Abanti Pal

Tragedy

4  

Abanti Pal

Tragedy

মণিহার

মণিহার

3 mins
568



রাতে তুষারপাত ভালোই শুরু হয়েছে। গুমটিঘরের ওইটুকু লিকলিকে আগুন যেন পরিহাস। মেয়েটা হর্ষিতের আরও কাছে এসে বসল। ফিকে আগুনের হাল্কা লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে ওর চোখেমুখে। 


হর্ষিত জিজ্ঞেস করল, 

"ঠাণ্ডা লাগছে?"


"কি জানেন বাবু, আমার ফেরাটা যদি না হয়..."


"আরে, এত ভাবছ কেন? আমি তো আছি, পৌঁছে দেব ঠিক তোমার পরিবারের কাছে। অবলীলায় সীমান্ত পারাপার করে আসছি বছরের পর বছর"


"যাকে বিয়ে করতে দেশান্তর করলাম, সেই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নরকে ফেলে দিল ছুঁড়ে। কত যে ছেলেমেয়ে ভুলিয়ে এনে অস্ত্র গড়ার কাজে নিয়োগ করে। সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি বাবু। সহজে কি ছাড়বে? লোক লাগিয়েছে আমায় খুঁজে বের করতে। যদি ধরে ফেলে?" 


"তোমার প্রেমিকের এলাকায় এসব গুপ্ত অস্ত্র তৈরির চক্র আমার নখদর্পণে। জানো, এইসব সরবরাহ করার গুরুদায়িত্ব অনেকটা আমার ঘাড়ে"


"কিন্তু আপনি কেন আমার জন্য এত করছেন বলুন তো? তিন বছর একজনকে বিশ্বাস করে নিজের জীবনটা জলাঞ্জলি দিলাম। এদিকে আপনাকে তো চিনিই না, তবু প্রথম সাক্ষাতেই আপনি আমাকে পরিত্রাণ দিতে এগিয়ে এলেন..."


"চিন্তা নেই, আমি বিশ্বাসঘাতকতা করব না। শুয়ে পড় এখন, মধ্যরাত পেরলে আমরা আবার রওনা হবো"


মেয়েটা মাথার ওপর দেওয়া ওড়না আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে, হর্ষিতের গা ঘেঁষে বসল। সেই মেয়েটা, যে দীর্ঘ দশ বছর আগে হর্ষিতের প্রত্যাখ্যানে বিনা বাক্যব্যয়ে চোখের জলে বিদায় নিয়েছিল ওর জীবন থেকে। রেহানা, এই মেয়ে সেইই। তখন মেয়েটা জানত, হর্ষিত যুদ্ধে যাচ্ছে। শেষ রাত্রি ছিল সেদিন ওদের। যোদ্ধার টালমাটাল জীবনের অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হর্ষিতের ছেড়ে চলে যাওয়ার অনড় সিদ্ধান্ত। তখন কি আর রেহানা জানত, তার ভালোবাসার পাত্র আসলে সন্ত্রাসী? হর্ষিতের গলায় সর্বক্ষণ ঝুলে থাকা হার জোর করেই কেড়ে নিয়েছিল মেয়েটা শেষমূহুর্তে। আজও সেই হার রেহানার গলায় স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। দীর্ঘকাল পরে, ঘর-সংসার করতে আসার স্বপ্ন নিয়ে এসেও সে হর্ষিতকে নিজের মনমন্দিরে রেখেছে নীরবে! একমাত্র এই কারণেই, হর্ষিত তার এই পুরোনো প্রেমিকার আসন্ন বিপদ দেখে তাকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জানে, এর পরিণাম হয়ত ওকে জীবন দিয়ে দিতে হবে। হোক। তবু আজ অমূল্য এই ভালোবাসার কিছু প্রতিদান ও দেবেই। আফসোস, রেহানা চিনতে পারেনি ওকে। পারবেই বা কি করে, এখন সে তো এক ভিন্ন নাগরিকের বেশধারী, আমূল বদলে ফেলেছে নিজের পরিচয়। 


***


নিস্তব্ধ চরাচরে একটাও জনমানবের চিন্হ নেই। ওপরে বয়ে চলেছে উদাস অনন্ত কালো মহাকাশ আর নীচে নির্মম বরফ-কঠিন পৃথিবী। সবকিছু হেলায় ফেলে বোকা মেয়েটা হর্ষিতের ভরসায় পা বাড়িয়েছে মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়ার যাত্রায়। সন্তর্পনে, সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে বেড়াজাল পারাপার করে হর্ষিত আর রেহানা। হাতে হাত রেখে।


বিরাট অন্ধকার আজ দুজনেরই আশ্রয়। আচ্ছা, সবকিছু পরিত্যাগ করে, দেশে ফিরে গিয়ে রেহানার কাছে আত্মসমর্পণ করলে কেমন হয়? হ্যাঁ, ভারতবর্ষই হর্ষিতের দেশ। ভুল প্ররোচনায় সে এই সন্ত্রাসের ফাঁদে পা দিয়েছে। এর থেকে বেরোতে চাওয়া মানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু যে কয়েকটা দিন পাবে, পারবে না রেহানার কোলে মাথা রেখে নিজের জন্মভূমিতে কাটাতে? নেবে না ফিরিয়ে রেহানা ওকে? নিশ্চয়ই নেবে! এটাই হবে ওর প্রায়শ্চিত্ত। 


জঙ্গলটা পেরোলেই খোলা উপত্যকা। ভোরের কাঁচা আলো ম্লান বাতি জ্বালিয়েছে ফুরিয়ে যেতে থাকা পৃথিবীর আকাশে। রেহানা খোলা উপত্যকায় এসে খলখল করে হেসে উঠল। মুক্তির আস্বাদন!


আশান্বিত হর্ষিত পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় খোলা উপত্যকায়। জং-ধরা দিনের প্রথম আলোয় ডাকলো,

"রেহানা! রেহানা!"


"বলো হর্ষিত" ঘুরে দাঁড়ায় রেহানা। চোখেমুখে অদ্ভুত পরিবর্তন। 


"চিনতে পেরেছ আমাকে?" খুশির অভিব্যক্তি হঠাৎ পরিবর্তিত হয় আতঙ্কে,

"একি, তোমার হাতে পিস্তল কেন?"


খেয়াল হয় হর্ষিতের, ক্রমে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলেছে চারদিক থেকে ওদের। কিন্তু ধুরন্ধর হর্ষিতকে ট্র্যাক করে কার সাধ্য?


"শ্রমসাধ্য ছিল, বাঘের ডেরায় পা রেখে তোমার ছদ্মবেশ উপড়ে বের করে নিজেদের দেশের মাটিতে এনে পাকড়াও করা। বহুবছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছ তুমি। আমি, মেজর প্রদীপ পাণ্ডের মেয়ে। ও হ্যাঁ, আমি ছিলাম হয়ত তোমার বোকা প্রেমিকা রেহানা। কিন্তু ওই যে, টুকি! তোমার মতন সেটা আমারও ছদ্মপরিচয়"


"ইউ ট্রেটর! তুমি ভালোবাসার নাটক করলে? তবে কেন, কেন আমার গলার হার আজও তোমার বুকে? কেন দশ বছর আগে ওভাবে এসেছিলে আমার কাছে?"


"হার ছাড়া তোমাকে ট্র্যাক করতাম কিভাবে? সেই রাতে তুমি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ার পরই তো তোমার মধ্যে চিপটা ইমপ্ল্যান্ট করি, আর কানেক্ট করি তোমারই হারের সাথে। বিদায়মূহুর্ত থেকে গতকাল রাত অবধি সেইই আমাকে তোমার কাছে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছে!"


"ভালোবাসোনি একমুহুর্তের জন্যও? আমি যে তোমার কাছেই ফিরে আসতে চেয়েছিলাম রেহানা..." চোখটা অকারণ জ্বালা করে ওঠে অবোধ সন্ত্রাসীর।


"বিস্ফোরণে নিষ্পাপ মানুষদের উড়িয়ে দেওয়ার আগে সেটা ভাবা উচিত ছিল। সো লং!" ট্রিগারে চাপ দেয় রেহানা। 


সমাপ্ত।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy