জাদুকরের বাগান
জাদুকরের বাগান
টিঙ্কু আর মিঙ্কুর আজ ভারী আনন্দ। দূর উপত্যকার ওই স্বর্গতুল্য বাগানটায় ওরা আজ বেড়াতে এসেছে। টিঙ্কু আর মিঙ্কুদের এদিকটায় পাহাড় বেশ রুক্ষ। গাছপালায় ঘেরা থাকলেও, সেই মনোরম পরিবেশের ছোঁয়া নেই। সেই কারণেই হয়তো ওই একফালি উন্মুক্ত বাগানের প্রতি ওদের এক অমোঘ আকর্ষণ জন্মেছে। কিন্তু নিজেদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলে, ওদের বন্ধুবান্ধবেরা সতর্ক করে দেয়
'অনেক দূরের পথ তো, পথ ভুলে যদি হারিয়ে যাস?'
'ওখানে অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটে শুনেছি। বোধহয় কোন জাদুকরের কীর্তি। ওইসব জায়গা মোটেই ভালো নয়'
'না না, তা কেন হবে? বাগানের সামনে ওটা মনে হয় একটা ইস্কুলবাড়ি। তবে পড়ুয়ারা খুব দুষ্টুমি করে কিনা, তাইতো যেতে মানা'
'শুনেছি ওখানে অন্য একটা পৃথিবীতে যাওয়ার গুপ্তপথ আছে। সেখানে ভুলবশত একবার ঢুকে গেলে কেউ আর ফেরত আসতে পারে না'
এরকম আরো কত্ত কি!
কিন্তু পরামর্শদাতারা নিজেরাই অনভিজ্ঞ কচিকাঁচা। রটনায় শোনা কথাবার্তাটুকু শুনেই ওরা আলোচনায় ব্যস্ত। পাহাড়ের এই তল্লাটের মধ্যে থেকে কেউ কোনোদিন ওদিকটায় যাওয়ার সাহস পায়নি।
তবে টিঙ্কু আর মিঙ্কু কিন্তু মোটেই দমবার পাত্র নয়। আজ তাই সুযোগ বুঝে ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়েছিল বাগানটার উদ্দেশ্যে। নিরিবিলি পাহাড়ের বুক বরাবর, জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে অনেকখানি নেমে গেলে তবেই পড়বে উপত্যকা। সেখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকৃতির বাড়িটার ঠিক পাশেই বাগানটা। অদ্ভুত বাড়িটার ভেতর থেকে মাঝেমধ্যেই ঘুঁট-ঘ্যাঁট আওয়াজ বেরোচ্ছে আর ছাদের উপরের একটা নল দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
কিন্তু টিঙ্কু আর মিঙ্কুর এইসবে মন দেওয়ার সময় অথবা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। ওদের নজর পড়ে আছে বাড়ি লাগোয়া ঐ বিশাল বাগানটায়। দৌড়ে ওরা সেখানেই চলে গেল।
আহা, কত রঙের বাহারি ফুল সেখানে। চোখ জুড়িয়ে যায়। এদিকটা শুধুই ফুলবাগান। তবে আসলে যে কারণে আসা, সেটা হলো বাগানের অন্য একটা দিকে ভর্তি শুধুমাত্র ফলের গাছ, সেটার আকর্ষণে। সেই ফলবাগানে কত টুসটুসে খোবানি ঝুলছে গাছ থেকে, লাল টুকটুকে আপেল, রংবেরঙের জাম... দেখলেই জিভে জল এসে যায়!
ওরা যখন এক ছুট্টে ফুলবাগান পেরিয়ে ফলবাগানে ঢুকতে যাবে, তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখে থমকে গেল। ফলবাগানের একটা অংশ সম্পূর্ণ ফাঁকা। গাছগাছালি নেই, শুধুই ঘাস। ওরা সেদিকেই যাচ্ছিল আর সেদিক থেকে সরাসরি ওদের দিকে তীর বেগে দৌড়ে আসছিল দুজন। সূর্যের আলো কমে আসছে, পরিষ্কার দেখে বোঝা যাচ্ছে না ফলবাগনের দিক থেকে আসা ওরা ঠিক কারা।
পাখিদের কিচিরমিচির কমে আসছে, একটু একটু করে অন্ধকার নামছে, শান্ত হয়ে যাচ্ছে চারিদিক। ফলবাগানের গাছগুলো আস্তে আস্তে লম্বা ছায়া ফেলতে শুরু করছে। দূর পাহাড়ের থেকে যতটা মায়াবী দেখাতো, এই আসন্ন সন্ধ্যার আলোতে ঠিক তেমনটা কিন্তু লাগছে না আর। এতটা দূরের বাগানে পৌঁছতে যে দিন শেষ হয়ে যাবে, সেটা কি ওরা আগে বুঝতে পেরেছিল? কেমন যেন গা-ছমছমে ভাব চারদিকে। কিন্তু এসেই যখন পড়েছে, তখন শেষ অবধি দেখেই যাক না। নাহলে ঘরে ফিরে বন্ধুবান্ধবদের কাছে কি হাসি-ঠাট্টার পাত্রই না হতে হবে!
এবার কিন্তু ধীরেসুস্থে এগোতে লাগল টিঙ্কু আর মিঙ্কু। আশ্চর্যের বিষয়, ফলবাগানের দিক থেকে আসা ওই দুজনের গতিও কমে গেল। যতটা টিঙ্কু-মিঙ্কু ফুলবাগানের দিক থেকে ফলবাগানের দিকে এগিয়ে যায়, ওরা ঠিক ততটাই ফলবাগানের দিক থেকে ফুলবাগানের দিকে এগিয়ে আসে। অবশেষে একেবারে মুখোমুখি হলো চারজন। আরে, এরা যে অবিকল ওদের মতন দেখতে! তাছাড়া টিঙ্কু আর মিঙ্কু যাই করছে, ওরাও ঠিক তাই করছে। নকল করছে বুঝি? এত বড় সাহস! কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করলে, ওদের মুখের সেই অঙ্গীভঙ্গি অনুকরণ করেছে শুধু, প্রত্যুত্তরে কিন্তু আর কিছু বলছে না, একেবারে মূক। একসময় ভীষণ রেগে গেল টিঙ্কু আর মিঙ্কু। দুম করে ঘুষি চালিয়ে দিল সামনের দিকে। কিন্তু একি? সামনের দুজনেও সঙ্গেসঙ্গে হাত মুঠো করে ঘুষি ছুড়ে দিল। আহ, কি জোর হাতে লাগলো! সামনের বাতাসটা একটু নড়ে উঠলো কি? কিন্তু ওদের কাউকেই ছুঁতে পারল না টিঙ্কু অথবা মিঙ্কু। সামনে কোন অদৃশ্য পদার্থ আছে কি? এক ঝটকায় ভালো বোঝা গেল না, মনে হলো পাতলা কোনো পর্দা। কিন্তু কিছু তো চোখে পড়ছে না! অথচ ঘুষি দিতে গিয়ে হাতে লাগল বেশ জোরে। ওদিকটায় যাওয়াও যাচ্ছেনা। তাহলে কি সামনের ওই দুজন - ওরা কি সত্যিই অন্য জগতের বাসিন্দা? সেই যে শুনেছিল, এখানে একটা গুপ্ত দ্বার আছে অন্য একটা পৃথিবীতে যাওয়ার! না কি এইসবই হচ্ছে বন্ধুদের মুখে শোনা সেই অদ্ভূতুড়ে জাদুকরের কারসাজি, যে ওদিকের দুজনকে আটকে রেখে দিয়েছে, আর বেরোতে দিচ্ছে না?
সর্বনাশ! যদি সেই জাদুকর জানতে পারে টিঙ্কু আর মিঙ্কু তার বাগানবাড়িতে ফল খাওয়ার গুপ্ত অভিপ্রায় নিয়ে এসেছে, তাহলে তো আর রক্ষে নেই। এদিকে পাহাড়ে, উপত্যকায় সব দিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে তাড়াতাড়ি। ইতস্তত কি করবে কি করবে ভাবছে দুজনে, এমন সময় উইইই-ফুসফুস করে একটা জোরালো আওয়াজে কেঁপে উঠলে সামনের বাড়িটা। শব্দটা প্রতিধ্বনিত হলো ফাঁকা উপত্যকায়, আওয়াজটা কেমন হাড়-হিম করা শোনালো নিরিবিলিতে। বাড়িটার সমস্ত কাঁচ লাগানো জানলাগুলো ঝনঝনিয়া উঠলো, সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে খেয়ে বেরোতে লাগলো উপরের নলটা দিয়ে। ঐতো, ঘরের মধ্যে একটা আলো জ্বলে উঠলো। লম্বা সাদা আলখাল্লা পরা, বুক অবধি নেমে আসা ইয়া বড়ো ধবধবে সাড়া দাঁড়ি, চোখে মোটা কালো চশমা আঁটা একটা মানুষকে দেখা গেল। একটু ভালোভাবে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কি সব সর্বনেশে কান্ড করছে লোকটা। একটা কাঁচের পাত্রে রাখা সাদা তরলের মধ্যে একটা ধোঁয়া ওঠা হালকা হলদে তরল মেশালো ফোঁটা ফোঁটা করে, ওমনি ওর মধ্যে নীল পদার্থের উদয় হল! আরিব্বাস, একটা গোলাপী তরলে আবার কি ঢালল আর সোনালী রঙের চকমকে একটা দ্রব্য তৈরি হয়ে ভাসতে লাগলো ওর মধ্যে!
সর্বনাশ, ঘাড় ঘোরালো কেন ওদের দিকে? দেখতে পেয়ে গেল ওদেরকে? এবার কি হবে? ক্যাঁচ-পটাশ-ক্যাঁচ-কটাস করে জানলাটা খুলে তার মস্ত ডিমওয়ালা মুখটা বের করে লোকটা দেখল ওদের দুজনকে। তার হাতে অদ্ভুত একটা ছড়ির মতন জিনিস। অল্পস্বল্প আগুন বেরোচ্ছে সেখান দিয়ে। এ নির্ঘাত সেই জাদুকর! হাতের ওই জিনিসটা মনে হচ্ছে তার যাদু ছড়ি। আবার দরজা খুলে ওদের দিকেই আসছে যে! এবার নিশ্চয়ই ছুমন্তর-ফুস বলে যাদুমন্ত্র আউড়িয়ে ওদের দুজনকেও আটক করবে! ওরা চাইলেও আর বেরোতে পারবে না ওই জাদুগরের বাগান থেকে! কোনোদিনও ওদের পাহাড়ে ফিরতে পারবে না। যেই না ভাবা, ওমনি আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ওমাগোওওও... ওবাবাগোওওও... বলে মস্ত লাফে দৌড় লাগালো টিঙ্কু আর মিঙ্কু। বাগান পেরিয়ে, জঙ্গল কাটিয়ে, সোজা ওদের আস্তানার উদ্দেশ্য দৌড় দিলো, দূর থমথমে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। কলিজায় প্রাণ থাকতে আর এদিকমুখো হবে না ওরা কক্ষনও, খুব বাঁচান বেঁচে গেছে এই যাত্রায়! অন্যের বাগানের থেকে ফল চুরি? আর কক্ষনো নয়। নিজেদের রুক্ষসূক্ষ্ম পাহাড়ই ঢের ভালো!
এদিকে গজ গজ করতে করতে, খিটখিটে গবেষক ডক্টর রানা বললেন
'আবার হনুমানের উপদ্রব! আমার তৈরি সুপার ফাইন আয়নায় ব্যাটাগুলো নিজেদের সোনা মুখ দেখতে আসে কিনা কে জানে! চারিপাশের মধ্যে মিশে থাকে এমন ভাবে যে চোখে দেখে বোঝা যায় না আয়নাটা। মানুষ এখনও টের পেল না ঐখানে আয়না রাখা আছে, তবে এই ব্যাটারা কোত্থেকে হদিস পেয়ে এসে হাজির হয় কে জানে? বাগান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে দেখছি আয়নাটাকে। এই আয়না দিয়ে ভিনগ্রহীদের হদিস পাবো বলে ওখানে রাখা। তা নয়, আমাদের পৃথিবীর বাঁদরগুলোই ধরা পড়ছে বারবার আর ফলস্ অ্যালার্ম বেজে উঠে আমার কাজের বারোটা বাজাচ্ছে বারবার! দুষ্টু জাদুকর হলে এক্ষুনি ছুমন্তর-ফুস বলে দিতাম!'
সমাপ্ত।।