Abanti Pal

Romance Classics Fantasy

4  

Abanti Pal

Romance Classics Fantasy

অরোরার আলোকতলে

অরোরার আলোকতলে

4 mins
284



সময়কাল: ১৯ সেপটেম্বর, ২০১৯


এবারের হীরক বিবাহবার্ষিকীতে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে অনুপ! পোল্যান্ডে কর্মরত একটি নামী অয়েল কোম্পানির উচ্চপদস্থ ম্যানেজার অনুপ মজুমদার এবার তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রাইভেট জেটে আইসল্যান্ড ভ্রমণের আয়োজন করেছে। 


পরিকল্পনা অনুসারে অনুপ আর তার স্ত্রী অন্তরা রেকজাভিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে, সেখান থেকে সরাসরি তাদের প্রাইভেট জেটে উঠে বসলো। এই দেশে তাদের সর্বমোট দিন দশেকের সফর। প্রথমেই গন্তব্যস্থল জকুলসার্লন লেগুন। প্রথমদিন সেখানে কাটিয়ে পরেরদিন ভাটনাজোকুল ন্যাশনাল পার্কে ট্রেক করার পরিকল্পনা রয়েছে। সূচিতে পরবর্তী দিনগুলিতে যথাক্রমে রয়েছে ভলসভল্লুরের ভলক্যানো মিউসিয়াম, থিংভেলির জাতীয় উদ্যান, গুলফসের জলপ্রপাত, আরও ছোটবড় কিছু গ্লেসিয়ার। সর্বশেষে লগর্ডালুরে পৌঁছে একান্তে নির্জনে স্বতন্ত্র অট্টালিকায় থার্মাল পুলের উষ্ণতায় মগ্ন থেকে, উন্মুক্ত আকাশ ভরা অরোরা বরিয়ালিস উপভোগ করা প্রাণ ভরে।


আনন্দে আত্মহারা অন্তরা নিজের সমস্ত ইন্দ্রিয় সহযোগে আইসল্যান্ডের সৌন্দর্যসুধা পান করছিল। এতগুলো দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো, টের পাওয়া গেলো না! পিছলে যাওয়া এই মুহুর্তগুলো জীবনভর সুখের স্মৃতি হয়ে থাকবে। এ এক নতুন জীবন, নতুন মুক্তির আস্বাদন, নতুন করে তার প্রিয়তমকে কাছে পাওয়া। থার্মাল পুলের উষ্ণতায় অনুপের বাহুবন্ধনের মধ্যে এই আনন্দঘন সন্ধিক্ষণে অন্তরা চোখ বুজে ভাবলো, হে ঈশ্বর, যদি এই শেষ রাতটা চিরস্থায়ী হয়ে থাকে! তারপরেই তো আবার ফিরে যাওয়া নিজেদের কর্মব্যস্ত জীবনে, যেখানে অনুপ থেকেও থাকে না। যেখানে কাজ-পাগলা মানুষটার জীবনে বুঝি অন্তরা একটি যান্ত্রিক রোবট মাত্র। নির্বান্ধব ঠান্ডা জীবনযাপনটি যে কতটা গ্লানিময়, অন্তরার সে অন্তরের কথা শুনবে কে? বিলাসবহুল বাড়িটা তখন তার কাছে নির্বাসন-সম শূন্য কারাগার। তার থেকে এই ভালো...


একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে চাইলো অন্তরা। থার্মাল পুলের জলটা কি উষ্ণতা হারাচ্ছে? পুলের জলের ভেতরের হাল্কা নীলচে আলোগুলো হঠাৎ কাঁপছে কেন? আশেপাশের নির্জনতা বুঝি আরও প্রগাঢ়, বাতাসে কেমন যেন একটা শিহরণ জাগানো কম্পন। 


'অনুপ?' ডাকল অন্তরা। 


তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেন অনুপ? একটু ঝাঁকিয়ে ডাকল সে আবারও। 


'হুঁ?' গভীর নিদ্রাভঙ্গ হলো বুঝি অনুপের। 


ওপরে তখনও চলছে অরোরার বাঁধনছাড়া খেলা। নীলচে কালো আকাশপথে নৃত্যে নৃত্যে আপন ছন্দে দুলে উঠছে সবুজ আলোর ভেল্কি। তার এক কণা বুঝি ঠিকরে এসে আলোকিত করেছে ওদের দুজনের চোখমুখ।


'ঘরে চলো অনুপ' কথাটা বলার সময়ও এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে গেল অন্তরার অন্তরাত্মায়। বুঝি এক যুগ ধরে জমিয়ে রাখা চাওয়াটা এক পলক আগে আনমনে ব্যক্ত হওয়ার সাথেসাথেই, নিমেষে পরিপূর্ন হলো সেটা। অদ্ভুত এক পরিতৃপ্তি অনুপের চোখেমুখেও। 


