অপরাজিতা
অপরাজিতা
এই রাত তিনটের সময় কে আবার নৃত্য শুরু করলো? ধুত্তোর, ঘুমটাই গেল ভেঙ্গে!
হায়দরাবাদ থেকে বছরখানেক বাদে বাড়ি আসার সুযোগ হলো যদিওবা, প্রথম রাত্রিটা যে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাবো, তারও উপায় নেই দেখছি!
কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো, সত্যি তো! এই গভীর রাতে কিসের আওয়াজ আসছে? ঘুমের ঘোর কাটতে, কান পেতে শুনি ঠুনঠান-রিনিঝিনি-শিঞ্জিনী আওয়াজ, কেউ যেন ভারী নূপুর পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাছাকাছি কোথাও।
আমার ঘরের পূবের জানলাটা হাট করে খোলা। সেখান দিয়ে ফিরফির করে বয়ে আসা হাওয়ার তালে তালে, পাতলা শিফনের পর্দাটা ওঠানামা করছে। পর্দার ফাঁক দিয়েই এবারে দেখতে পেলাম, আমাদের বাড়ি লাগোয়া পাশের ফ্ল্যাটের ছাদে কেউ মৃদুমন্দতালে হাঁটছে!
তারই হাতের চুড়ি, কানের ভারী ঝুমঝুমি আর পায়ের নূপুরের আওয়াজ ভেসে আসছে।
অপরাজিতা কি? মেয়েটার বড্ডো সাজগোজের নেশা আর নাচের শখ! সেই ছোট্টবেলা থেকেই সাজ-সাজ করে এমন পাগলামি করতো যে আশেপাশের বাড়ির আমরা সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতাম!
না, মেয়েটা এমনিতে খুবই হাসিখুশি-প্রাণবন্ত। কিন্তু ওই যে, সর্বক্ষন নাকি গলা অবধি সেজেগুজে না থাকলে কোনো সিনেমা ডিরেক্টরের চোখেই পড়বে না! যখন ইচ্ছা নাচ প্র্যাক্টিস না করলে, নূপুর জোড়া পরবর্তীকালে ওকে অবমাননা করবে। ভোর চারটে হোক অথবা বেলা তিনটে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নাচতে মন চাইলে, সে ডাক নাকি অপ্রতিরোধ্য! তা এমন ভাবনাচিন্তার কদর আমরা করতাম না বলে বেজায় খেপে থাকতো আমাদের ওপর। আবার আমরা হাসি-ঠাট্টা করতাম বলে বড়োরা আমাদেরকেই উল্টে বকাবকি করতেন!
ওর এসব ক্রিয়াকলাপের সব থেকে প্রিয় জায়গা ওদের ফ্ল্যাটবাড়ির চার-তলা ছাদে বানানো একটা ছোট্ট চিলেকোঠার ঘর। নাচ শেষে, ছাদের ধারে এসে অনেকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে দেখত সামনের দীঘিটার দিকে।
'কি দেখিস হাঁ করে ওদিকে, এই ভরদুপুরে?' জিজ্ঞাসা করেছিল আমার মা ওকে একদিন।
‘ওই দীঘির পাড়ে ফুলগুলোর কি মজা বলো কাকিমা? কয়েকদিনের জীবন, তবুও তো খোলা আকাশের নিচে আপন খেয়ালে দিন কাটাতে পারে। পায়ে নূপুরের শেকল না বেঁধে, ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে সত্যিই পৃথিবীটাকে সম্মোহিত করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মালেই হয়তো ভালো হতো' আনমনে উত্তর দিয়েছিলো ও।
'কি যে বলিস! দেখবি একদিন খুব ভালো নৃত্যশিল্পী হবি তুই' অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো মা, ‘নিজের স্বপ্নের পথে কাউকে কখনও বাধা হয়ে আসতে দিবি না।'
'ঠিক বলেছো তো’ উজ্জীবিত হয়ে বলেছিল অপরাজিতা, ‘এই যে তোমরা সব্বাই আমাকে এত ভালবাসো, বাবা-মায়ের এত্ত স্বপ্ন আমাকে নিয়ে, আমি জীবন দিয়েও সবার মুখে হাঁসি ফোটাতে পারবো। পারতেই হবে আমাকে!'
সেই অপরাজিতা, তার খামখেয়ালীপনা এখনও বদলায়নি!
দোতলার ঘর থেকে চার-তলার ছাদ স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব না, তাও মনে হলো কে যেন হাসলো আমার দিকে তাকিয়ে। তার অলঙ্কৃতা গহনাগুলো ফিকে চাঁদের আলোয় অল্প ঝলমল করলেও, মুখটা স্পষ্ট নয়। এমন আজব সময়ে, এ কিছুতেই অপরাজিতা না হয়ে যায়না।
তাই হাঁক পেরে ডাকলাম 'অপরাজিতা না কি?'
মনে হলো আবারও হাসির আওয়াজ এলো, এবারে একটু জোরালো। তার মানে অপরাজিতাই হবে।
'কি রে তোর আক্কেল কি পাহাড়ে গেছে না সমুদ্রে? এতো রাতে ছাদে ঘুরছিস কেন? না কি বহুদিন লকডাউনের ঠেলায় বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রন না পেয়ে, লেহেঙ্গা পরে সেজেগুজে ছাদে উঠে পড়েছিস!'
রিনরিনে হেসে সরে গেল মেয়েটা। যাচ্চলে!
আমার গলার আওয়াজে মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো এই ঘরে।
'কি রে বাবু, এতো চেল্লাছিস কেন এতো রাতে? কার সাথে কথা বলছিলি?
'অপরাজিতা এখনও বদলায়নি বলো মা! এতো রাতে সেজেগুজে ছাদে পায়চারী করছিল! নিশ্চয়ই আবার কোনো নাটকের লাইন মুখস্ত করছিল! উফফফ, পারেও বটে'
'কি বলছিস কি যাতা?' মায়ের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
'কেন? ছোটবেলায় তো এমন কত করতো! যা ডাকাবুকো মেয়েটা!'
'বাবু তুই আজ সামনের ঘরটায় শুবি চল' মায়ের এরকম অপ্রাসঙ্গিক উত্তরে যারপরনাই অবাক হলাম।
'কেন?'
'কিছুই নয়, এই ঘরটা আরেকটু পরিষ্কার করা দরকার। তুই এতটাই ক্লান্ত আছিস আর এতো রাতে পৌঁছেছিস, কোনদিকেই তোর কোনো নজর নেই বলে তোর কিছু চোখে পড়েনি। আমিও আর কিছু বলিনি তোকে। কিন্তু এখন যখন তোর ঘুম ভেঙেই গাছে, তখন চল বাবা, না করিস না'
আর কথা বাড়ালাম না। বড্ডো ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু এই উত্তর দিকের ঘরটাতেও মনে হলো কোথাও থেকে ঝুমঝুম আওয়াজ ভেসে আসছে। নুপুরের আওয়াজ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে। জানলা-দরজার আরশিগুলো কেউ যেন ক্রমাগত ধাক্কিয়ে ভেঙে ফেলে বেরিয়ে পরিত্রাণ চাইছে খোলা হাওয়ায়। ঝোড়ো হাওয়া দিতে শুরু করেছে। কিছুক্ষনের জন্য আওয়াজটা থামলো, কিন্তু আবার একটু পরেই আরও জোরালো ভাবে শুরু হলো ঝুমঝুম-ঠুনঠান সেই আওয়াজ। বাড়তি কিছু না শোনা গেলেও, বাতাস যেন কার অশ্রুত আর্তনাদে ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ। হচ্ছেটা কি? ব্যাপারটা জানার জন্য প্রবলভাবে অস্থির হয়ে পড়লাম। পাশের তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়িতে, অপরাজিতারা ছাড়া এমনিতেও আর কোনো পরিবার থাকে না। আওয়াজটা তাহলে নিশ্চয়ই ওদের ঘর থেকেই আসছে। কিন্তু অপরাজিতারা যে ফ্ল্যাটটায় থাকে, সেটা আমাদের ঘর থেকে সরাসরি কোনোভাবেই দেখা যায় না।
আচ্ছা, একবার বারান্দায় গিয়ে দেখলে হয় না? একটা বাগানমুখী জানলা আছে ওদের আর সেই ঘরে আলো জ্বললে, সেই আলো বাগানে গিয়ে পড়বে, যেটা আমাদের বারান্দা থেকেও দেখা যাবে!
উঠে বারান্দায় যেতে না যেতেই, ফস করে কারেন্টটা গেল চলে। ঘর তো এমনিতেই অন্ধকার ছিল, কিন্তু পাড়ার ভ্যাপর-ল্যাম্পগুলোও সব একত্রে নিভে গেল। বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাঁদটুকুও কখন যেন মেঘের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়েছে। কি যেন একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে, সেটা নিজেও ভালো বুঝতে পারছি, তবে তার উৎস ঠাহর করে উঠতে পারছি না।
ভাবনায় ছেদ ঘটলো মায়ের পদশব্দে।
‘এখনো ঘুমোলে না তুমি? আচ্ছা, আমি কি কচি খোকাটা আছি যে আমাকে সারারাত ধরে পাহারা দিচ্ছ? তোমার হলো কি বলো তো?’ আমি এবারে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম।
উল্টে জননী আমাকেই প্রশ্নবাণে ভরিয়ে দিলো ‘তুই বারান্দায় কেন এসেছিস বাবু? এমন শ্রাবনের স্যাঁতস্যাঁতে রাতে কেউ বাইরে এসে দাঁড়ায়?’
