Abanti Pal

Fantasy Others

4  

Abanti Pal

Fantasy Others

গবুদাদুর গুপ্ত গবেষণাগার

গবুদাদুর গুপ্ত গবেষণাগার

15 mins
419



গবুদাদু যখন নিরুদ্দেশ হলো, আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের পাশের গ্রামের শেষপ্রান্তে, যেখান থেকে শালবন শুরু হয়ে নিজের মধ্যে আড়াল করেছে বিদ্যাধরীর গতিপথ, ঠিক সেইখানে গবুদাদুর বাড়ি। সে এক পেল্লায় বড় বাড়ি। কত যুগ আগের যে ওই পুরোনো বাড়ি, তা আমরা কেউ ঠাহর করতে পারি না। গড়ন দেখে মনে হয়, এ বাড়ি নিশ্চয়ই ব্রিটিশ আমলে তৈরি। কিন্তু বহুদিনের অযত্নে তার আজ ভগ্নদশা উপস্থিত। চারদিকে আগাছা, বিশাল থাম ভেদ করে দেওয়াল বেয়ে উঠে এসেছে সহস্র লতানো গাছ-গাছালি। দোতলার বারান্দার একটা দিক ভেঙে ঢুকেছে অশ্বত্থ গাছের ডালপালা। চারদিকে পরিত্যক্ত বাড়ির চিন্হ বিস্তৃত। হুট করে দেখলে মনে হবে বুঝি বাড়ির চারপাশের জঙ্গলটা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে! 


শেষপ্রান্ত বলতে আমরা আমাদের স্কুলের ভূগোলের মাষ্টারমশাই, শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ ধরের বাড়িটাই ধর্তব্যের মধ্যে ফেলতাম। মাষ্টারমশায়ের বাড়ি ছাড়িয়ে আরো কিছু দূর গেলে তবে পড়ে গবুদাদুর বাড়ি। সে একেবারেই লোকালয়ের বাইরে। অতদূর আমরা যাবো, ওই জঙ্গলের আশেপাশে, এমন বুকের পাটা আমাদের কারুর ছিল না। তাই বাড়িটা দেখে আমরা দূর থেকেই কৌতূহল নিবারণ করতাম, ধারেকাছে যাওয়ার সাহস ছিল না। কিন্তু সবাই জানতাম এই কঙ্কালসার বাড়ির মধ্যেও গবুদাদু থাকে। কিভাবে যে থেকে, কেন যে সংস্কার না করিয়ে দিনের পর দিন ওই বাড়িতে থাকে, তা আমরা কেউ বলতে পারিনা। দূর থেকে এক দুই দিন দেখেছিলাম, কড়া আলোয় দেখা যায় জানলার ধারে গবুদাদুর সিলুয়েট। হাতে কিছু না কিছু যন্ত্রপাতি ধরা থাকত। বুঝতাম, ওই দোতলার বারান্দার উল্টোদিকের ঘরটা গবুদাদুর গবেষণাগার। ওহ, বলতেই ভুলে গেছি, গবুদাদুর আসল নাম কিন্তু শ্রীমান মণিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। এত জ্ঞানী গুণী গবেষক মানুষ হওয়ার কারণে, আমরা সবাই তাকে গবেষকদাদু বলে ডাকতাম। কবে যে সেটার অপভ্রংশ হয়ে গবুদাদু হয়ে গেল, কে জানে?


রাস্তাঘাটে কখনো-সখনো দূর থেকে আমরা দাদুকে দেখেছি। দেখেছি ওই বাড়ি থেকে বের হতে বা ঢুকতে, যন্ত্রপাতি নিয়ে। সাদা ধবধবে কোঁকড়ানো চুল মাথায়, চিবুকস্পর্শী লম্বা সাদা গোঁফদাঁড়ি আর সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত গুরুগম্ভীর মানুষটা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত, খানিকটা ভয় আর অনেকখানি শ্রদ্ধা মিশে আমাদের মাথা এমনিই ঝুঁকে যেত। অত বুদ্ধিদীপ্ত চোখের দিকে তাকাবে কার সাধ্য আছে? দাদু মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারত। এই যে, একটু দাদুর কাছে ঘেঁষতে চাই, রকমারি গবেষণার গল্প শুনতে চাই, দেশ-বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শুনতে চাই, আমার মস্তিষ্কের সেইসব সুপ্ত ইচ্ছা কেমনভাবে যেন পড়ে ফেলত। তাই না হলে কি আর সেদিন রাস্তায় আমাকে ডেকে বলত,

'নীরেন্দ্রনাথ, রোববার সক্কাল সক্কাল আমার বাড়িতে চলে আসিস তোর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে'


সাঙ্গপাঙ্গ বলতে খগেন, পুকাই, ভজা আর আমি। শালবনের ধারে ওই ভগ্ন বাড়িতে যাবো? তার চাইতে স্কুলের মাঠে অথবা রায়দিঘীর পাড়ে গল্পের আসর জমালে হয় না? তাতে আপত্তি থাকলে অন্তত শিবমন্দিরের পাশে বটতলায়? ঢোক গিলে আমতা আমতা করছি, ঠিক কি ভাবে কথাটা পাড়ব ভাবছি, তার মধ্যে পুকাই ফস করে বলে বসল


'নিশ্চয়ই যাব দাদু! নারাণ বলছিল, কতদিনের শখ তোমার বাড়িতে যাওয়ার' 

'ব্যাস, চলে আয় তবে' রহস্যময় হেসে এগিয়ে গেল গবুদাদু।


ওমনি আমি চোখ পাকিয়ে পুকাইকে বললাম,

'কি হলো এটা? আমার নাম করে বলার কি কোনো দরকার ছিল?'


'আহা, গবুদাদু তো তোকেই ডাকলেন, তাই তোর নামে বললে যে উনি খুশি হবেন, সেটা বুঝিস না?'


'ঢের বুঝেছি, এরপর রোববার এলে তোরা কেটে পড়বি জানি' নিশ্চিত কণ্ঠে বললাম আমি।


'সে কেন? আমাদের বুঝি দেখবার ইচ্ছে নেই?' ভজা বলল।


'তাহলে আগ বাড়িয়ে নিজেদের নাম বললেই পারতিস ' বলে হনহন করে পা চালিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম আমি।


ঢিপঢিপ বুকে রবিবারের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু রবিবার আসার আগেই খবর রাষ্ট্র হলো, গবুদাদু নিখোঁজ হয়েছে।


২ 


আমরা কিন্তু পিছুপা হলাম না। কথা দিয়েছি বলে কথা। দেখাই যাক না গবুদাদুর বাড়িতে গিয়ে, ব্যাপারটা কি। রবিবারের সকালে আমরা চার বন্ধু গিয়ে হাজির হলাম সেখানে। ইতিমধ্যে ছয়দিন পেরিয়ে গেছে, এখনো গবুদাদুর হদিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু যেরকম শোরগোল হবে বলে ভেবেছিলাম, গবুদাদুর বাড়ির আশেপাশে গিয়ে সেরকম কিছুই নজরে পড়ল না। দিব্যি একটা নির্ঝঞ্ঝাট, শান্তির সকাল এসেছে সেখানেও। কাছ থেকে দেখে মনে হলো, আগে যতটা অপরিচ্ছন্ন জংলা জায়গা লাগতো বাড়ির চারপাশটা, আসলে কিন্তু ততটাও নয়। গবুদাদু কি তাহলে বাড়িতেই আছে? স্কুলে কি তাহলে ন্যাপা আমাদের ভুল খবর দিল?


টপ করে বেড়া টপকে খগেন গিয়ে ঢুকলো বাড়ির সামনে, দেখাদেখি আমরাও। সামনের দরজায় গিয়ে বিস্তর ডাকাডাকি করেও যখন কারুর সাড়া পাওয়া গেল না, তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে ন্যাপার কথাই ঠিক। কিন্তু এতদূর যখন সাহস করে এসেছি, তখন একবার ভেতরে ঢুকবো না? কত কানাঘুষো শুনি এই শালবনের এদিকটা নিয়ে, ধারেকাছে না কি ভূত প্রেতেদের বাস, কি সব অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা হয়, তা অত বড় সুয্যিমামা আকাশে থাকতে আমরা কি একবার যাচাই করবো না? বাড়িটার ভেতরে একবার ঢুকে দেখল ক্ষতি কি? এতজন তো একসাথে আছি।


এই ভেবে আমরা চার বীর মনস্থির করলাম, বাড়ির ভেতরটা ঘুরে দেখা যাক। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সামনে পড়ল একটা বিরাট হলঘর। আমাদের আস্ত ফুটবল মাঠ এখানে ছোট পড়বে। মার্বেলের মেঝেতে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে। খুব যে ধুলোয় ভরা ভেতরটা, সেটা কিন্তু বলা চলে না। বরং বাইরের তুলনায় ভেতরটা দেখলে অনুমান করা যায় যে এখানে লোকজনের বসবাস আছে। হলঘর পেরিয়ে সামনে একটা লম্বা বারান্দা। সেদিকে এগোতে গিয়ে ভজা বিকট আওয়াজ করে উঠলো।


'কি রে ভজা? চিল্লালি কেন?' খগেনের প্রশ্ন। কাঁপা আঙ্গুল তুলে ভজা দেখাল বারান্দার ওপর প্রান্তে। মুখ দিয়ে ওর কথা সরছে না। দেখে আমরাও আঁতকে উঠলাম। ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ছাদ সমান উঁচু গবুদাদু! আলো আঁধারিতে কি অদ্ভুত রাক্ষুসে রূপ তার। কিন্তু একি, গবুদাদুর বৃহদাকৃতি মাথার ওপর থেকে একটা পায়রা উড়ে গেল যে, তবুও তার কোনো হেলদোল নেই! ডানা ঝটপট করে আরো দুটো পায়রা এসে বসলো সেখানে, তাও কোনো নড়নচড়ন নেই। এ কেমন রাক্ষস?

একটু সাহস করে পুকাই এগিয়ে গেল দুই পা। 

'আরে এটা তো ছবি!'


ওর কথায় আমরাও এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো, ছবিই বটে, দেওয়ালজোড়া এক ছবি, একেবারে জীবন্ত লাগছে! কিন্তু গবুদাদুর সাথে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও ছবিটা দাদুর নিজের নয়। মনে হচ্ছে দাদুর কোনো পূর্বপুরুষের।


'ওই দেখ, ওপরে ওঠার সিঁড়ি' আমি বললাম, 'যাবি দোতলায়? গবেষণাগার দেখতে হবে তো?'


কিন্তু অন্যরা দেখলাম সায় দিলো না। ছবি কন্ডের পর আর কি কি চমক অপেক্ষা করছে, সেটা জানার আগ্রহ কারুর নেই। কেউ রাজি হচ্ছে না দেখে আমি একাই দোতলায় যাব ঠিক করলাম।

ঘর অনুপাতে সিঁড়ি খুবই সরু, একজন একজন করে উঠতে হয়। আলো খুব কম এখানে। কিন্তু উঠেই আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। দোতলার অনেকটা অংশ ধসে পড়েছে। তবে ওই সামনের ঘরটায় ঢোকা যাবে, ভেবে যেই আমি সেখানে ঢুকলাম, ওমনি ভেবলে গেলাম।



ঘরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা আসবাব পর্যন্ত নেই। জানলাবিহীন স্যাঁতস্যাঁতে এই ঘরটায় একদম শেষ প্রান্তে শুধুমাত্র একটা পেল্লায় বড় কাঠের আলমারি। তার মস্ত দুই পাল্লায় খোদাই করা একটা আজব জীব। না সে গাছ, না সে মানুষ। দুইয়ের সংমিশ্রণে কিম্ভুত কিমাকার গাছ-মানুষ। ঠিক কেমনটা যদি উদাহরণ দিতে হয়, বলতে হবে ওপরের অংশটা মানুষের মুখ, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের মতন জিনিস ওপরের দিকে উড়ে ক্রমে লতা-পাতায় পরিণত হয়েছে, দুই দিকে দুই মোটা ডাল বেরিয়ে এসে প্রসারিত হয়েছে হাতের আঙ্গুলে, আঙ্গুল থেকে পাতার গুচ্ছে। শরীরটা একটা মোটা গাছের গুঁড়ির মতন। নিচের দিকে, যেখানে দুটো পা থাকার কথা, তার তলা থেকে ক্রমে শিকড়ে নেমে এসে মিশেছে মাটির ভেতরে। মাটিই বটে, কারণ এই অদ্ভুত জিনিসটার চারপাশে অজস্র গুল্ম খোদাই করা রয়েছে, তারও কিছু নীচে খোদাই হয়েছে মস্ত গাছের শিকড়টা।


ভারি কৌতূহল হলো আমার। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম আলমারিটার সামনে। নিখুঁত কারুকার্য করা আলমারির গায়ে রয়েছে একটা ব্রোঞ্জের হাতল। হাতল ধরে ঘোরাতে, এক ঝটকায় খুলে গেল আলমারির পাল্লা। লম্বায় আর প্রস্থে যত বড়, ভেতরে দৈর্ঘ্য কিন্তু মোটেই ততটা নয়। উপরন্তু ফ্যাটফ্যাটে ফাঁকা আলমারি। না কোনো তাক আছে আর না একটাও জিনিস। কিন্তু কান পাতলে ও কিসের শব্দ শোনা যায়? দুই কান হাত দিয়ে ঢাকলে যেমন নিজের মধ্যে থেকে একটা গভীর সমুদ্রের উথাল পাথাল আওয়াজ ভেসে উঠে আসে, তেমনই মনে হলো এই আলমারির গভীর থেকে কোনও আওয়াজ আসছে। কিন্তু আলমারি তো ওইটুকুই। এরকম আওয়াজের উৎস যে কি, সেটা অবশ্য বোঝার কোনো আগ্রহ আমার নেই। কৌতূহলবশত এই ঘরে ঢুকে অনেক্ষন সময় একলা কাটিয়েছি, এবার বেরিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। ভজারাও তো অপেক্ষা করছে নীচে। অতএব, আলমারির পাল্লা বন্ধ করে দরজার দিকে পা বাড়ালাম।


কিন্তু পরক্ষনেই স্থির হয়ে গেলাম। কার পায়ের আওয়াজ আসছে বারান্দা দিয়ে? কেউ এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকে, একেবারে দরজার বাইরে এসে থেমে গেল তার জুতোর আওয়াজ। মচমচ জুতোর আওয়াজে বেশ বুঝলাম সে যেই হোক, আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ নয়। কারণ আমরা সবাই ফটফট শব্দ তোলা হাওয়াই চটি পরে এসেছি। এই আগন্তুক তাহলে কে?



দরজাটার হাতল ততক্ষনে ঘুরতে শুরু করেছে। এভাবে নিরাপত্তাহীন দাঁড়িয়ে থাকা বড্ড বোকামি। পালানোর পথ একটাই, সেটা বন্ধ। কোথায় লুকাবো আমি? এদিক-সেদিক তাকিয়ে শেষ মুহূর্তে আলমারির পাল্লা খুলে তার ভেতরে ঢুকে পাল্লা বন্ধ করলাম।

বদ্ধ জায়গায় আমার বরাবরই হাসফাস লাগে, তাই বাধ্য হয়ে যখন আলমারিতে ঢুকেছিলাম, তখনই দুচোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আওয়াজটা এবারে মনে হলো আলমারির একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো। অগত্যা যতটা সম্ভব পিছিয়ে একটা ধারে সরে এলাম। তবুও পাল্লা যদি খোলে আগন্তুক, সামনেই পড়বো আমি। কি একটা ঠান্ডা মতন ঠেকলো আমার গায়ে, পাশ ফিরে দেখি আলমারির ধারটা কাঠের নয়।


একটা লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে অতল গহ্বরে! ওদিকে ক্যাঁচ করে আলমারির হাতল ঘুরেছে, দরদর করে ঘামছে আমি। পাল্লাটা সবে ফাঁক হতে শুরু করেছে, আর উপায় না পেয়ে আমি তাড়াহুড়ো করে নামতে লাগলাম নীচে। 


নামতে নামতে পাল্লা খোলার আওয়াজ তো পেলাম, কিন্তু কেউ বন্ধ তো করলো না? যাক গে, এই পুরোনো বাড়িতে যে একটা সাংঘাতিক আবিষ্কার করেছি, একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গপথ খুঁজে পেয়েছি, সেটা কি কম বড় ব্যাপার? ফিরে গিয়ে গ্রামে সব্বাইকে বলতে হবে। তাই নেমেই যখন পড়েছি, যা থাকে কপালে, এই ভেবে এক বুক সাহস নিয়ে নামতে থাকলাম আরও। দেখাই যাক না, এর শেষ হয় কোথায়?


কিছুক্ষন নামার পরে, পায়ের তলায় মাটি ঠেকলো। একটা নরম সবুজ আলো দেখা যাচ্ছে। তাড়াহুড়োয় এতক্ষণ যেটা খেয়াল করিনি, হুট করেই সেটা কানে আসলো। সেই সমুদ্রের ঢেউয়ের উথাল পাথাল আওয়াজ। সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে কিন্তু কিছুই নেই, শুধু মাটি খুঁড়ে একটা সরু পথ এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে এগোনো যায়। এবারে সাহসটা একটু কমে গেল আমার। না জানি কি আছে ঐ দিকে। তরতর করে একটা আলমারির ভেতরে এতটা আসা কি ঠিক হয়েছে? ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি অন্ধকার, কিছুই যে বোঝা যায় না। ঢোক গিলে সামনের দিকে ঝুঁকে হামা দিই বরং।


মাটি হাতড়ে সামনের দিকে এগিয়ে দেখি, আরে, একটা বিশাল বড় ঘর যে! শুধু ঘর কি? ঘরের মধ্যে একটা বাগান। কত গাছপালা সেখানে, ছোট বড় মাঝারি। কোনোটারই নাম জানা নেই আমার, সবই কেমন জানি অচেনা উদ্ভট আকৃতির। ছাদ যে কত উঁচুতে বোঝা দায়। সেখান থেকেই আসছে সবুজ আলো। এই সব গাছগুলোর পাতা নড়ছে যেমন ঝোড়ো হওয়া দিলে নড়ে, অথচ কোনো হওয়া নেই কোথাও। সো-সো করে গভীর মাটির তল থেকে যে ওরা জল টানছে, সেটারই আওয়াজে মনে হচ্ছে এটা। ঘরের মধ্যে এতগুলো গাছের সমাগমে এসে পড়ায়, মনে হলো ওদের সব ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে গেল। গাছেরা কি শুনতে পেল, বুঝতে পারল আমার উপস্থিতি? সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা গাছ একটু ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখি, আরে, এর ডালপালা কেমন খসখসে। হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে পিলে চমকে উঠলাম! গাছটা একটা আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল দুই পা। 


ঘাবড়ে গিয়ে এক লাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে যাবো, কিন্তু এ কি কান্ড... ইতিমধ্যে যে গাছেরা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে! এরা গুঁড়ি ঘষে এগোতে পারে, বুঝি মাটির তলে জলের মধ্যে ভেসে এগোচ্ছে, এমন ভাবে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ডালপালাগুলো শেষ হয়েছে আঙ্গুলে, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া পাতা-গুচ্ছের তলাটা খানিক মুখের মতন দেখতে। আর, ও কি? ওই তো দুটো চোখ! এরা তো সেই বস্তু যেটা আলমারির গায়ে খোদাই করা আছে, সেই গাছ-মানুষ! এসব কিম্ভুত উদ্ভিদ যে বাস্তব হতে পারে, সে তো আমার কল্পনার বাইরে। আমার পা মাটিতে সেঁটে যাওয়ার জোগাড়, হাত পা যাচ্ছে অবশ হয়ে। কোথায় যে এসে পড়লাম, কেন যে আগ বাড়িয়ে এলাম... বেজায় ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম


'গবুদাদু তুমি কোথায়? বাঁচাও গবুদাদু বাঁচাও...'


আর ওমনি একটা চমৎকার ঘটে গেল!



পেছন থেকে কে একটা এগিয়ে এসে আমার মাথায় এক গাট্টা দিল! পরিষ্কার মানুষের ভাষায় গলা খাঁকরে বলল


'এত চেল্লাও কেন হে নারাণ? দেখতে পাচ্ছ না এখানে দরকারি কাজ হচ্ছে?'


'গবুদাদু তুমি?' বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম গবুদাদু আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখের তলায় কালি পড়েছে, রুক্ষ চেহারা। 

'তোমার এ কি দুরবস্থা? কেমন করে হলো? দাঁড়াও আমি এখনই ডাক্তার ডেকে আনি' সব ভুলে আমি অনর্গল বলে চললাম। 


'আরে দাঁড়াও, যাবে কোথা?' পথ রোধ করে দাঁড়ালো আরেকটা গাছ, মানে ওই গাছ-মানুষ। এরা কথাও বলতে পারে? আমি ভেবলে গিয়ে গবুদাদুর দিকে তাকালাম। হচ্ছেটা কি?


আমার মনের কথা বুঝে গবুদাদু আমাকে একটা দেওয়ালের আড়ালে একটা গুপ্ত ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। এই ঘরে অনেক যন্ত্রপাতি, অনেক রাসায়নিক পদার্থ আর একটা টিমটিমে হলদে আলো। এটা নাকি গবুদাদুর গুপ্ত অফিস ঘর।


'নারাণ, এই সমস্ত হচ্ছে আমার গুপ্ত গবেষণাগার। বাইরে যাদের দেখলে, এরা কারা জানো?'


আশ্চর্য হওয়ার আর বাকি ছিল না আমার। মুখটা হাঁ রেখেই নেতিবাচক ঘাড় নাড়লাম।


'আমার বিগত বিয়াল্লিশ বছরের কর্মের ফসল এই উদ্যান' গাছেদের কথা বলল গবুদাদু।


'অনেক অধ্যবসায়, অনেক পরিশ্রম করে আমি সংগ্রহ করেছি গাছের স্টেম সেল - মেরিস্টেম। তার সাথে সংগ্রহ করেছি মানুষের ভিন্ন জায়গায় থাকা স্টেম সেল, যেমন মাথায়, অস্থি মজ্জায়, রক্তনালীতে, পেশীতে, ত্বকে, হার্টে। এসবের সংমিশ্রণে তৈরি করেছি এস.ভি.এফ, মানে স্টেম সেল কালচার। সেইটা তৈরি করতে আমার জীবদ্দশা প্রায় শেষ হতে চলল'


'তারপর তারপর?' সব ভুলে আমি অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম।


'তারপর সেই কালচারের ওপর আরো অনেক জটিল প্রক্রিয়া এনে তৈরি করলাম আমার সেরাম। সেইটা আমি বিশেষ কিছু মানুষের উপর প্রয়োগ করা শুরু করলাম। দীর্ঘ বিশ বছর লেগেছে আমার আজকের এই ফল পেতে। এই উদ্যানের সমস্ত গাছগাছালি আমার অক্লান্ত পরিশ্রমের পরিণাম'