পরের দিনটা ফেরার। সেদিন অনুপের ভাইয়ের জন্মদিনও। শুভদিনে ভারতবর্ষে ভাইয়ের ফোনে ফোন করলো সে। কিন্তু কোনো কারণে, একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ জানান দিল, নম্বরটা ভুল। আবারও ডায়াল করতে একই উত্তর। অন্যান্য নম্বরে এরপর ফোন করতে লাগলো দুজনেই। নেটওয়ার্ক সমস্যা ভেবে প্রথমটা সায় না দিলেও, অনুপের খটকা লাগলো যখন ওদের পাইলটকে নির্ধারিত সময়ে জেট ছাড়ার কথা জানানোর জন্য তার স্থানীয় নম্বরে ফোন করলো। এই নম্বরও ভুল? 


একেবারে লাগেজ নিয়েই ওরা দুজনে অট্টালিকার অভ্যর্থনা-কক্ষে নেমে এলো, চেকআউট করে বেরিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে। ফোনের সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকতে গিয়ে অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে ওরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কোনরকমে কয়েকটা স্তম্ভে ভোর করে টিকে আছে লন্ডভন্ড, বিধ্বস্ত, ভাঙ্গা হলঘর। বিশাল ঘড়িটা অশনি সঙ্কেতের মতন বেজে চলেছে... ডং ডং ডং... কেউ কোথাও নেই।


হন্তদন্ত হয়ে ওরা বেরিয়ে এসে হাজির হলো সামনের মাঠের হ্যাঙ্গারে। অক্ষত জেটের সামনে এসে মনে হলো, এই সবটাই কি তবে ভ্রম ছিল? ভেতরে সবকিছু এমন এলোমেলো দেখালো কেন? বাইরেটা তো একদম পরিপাটি পরিচ্ছন্ন। পাইলট তো না বলতেই যথাস্থানে হাজির, যদিও তার মুখ দেখা যায়না। পাইলটের তাড়ায় চেপে বসলো জেটে। নির্দেশ অনুযায়ী সেও জেট উড়িয়ে নিয়ে চলেছে নীল আকাশ ফুঁড়ে। অট্টালিকার ভাঙাচোরা অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করতে, সে জানালো,


'কোথায় ছিলেন বললেন? আমি তো এরকম হোটেল চিনি না স্যার। আমি শিডিউল্ড বুকিং অনুযায়ী লোকেশন দেখে চলে এসেছিলাম আপনাদের নিতে। ওই ফোন নম্বরও তো আমার নয়'


ফিরতি পথে পাইলটকে আর বেশি প্রশ্ন করলো না অনুপ। আবার ধাক্কাটা খেলো আইসল্যান্ডের রেকজাভিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে, বিমান ধরতে যাওয়ার পথে। সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম। রাস্তাঘাট, লোকজন, পোশাকআশাক, গাড়ি, এমনকি বিমানবন্দরটাও যেন এই কয়েকদিনে অনেকটা পাল্টে গেছে। এই সবই কি অরোরার জাদুবলে?


সিকিউরিটি চেক-ইন করতে গিয়ে এভিয়েশনের নিরাপত্তারক্ষী অফিসার ওদের পরিচয়পত্র চাইতে দুজনের পাসপোর্ট এগিয়ে দিল অনুপ। লোকটা সেটি দেখতে গিয়ে বোধহয় সন্দেহজনক কিছু পেল, তার পাশের অফিসারকে ডেকে নিল তখনই।


'এনি প্রবলেম অফিসার?' ভ্রুকুঞ্চিত হলো অনুপের। লোকটা একটু কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,


'মস্করা করছেন? এই আউট-ডেটেড পাসপোর্ট আর ভিসা তো জাল। আসল প্রমাণপত্র দেখান!'


পাশ থেকে অনুপের জামা খামচে ধরে অন্তরা আর্তনাদ করে উঠলো সহসা।


'হোয়াট?' পুলিশকর্মীর অস্বাভাবিক আচরণে ক্ষুব্ধ অনুপ অন্তরার দিকে তাকিয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করলো। সামনের এল.ই. ডি ডিসপ্লে ঘড়িটা পৃথিবীর বিভিন্ন সময়-মান মণ্ডলের সময় দেখিয়ে যাচ্ছে। লাল আলোয় ফুটে উঠেছে আঞ্চলিক সময় - 


দুপুর ১২:০১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০৯৯


সমাপ্ত।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance