Abanti Pal

Drama Inspirational

3  

Abanti Pal

Drama Inspirational

কৃষ্ণগহ্বর

কৃষ্ণগহ্বর

2 mins
225


আজ জয় অনিবার্য, কিছুতেই দমবে না অধিরাজ। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছে মাউন্ট এভারেস্টের শিখরে। গতকাল সন্ধ্যেবেলায় ছাব্বিশহাজার ফিট পেরিয়ে মৃত্যুবলয় অঞ্চল, অর্থাৎ পর্বতারোহীদের কথ্য ভাষায় ডেথ জোনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ দিন পর। হ্যাঁ, একটু বেশী সময় নিয়েই এ যাত্রা শুরু করেছে অধিরাজ, নিজের কাছে কথা রাখা নিয়ে কথা যে! 


আর মাত্র বছরখানেকের সময় দিয়েছেন ডাক্তার। বড্ড পাপী লাগছিল নিজেকে। যে কর্মযজ্ঞের সাধনায় খুইয়েছে অনেক কিছু, সেই আর্মির চাকরিটা শেষ পর্যন্ত ছাড়তেই হলো। দেশমাতৃকার সামনে লজ্জিত সে। মনে পড়ল মায়ের কথা - 

গণ্ডি শুধু দুর্বলদের অজুহাত অধি, সে মানুষের দুর্বলতম জায়গায় অধিষ্ঠান করে, তাকে সিংহাসনে চড়িও না। 


নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অধিরাজ, বিশ্বজয় সে করবেই! রাতের পর রাত ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে একটুখানি ওম হাতড়ে বেড়ানো নাবালক সে আর নেই, শূন্য বুকে মনের বরফ গলিয়ে প্রয়াত প্রিয়তমাকে ফিরে পাওয়ার আশ তার আর নেই, নেই তুলোর শীতপোশাকে মোড়ানো তার ক্ষণস্থায়ী নবজন্মাকে আর একবারের জন্য দেখার প্রত্যাশা, কিছুই আজ আর বাকি নেই। যা গেছে, অন্তরাত্মা নিংড়ে দিয়ে গেছে। আছে শুধু অদম্য জেদে অন্যায্য পৃথিবীকে পায়ের তলায় দেখার ইচ্ছা, সর্বশ্রেষ্ট শৃঙ্গে অভিযান করে গেঁথে দেওয়া দাম্ভিক এই জগৎসংসারের বুকে, সপাটে উত্তর দেওয়ার চাহিদা - দেখ, আছি আমি! আমি আজও সৈনিক!


অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু কর্কটরোগরূপে অতিথি হয়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে থাকলে বুঝি বড়ো অস্বস্তি হয়। না তাকে তাড়ানো যায়, না সাদর অভ্যর্থনা জানানো যায়। বেপরোয়াভাবে অন্তিমযাত্রায় একমাত্র নিজের ইচ্ছের কথা ভেবেই বেরিয়ে পড়েছে অধিরাজ। এভারেস্টের মৃত্যুবলয়ের মধ্যে বেশিক্ষন থাকা আর ঠিক নয়। নিজের অজস্র শীতপোশাকে আচ্ছাদিত হলেও নিঃশ্বাস নিতে বড়ই কষ্ট। চূড়ান্ত মাইনাস ৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ঠাণ্ডায় কঠিন শরীরও শীতাতুর। সে হোক, কিন্তু জাতীয় পতাকা শিখরে উত্তোলন করার পরেও মনের কৃষ্ণগহ্বর পরিতৃপ্ত হলো না যে। 


বিপদটা হলো ফিরতি পথে। এক পলকের ভুল হিসেবে পা ফস্কে তরতর করে খানিকটা গড়িয়ে পড়ল অধিরাজ। আছড়ে পড়ল পাহাড়ের মাঝখানে মাইলখানেক লম্বা একটা ফাটলের মধ্যে। অন্ধকার, দিশেহারা সর্বহারা রাতগুলোর মতন অন্ধকার এখানে। ওই অনেক উপরে ফাটলের মুখ। নিজের দুরুদুরু বুকের ওঠানামা ছাড়া এখানে জগৎ স্তব্ধ। কাকে জয় করলো সে এত কান্ড করে? পায়ের তলায় স্রষ্টাগ্রহকে দেখে কি পাল্টাতে পারলো জীবনযুদ্ধের পরিণতি? আজ অনেক দিন পর, আবার বড্ড শীত করছে অধিরাজের। এই শীত নিবারণের ঐশ্বরিক ক্ষমতা কারুর নেই। যে মাটির জন্য তার বাপ-মা প্রাণ দিয়েছে, সে নিজেও থেকেছে পরিবার-পরিজনের থেকে দূরে, সেই আজ তার ভূমি কেড়ে নিল, না? 


রাতের তারারা ফুটেছে। 

হাসছে মা - জয় কি শুধুই রক্ত দিয়ে হয় খোকা? মনকে জয় করে যে, সেও মহাত্মা। ঘরে ফিরে আয়। 

আদুরে স্ত্রী ঝিলমিল - স্যান্টা ক্লজ হয়ে এবছরটা ছুটিতে আসবে তো লক্ষীটি? কথা দিয়েছিলে?

ডাকছে নবজাতিকা ক্ষণিকের উত্তাপের আশায়... ফিরে যাবে সে, অপেক্ষা আজ শেষ। শুধু একবারের জন্য যদি ঠান্ডাটা একটু কম লাগত! চোখ বুজে আসে, হঠাৎ অনুভূত হয় এক স্বর্গীয় ওম। বহুকাঙ্খিত শীতবস্ত্র কেউ জড়িয়ে দিয়েছে তার গায়ে, ফুরিয়ে যাচ্ছে মনের কৃষ্ণগহ্বর।


দশদিন পরে এক সকালে একজন শেরপা খুঁজে পায় অধিরাজের নিথর দেহ, আশ্চর্যভাবে গায়ে তার সযত্নে জড়ানো জাতীয় পতাকা। 


সমাপ্ত ।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama