে আরামকেদারায় বসে বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে আসা জানালার কাঁচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌনক। বাইরের দৃশ্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না..... শুধু দেখা যাচ্ছে তীব্র ছাট, বারবার কাঁচের জানলায় এসে বাড়ী মাড়ছে, আর তার সাথে দমকা হাওয়া তাল দিচ্ছে। সৌনকের পাশে টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলে খুব ধিমে সুরে তখন গান বাজছে.......
"আশা.... ছিল........ভালোবাসা
ছিল....... আজ আশা......নেই
ভালোবাসা নেই....."
গানটা কতটা শুনছে সৌনক সেটা বোঝা মুশকিল, কারন সৌনকের মন তখন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ফেলা আসা অতীতের গলিতে। সৌনকের চোখের সামনে বারবার ফুটে উঠছে একটা হাস্যেজ্বল মুখ, আর কাজল কালো টানা টানা হরিণের মতো চোখ, চঞ্চল ফিনিক্স পাখির মত এদিক থেকে ওদিক তার ছুটে বেড়ানো, তার পায়ের নূপুরের ছম ছম শব্দ, তার হাতের চুড়ির শব্দ, খিলখিল করে হাসির আওয়াজ আর তার আদুরে কন্ঠের ডাক সৌনক সৌনক....। হঠাৎ সেই ছবির পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ভেসে উঠছে কান্নাভেজা গলার স্বর, উদাসী চোখের দৃষ্টি, অবহেলা সহ্য করার তীব্র কষ্ট, আকাশের বুক চিরে তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে তার সাথে তীব্র গর্জনের আওয়াজ। সৌনকের চোখ ধাঁধিয়ে গেল তীব্র আলোর ছটায়। সৌনক চোখের পাতা ফেলল সাথে সাথে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল সৌনকের গাল বেয়ে। সৌনক হাত বাড়িয়ে মোবাইলের গানটা বন্ধ করল। এবং চিলেকোঠার ঘর থেকে নিচে নেমে আসতে লাগল।
সৌনকের কানে হঠাৎ করে বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল। সৌনক নিজের মনে বলে উঠল, এত দূর্যোগে বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ আসবে কোথা থেকে!!! নিজের মনের ভুল ভেবে সৌনক এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। ঘরের দরজাটা অল্প করে খুলে দেখল বনলতা দেবী ঘুমাচ্ছেন। যদিও এটা ওষুধের প্রভাবে। এখনতো সারাদিন শুয়েই কাটে। চলা, ফেরা, ওঠা, বসা, খাওয়া, দাওয়া সবকিছুর শক্তিই হারিয়েছেন হঠাৎ করেই সেরিব্রাল অ্যাটাকে। সৌনক ঘরের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে আসল। সাথে সাথে সৌনকের কানে আবার বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল। সৌনক এবার আওয়াজটাকে ঠিকমতো উপলব্ধি করে এগিয়ে যেতে লাগল বাইরের দরজার দিকে, এবং মনে মনে নিজেকে বলে উঠল, না... না.... একই শব্দ বারবার মনের ভুল হতে পারেনা!!! দেখতেই হবে এই বাচ্ছার কান্নার উৎস কোথা থেকে।
সৌনক ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলল সাথে সাথে দমকা হাওয়া এবং বৃষ্টির ছাট সৌনককে ছুঁয়ে গেল। বাইরে বেড়িয়ে সৌনক কান্নার আওয়াজটা আরও বেশি করে শুনতে পেল। সৌনক বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল গ্যারেজের দিকে। গ্যারেজের সামনে এসে সৌনকের পা.... আটকে গেল সামনের দৃশ্য দেখে, একটা বড় ধামার মধ্যে তোয়ালে মোড়ানো একটা সদ্যজাত শিশু। সৌনক অদ্ভুত ভাবে শুধু তাকিয়ে আছে সেইদিকে। সৌনক চারিদিকে ভালো করে চোখ বোলাতে লাগল, না.... কোথাও কারোর কোনো চিহ্ন নেই। সৌনক এগিয়ে গিয়ে বসে কোলে তুলে নিল ছোট্ট শিশুটিকে। নিরাপদ আশ্রয় এবং উষ্ণ পরশ পেয়ে শিশুটি চুপ করে গেল। সৌনক মনে মনে ভাবতে লাগল, কে.... ফেলে দিয়ে যেতে পারে এই সদ্যজাত শিশুটিকে এখানে!!! তার মনের মধ্যে কি... কোনো রকম কোনো মায়া দয়া নেই!! সন্তান হওয়ার পর তাকে যদি ফেলেই দিবি, তাহলে তাকে জন্ম দেওয়ার কি.... দরকার!!! সৌনক নিজেই নিজের মনের সাথে কথা বলে চলেছে। সৌনক আলতো ভাবে হাত রাখল শিশুটির মাথায়।
হঠাৎ সৌনকের চোখ গেল ধামার দিকে। ধামায় করা বিছানার ওপর দুধের বোতল এবং তারপাশে একটা লাল খাম জ্বলজ্বল করছে। সৌনক সময় নষ্ট না করে দুধের বোতলটা শিশুটার মুখে ধরে। এবং খামটা হাতে তুলে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে শিশুটি ঘুমের রাজ্যে ঢলে পড়ে। সৌনক লাল খামটা খুলে একটা চারভাঁজ করা সাদা কাগজ দেখতে পায়। এবং কাগজটা খোলার সাথে সাথে কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরের লেখা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এবং যে.... লেখা সৌনকের খুব চেনা। সৌনকের বুঝতে বাকি থাকেনা এটা ঈশার হাতে লেখা। সৌনক জোড়ে জোড়ে ডেকে ওঠে, ঈশা.... ঈশা.... প্লিজ বেরিয়ে এসো লুকিয়ে থেকোনা!!! আমি তোমার হাতের লেখা চিনতে পেরেছি, যদি কাছাকাছি তুমি লুকিয়ে থাকো, তাহলে প্লিজ.... ঈশা বেড়িয়ে এস। কিন্তু সৌনকের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার ফিরে আসলো। সৌনক কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কিছুক্ষন পর নিজেকে সামলে নিয়ে সৌনক চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।
************************
প্রিয় সৌনক.........,
যখন বা.... যেদিন তুমি এই চিঠিটা পড়বে, সেই দিন আমি আর থাকবোনা এই পৃথিবীতে!!! কিন্তু তাতে আমার কোনো দুঃখ বা.... কষ্ট থাকবেনা!! কারন আমি তার আগেই আমার শেষ কাজের দায়িত্ব একজনের হাতে তুলে দিয়েছি, এবং আমি জানি সে... আমার বলা কাজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমি আমার জীবনের শেষ সন্ধ্যিক্ষনে পৌঁছনোর আগে এ... চিঠিটা লিখে রাখছি তোমার জন্য, কারন আমি জানি আমি বাঁচবোনা!!! কিন্তু তবুও আমি আমাদের ভালোবাসার চিহ্নকে এই পৃথিবীর আলো দেখা থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি, তাই ডাক্তারের হাজার বারন সত্বেও আমি মা... হতে চলেছি। কথাটা শুনে খুব অবাক হচ্ছো তাইনা!!! হওয়ারই কথা, আমিও হয়েছিলাম, যখন জানতে পেরেছিলাম আমি মা... হতে চলেছি, কিন্তু সেই আনন্দের খবরটা তোমাকে দিতে পারিনি!!! অবশ্য এই কথাটা বললে ভুল হবে, বরং দিতে চাইনি!! কারন তখন তুমি আমার থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছো। তুমি আর তোমার মা... তখন নতুন কাউকে ঘরে আনার স্বপ্ন সাজাতে ব্যস্ত। আমি কোনদিনও ভাবতে পাড়িনি আমাদের এতদিনের সম্পর্ক বিয়ের পাঁচবছর পার হতে না.... হতেই এই রকম তিক্ত হয়ে উঠবে। প্রেমের আঘাত এইভাবে সব কিছু শেষ করে দেবে। পরে নিজেই... নিজের অবস্থার ওপর হেসেছিলাম, যে.... কারনের জন্য আমি তোমার বাড়ি ছাড়া, এবং তোমার হৃদয় কানন থেকে উৎপাটিত হলাম, সে.... তখন আমার ভীতরে একটু একটু করে বড় হচ্ছে আমার অজান্তেই।
যাক সে.... সব পুরনো কথা, আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথে আমাদের সন্তান তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। তাই তোমার কাছে একটাই অনুরোধ ওকে অাগলে রেখো। পৃথিবীর আলো দেখানোর দায়িত্ব আমার ছিল, আর বাকি জীবনের দায়িত্ব আমি তোমার ওপর দিয়ে গেলাম, আমার ভরসা, বিশ্বাস আর ভেঙে দিওনা। খুব যত্নে খুব ভালোবাসা দিয়ে ওকে বড় কোরো। অবহেলা কোরোনা আগলে রেখো। তোমাকে এ.... জীবনে আমার আর দেখা হলো না!!! আর তুমিও আমাকে দেখতে পাবেনা!! তাতে তোমার কি... কিছু যাবে আসবে, কে... জানে আসবে হয়তো!!! এখন তোমাকে বড্ড অচেনা লাগে, আমি যে.... সৌনককে চিনতাম সে.... যে হারিয়ে গেছে তাই আমিও হারিয়ে গেলাম তার জীবন থেকে। তবে আমার প্রতিচ্ছবি পাবে আমাদের সন্তানের মাঝে। ভালো থেকো সৌনক, আর আমাদের সন্তানকে আগলে রেখো, ভালো রেখো, মাএর যত্ন নিও।
ইতি
ঈশা।
************************
চিঠির প্রত্যেকটা অক্ষর ভিজে যেতে লাগল সৌনকের চোখের জলে। সৌনক শিশুটির কপালে আলতো ভাবে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াল। সৌনকের গাল বেয়ে ঝড়ে চলেছে নোনা জলধারা। বাইরে প্রকৃতিক দূর্যোগ তখন কেটে গেছে। তীব্র ঝড়, জলে প্রকৃতি এখন শীতল হয়ে উঠেছে। আকাশের বুকে হাল্কা মেঘের আড়ালে চাঁদ তার উজ্জ্বল মুখ মেলে ধরেছে। তবে মেঘ আর চাঁদের মধ্যে লুকোচুরি খেলা চলছে।
--------সৌনক ধীর পায়ে ঢুকলো ভীতরে, এবং বনলতা দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠল মা.......
বনলতা দেবী চোখ মেলে তাকিয়ে রইল, সৌনক বনলতা দেবীকে উঠিয়ে পিছনে বালিশ দিয়ে বসিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে বনলতা দেবীর কোলে শুয়ে দিলো ওদের সন্তানকে। বনলতা দেবী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন শিশুটার দিকে।
----------সৌনক কান্না ভেজা গলায় বলে উঠল, মা... ও তোমার নাতি। তোমার খুব শখ ছিল নাতির মুখ দেখার। তোমার শখ পূরন হয়েছে মা, দেখ তোমার নাতি তোমার কোলে শুয়ে আছে। আমার আর ঈশার সন্তান তোমার কোলে কিন্তু ঈশা আর নেই মা....!! ও... চলে গেছে না.... ফেরার দেশে আমাদের ছেড়ে। আমি জানতাম আমার ঈশা কোনদিন আর আমার কাছে ফিরবে না....!!! ও.... যে বড্ড অভিমানি ছিল মা...। কেন যে.... আমি ওর সাথে এই রকম ব্যাবহার করেছিলাম কে.. জানে??? সব আমার জন্য হয়েছে!!! সবকিছুর জন্য আমি দায়ি, ঠিকই হয়েছে আমার সাথে, এই রকম হওয়াই উচিত!! সৌনক আর কিছু বলতে পাড়লোনা, কথা গুলো দলাপাকিয়ে গলা রুদ্ধ করে দিয়েছে, শুধু বেড়িয়ে আসছে ফোঁপানি।
বনলতা দেবীও আপ্রান চেষ্টা করছেন কিছু কথা বলার কিন্তু বলতে পারছেনা, শুধু গোঁঙানির ক্ষীন আওয়াজ বেড়িয়ে আসছে, আর চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে চলেছে নোনা জল।