‘সারা রাত ধরে কি মেয়েটা নাচানাচি করে মা? এতো আওয়াজে ঘুম আসে কারুর? তোমাদের প্রশ্রয়েই ও দিন-কে-দিন বেড়ে উঠছে’ খানিক রাগ দেখিয়ে বললাম আমি।
‘কে নাচছে?’ মায়ের চোখে যেন ঈষৎ আতঙ্ক খেলে গেল…
‘কে আবার? তোমাদের সবার আদুরী অপরাজিতাই হবে’ আমার কথা শেষ হতে না হতেই, মা আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে উত্তরের ঘরে চলে গেল।
‘চুপচাপ শুয়ে পর। কেউ নাচছে না কোথাও। কি শুনতে যে কি শুনছিস কে জানে! কালকেই ঠাকুরমশাইকে ডাকবো এবাড়িতে একটা পুজো করে দিতে’
‘কি যে বলছো কিছুই বুঝছি না, একটু পরিস্কার করে বলো না। কিছু কি হয়েছে?’
মা যেন ছায়ার মতন আমার আশেপাশে থেকে আমাকে কিছুর থেকে আগলে রাখছে। দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম আমি, কিন্তু মা আর কিছু না বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতে লাগল!
শেষ রাতের দিকে, একসময়ে চোখটা লেগে এসেছিল। মুষলধারে বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। দৌড়ে গেলাম আমার ঘরে। পূবের জানলাটা যে খোলা আছে, সেটা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসলে আমার বিছানা-ব্যাগপত্র-ল্যাপটপ সব ভিজে যাবে। গিয়ে দেখলাম, যা ভেবেছিলাম তাই। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে ঘরে। কিন্তু তড়িঘড়ি জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। এ কি দেখছি আমি? নিজের চোখকেই যে বিশ্বাস হচ্ছে না!
সামনেই, যেখানে অপরাজিতাদের ফ্ল্যাটবাড়িটা থাকার কথা, সেটা পুড়ে ছারখার হয়ে আছে। জায়গাটা শুধুমাত্র একটা কালো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কোনোমতে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বিক্ষিপ্ত স্তম্ভ। তারই একটায়, রহস্যময়ভাবে ভাঙা একটুকরো নুপুর আটকে আছে|
বৃষ্টির আওয়াজে, হয়তো বা আমাকে না দেখতে পেয়েই, মা এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে জানালো এক বিভীষিকাময় রাত্রের কথা, যেদিন পাশের ফ্ল্যাটবাড়িতে আগুন লেগে, পুরো ফ্ল্যাটবাড়ি ছারখার হয়ে যায়। দমকল এসে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ। তবে ভাগ্যক্রমে, হাওয়া বিপরীতে থাকায়, আশপাশের বাড়িঘরে আগুন ছড়াতে পারেনি।
সেদিন মেয়েটা একাই ছিল বাড়িতে। ওর মা বাবা বিশেষ প্রয়োজনে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। অপরাজিতাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি ওই ধ্বংসস্তূপে আর কিভাবে যে আগুন লেগেছিল, তাও আজ দুমাস পরেও জানা যায়নি।
বৃষ্টি কিছুটা ধরে আসলেও, আকাশের মুখ এখনও রাতের আর মেঘের আভরণে ভারাক্রান্ত। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই ছাইপাঁশের মধ্যেও, কিভাবে যেন একটা অপরাজিতা গাছ লতিয়ে-পেঁচিয়ে গজিয়ে উঠেছে আপন খেয়ালে। সন্তর্পনে প্যাঁচ খেয়ে সেটা এগিয়ে এসেছে আমার ঘরের পুব-জানলাটার দিকে। আর সেখান থেকেই, দীর্ঘ অপেক্ষিত বর্ষণে স্নাত হয়ে, একটা অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। বুঝি তার অপার্থিব নৃত্যধ্বনি শুনিয়ে, তার বহুকাঙ্খিত মুক্তি পেয়ে, অবশেষে নতুন জীবন খুঁজে নিয়েছে। তার এই ক্ষুদ্র অস্তিত্ব দিয়ে, তার প্রতিশ্রুতি মতো, পৃথিবীটাকে আরেকটু রাঙিয়ে তুলতে আজও সে অঙ্গীকারবদ্ধ!
সমাপ্ত।।