'মানুষের উপর প্রয়োগ করলে একেবারে? তার আগে অন্য কোনোভাবে পরীক্ষা করলে না দাদু?' আমি শিউরে উঠে বললাম।


'ভয় পেয়ো না নারাণ, আমি তাদের উপরেই পরীক্ষা চালিয়েছি, যারা সদিচ্ছায় এসেছে আমার কাছে। এমন অনেক মানুষ আছে নারাণ, যারা জীবনের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছিল। হাজারো কারণে পলাতক, বেকার, ভবঘুরে, এমন আরো অনেক রকমের মানুষ যারা জীবনের উদ্দেশ্য না খুঁজে পেয়ে হয়তো জীবনটাকে শেষ করতে চেয়েছিল। আমি তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করেছি। দিনের পর দিন সময় দিয়ে বুঝিয়েছি আমার কাজ, আমার স্বপ্ন। জিজ্ঞাসা করেছি আমার এই গবেষণায় তারা যোগদান করতে রাজি কি না। প্রত্যেকের সম্মতি নিয়েই কিন্তু আমি তার ওপর আমার তৈরি সেরাম প্রয়োগ করেছি'


'এদের কি হয়েছে গবুদাদু?' কেমন বিহ্বল হয়ে পড়লাম।


'এরা মানুষ, কিন্তু এদের মধ্যে গাছের বৈশিষ্ট্যও এসেছে। এদেরকে আমি মানবুদ্ভিদ বলি। মানুষ যুক্ত উদ্ভিদ। দৃশ্যত এরা আধা গাছ, আধা মানুষ। মানুষের চামড়ার ওপরের এক স্তর গাছের ছাল তৈরি হয়েছে দেখ। সেই কারণেই এদের শরীর দেখলে মনে হবে কোনো গাছ। মাথার চুল তো মৃত কোষ, কিন্তু তার শিকড় তো জীবন্ত, এটা নিশ্চয়ই পড়েছ নারাণ? সেই শিকড় থেকে উদ্ভিদের মতন পাতা জাতীয় ওই জিনিসগুলো বেড়ে উঠেছে ওপরের দিকে। তারা আলো শুষে নিতে পারে জানো? দুই হাতের আঙ্গুলের শেষ থেকেও পাতাগুচ্ছের উৎপত্তি হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে গাছের ডালপালার শেষে আঙ্গুল গজিয়েছে দেখতে লাগলেও, আসলে কিন্তু হাতের ওপরে তৈরি হয়েছে ফ্লোয়েম - গাছের জীবন্ত ছাল যেটা দিয়ে গাছের মাথা থেকে গুঁড়ি অবধি খাদ্য সঞ্চালন হয়। তেমনই পায়ের পাতার চারপাশ দিয়ে তৈরি হয়েছে শিকড়। এগুলো প্রধানত মাটি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে স্থায়ীত্ব খোঁজে। জল শুষে নিতে পারে মাটির তলা থেকে, যেটার কারণে একটি তরঙ্গের আছড়ে পড়ার আওয়াজ হতে থাকে। কিন্তু প্রয়োজন মতো নিজেদের শেকড় গুটিয়ে নিতে পারে ওপরের দিকে, মূল গুঁড়ির কাছে। তখন ওরা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে। খাদ্যের অভাবে, আলো-বাতাস-জল কাজে লাগিয়ে এই মানবুদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারে। এদের সৃষ্টি একটা বিপ্লব নারাণ, বিপ্লব!' এতক্ষণ একভাবে কথা বলে গবুদাদু এবারে থামল।


'কিন্তু কিসের বিপ্লব? কি কারণে এদের সৃষ্টি?' জিজ্ঞাসা করলাম আমি।


'কেন, এদের নিজস্ব স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটাই কি যথেষ্ট নয়? তাছাড়া, সমাজের কত মঙ্গল করতে পারে ভেবে দেখ নারাণ। নীরব নিরাপত্তারক্ষী হয়ে কত মানুষের সাহায্য করতে পারবে গাছের ছদ্মবেশে। ভাবো, রাস্তায় কোনো গন্ডগোল বাধল, তখন এদের কেউ সেই ঘটনাস্থলে থাকলে কিন্তু সাক্ষী হয়ে রইলো। দরকার মতন আসল অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে পারবে। ভাবো নারাণ, রাত-বিরেতে অন্ধকারের আশ্রয়ে ভয় দেখিয়েও কিন্তু এরা দুষ্কৃতিকে আটকাতে পারবে!'


'বেশ মজার ব্যাপার তো! কিন্তু তাহলে তুমি কেন লোকচক্ষুর বাইরে এইরকম মস্ত কাজ করছ? মাটির তলায় কেন এই ব্যবস্থা, যখন মাটির ওপরে সেটা সহজভাবে সম্ভব? এদিকে সমস্ত গ্রাম তো জানে যে গবুদাদু নিখোঁজ হয়েছে' আমি বেশ অবাক হলাম।


'আমি আসলে নিখোঁজ হয়ে এসেছি এইখানে। আমার গবেষণার কথা জানতে পেরে সরকার থেকে আমার ডাক এসেছে' মস্ত গোলগোল চোখে তাকায় গবুদাদু। 

'সে যে কি ভীষন ডাক আর কি তার পরিণতি, সে আমি বেশ জানি। তাই তো আপাতত গা ঢাকা দিয়ে রয়েছি এখানে, যদ্দিন না হাওয়া শান্ত হচ্ছে। এই যে গবেষণাগার দেখছ, এ আমার কাজের সামান্য নমুনা মাত্র। বিশেষ প্রয়োজনে যাতে আমি লোকচক্ষুর আড়ালেও কাজ চালিয়ে যেতে পারি, এই মানবুদ্ভিদ জাতিকে যাতে আরও নির্ভুল তৈরি করতে পারি, সেই কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাতেই এই গবেষণাগার তৈরি করেছিলাম। আমার কিছু নমুনা এরা, যাদেরকে তুমি দেখছ। এরা স্বাধীনভাবে আগে আমার বাগানে বিচরণ করতো। তাই তো এমন ভেঙেচুরে পড়ছে বাড়িটা একদিকে। অগোছালো বাড়ি রেখেছিলাম সেই কারণেই তো, যাতে কারুর চোখে না পড়ে আমার গবেষণার কাজ। এতে ঝুঁকি অনেক। কিন্তু দেখ, সেই ফাঁপরে পড়তে হলো। আর আমাকে রাতারাতি তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখানে চলে আসতে হলো'


'কিন্তু কিসের জন্য সরকার থেকে ডেকেছে তোমায় গবুদাদু? আর কেনই বা তুমি লুকোতে চাইছ? তুমি কি কোনো অন্যায় করেছ?' আমি জানতে চাইলাম।


গবুদাদু আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,

'নারাণ, তুমি খুব ছোট। তাই হয়তো ভাবতেও পারছো না যে আমার এই সৃষ্টি সমাজের জন্য যতটা মঙ্গলের, ততটা অমঙ্গলেরও। এদেরকে ভুলভাবে ব্যাবহার করলে এরা তো খারাপ লোকেদের হয়েও কাজ করতে পারে, তাই না? এই কাজ অত্যন্ত গোপন স্তরে করছিলাম শুধু এদের নিজেদের ভালোর জন্য, দ্বিতীয় ব্যক্তি অথবা স্বার্থলাভের কারণে নয়। কিন্তু এখন এদেরকে যুদ্ধে ব্যবহার করার কারণে চাওয়া হচ্ছে আমার গবেষণার কাজ। এরা লুকিয়ে যাতে খবরাখবর নিতে পারে সীমান্তে, শত্রুদের গোপন খবরাখবর এনে দিতে পারে, দরকার ধ্বংস করতে পারে, সেইসব বিভিন্ন কারণে আমাকে দ্রুত কাজ সেরে চূড়ান্ত সেরাম তৈরি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি তো সেটা চাইনি। আমি তো যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি করার কারিগর না, আমি বৈজ্ঞানিক, আমি মানুষ বাঁচাতে, মানুষকে ভালোভাবে রাখতে ব্রতী। কেন আমি ওদেরকে অস্ত্র হিসেবে তুলে দেব বলতে পারো? ওরা যখন নিজেদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে নিতে রাজি হয়েছে, তখন আমি কেন ওদের এই নিষ্ঠা, এই ত্যাগ, এই উৎসর্গ কোনো খারাপ কাজে লাগাবো? সেই জন্যই দেশের চারদিকে বার্তা গেছে যে আমি নিখোঁজ। আমার জীবনব্যাপী কাজ আজ অর্ধসমাপ্ত আর সম্পূর্ন অকৃতকার্য' খুব বিষন্ন শোনায় গবুদাদুকে।



'কিন্তু তোমার কাজ তো এগোচ্ছে গবুদাদু? ' আমি জিজ্ঞাসা না করে পারি না। 'এরাই বা কতদিন এখানে থাকবে এই অবস্থায়? একদিন না একদিন তো বেরোতেই হবে বাইরে, মাটির ওপরে। তখন তো এদের দেখলে সাধারণ মানুষ চিনে যাবে'


'না, নিয়মিত সেরাম না দিতে থাকলে, এরা গাছের বৈশিষ্ট্য হারাবে ধীরে ধীরে। হয়তো অনেক সময় লাগবে, হয়তো সম্পূর্ন পরিত্যাগ করতে পারবে না সমস্ত মানবুদ্ভিদগত আচরণ। কিন্তু এই অবস্থা ধরেও রাখতে পারবে না, উন্নতিও হবে না। তখন ওরা আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু ওরা কেউই আর সেই জীবনে ফিরে যেতে চায়না। বলে এই ভালো। তাই, যতক্ষণ না নিরাপদ জায়গা খুঁজে সেখানে ওদেরকে নিয়ে যেতে পারছি, ততক্ষন এইটাই ওদের আশ্রয় থাক'


'এটা কি খুব নিরাপদ জায়গা গবুদাদু? আমি কিন্তু ভুল করে হলেও, আলমারি খুলে এখানে পৌঁছে গেলাম। বড়ো কেউ তো সেটা আরো সহজে পারবে'


রহস্যময় হাসছে গবুদাদু। মাথা চুলকাচ্ছি কিছু বুঝতে না পেরে, তখন দাদু বলল,

'ওই আলমারি আমার আরেকটা সৃষ্টি। যান্ত্রিক-গাছ। ওটা আসলে কৃত্রিম গাছ। দরকার মতন কিছু বিশেষ আকার ধারণ করতে পারে। তাছাড়া চলাফেরা করার ক্ষমতা আছে ওর মধ্যে। তোমাকে আর তোমার পরে আমাকে এই সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়ে, আমার নির্দেশ মত সে এই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে দু-চার ফুট নীচে নামলেও আর রাস্তা পাবে না। একাধারে তৈরি করেছি গাছ-মানুষ, অন্যোধারে যান্ত্রিক-গাছ। এরা একে অপরকে রক্ষা করবে দরকার পড়লে'


'মানে?' কিংকর্তব্যবিমূ়ড় হয়ে বললাম, 'আমি তো আলমারির পাল্লা খুলে ঢুকলাম, এতটা পথ আসলাম। এবার আমি ফেরত যাবো কিভাবে?'


'বাইরে বেরোনোর পথ আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, যদি তুমি কথা দাও নারাণ, যে আমার আর আমার গুপ্ত গবেষণাগার দেখার কথা তুমি তোমার কাছেই রাখবে। একদিন যখন তুমি বড় হবে, যদি সুযোগ পাও, এগিয়ে নিয়ে যেও এই কাজ। আর নাহলে এখানেই চাপা পড়ে থাক সমস্ত প্রমাণ। আর কোনোদিন যদি আমার কোনো মানবুদ্ভিদকে দেখতে পেয়ে যাও সুদূর কোথাও, বুঝবে আমি আছি কাছাকাছি, অথবা আছে কোনো যোগ্য মানুষ এদের পেছনে। কারণ হিংস্র পৃথিবীতে এদের সৃষ্টি করা বড়ো দায়, আমি এতবছর পর বুঝেছি'


গবুদাদু আমাকে বাইরে যাওয়ার অন্য একটা পথ দেখিয়ে দিল। সেই সরু অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ ধরে অনেক অনেক দূর এগিয়ে, শেষমেষ পেলাম একটা বেরোনোর সিঁড়ি। কিন্তু এবারের সিঁড়ি লোহার নয়, মাটি দিয়েই ধাপে ধাপে তৈরি। যখন উঠলাম মাটির ওপরে, দেখলাম সূর্য প্রায় মধ্যগগনে উঠেছে, ঝিলমিল করছে বিদ্যাধরীর জল।


গবু দাদুর বাগানে ফিরে গিয়ে দেখি, পুকাইরা তখনও বসে আছে বাগানে। আমাকে দেখে খগেন বলল

'তোর আক্কেল কি হে? তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর তুই কেটে পড়লি? দোতলা থেকে নামলি কখন?'


'নেমেছিলাম একসময়ে। চল চল ফিরি, অনেক বেলা হয়েছে। ধীরেন মাষ্টার এখানে আমাদের দেখলে আর রক্ষে নেই' এই বলে ওদের নিরস্ত করে, আমি হাঁটা লাগলাম।


এর কয়েকদিন পর আবার একা একদিন গিয়েছিলাম গবুদাদুর বাড়িতে। কিন্তু সেই ঘরে গিয়ে দেখলাম কোনো আলমারি নেই। শেওলা ধরা দেওয়াল যেন এগিয়ে এসেছে। বিদ্যাধরীর তীরে ওই খোলা জায়গাটাও আজ বন্ধ। তবে এবার থেকে আমি গাছপালাদের আরো ভালোভাবে নিরীক্ষণ করি! 


সমাপ্ত ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy